ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আমি বুদ্ধদেবকে দেখেছি


    শুভময় মিত্র (September 3, 2021)
     

    ঋতু গুহর নাম আমি জানতাম ছোটবেলা থেকে। লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ। আমাদের বাড়িতে রেকর্ড ছিল। একবার সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের কাছে কার বাড়িতে যেন যাওয়া হয়েছিল। সে একটু দূরে একটা গাছপালা-ভরা সুন্দর বাড়ি দেখিয়ে বলেছিল, ওখানে বুদ্ধদেব গুহ থাকেন। উনি কে জিজ্ঞেস করায় একটা অদ্ভুত হাসি হেসে বলেছিল, কেন, ঋতু গুহর হাজব্যান্ড। এরপর বড়রা নানা রকম কথা বলছিল আমাকে বাঁচিয়ে, সাবধানে। আমি কিছু বুঝিনি। বাবা বলেছিল, নামকরা চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। আমি আর মাথা দিইনি। তখন জানতামই না যে কিছুদিনের মধ্যে বড় হয়ে ওঠার অন্যতম ক্যাটালিস্ট হয়ে উঠবেন এই ভদ্রলোক। ওঁর প্রসঙ্গে টুকরো-টাকরা কথা কানে আসত। বুদ্ধদেব গুহ নাকি শিকারি। উনি নাকি দারুণ টপ্পা গান করেন। অল্প বয়েসে হুডখোলা গাড়িতে বান্ধবীদের নিয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে বেরোতেন। তাহলে লোকটা কে? নানা ধরনের ইনফর্মেশনের এই জিগ-স পাজল আমি সমাধান করতে পারিনি। কারণ, ছোট হলেও, অনেকগুলো তথ্য আমাকে যে জানানো হচ্ছে না সেটা বুঝতাম। হয়তো ওইখানেই আটকাত। আমার স্কুলে পড়ার শেষদিকে, শীর্ষেন্দুর ‘ঘুণপোকা’, বিমল করের ‘অসময়’, অনেকগুলো সুনীল-নীললোহিত পড়ে ফেলেছি। নবারুণ বা সন্দীপনের সময় হয়নি তখনও। এই সময়ে হলুদ ডানা মেলে একেবারে আমার কোলের ওপর নামল একটা বই। দারুণ প্রচ্ছদ হত ওই সময়ে। সুধীর মৈত্র। বুনো বেসলাইন, ঘাস-ফুল-ডাল-পাতার গালিচায় উপুড় হয়ে মুখ তুলে জলরঙে মাখা একটা মেয়ে, ওপরে জংলি আকাশ। দেখে মরে যাই আর কী! ফ্লাই পেজের পরের পাতায় ইংরিজিতে কার যেন দুটি লাইন, পড়লেই মুচড়ে ওঠে ভেতরটা। পাতা গড়াতে না গড়াতেই অ্যাড্রিনালিনের অতিরিক্ত ক্ষরণ শুরু হল।

    শিল্পী সুধীর মৈত্রের সঙ্গে লেখক

    প্রাচীন ইংলিশ কুয়াশায় পালামৌয়ের জঙ্গুলে নিভৃত জনপদে তৃষিত এক মরু, সুকুদা। প্রচ্ছদে মাথা খারাপ করা সেই মেয়ে, সলিল চৌধুরীও কি ওর কথাই বলেছিলেন? এর নাম ছুটি, দৌড়ে এসেছে নিয়ম না মেনে, কমই আসে, এমন এক বাসে। এদিকে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে নিজেই হয়ে উঠতে চাইছি সুকুদা। পারছি না। লেখা এগোচ্ছে শুকনো ডাল-পাতার ওপর দিয়ে সরসর করে। বনজ্যোৎস্নায়, সবুজ আলোয়, অরেঞ্জ অন্ধকারে। উইংসের আড়াল থেকে আসছে যাচ্ছে আরও কত পাথর-কাঠ খোদাই করা চরিত্র। এদের কাউকে আমি চিনি না। আসা-যাওয়ার মাঝে সুকুদা সাজা বুদ্ধদেবকে চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না। স্রেফ একটু উষ্ণতার জন্যে আমি নিজেই ভেঙে যাচ্ছি দামি আয়নার কাচের মতো। এমন বই আর পড়তে চাইনি আমি। অথচ পথ ভুলে চলে যেতেই হল, কোয়েলের কাছে। তারপর সে অনেক কাণ্ড। এবং আরও অনেক।

    এর অনেক পরেও লোকের মুখে শুনেছি, ‘উনি লেখেনও’। জানি না, এখন, মৃত্যুর পর, ‘উনি লিখতেনও না কি?’— এটা শুনব কি না। বুদ্ধদেব গুহর সাহিত্য মূল্যায়নের চাপ অনুভব করেছেন বই-জগতের বহু মানুষ। অধিকাংশ, আহ্লাদে আটখানা। আবার অনেকে, ‘বড়লোকের ছেলে, বড় কোম্পানির ধনদৌলত সামলান (তার ওপর রমণীমোহন), জঙ্গলে ঘোরেন, তো কী হয়েছে? এমন লোককে সাহিত্যিক বলার কী দরকার? লেখক কি আমাদের কম পড়িয়াছে?’ এদিকে চিরকাল খানদানি, সুপুরুষ, রেডি উইট, নটি আউটবার্স্ট, খুল্লমখুল্লা মাস্তানি, একের পর এক বেস্টসেলার, মাফিয়া প্রকাশক ছড়ি ঘোরাতে ব্যর্থ, যা মুখে আসছে দুমদাম বলে দিচ্ছেন, লিখছেন অকাতরে, সুতোটি রাখছেন না শব্দের শরীরে, বাংলা লেখালেখির জগতের চুনী গোস্বামী— এই দুষ্টু লোককে সামলানো শক্ত। জঙ্গল-টঙ্গল নিয়ে কারবার, তাই রবীন্দ্রনাথকে রেহাই দিয়ে বিভূতিভূষণকে পাকড়েছেন অনেকে, স্রেফ তুলনার প্রয়োজনে। প্রকৃতিপ্রেমের নির্মল সততা, ভাষার উৎকর্ষ, সামাজিক ইমপ্যাক্ট, বৌদ্ধিক মরালিটির ব্যাপার-স্যাপার, নানা বাণে বিদ্ধ করার চেষ্টা বিফল হয়েছে। বেস্টসেলারে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, আবার সেই ‘মাধুকরী’। ব্যক্তি বুদ্ধদেবকে দুরমুশ করতে চাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

    ‘মাধুকরী’ বইয়ের প্রচ্ছদ

    আমার ধারণা, ওঁর অনেক লেখার এবং আরও অনেক কার্যকলাপের আনপুটডাউনেবল আকর্ষণের ঝাঁঝটা অস্বস্তির অন্যতম কারণ। যিনি আদতে ব্যাকস্ট্রিট বয়, হ্যাঁ ‘বয়’, দুষ্টু ছেলে, কিছুতেই দুষ্টু ‘লোক’ হয়ে উঠতে উৎসাহী নন, কিছুতেই গুডবয় সাজতে রাজি নন, উনি নীললোহিতের মতো সেফ নন, অপাপবিদ্ধ নন, সর্বোপরি ইনভিজিবল নন— তাঁর ক্ষেত্রে গজগজানি চলারই কথা। অরণ্যের রোম্যান্সটা ওঁর কাছে খুব আরবান, প্রয়োজনে শারীরিক, যা মূলত মন প্রসূত। বুদ্ধদেবের লেখার মানবীরা গাছের মতো। জগদীশ পড়লে বোঝা যাবে, গাছেরও আছে প্রাণ, আছে শরীর, আছে মন। বঙ্গবাসী আপ্রাণ ভাবতে চেয়েছে যে, হাওয়া দিলেই গাছের ওপরে ডালপালা উতলা হোক, কাণ্ডে, শিকড়ে যেন শিহরন না লাগে। পুরুষেরা কখনও পাথর, কখনও ভেজা দেশলাই কাঠি। বাঙালি পাঠকের ইচ্ছে অনুযায়ী, স্রেফ জঙ্গলের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে বিভূতিভূষণ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব গুহকে অজস্রবার একই কথা বলতে শুনেছি। অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা। ‘বিভূতিভূষণ প্রকৃতির পায়ে অঞ্জলি দিয়েছেন, আমি আহরণ করেছি নারী রূপে’, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের লাগোয়া, অ্যাম্বার রেস্টুরেন্টের পাশে, ওঁর আদ্যিকালের ঝুপসি বাড়ির, কাঠের লিফ্ট লাগানো আপিসে বসে এই কথা আমিও শুনেছি। সুযোগ ছিল, সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়নি কখনও। সাক্ষাৎটুকুই যথেষ্ট ছিল।

    বইমেলায় লেখক

    আমরা ক’জন একটা পত্রিকা বের করতাম, নাম ‘যারা পরিযায়ী’, ঘোরাঘুরি, যাওয়া-আসা, বোঝাবুঝি, ভালবাসা— এইসব নিয়ে। রঙিন, প্রচুর ছবি। লিট্‌ল নয়। একদিন শুনলাম বুদ্ধদেব গুহ আমাদের ডেকেছেন। ওঁর কাছে নিজে থেকে যাওয়ার ধৃষ্টতা আমাদের ছিল না। ‘আপনার একটা লেখা পেলে ধন্য হব’— এসবের প্রশ্নই উঠছে না, কিন্তু ডেকেছেন, তাই গেলাম। পৌঁছতেই সেক্রেটারি আমাদের ভেতরে যেতে বললেন। এই প্রথম ওঁকে দেখলামও। লম্বা ঘর, একদিকে বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলে অনেক কিছু, টেবিল ল্যাম্প, বইপত্র, কাগজপত্র, লুজ কাগজ, গুচ্ছের ফাউন্টেন পেন নিয়ে রাজ্যপাট চালাচ্ছেন। সামনে বেশ কয়েক রো চেয়ার, সাক্ষাৎপ্রার্থীরা বসে আছেন। আমাদের দেখেই তাঁদের ‘ওহে তোমরা পেছনে যাও তো, পরে কথা বলছি’ বলে আমাদের সামনে বসতে বললেন। বসে গেলাম বাধ্য ছাত্রের মতো। কোনও কথা বলার আগে, ‘এই নাও’ বলে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন। সস্নেহে অনেক কথা বললেন, আমরা পালাতে পারলে বাঁচি, খামে কী আছে কে জানে, ‘কেমন লাগল বোলো কিন্তু, ইচ্ছে হলেই চলে আসবে’, দুদ্দাড় করে বেরিয়ে এসে আলিয়াতে ঢুকে খাম খুললাম। লেখা। বুদ্ধদেব গুহর লেখা। ব্যাস, শুরু হল ধারাবাহিক। প্রত্যেকবার ডাকতেন, ঠিক সময়ে, যেতাম, প্রচুর গল্প করতেন, মানে উনি বলতেন, আমরা শুনতাম, খাম দিতেন, আমরা পালাতাম, ছেপে ফেলতাম। ভয়ের চোটে কোনওদিন সাম্মানিকের কথা তুলিনি। একটা ব্যাপার বুঝতাম না, ছেলেপুলেরা উৎসাহ করে ম্যাগাজিন করছে, আমি লিখলে ওদের ভাল হবে, এই অবধি ঠিক আছে। উনি তো হেঁজিপেঁজি লোক নন, লেখার অসীম পরিশ্রমটা আমাদের জন্য কেন? এর উত্তর আর পাওয়া হয়নি। তবে, কেউ জানে না, নিজেও বলেননি, বহু মানুষের জন্য বহু কিছু করেছেন এই রাজা, সে-খবর পেতাম। আশকারা পেয়ে পেয়ে আমরাও এটা-সেটা বলতাম, জিজ্ঞেস করতাম। বিভূতিভূষণের ব্যাপারে তখন ওই কথা বলেছিলেন। মুখে সারাক্ষণ একটা দুষ্টুমির হাসি লেগে থাকত, কোনও টেনশন দেখিনি, একদিন দুম করে বললেন, ‘রিনাকে ফোন করি।’ অপর্ণা সেন? ওঁর খুব ক্লোজ, জানতাম। ওঁর ম্যাকলস্কির বাড়িটা অপর্ণা সেন কিনেছেন, তাও জানা ছিল। ম্যাকলস্কি বাঙালি চিনেছে বুদ্ধদেবের লেখায়, সত্যজিতের জয়সলমিরের মতোই। সামনের বেঞ্চে বসে আমাদের অবস্থা তখন খুবই কাহিল। দুই বন্ধুর খুল্লমখুল্লা গল্প, শুনতে পাচ্ছি একপক্ষের হাই ভোল্টেজ লেগপুলিং, টেলিফোনের রিসিভারে অস্পষ্ট অপর্ণা। আমরা টেবিলের তলায় ঢুকে পড়তে পারলে বাঁচি। একটু পরে ফোন রেখে বিজয়ীর হাসি হাসলেন। আমরাও, নিশ্চিন্দির। খাম নিয়ে দ্রুত নিষ্ক্রমণ, এবং আলিয়া। যে-সময়ের কথা হচ্ছে, তখনও মোবাইল ফোন সবার কথোপকথন শুনত না। ওঁকে টাইপ করতে দেখিনি কখনও। পাণ্ডুলিপি বরাবরই। বড়সড় মানুষটার ছোট-ছোট অক্ষর। রুক্ষ অসমান জমিতে ইতস্তত পড়ে থাকা কুচো ফুলের মতো। মাঝে মাঝে খেয়ালি লাইন ড্রইং, অসম্পূর্ণ। শব্দ, বাক্যের মধ্যে প্রচুর সুগন্ধি হাওয়া চলাচলের অলিগলি। কোথাও যেন একটা রবীন্দ্রনাথ পাওয়া যেত বন্ধ খাম খুললেই। উনি নিজেই এক বিচিত্র জীবনানন্দ।

    ‘যারা পরিযায়ী’ পত্রিকার পাতায় বুদ্ধদেব গুহ

    একদিন ধাঁই করে বললেন, ‘কী, আর ভাল্লাগছে না বুঝি?’ সত্যি বলতে কী, অনেকের মতো, আমাদেরও মনে হত, ওঁর বলার মতো গল্প বোধহয় ফুরিয়ে আসছে। বয়স, শরীর একটা ব্যাপার। এদিকে ছেলেমানুষের মতো মুঠো-মুঠো বাদাম খেয়ে ফেলছেন। দুষ্টুমিগুলো পূর্ণমাত্রায়। একবার এক বিয়েবাড়িতে পৌঁছে দেখি, গেটের কাছে চেয়ার পেতে একা বসে আছেন। ‘এ কী, আপনি এখানে একা একা কী করছেন, চলুন চলুন।’ ‘ওরা আমাকে এই বিয়ের চেয়ারম্যান করেছে।’ বুদ্ধদেব গুহ আমাকে চেনেন দেখে আমার আত্মীয়রা আমাকে অবহেলা করাটা কিঞ্চিৎ কমিয়েছিল। নিজের চোখে দেখলাম, একটা মানুষ, উৎসবের সব রোশনাইটুকু শুষে নিলেন অনায়াসে। রাতে, কী মনে হল, জিজ্ঞেস করলাম, ‘ফিরবেন তো?’ বললেন, ‘ড্রাইভার ছেড়ে দিয়েছি, আমি হেঁটে যাব, রাতের গোলপার্কের আশেপাশে কত কী হয়, দেখব।’ আর একটিও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমার দাদার গাড়িতে ওঁকে তুলে দিলাম। চিরকালের দুষ্টু ছেলেকে রাজি করাতে একটু বেগ পেতে হল বইকি। বইমেলায় আমাদের স্টলে আসতেন নিজেই। ক্ষুদ্র বইঘরে ওঁর দশাসই উপস্থিতি, তসরের পাঞ্জাবি, গলায় সোনার চেন, টকটকে গায়ের রং, ক্রমাগত কথার ঝলসানি ম্লান করে দিত আশপাশ। গরমে দরদর করে ঘামছেন, ভ্রুক্ষেপ নেই। অনেকে উঁকি মেরে মুখ বাড়িয়ে দেখত সভয়ে। এমন চেহারা দেখা যায় না বিশেষ। চোখে দেখে, উনি যে লেখক তা বোঝা শক্ত। এর মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটল। স্বামীর দু’হাতে বইয়ের ভারী থলি। ভিড় দেখে, স্ত্রী সদ্য কেনা একটি জাবদা বাংলা উপন্যাস নিয়ে ঢুকে পড়েছেন আমাদের স্টলে, মলাট দেখেই মালুম হচ্ছে সে-বই পদের নয়। তারপর দেখেছেন সাংঘাতিক কেউ একজন বসে আছেন। ‘আপনি একটা সই করে দিন প্লিজ’, বলায় বিনা বাক্যব্যয়ে ‘প্রিয় অমুক, শুভেচ্ছাসহ’ লিখে ওঁর দিকে তাকালেন। আমরা প্রমাদ গুনলাম। বাঘের হাসি দেখলাম জীবনে প্রথমবার। ‘উনি, বাইরে, আপনার স্বামী নাকি? তা, ওঁকে জোটানোর কী দরকার? একা এলেই তো পারতেন…’ ভাগ্যিস বুদ্ধদেব গুহকে সেই ভদ্রমহিলা চেনেন না, কী বুঝলেন কে জানে, কাজ হয়ে গেছে, থ্যাঙ্কিউ বলে বাঘের থাবার নাগালের বাইরে বেরিয়ে গেলেন অবলীলায়। ‘অন্য কার কী একটা বই, আপনাকে চেনেও না, আর আপনি সই করে দিলেন?’ ‘কত বই কিনেছে দেখেছ? এই আমাদের সবার অনেক ভাগ্য।’ প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে আমাদের মাথায় তুলেছেন সন্দেহ নেই, আমরাও ওঁকে চিনেছি অনেক কথিত গল্পের মেঘের ওপরে উঠতে পেরে, উনিই টেনে তুলেছেন। বলে বসলাম, ‘আপনাকে এবারে একটা নতুন কিছু লিখতে হবে।’ একেবারেই রাগলেন না, সবিনয় নিবেদন যে আর হচ্ছে না, তা নিয়ে সবারই দুঃখ, উনি কী ভাবছেন জানা নেই। নিজেই একদিন বলেছিলেন, ‘বহু মানুষের সংসার চলে আমি লিখি বলে। শুধু এই লেখক-পাঠক নিয়েই লেখার জগৎ, তা তো নয়। যে-লোকগুলো প্রেসে কাজ করছে, বই বাঁধাই করছে, প্যাকিং করে ভ্যানে তুলছে…’ এ কথা অহংকারের নয় বোঝার মতো সাবালক ততদিনে হয়েছিলাম বলেই আমার ধারণা। কলেজ স্ট্রিট, বইবাজারে খেটে চলা, সাহিত্য থেকে বহু দূরে অবস্থানকারী এই মানুষগুলোর মধ্যে জঙ্গলে কাঠ কাটা, মহুয়া কুড়োনো, জানোয়ারের সঙ্গে সহাবস্থান করা আদিবাসীদের দেখতে পাচ্ছেন উনি। সফিস্টিকেশনের, বৈভবের, জৌলুসের অনেক ওপরে উঠতে পেরেছেন বলেই। মুখে পাইপ, মাথায় জাঙ্গল হ্যাট দেখে বিভ্রান্তি হতেই পারে। গৌতম বুদ্ধের মতো, জাগতিক ঝলমলানির চেনা বৃত্তের বাইরে, অনেক মানুষের গভীর মনের খবর ছিল ওঁর কাছে। শহুরে লেখক অনায়াসে হয়ে উঠতেন বন্য কবি। স্রেফ ওঁর কিছু লেখা পড়ে নয়, কথা বলার, শোনার সুযোগ জুটে যাওয়ায় এটুকু বুঝতে পারতাম।

    জঙ্গলে একাকী

    ‘বলছ? কী লিখি বলো তো!’ সাহস সঞ্চয় করাই ছিল, আবদার করলাম, ‘আপনার জনপ্রিয় লেখাগুলোর বিহাইন্ড দ্য সিনগুলো।’ হেসে উড়িয়ে দিতে পারতেন। দিলেন না। খুব শান্ত, সিরিয়াস মুখে একটু চুপ করে রইলেন। ‘ওসব লেখা কি ঠিক হবে?’ আমরা চুপ। কীসব লেখা? কার কথা? কোন আসল ঘটনা? বহু নামকরা বাড়ি, মহল, এস্টেট, অলিন্দে ওঁর স্বচ্ছন্দ যাতায়াত। যা দেখার ঠিকই দেখেছেন, বুঝেছেন, লিখেওছেন। সাহিত্যিকের স্বাধীনতায় আসল চরিত্র হয়তো কলকাতা ছেড়ে উড়ে গেছে বেতলায়। মারুমারের কাঠবুড়ো গুগুনোগুম্বারে। বুদ্ধদেবের ক্যামেরা বাঘের ওয়াটার-হোল থেকে বাথরুমের কি-হোলে চোখ রেখেছে সমান উৎসাহে। লুকিয়ে করেছেন তা নয়, অজস্র হুইসলিং টিল, হাওয়ায় হাসাহাসি করা জ্যাকারান্ডা গাছের পাতারা সাক্ষী ছিল বইকি। উপন্যাসে, গল্পে তার অকপট প্রমাণ ভূরি ভূরি। ‘এমনিতেই লোকে কত কী বলে, এবারে তো আমাকে মারবে।’ আন্দাজ করলাম, বয়সকালের বুদ্ধদেবের ক্লান্তি নামছে। কথায়-কথায় উইনচেস্টার রাইফেলে টোটা ভরার সাহস পাচ্ছেন না আর, ঋজুদার মতো। চুপ করে রইলাম। এর এক সপ্তাহের মধ্যে ডাক পড়ল। খাম পেলাম। একটু বড়। পাণ্ডুলিপির সঙ্গে নিজের হাতে আঁকা ছবি। শুরু হল ধারাবাহিক, ‘বনবিহারীর স্মৃতিচারণ’। বইও হল, হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল কয়েকটি সংস্করণ। আমাদের পত্রিকা আমরা খুব বেশিদিন চালাতে চাইনি, পারিনি। আমাদের জীবন বদলাচ্ছিল, সময় কমে যাচ্ছিল। উনি নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন, কিছু বলেননি, ডেকে পাঠাতেন, গল্পসল্প আগের মতোই। 

    শুধু জংলি নাগরিকতা বা নাগরিক জংলিপনা বিষয়ক কথা নয়, প্রকৃতির বহু বিভঙ্গের নির্লজ্জ আশ্লেষজনিত অভিব্যক্তি নয়, টিভি ইন্টারভিউ, লাইভ গান, অবধারিত বিতর্ক নয়, বৃদ্ধ বুদ্ধদেব গুহকে শেষ দেখেছি অন্য চেহারায়। ক্লান্ত, অসুস্থ তো অনেকদিনই। একসময় নানা রকম বন্দুক-টোটার বর্ণনা, কখনও বিজাতীয় রান্নার রেসিপি শুনতাম, এই সময়টায় নিজের সংসারের কথা বলতেন একটু-আধটু। আগে বিশেষ শুনিনি। ওঁর প্রশ্রয়ের সম্মান ধরে রাখতে পারিনি আমরা। একটা পাপবোধ কাজ করত। সানি টাওয়ার্স-এ রাজকুঠুরিতে যেতে অস্বস্তি হত। গেলে দেখতাম, সখা-পরিবৃত অবস্থায় এগিয়ে আসা মৃত্যুর হাতছানিকে তুড়ি মেরে ভাগিয়ে দিচ্ছেন হাসতে হাসতে। ওঁর নিত্য অসুস্থতা দেখে আমরা থমথমে হয়ে যাচ্ছি দেখে ঝুলি থেকে বের করতেন অপ্রত্যাশিত নতুন সব এক্সপেরিয়েন্স। গুলিয়ে দিতেন সবকিছু, তুলে নিতেন সময় ও পরিস্থিতির দমবন্ধ করা চাপ। যা বলতেন, তা সত্যি না কল্পনা বোঝা দুষ্কর, দরকারও ছিল না। যে-মানুষটা সারাজীবন নিজেকে নিয়ে, নিজের আশেপাশের মানুষকে নিয়ে, শব্দ নিয়ে, ভাবনা নিয়ে, ইচ্ছে নিয়ে, সর্বোপরি সীমাহীন রোম্যান্স আর অ্যাবস্ট্রাকশন নিয়ে যথেচ্ছ দুষ্টুমি করে এসেছে, আজ সে থামতে চাইবে কেন? ওঁর সবকিছুই, কল্পনার পুকুরে বাস্তবের পদ্ম, না কি অবাস্তব অমলতাসের শাখায় কল্পনার বসন্তবৌরি, বোঝা অসম্ভব। সব তাস দেখিয়ে দেওয়া ইলিউশনের জাদুকরের একটাও যন্ত্র লাগত না। স্টেজের মধ্যমণি হয়ে ক্রমাগত বোকা বানিয়ে যেতেন সবাইকে, অমন সার্ভিস রিটার্ন করবে কার এত বুকের পাটা?

    বুদ্ধদেব গুহ-র আঁকা একটা ছবি

    একসময় দেখলাম দাড়ি রেখেছেন, ধপধপে সাদা, বেশ লাগছে। ‘জানো তো…’ আবার সেই মন্দ্র কণ্ঠস্বর, আবার সেই মারাত্মক হাসি, ‘অনেক বড় ঘরের বউরা আসত আমার ওখানে। না না, জঙ্গল-টঙ্গল ঠিক না, এত দূরে আসত আমার কাছেই। আমার বাবুর্চি যা রান্না করত, ওসব ওদের রান্নাঘরে বা লোক দেখানো রেস্টুরেন্টে পাওয়া যেত না। আমি জানতাম, জীবনের আসল ফুর্তিগুলো তো তালাবন্ধ। শুধুমাত্র রোস্ট বা সুফলে নয়। ড্রিঙ্কস, পুরুষরা ইয়েস, মেয়েদের মেরে কেটে একটু ওয়াইন। হ্যাঁ, এই আমাদের সোসাইটি। যদি ভাবো, এত স্কচের তো অনেক খরচ, ঠিকই। কিন্তু আসল ব্যাপারটা কী জানো? এর কোনও উত্তর হয় না। স্কচের বোতলে ভরে মহুয়া-টহুয়া কত কী খাইয়েছি, খেয়ে প্রচুর আহ্লাদ করেছে। করারই কথা। তাদের মরদরাও বাদ যায়নি।’

    বুদ্ধদেব গুহ কোন ইস্কুলে, কোন বই পড়ে জীবনের এইসব ডেঞ্জারাস সায়েন্স কেমিস্ট্রি জেনে ফেলেছিলেন তা অজানা থেকে গেল। ভালই হল। রেখে গেলেন অনেক কিছু। সঙ্গে নিয়ে গেলেন ওঁর নিজের তৈরি প্যান্ডোরার বাক্স। এর মধ্যে যা রয়ে গেল, তা আর জানা হল না। সবকিছু জানতে নেই।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook