তারপর যা হয়। আমরা একটা আলো-অন্ধকার ঘরে একটুখানি বনেদিয়ানা নিয়ে লড়ি। মাটিতে গোল করে চারজন-পাঁচজন-ছ’জন। কেউ উঠে যায় হঠাৎ। কেউ পরে। অনেক খেয়ে হাঁফ ধরে যায়। একটা হোস্টেল রুম। মা’র কথায় ‘সেই সমস্ত বোর্ডিং’। ‘এই, এই, মাস্টারজি’— কেউ বিছানায়, কেউ খাটের তলায়। অন্ধকার। টর্চ। কেউ ছুড়ে দিল উপরে। একটু খেয়ে বাকিটা গড়িয়ে দিল নীচে। স্যারের পা। লাঠি। রাগী চোখ। ‘হজমোলা স্যার…’। ছেলেটিকে কি ছেড়ে দিয়েছিলেন স্যার? ঝাপসা একটা ব্লু-প্রিন্ট। আর ততোধিক ঝাপসা আমাদের চারকোণা জীবন। ওরা ভেতর থেকে আমাদের দেখত। আমরা ভেতরটা। বিজ্ঞাপন হলে গন্ধ পেতাম। তখন চ্যানেল পাল্টাতাম না। কারণ চ্যানেল আর ছিল না কিছু। আমরা দেখতাম, পরিবার ছোট হতে-হতে, শরিকি সমস্যা বাড়তে-বাড়তে কীভাবে অনিডার রাক্ষস টিভি আঁকড়ে ধরে থাকছে আরও বেশি-বেশি করে। পণ্য বুঝতাম না। একটু হলেও ভয় করত যেন। পড়শিকে তো হিংসে করতে দেখিনি। কাগজ চাইতে যেতাম। দিয়ে দিত। গাল টিপে দিয়ে বলত, ‘বড় হয়ে যাচ্ছিস।’ শব্দমেলা। ক্রসওয়ার্ড। বাদবাকি কে পড়ে! পড়শিদের জ্বলন। অনিডার দৈত্য শেখাল। রোববারের বই। পাড়া জমিয়ে ভিড়। রাক্ষসকুলে এসব সিলেবাসে নেই। পাত্তা দিইনি। গলার পোকাটাকেও না। তবে খিচখিচ দূর করতে ভিক্স খেতাম। গলায় হাত দিতাম। টিভির পোকাটা সত্যি এখানে? সত্যি? চোখ নামিয়ে দেখি নটরাজ পেন্সিলটার মুখ ভোঁতা হয়ে ছোট হচ্ছে ক্রমশ। আমি কলের পর কল দিয়ে ছুলে যাচ্ছি। শিস ভাঙছে। আমি ধার পাচ্ছি না আর। ওই রেসটা হবে না? নটরাজ পেন্সিলের যে জেতার কথা! অথচ আমার ঘর, বাড়ি, সীমানা সব কেমন ভেঙে যাচ্ছে যে! আমরা হারছি। হারার শব্দ পাচ্ছি। নেরোলাকের হলদে রঙের জানলা চাই না। আমার জানলা লম্বা-লম্বা পুরনো দিনের মতো হোক। হোক ভেনেশীয় খড়খড়ি। আমি ওখানে পায়রা ধরব। ছাড়ব। আবার ধরব। ঘামে ভিজে গেলে মা রসনা দিতে আসবে। আমি তোমাকে ভালবাসি রসনা। আই লাভ ইউ। মায়ের মতোই। তখন সব নতুন-নতুন। ভালবাসাও। মহিমা চৌধুরীর ‘চন্দন সা বদন’। সেখান থেকে হকিন্স প্রেশার-কুকারে আসতে ক্যামেরার টিল্ট আপ। শরীর। ওটুকুই প্রাপ্তি। মুঝে দোষ না দেনা…। লিরিলের মেয়েটা। জলে ঝাপসা। তবু…। ভিকো টারমারিকের ওই মেয়েটা যেন আমার দিকে তাকিয়ে হাসত। আমার থেকে তো বড় অনেক? কীভাবে পাব? সঙ্গীতা বিজলানি একটা সাদা ঝকঝকে পোশাকে জাপানি কোনও স্থাপত্য থেকে নেমে আসত। সিঁড়ি। দীপিকা সাহানি গাড়ি থেকে নামলে জলতরঙ্গ বেজে উঠত। মিথ থেকে উঠে আসা এক নারীর চোখে সবুজ রঙের আভা। সরু, ফর্সা আঙুলে প্রত্যাখ্যাত সেইসব ‘ম্যাহেঙ্গেবালি টিকিয়া’। তখন অবশ্য হিন্দি সিনেমা বলতে ভাগ্যশ্রী চিনি। চিনি দিব্যা ভারতী। আর কিছু ভাল লাগত না। কাপড় কীভাবে ঝকঝকে সাদা হয় জানার আগে জেনে গেছি অনেক কিছু। বয়স। সময়। খিদে। একটুখানি রবিন নিয়ে আমাদের সময়টা ধরা গেল না? সামান্য একটু জলে মিশিয়ে গুলে দেওয়া যেত। সব ঝকঝকে সাদা। বাড়ি ফিরে টানা সাতদিন আমি কোনও গ্লাস ছোড়ার শব্দ পাব না। কেউ আর দশ ইঞ্চির পুরু দেওয়ালে মাথা খুঁড়ছে না। কেউ সপ্তাহান্তে ফেরত ক্লান্ত স্বামীকে বলছে না, ‘আলাদা হও’। সব ঠিকঠাক। পারবে না রবিন? উজালা? বড়দের কেউ একজন বলেছিল, ‘ওইসব অ্যাডে যা দেখানো হয় সব বানানো।’ বিশ্বাস করিনি। আমি রবিনে ভরসা রেখেছিলাম। পান পসন্দে ভরসা রেখেছিলাম। বিশ্বাস করতাম, পান পসন্দ মুখে দিলে পারিবারিক জ্বালাগুলো বলতে গেলেও একমুখ হাসি রেখে দেবে মা-কাকিমারা। বলবে, ‘এসব হতেই পারে, মিটিয়ে নেব।’ আমিও এবারের মতো মিটে গেল ভেবে শুতে চলে যাব দাদুর পাশে। পরের দিন খুব ভোর থেকে ডাবর লাল দন্তমাঞ্জনের সংসার। আমার দাঁতে কোনও ব্যথা নেই। মনে ব্যথা। কারণ সকালে আর পান পসন্দ নেই। কমন প্রশ্ন। উত্তর। তখন খুব জোরে টিভি চালাব। চোখ মেলে দেখব পুবের আকাশ লাল। থিন অ্যারারুট। আমি চায়ে ডোবাতে গেলে নরম হয়ে ডুবে যাবে ভেতরে। আমি ওর সঙ্গে ডুবব। আঙুলে লেগে থাকবে পিচ্ছিলতা। বিকেলে চা খাব না। কারণ আমার বুস্ট আছে। টপ সিক্রেট। তখনও কপিল খেলছে। সামনে হ্যাডলি। ৪৩১। ছুঁতে হবে, ছুঁতে হবেই স্যার। একগাল হাসি মুখে একটা উইকেট তুলে সই করছেন সানি গাভাসকার। আমি ফ্রিজ করে নিই। টাইম, স্পেস— ফ্রিজ করে নিই।
দাদুর বয়স বাড়ে। ঠাকুমার বয়স বাড়ে। অপারেশনের দাগ, দেওয়ালের দাগ— কোনটা ভোগায় বেশি, কে জানে! একটুখানি বোরোলিন দিই ঠাম্মা? আমাদের সমস্ত ক্ষত সুরভিত অ্যান্টিসেপটিকে সারবে তো? লিজ্জl পাঁপড়ের খরগোশটা বলে, ‘সারবে।’ আমি ঘরের লাইট বাড়াই। টিভির ব্রাইটনেস বাড়াই। স্ক্রিন তবু ঝাপসাই থাকে। ঝকঝকে মানেই দিন বদল। সময় বদল। দশক বদল। রিভার্স ক্রনোলজিতে আলোর চেয়েও আগে নিয়ে যেতে পারে না হামারা বাজাজ? কাওয়াসাকি বাজাজ? সীমান্তে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছতে হবে। জরুরি ঘোষণা। অনেক, অনেক দিন পরে চশমা-পরা এক কিশোরের মুখের রিসেমব্লেন্স। অন্ধকার। তরুণী বিদ্যা বালনের মতো এক নারী আয়নার সামনে। সিঁদুর। স্থায়িত্ব অ্যাড ধরতে পারবে তো? যার জন্য এত অপেক্ষা, আঙুলে আঙুল, যদি সে ফিরে না আসে? আমাদের যাওয়া তো নয় যাওয়া! আসা-যাওয়ার গল্পের ভেতর চলে আসা পরিবার। কে আগে যাবে, কে পরে। ছোট-ছোট অসুখ, জ্বর আর পেটব্যথার মধ্যে থেকে হঠাৎ করে ঢুকে পড়ে স্ট্রোক। সেরিব্রাল। আমাদের গ্রাইপওয়াটার আছে, পেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বার করে দেবে অসুখ। মাথার ভেতর ঢোকে না। ঠোঁট বেঁকে গেলে কানের কাছে মুখ এনে কথা বলতে হয়। তখন পারিবারিক দ্বন্দ্বে বিজ্ঞাপনের হিসেবগুলো গুলিয়ে যায়। প্রেস্টিজ কুকারে সাদা ভাতের গন্ধ। টিকে থাকা। স্ত্রীকে ভালবাসা। কোন নৌকোয় পা ফেলব ভাবতে-ভাবতে একটা নৌকো নিয়মমাফিক ডুবে যায়। অথচ, দুটো নৌকোই এক হতে পারত, গলুই বরাবর সবচেয়ে সাহসী পুরুষেরা বুনে যেতে পারত অফিস-ফেরত কার্ফুর গল্প। আমরা ভেতরের ছাউনির ভেতরের স্বল্পতায় ভাবতাম, এই আমাদের আকাশ-ঘরবাড়ি। পরে, অনেক পরে, সব পাল্টে গেলে টেরেসের এক-একটা ব্যক্তিগত কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখব সেসব দিন। আনা ফ্রাঙ্ক, হেলগা ওয়েসের ডায়েরির মতো। মুক্তি চাইব। জোজো র্যাবিটের কিশোর অসম্ভব এক ভালবাসায় জানতে চাইবে পাশের তরুণীর কাছে, ‘কোনওদিন মুক্তি পেলে প্রথমে কী করবে?’
চোখের সামনে ডেয়ারি মিল্কের কাগজ। ঠোঁট। গলা অবধি নেমা আসা আস্বাদ। উর্দির তলা দিয়ে ঢুকে পড়া সবুজ ঘাসের উদ্দামতা। জিন্দেগি। কুছ খাস হ্যায়। সোয়াদ হ্যায়।
একটা হালকা নীল আলোর ভেতর এলোমেলো চুলের সেই তরুণী উত্তর দেবে— ‘নাচব’…
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী