ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • দলিত! তোমার মূলস্রোত নাই?


    সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় (September 25, 2021)
     

    এখন নিজ নিজ আয়তক্ষেত্রে নিজ নিজ সিনেমা-সিরিজ দেখার একটা বিশেষ সুবিধে আছে। তাতে আকাশ-পাতাল এক করা রেভোলিউশন হলেও কিছু যায়-আসে না, আবার অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে আক্রমণ করলেও তা তাবড় রাজনৈতিক ভিত্তিকে টলিয়ে দেয় না। ‘২০০ হাল্লা হো’ তেমনই একটি সিনেমা, যাকে নিয়ে দলিত রাজনীতি তোলপাড় হতে পারত, বা ন্যায়-অন্যায়, দণ্ড দেওয়া-আইনের অধিকার নিয়ে বড় বড় বিতর্ক হতে পারত, কিন্তু কোনওটাই হল না, কারণ এই ছবিটি নিঃশব্দে জি-৫ ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেল। 

    ছবিটি একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে। আক্কু যাদব নামে নাগপুরের এক কুখ্যাত গুন্ডা দলিত বসতির মেয়েদের ওপর দশ বছর ধরে অকথ্য অত্যাচার চালায়। ৪০টির বেশি ধর্ষণের অভিযোগ, অসংখ্য যৌন হেনস্থা এবং অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত সে। অবশ্যই একাধিক রাজনৈতিক নেতার আশ্রিত। ফলে পুলিশ বা আইন তাকে ছুঁতে পারে না। অত্যাচারের দশ-দশটা বছর কেটে যাওয়ার পর একবার একটি পেটি কেসে পুলিশ তাকে বাঁচাতে লকআপে পাঠায়। আক্কু যাদব সহ সমস্ত নাগপুর জানত যে সে ছাড়া পেয়ে যাবে। কিন্তু তার বিচার শুরুর আগে দলিত বস্তির ২০০ মহিলা মুখে কাপড় বেঁধে, পরিচয় গোপন করে কোর্টরুমে ঢুকে, আক্কুর বিচার শুরু আগেই তাকে হাতা, খুন্তি, কাঁচি, বঁটি, চাকু, ছুরি এবং অন্যান্য ধারালো অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে। তার বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে নেয়, এমনকী যৌনাঙ্গও। আঙুলগুলি ছড়িয়ে পড়ে কোর্টরুমের বিভিন্ন প্রান্তে, মাথা থেঁতলে ঘিলু বেরিয়ে আসে। পুলিশ ও অন্যান্য কর্মীদের আটকাতে লঙ্কাগুঁড়ো ছড়িয়ে দেয় ওই মহিলারা। হ্যাঁ, আদতে ঘটনাটা এ রকমই ঘটেছিল। নৃশংস, বর্বর।

    কিন্তু এ-ও ভাবতে হবে, অত্যাচার কতদূর গেলে, লাগাতার অন্যায়ের শিকার হয়ে কত যন্ত্রণাময় জীবন কাটাতে বাধ্য হলে, সমবেত ভাবে এমন পদক্ষেপ করা যায়। এই ছবি সে প্রশ্নও তোলে। যে লোকটা গোটা বস্তির সামনে এক মহিলাকে ধর্ষণ করে (তার চ্যালারা সবাইকে ঠেকিয়ে রাখে), তারপর খুন করে, এবং তারপর বীরদর্পে বেরিয়ে যায়, যে লোকটা নিদান দেয়, বস্তি থেকে তাকে নিয়মিত মেয়ে পাঠাতে হবে ভোগের জন্য, এবং বস্তির লোকেরা সভয়ে তা মানতে বাধ্য হয়— সেই লোকটার হাতে দশ বছর ধরে আক্ষরিক বা মানসিক ধর্ষিত হতে হতে কিছু মানুষ একদিন গর্জে উঠলে, এই দেশের ন্যায়বিচারের ওপর আর আস্থা রাখতে না পেরে নিজেদের হাতে শাস্তির ভার তুলে নিলে, তা কি খুব অস্বাভাবিক সিদ্ধান্ত? দর্শক সেই কথাও ভাবতে বাধ্য হয়। সেই ঘটনায় পাঁচজন মহিলাকে দলিত বস্তি থেকে গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু প্রমাণাভাবে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। 

    এই ছবি জন্ম দেয় এমন অনেক প্রশ্নের, যা আমরা– সমাজে স্বস্তিতে থাকা শ্রেণির মানুষরা– স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে চলি। ওদিকে একটি সম্প্রদায়ের মানুষ সমাজে অহরহ বিড়ম্বনা নিয়ে দিন কাটায়। দলিত শ্রেণি। যে শ্রেণির মানুষদের নিয়ে রাজনীতি হয়, ভোট ভাগাভাগি হয়, কিন্তু  সমাজে তাদের স্থান দেওয়া যায় না। আমরা এই ভয়ে তাদের অধিকার দিই না, যে, তা আমাদের সুবিধায় ভাগ বসাবে। অথচ আমাদের ঘৃণা তাদের প্রতি চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে চলে নিয়ত।

    পরিচালক সার্থক দাশগুপ্ত ও অলোক বাত্রা যে প্রশ্নগুলি তুলতে চেয়েছেন, যে অসহায়তা দেখাতে চেয়েছেন, তা আরও জোরালো হত যদি চিত্রনাট্যের বাঁধুনি আরও একটু বেশি হত, একটু মন দিয়ে ফাঁকফোকরগুলো ভরাট করতে পারতেন। ভিলেন বালি চৌধুরীর কাণ্ডকারখানা এতটা না দেখালেও বোধহয় আরও একটু মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতেন। 

    তবে হ্যাঁ, চিত্রনাট্যকার সার্থক দাশগুপ্ত ও গৌরব শর্মা পুরুষদের ভঙ্গুর হওয়াকে এত মরমি করে তুলে ধরেছেন যে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে পৃথিবীটা কেবল ‘সত্যিকারের’ পুরুষদের হয়ে যায়নি। এখানে উমেশ পণ্ডিত (বরুণ সোবতি) এক ব্রাহ্মণ উকিল, যে এই দলিত মহিলাদের হয়ে কেস লড়ে এবং প্রাথমিকভাবে হেরে যায়। বিপক্ষের উকিল তাকে নাকানিচোবানি খাইয়ে দেয়। বোঝা যায়, সে ভালমানুষ হতে পারে, সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে পারে, গরিবদের হয়ে কেস লড়তে পারে, কিন্তু যথেষ্ট ‘পুরুষ’ হয়ে হম্বিতম্বি করে, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বিজয়ী হতে পারে না। পরের ধাপে সে ফের চেষ্টা করে। প্রমাণ জোগাড় করে এবং শেষমেশ কেসের শুনানির আগের দিন খুন হয়। তার পরিণতি গৌরববজনক হয় না। একজন নিতান্ত হেরে যাওয়া মানুষ হয়ে সে থেকে যায়। সে বলিষ্ঠ ভাবে কোর্টরুম ড্রামায় নায়কের ভূমিকা নিতে পারে না। 

    এই ছবি সেই সমস্যাগুলোর কিছু পরত খুলে দেখাতে চায়, ক্রমাগত রূপ ও রং বদলাতে থাকা ধাঁধার দিকে বেশ কিছু সার্চলাইট ফেলে আমাদের খুঁজতে ও খুঁড়তে বলে। নিজস্ব আয়তক্ষেত্রের আরও একটি বিনোদন হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না।

    এই সিনেমার সত্যিকারের সম্পদ অমল পালেকর। যিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত, সম্মাননীয় বিচারক– বিট্ঠল ডাঙরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। দলিত বিচারক। তিনি আইন থেকে একচুল সরেন না। এমনিতে তাঁকে দলিত বিচারক হিসেবে দেখা হয় না, বরং দক্ষ বিচারক হিসেবে দেখা হয়। অথচ ঘটনাটি যখন ঘটে, তখন রাজনৈতিক নেতার এক চালে তিনি হয়ে যান ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির মাথা (কারণ দলিত মহিলারা আক্কুকে খুন করেছে)। এ কথা তিনি নিজেও বুঝতে পারেন যে, এত বছর আইনকে তাঁর জীবনের সবটুকু সততা দেওয়ার পরেও তাঁর জাত বা সম্প্রদায় পিছু ছাড়েনি। কিন্তু লক্ষ্যে স্থির থেকে তিনি ঘটনার গভীরে গিয়ে সত্যটা জানতে চেষ্টা করেন। তাঁর সহযোগীদের বলেন, কোনওভাবে পক্ষপাতিত্ব না করে শুধুমাত্র ঘটনা পরম্পরা খুঁজে বার করতে। দলিত বস্তির একটি মেয়ে, আশা(রিঙ্কু রাজগুরু) এই পুরো ঘটনার নেতৃত্ব দেয়। সে একবার বিট্ঠল ডাঙরে-র কাছে এসে বলে, কেবল দলিত বলেই আদালত ও আইন তাদের দীর্ঘ অত্যাচারের কথা শুনছে না। জজসাহেব আশার কথা খারিজ করে বলেন, আইনের চোখে জাতপাত বলে কিছু নেই। দলিত-রাজনীতির খেলা আমার কাছে খেলতে এসো না। মেয়েটির সব আশা ভেঙে যায়। কারণ সে বিশ্বাস করে, দলিত সত্তাকে অস্বীকার করে তারা কিছুই করতে পারবে না। তাদের অধিকার মূলস্রোতে প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে, শুধু উঁচুতলার লোকের দয়ার ওপরে নির্ভর করেই থাকতে হবে তাদের। আর অন্যদিকে জজসাহেব ভাবেন, দলিত সত্তাকে প্রাধান্য দিলে, তাঁর কৃতিত্ব কমে যাবে। তখন লোকে বলবে, তিনি দলিত কার্ড খেলে ওপরে উঠেছেন, তাঁর নিরপেক্ষতাকে প্রশ্ন করবে। তাই তিনি ভুলে যেতে চান যে তিনি একজন দলিত,  শুধু  মনে রাখতে চান, তিনি একজন ভারতীয় এবং আইনের রক্ষক। 

    কিন্তু আইন-আদালত-পুলিশ-রাজনৈতিক নেতা সবাই যখন ঘটনাটিকে কেবল দলিত-দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখতে চায়, তখন জজসাহেবের মনে হয়, তাঁর দলিত সত্তাকে অস্বীকার করা বোধহয় উচিত হয়নি।  এবং উমেশ পণ্ডিত মারা যাওয়ার পর তিনি দলিত মহিলাদের আইনজীবী হয়ে কেসটি লড়েন এবং জেতেন। 

    ২০০ হাল্লা হো, কোনও রাজনৈতিক থ্রিলার নয়। এই সিনেমা সাময়িক সমাধান দেখালেও হাজার হাজার প্রশ্ন তুলে দিয়ে যায়। কেবল আইনি প্রশ্ন নয়, সাংবিধানিক এবং সামাজিক প্রশ্ন। ভারত নামেই অসাম্প্রদায়িক, সংবিধানে অসাম্প্রদায়িক, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর রকম সাম্প্রদায়িক। এই দেশের বাস্তবতাকে তুলে ধরাই এই ছবির কাজ। কিন্তু সেই বাস্তব তো একমাত্রিক নয়, তার অনেকগুলো স্তর আছে, এবং সেগুলোও খুব জটিল। এই কথাটাই নিশ্চিতভাবে ঠিক, আর ওইটা ভুল— তা জোর গলায় কখনও বলা যাবে না। এই ছবি সেই সমস্যাগুলোর কিছু পরত খুলে দেখাতে চায়, ক্রমাগত রূপ ও রং বদলাতে থাকা ধাঁধার দিকে বেশ কিছু সার্চলাইট ফেলে আমাদের খুঁজতে ও খুঁড়তে বলে। নিজস্ব আয়তক্ষেত্রের আরও একটি বিনোদন হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook