বললাম— ভালোই নাম—
— একটা ভালো পোশাকি নাম দরকার। অনেক দিন থেকে গুরুর ইচ্ছে ছিল যেন একটা মেয়ে হয় তাদের। দুটো ছেলে, একটা মেয়ে থাকলে যেন সংসারটা সম্পূর্ণ হয়—
গুরু বললে, যখন কাশ্মীরে গিয়েছিলাম তখন একজন সাধু আমাদের হাত দেখে বলেছিল যে এবার মেয়ে হবে। তার কথাই সত্যি হল শেষ পর্যন্ত।
কথা বলতে-বলতে গুরুর মনের মেঘটা যেন কিছুটা কেটে গেল। দেখলাম আবার তার মুখে হাসি বেরিয়েছে। আবার তার মুখে কথা বেরিয়েছে। বললে— বাড়িটা ভেঙে দেওয়ার পর কিছুদিন সান-অ্যান্ড-স্যান্ড হোটেলে কাটিয়েছিলাম। কারণ থাকবার একটা বাড়ি তো দরকার, কিন্তু সেখানকার খাবার ভালো লাগল না। তাই এই বাড়িটা ভাড়া নিলাম—
— এর ভাড়া কত?
গুরু বললে— দু হাজার টাকা।
বললাম— কি জন্যে ডেকেছেন?
গুরু হাসতে লাগল। বললে—এমনি, ভালো লাগছিল না—
বললাম— কি ছবি করছেন এখন?
গুরু বললে— একটা ছবি চলছে। শহীদ লতিফকে দিয়েছি ডাইরেকশনের ভার। নাম দিয়েছি ‘বাহারে ফির ভি আয়েঙ্গে’— শহীদ পুরনো ডাইরেক্টর, ওর বউ ভালো লেখিকা। নিউ থিয়েটার্সে একটা ‘প্রেসিডেন্ট’ বলে ছবি ছিল, তারই হিন্দি করছি—
বললাম—কিন্তু সে কি ভালো হবে?
গুরু বললে— তা নিয়ে ভাবছি না, কারণ সব ভার দিয়েছি শহীদকে—
বহুদিন পর গুরুর সঙ্গে দেখা হয়েছে। আমারও খুব ভালো লাগছিল। একটু আগেই গীতার সঙ্গে লন্ডন যাওয়া নিয়ে কথা কাটাকাটি করেছে, তারপরেই আমি গিয়ে পৌঁছিয়েছি। আমাকে পেয়ে গুরু সব ভুলে গেল যেন। বেশিক্ষণ গুরুর সংসার বা স্টুডিও নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে না। ওই জন্যেই তার যন্ত্রণা। যন্ত্রণাটা গুরু যতক্ষণ ভুলে থাকে ততক্ষণই লাভ।
আমি গেলেই আমার সঙ্গে গল্প নিয়ে আলোচনা করে। গল্পের কথা আলোচনা করলে তার শরীর ভালো হয়। গুরু কি-কি পড়েছে, আমি কি কি পড়েছি, তারই আলোচনা হতে লাগল।
গুরু বললে— জানেন এবার কলকাতায় গিয়ে বহুদিন পরে হঠাৎ উদয়শঙ্করের সঙ্গে দেখা করেছি। তাকে একদিন আমার হোটেলে নেমন্তন্ন করেছিলাম—জানেন তো আমি আলমোড়ায় উদয়শঙ্করের দলে ছিলাম—
বললাম— হ্যাঁ শুনেছি—
— আমার নাচের গুরু উদয়শঙ্কর—
উদয়শঙ্করের সম্বন্ধেই অনেকক্ষণ গল্প হতে লাগল। তারপর অনেক রাত হয়ে গেল গল্প করতে করতে। একসময় বললে— আচ্ছা, এই বইটা দেখুন তো—এই বইটা আমি লন্ডনের ফুটপাথ থেকে কিনেছি—
দেখলাম একটা ইংরেজি বই। ইন্ডিয়ার পৌরাণিক ব্যাপার নিয়ে লেখা।
গুরু বললে— আপনি নিয়ে গিয়ে পড়ুন, দেখুন ওইটে নিয়ে কোনও রঙিন ছবি করা যায় কি না—
বইটা নিয়ে আমি নিজের ঘরে চলে এলুম। নতুন বাড়ি, নতুন ঘর, নতুন পরিবেশ। এ-বাড়িতে আগে কখনও আসিনি। দক্ষিণ দিকে সমস্ত দেয়ালটাই জানালা। কাঁচের ওপর পর্দা দিয়ে ঢাকা। সামনের বাড়িটাই অভিনেতা দিলীপকুমারের বাড়ি। অনেক রাত পর্যন্ত দেখলাম সে বাড়ির ঘরের ভেতরে আলো জ্বলছে। আমি একসময়ে বইট পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালবেলাই ঘুম ভেঙেছে। যথাসময়ে তৈরি হয়ে ছিলাম। গুরু এল। মুখখানার দিকে চেয়ে দেখলাম। গুরুর মুখ দেখে বোঝা যেত না রাত্রে ঘুমিয়েছে কি না! আমি জিজ্ঞেস করলাম—আপনার ঘুম হয়েছিল রাত্রে?
গুরু বললে—হ্যাঁ, আপনার?
বললাম— হ্যাঁ—
তারপর গুরু বললে— চলুন, স্টুডিওয় যাই—
দুজনে স্টুডিওয় চলেছি। কথাটা সেখানেই পাড়লাম। বললাম— বাড়িটা ভেঙে দিলেন কেন?
গুরু চমকে উঠল। বললে— সে বাড়িটা দেখতে যাবেন?
বললাম— চলুন।
গুরু গাড়ি ঘোরাল। অনেকখানি ঢালু রাস্তায় নেমে এসেছিলাম। আবার উঁচুতে উঠে পেছন দিকে চলতে লাগলাম। ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পড়লাম সেই আটচল্লিশ নম্বরের বাড়িতে। সামনে সেই লালা দাঁড়িয়ে আছে। গুরুর পুরনো সেই দারোয়ান। দরজাটা খুলে দিতেই নজরে পড়ল ভেতরটা।
আমি আঁতকে উঠলাম। গুরু গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে ঢুকল। আমার মনে হল ও যেন গুরু নয়, এ যেন বোম্বাই নয়, এ যেন পালি হিল নয়। এ যেন কলকাতায় এসেছে পাড়াগাঁয়ের ছেলে ভূতনাথ। ভূতনাথ যেন বনমালী সরকার লেনের ভেতরে ঢুকে বড়বাড়ির ভাঙা চেহারাটা দেখছে।
সেই ভাঙা বাড়িটার দিকে সেই ভাবে চেয়ে থাকতে থাকতে আমার মনে হল যেন তার ভিত খুঁড়লে বউঠানের কঙ্কাল পাওয়া যাবে ঠিক সেই সেদিনকার মতো। গুরু তখনও সেই দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল।
আমি তার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলুম— আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো, আপনি আপনার এত সাধের বাড়ি ভেঙে ফেললেন কেন?
গুরু হেসে ফেললে। বড় করুণ সেই হাসি।
বললে— আপনার ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবি করেছি বলে—
বললাম— সে কি?
গুরু বললে— না, তা ঠিক নয়, আমি বাড়ি ভাঙলুম অন্য কারণে—
বললাম— কি কারণ?
গুরু বললে— চলুন, গাড়িতে গিয়ে উঠি, গাড়িতে উঠে আপনাকে বলছি—
গাড়িতে উঠতে গিয়েও উঠতে পারলুম না। আবার পেছন ফিরে চেয়ে দেখলাম। বাড়িটা নেই বটে কিন্তু বড়-বড় গাছগুলো ঠিক রয়েছে। যে-ঘরে আমি শুতাম, সে-ঘরখানার পাশে একটা কাঁঠাল গাছ ছিল। তাতে কাঁঠাল নেই, কিন্তু গাছটার ডালে দেখলুম নতুন পাতা, নতুন ডাল গজিয়েছে। যে-ঘরে গুরু শুতো, তার ওপর ভাঙা ইঁটের স্তূপ। বাথরুমটার ওপর সেই নীল ইটালিয়ান মার্বেল পাথরগুলো তেমনি পড়ে আছে, আর কিছু নেই। সামনের ফুলবাগানটা কাঁটা ঝোপে ঢেকে গেছে। আমার আর গুরুর বহু রাত, বহু দিনের স্মৃতির স্বাক্ষর মিশে আছে বাড়ির প্রতিটি ইঁটে প্রতিটি গাছে।
গীতাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম— আপনি কিছু বলতে পারেন, কেন গুরু বাড়িটা ভাঙল?
গীতা বলেছিল— আমিও তো জিজ্ঞেস করছি, আপনাকে কিছু বলেছে?
বললাম— না— আপনি যা-যা জানেন বলুন—
তখন কি জানি যে একদিন আমাকেই আবার এ-কাহিনী লিখতে হবে, আর সে কাহিনী এত বড় হবে? তাহলে তো যা-যা দেখেছি, সব লিখে রাখতাম। আজকে গুরুরই তো বেঁচে থাকার কথা, আর আমার চলে যাওয়ার পালা। এই ক-বছরে কত মৃত্যু দেখলুম, কত জন্ম দেখলুম। আরো হয়তো কত দেখবো কে জানে! কিন্তু মনে যখন ভীষণ কষ্ট হয়, তখন কেবল প্রার্থনা করি, যেন আর দেখতে না হয় এত যন্ত্রণা, এত সংগ্রাম, এত দুঃখ। কেন যে এমন হয়, মনে হয় পৃথিবীতে দুঃখ-যন্ত্রণার সংখ্যাই যেন জুড়ে চলেছে। জন্ম থেকে যেন মৃত্যু বেশি হচ্ছে, দুঃখ যেন আনন্দকে গ্রাস করে ফেলতে চাইছে। হয়তো এ আমার বয়েসেরই দোষ, বয়েস হলে হয়তো এই রকম মনে হওয়াটাই নিয়ম। তবু এক-একবার সন্দেহ হয়। তবে কি আমি নাস্তিক হয়ে পরেছি? নৈরাশ্যবাদী হয়ে যাচ্ছি?
তবু আবার একদিন প্রশ্ন করেছিলাম গীতাকে। বলেছিলাম— সত্যি বলুন তো, কী হয়েছিল আসলে?
গীতা বলেছিল— আমি ওই গেস্ট-হাউসের মধ্যে ঘুমোচ্ছিলাম, হঠাৎ বিকেল চারটের সময় ঘুম ভাঙলে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে দেখি মিস্ত্রিরা বাড়ি ভেঙে একেবারে মাটি সমান করে ফেলেছে—
বললাম— আপনি কিছুই জানতে পারেন নি—
গীতা বললে— না, আমি ঘুমোচ্ছিলাম—
— তারপর?
— তারপর আমি কি করব বুঝতে পারলুম না। বাড়ি মেরামত হচ্ছিল, মিস্ত্রি খাটছিল, এইটুকু শুধু জানি, কিন্তু বাড়িটা কখন ভেঙে ফেলল তা বুঝতে পারিনি। আমি টেলিফোনে স্টুডিওতে ওর সঙ্গে কথা বললাম। বললাম—মিস্ত্রিরা যে আমাদের বাড়ি ভেঙে ফেলে—
আমি তো শুনে অবাক। বললাম— তাতে গুরু কি বললে?
— ও বললে ভাঙ্গুক, আমিই ওদের ভেঙে ফেলতে বলেছি।
বললাম— জিজ্ঞেস করলেন না বাড়ি ভেঙে ফেলে থাকবেন কোথায়?
গীতা বললে— হ্যাঁ, তাও জিজ্ঞেস করলুম, ও বললে হোটেলে থাকব। হোটেলের ঘর রিজার্ভ করা হয়ে গেছে—
হোটেল মানে জুহুর ‘সান অ্যান্ড স্যান্ড’ হোটেল। মস্ত বড় শৌখিন হোটেল। প্রতিদিন মাথা পিছু দেড়শো টাকা খরচ। আমি নিজে সে হোটেলে কয়েকদিন থেকে এসেছি। সাজসজ্জা আরাম সব কিছুর দিক থেকে সে হোটেল ভালো। কিন্তু গুরুর মতো লোক সেখানে থাকতে পারবে না। সেখানে বাইরে থেকে খাবার আনানো যাবে না। তাদের দেওয়া ফুডই খেতে হবে।
কিন্তু গুরু চিরকাল খাওয়ার ব্যাপারে গণতান্ত্রিক। আমি নিজে তাকে চপ-কাটলেট ফেলে ডালনা-চচ্চড়ি খেতে দেখেছি। কলকাতায় এসে দ্বারিক ঘোষের দোকানে লুচি-ছোলার ডাল খেয়ে তৃপ্তি পেতে দেখেছি। চৌরঙ্গীর গ্র্যান্ড-হোটেল ছেড়ে রাস্তায় তো বেরিয়েছে পাইস-হোটেল খুঁজতে। গুরু কতবার বলেছে—দ্বারিক ঘোষের দোকানে এখনও সেই রকম লুচি-ছোলার ডাল পাওয়া যায়?
তারপর কলকাতার পাইস-হোটেল। সেকালের কলকাতার পাইস-হতেলে যে একবার খেয়েছে, সে আর তা ভুলতে পারবে না।
আমি বলতাম— এখন সে-সব খারাপ হয়ে গেছে, সে-রকম আর নেই—
তবু মনে আছে একবার সারাদিন ঘুরেও একটা পাইস-হোটেল খুঁজে পাইনি। গুরুর বহুদিনের সাধ পাইস-হোটেলে ঢুকে ইলিশ-মাছের ঝোল আর ভাত খাবে। গুরুর সে-সাধ আমি বহু চেষ্টা করে পূর্ণ করতে পারিনি। গুরু গ্র্যান্ড হোটেলের সামনের মাঠে গিয়ে ঘুগনি, ভেলপুরী, মশলা-মুড়ি খেয়েছে, কিন্তু পাইস-হোটেলের ভেতরে বসে ইলিশ-মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়ার শখ মেটাতে পারেনি।
গাড়িতে উঠে জিজ্ঞেস করলাম— তারপর? তারপর কি করলেন?
গুরু বললে— একদিন হোটেল ছেড়ে এ বাড়িটা ভাড়া নিলুম—
— কিন্তু বাড়ি ভাঙার আসল কারণটা বলুন তো? কেন—
গুরু নিজেও হয়তো জানে না কেন ভেঙেছে?
গাড়ি চালাতে-চালাতে বললে— গীতার জন্যে—
আমি চমকে উঠেছি। বললাম— সে কি?
গুরু সিগারেটে টান দিয়ে একটা লম্বা ধোঁয়া ছাড়ল। বললে— বাড়ি না-থাকার কষ্টের চেয়ে বাড়ি থাকার কষ্টটা আরো ভীষণ। তা তো জানেন?
বললাম— ঠিক বুঝতে পারলাম না, ভালো করে বুঝিয়ে বলুন—
গুরু আবার সিগারেট টেনে ধোঁয়া ছাড়ল—
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত