ওয়াচমেন’ (Watchmen) গ্রাফিক উপন্যাসের কথা অনেকেই শুনেছেন। না পড়ে থাকলেও বইটির ভিত্তিতে বানানো সিনেমাটা হয়তো দেখেছেন। ১৯৮৬ সাল থেকে দু’বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে এই উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। লেখায় ব্রিটিশ লেখক অ্যালান মুর, রেখায় ডেভ গিবন্স আর রঙে জন হিগিন্স। ওয়াচমেন প্রকাশিত হওয়ার পর কমিক্স জগতের (বিশেষ করে সুপারহিরো গল্পের) পটভূমি চিরকালের জন্য বদলে যায়। সেই আলোচনার আগে আমাদের একটু সুপারহিরো কমিক্সের প্রেক্ষাপটটা জেনে নিতে হবে।
সুপারহিরোদের গল্প শুরু সেইই ১৯৩৮ সালে, অ্যাকশন কমিক্সের প্রথম সংখ্যায়। কভারটা আপনাদের চেনা। প্রচ্ছদে, নীল আর লাল রঙের কস্টিউমধারী এক পেশিবহুল যুবক আস্ত একটা মোটরগাড়ি নিজের মাথার উপর তুলে কয়েকটা পাথরের চাঁইয়ে আছাড় মারছে। দুজন লোক সেই ঘটনাস্থল থেকে পলায়নরত, আর একজন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মাটিতে পড়ে। যুবকের বুকের কাছে একটা হলুদ বর্মের উপর জ্বলজ্বল করছে লাল রঙের ইংরেজি অক্ষর ‘এস’। এখান থেকেই কমিক্সের মোড় ঘুরে গেল অতিমানবের আখ্যানের দিকে।
কমিক্সের স্বর্ণযুগে (১৯৩৮-’৫৬) প্রায় সমস্ত মার্কিনি অতিমানব ছিল প্রোপাগান্ডার শিকার। জাতীয় পতাকার লাল, নীল আর হলুদ পোশাকধারী এই নায়ক-নায়িকারা পাল্প ম্যাগাজিনের পাতায় পাতায় শত্রুদের উত্তম-মাধ্যম দিত আর দেশপ্রেমের বুলি আওড়াত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, দূরদর্শনের ম্যাজিকে যখন সকলে বুঁদ হয়ে গেল, এই ফর্মুলা আর কাজ করল না।
রৌপ্যযুগে (১৯৫৬-১৯৬৯) এবং ব্রোঞ্জযুগে (১৯৬৯-১৯৮৬) তাই চলল অসংখ্য রিভ্যাম্প— গল্পে এবং কস্টিউম ডিজাইনে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ডিটেকটিভ কমিক্স এবং মার্ভেল কমিক্স (প্রথমে ছিল টাইমলি কমিক্স) জাদুটোনা আর আগডুম-বাগডুম বাদ দিয়ে বিজ্ঞানকে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করল। প্লট হল আরও টানটান, ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হল সর্বক্ষেত্রে। বর্তমান যুগে দেখতে পাওয়া বেশির ভাগ সুপারহিরো এই সময়েই কমিক্সের পাতায় জীবন্ত হয়েছিল।
তবে ১৯৮৬-র আগে সুপারহিরোদের গল্পে, প্রকৃত অর্থেই, গভীরতা কম ছিল। অদ্ভুত রঙিন পোশাক পরা সুপারম্যানেরা দিনের পর দিন সুপার-ভিলেনদের অতিনাটকীয় দুরভিসন্ধিকে ব্যর্থ করবে: এটাই ছিল প্রতিটা গল্পের ধাঁচ। সব ‘কেপড ক্রুসেডার’-এর চরিত্রাঙ্কন যথেষ্ট লঘু ছিল। বাস্তব জগতের সামাজিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর স্থান ছিল না কোথাও। কমিক্সগুলো যেন শুধুই এসকেপিজমের সরঞ্জাম।
অ্যালান মুর বললেন, না তা আর হবে না। সুপারহিরো মাত্রেই ন্যায়পরায়ণ আর নৈতিকতার আর্কিটাইপ— তা দেখানো আর সম্ভব নয়, বিশেষ করে সেই সময়ে, যখন ঠান্ডা যুদ্ধের কারণে রাজনৈতিক আর সামাজিক অস্থিরতা তুঙ্গে। ততদিনে আমেরিকার জনসাধারণের উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গিয়েছে। ভিয়েতনামে মার্কিনি সৈন্যদের নাক কাটা যাওয়ার পর এবং ওয়াটারগেটের স্ক্যান্ডাল হওয়ার পর অনেক আমেরিকান আর সেই সত্য, ন্যায় আর আমেরিকান পন্থার (Truth, Justice and the American way) উপর আস্থা রাখতে পারছিল না। দেশের নেতা আর নায়কদের প্রতি তাদের যে গভীর বিশ্বাস ছিল, সেই ভিতে তখন গভীর ফাটল ধরেছে। ঠিক হয়েছে ভুল, চেনা হয়েছে অচেনা। তার উপর ছিল মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তি আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক। এই সময় সদাহাস্য সুপারহিরোদের শিশুসুলভ অ্যাডভেঞ্চার হাস্যকর মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেন সেটারই জবাব হিসাবে, ১৯৮৬ থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করল ‘ওয়াচমেন’ (Watchmen), একটি অ্যান্টি-সুপারহিরো কমিক্স।
১৯৩৮-এর পর, এতদিনে, আরেকটা কাজ কমিক্স জগতে বিপুল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হল। গল্পের বাঁধুনিতে, চরিত্রাঙ্কনে, ছবি আঁকার পন্থায় এবং রঙের কারসাজিতে ‘ওয়াচমেন’ আর পাঁচটা কমিক্সের থেকে আলাদা।
গল্পের সারাংশ এখানে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না, কিন্তু তবু কিছুটা খেই ধরিয়ে দিচ্ছি। কমেডিয়ান নামে একজন সুপারহিরোকে অজ্ঞাত কেউ খুন করেছে। রড়শ্যাক নামে আরেকজন ভিজিল্যান্টি হিরো সেই রহস্যের সমাধান করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। অন্যান্য নায়কেরা তাকে প্রথমে তেমন পাত্তা দেয়নি, কিন্তু তারপর হঠাৎ সকলের উপর নানাদিক থেকে হামলা শুরু হয়। খুব শীঘ্রই বোঝা যায়, কেউ বা কারা সমস্ত সুপারহিরোদের এক এক করে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। আজ্ঞে হ্যাঁ, এটাকে একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস বলা যেতে পারে, খালি গোয়েন্দার বদলে রয়েছে সুপারহিরোর দল।
এই উপন্যাসে মুর সবার প্রথমে চেয়েছেন সুপারহিরো বিষয়টার সমালোচনা করতে। তাঁর মতে, বাস্তব জীবনে সুপারম্যানের মতো ন্যায়পরায়ণ ভাল মানুষ থাকা সম্ভব নয়। তাঁর মতে, পক্ষপাতদুষ্ট মানবসমাজের মধ্যে থাকা একটা সুপারহিরোর পক্ষে নৈর্ব্যক্তিক এবং নিরপেক্ষ ভাবে ভাল-মন্দের বিচার করা সম্ভব নয়। আর তা-ই যদি সত্যি হয়, তাহলে অতিমানবদের বিচার-বিবেচনার উপর জনসাধারণ ঠিক কতটা বিশ্বাস করতে পারবে? সুপারহিরোরা তো আমাদের মতোই ত্রুটিপূর্ণ।
ওয়াচমেনের নায়ক-নায়িকার মধ্যে রয়েছে আমাদের মতোই গুণ, আমাদের মতোই দোষ। কয়েকজন তো পুরোপুরি অসামাজিক সোশিওপ্যাথ, ঠান্ডা মাথায় খুনোখুনি করতে তাদের এক মুহূর্তের জন্যেও হাত কাঁপে না। এদিকে যাদের সুপার-পাওয়ার রয়েছে, তারা নিজেদের মানবিকতাকে হারিয়ে ফেলেছে, কারণ অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এনেছে আমূল পরিবর্তন। এদের চরিত্র গঠনের সময় মনস্তাত্ত্বিক দিকটায় প্রবল গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মুর প্রশ্ন তুলেছেন, একজন ব্যক্তি যদি উদ্ভট পোশাক-আশাক পরে দিনে-দুপুরে চোর-ডাকাত ঠেঙিয়ে বেড়ায়, তাহলে কি সে মানসিক ভাবে সুস্থ? যদি আমাদের মতো দুনিয়ায় সত্যি সুপারহিরো থাকত, তবে ঠিক কী ধরনের লোক এই পেশার প্রতি আকর্ষণ বোধ করত?
রোজ রোজ এইভাবে আইন এবং সামাজিক নিয়মের বাইরে হিংস্রতার পুজো করলে লোকেদের মধ্যে মানসিক চাপ একটু বেশিই থাকবে। সেই চাপ থেকে নানা প্রকার মানসিক সমস্যা দেখা দেওয়াটাও অসম্ভব কিছু নয়। এই সমস্যাটা প্রকাশিত হয়েছে ‘রড়শ্যাক’ এবং ‘দ্য কমেডিয়ান’ চরিত্র দুটির মাধ্যমে।
সমাজের নীচুতলা থেকে উঠে আসা রড়শ্যাক মানুষের ক্রূরতার পরিচয় পেয়েছে সেই ছোটবেলা থেকে, অনেকক্ষেত্রে নিজের গণিকা মায়ের হাতেই। বড় হয়ে রড়শ্যাক কাজ করত এক দর্জির দোকানে। সেই সময় নিউ ইয়র্কে একটা বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটে। একটা মেয়েকে নির্যাতন করে তার নিজের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের সামনেই খুন করা হয়। সব্বাই উঁকি মেরে সেটা দেখেছিল, কিন্তু সাহায্য করতে আসেনি কেউই। কাকতালীয় ভাবে, মেয়েটি ছিল রড়শ্যাকের দর্জির দোকানের এক খদ্দের। খবরটা জানার পর মেয়েটিরই অর্ডার করা একটা কাপড় থেকে রড়শ্যাক নিজের জন্য একটা মুখোশ বানায়। তার আসল চেহারা আয়নাতে দেখতে পেলে অসহ্য লাগছিল যে! মনে হচ্ছিল সেও ওই অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দাদের মতোই একটা জানোয়ার। তাই মুখোশ পরে ঢাকতে চেয়েছিল পাপবোধ। এইভাবে বারবার মানুষের বিভিন্ন নির্মমতার উদাহরণ পেয়ে রড়শ্যাক নিজেকে বুঝিয়েছে যে, মানুষ মাত্রেই নৈতিক ভাবে দুর্বল, অসামাজিক, অধার্মিক এবং অসৎ। সে চারিদিকে শুধুই সামাজিক অবক্ষয় দেখতে পায়, আর অপেক্ষা করে পৃথিবীর ধ্বংসের জন্যে। লোকটা নিজের জার্নালে লেখে, ‘The streets are extended gutters and the gutters are full of blood and when the drains finally scab over, all the vermin will drown.’
এইরকম একটা চরমপন্থী লোক, যার মানসিক বিকাশ কোনও কালেই যথাযথ ভাবে হয়নি, সে যখন মুখোশ পরে নৈতিকতার মঞ্চে নিজেকে স্থাপন করার চেষ্টা করে, তখনই হয় গন্ডগোল। জগৎটাকে সাদা-কালোর বাইনারিতে দেখা রড়শ্যাক সুপারহিরো রূপে প্রায় সকলের সাথে হিংস্র ভাবে আচরণ করে। অপরাধ জগতের কোনও তথ্য জানতে হলে সে হানা দেয় বিভিন্ন শুঁড়িখানায়, আর এলোপাথাড়ি ভাবে লোকেদের হাত-পা ভাঙে। তাতে কাজ হলে ভাল, আর না হলে জার্নালে লেখে, ‘একটু ডিপ্রেসেড লাগছে।’
অন্যদিকে রয়েছে দ্য কমেডিয়ান, একজন নিহিলিস্ট। তার মতে দুনিয়াতে নৈতিকতা আর ন্যায় বলে কিছুই নেই, সবই মানুষের ভ্রম, বানানো মিথ্যে। একটা ‘sick joke’। এখানে, ‘জোর যার, মুলুক তার’। তার কাছে সবকিছুই পরিহাস এবং সে বসে আছে শুধু তামাশা দেখার জন্য।
‘Once you realize what a joke everything is, being the Comedian is the only thing that makes sense.’
তাই কমেডিয়ান সবচেয়ে প্রভাবশালী দলেদের মধ্যে ভিড়ে যায়, তাদের ছত্রছায়ায় থেকে নৃশংসতার খেলায় মত্ত হয়। প্রথমে সে অন্যান্য সুপারহিরোদের সাথে বন্ধুত্ব পাতায়, যাতে ন্যায় আর সত্যের নামে যতটা সম্ভব মন্দ কাজ করা যায়। তারপর সে আমেরিকান সরকারের হয়ে বেগার খাটে। ভিয়েতনামে গিয়ে সেখানকার রণোন্মাদনা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। সেখানে, তার কাছে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুদের হত্যা করা যা, একটা নির্দোষ গর্ভবতী মেয়েকে খুন করাও তাই। নিজের দেশে ফিরে সে নিক্সনের চ্যালা হয়ে রাজনৈতিক শত্রুদের ঠান্ডা মাথায় খুন করতে আরম্ভ করে। ধর্ষণ, রাহাজানি, গুপ্তহত্যা— কিছুই বাদ রাখেনি কমেডিয়ান। এই নিয়ে কোনও অনুতাপও নেই তার। কারণ ওই যে, জীবনের সবই তো তার কাছে অর্থহীন। রড়শ্যাকের যেখানে নৈতিক বোধ অপরিণত, কমেডিয়ানের সেখানে নৈতিক বোধই নেই। সে হল সত্য অর্থে একজন a-moral লোক।
কী? এদের কাউকেই সুপারহিরো মনে হচ্ছে না, তাই তো? তাছাড়া এদের কারও কাছেই অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাও নেই। সুপারম্যান তো সাঁইসাঁই করে উড়ে এসে একটা থাবড়া মেরে সব সমস্যার সমাধান করে দেয়। সেইরকম কিছু না থাকলে আর কীসের সুপারহিরোর গল্প? আসলে এই উপন্যাসে ডক্টর ম্যানহাটান ছাড়া কারওরই সেইরকম সুপার-পাওয়ার নেই, কারণ গল্পের লেখক এবং আর্টিস্ট— দু’পক্ষই চেয়েছিলেন কমিক্সের জগৎটা যতটা সম্ভব বাস্তবসম্মত রাখতে। ম্যানহাটানের ক্ষমতা সীমাহীন। সে টেলিপোর্ট করতে পারে, যে কোনও বস্তুকে মুহূর্তের মধ্যে বাষ্পীভূত করতে পারে, নিজের দেহের আয়তন কমাতে ও বাড়াতে পারে ইত্যাদি। বাঁচার জন্য তার বাতাস, জল বা খাবার কিছুই লাগে না। তার কাছে সময়ের স্রোত আপেক্ষিক, তাই অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ, সবকিছুই সে একসাথে দেখতে পায়। ম্যানহাটানের উপস্থিতি গল্পে রয়েছে শুধুমাত্র অতিমানবের মধ্যে আসা apathy ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য। একজন ভগবানসম জীব, যার কিনা জীবন আর মৃত্যুর উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, যার কাছে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ সবই সমান, তার মধ্যে মানুষের ছোটখাটো ঝামেলার প্রতি যে উদাসীনতা আসবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! তাই ম্যানহাটান খুব সহজেই এক পলকের মধ্যে তার বহুবছরের প্রেমিকাকে ভুলে যায় নতুন আরেকজনের জন্য। তাই সে পৃথিবীর ঝামেলা থেকে পালিয়ে বেড়ায়, মঙ্গলগ্রহে বসে থাকে শান্তির খোঁজে। তাই সে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃতদেহের মাঝে অবিচলিত থাকে।
অ্যালান মুরের আগে সুপারহিরোদের নিয়ে এত গভীর চিন্তা কেউ করেনি, করলেও সেগুলো সীমিত রেখেছে ‘কী ক্ষমতা হবে? কী রঙের প্যান্ট পরবে? দিনে ক’টা লোককে প্যাঁদাবে?’ এইসবের মধ্যে। এই প্রথম কমিক্সের নায়ক-নায়িকারা আকাশ আর গগগনচুম্বী অট্টালিকা থেকে নেমে মাটিতে পা রাখল। গল্পে দেখা গেল তাদের দৈনন্দিন আর ব্যক্তিগত জীবনের ছোটবড় নানা সমস্যা। এ যেন সুপারহিরো কনসেপ্টেরই সম্পূর্ণ ডিকনস্ট্রাকশন। সুপারহিরোদের নিয়ে যে এতটা পূর্ণবয়স্ক, এতটা জটিল গল্প বলা সম্ভব, সেটা বুঝতে পেরে ইন্ডাস্ট্রিতে একটা ছোটখাটো রেনেসাঁস ঘটে যায়। মুর নিজেই এরপরে কাজ করেন ‘দ্য কিলিং জোক’-এর উপর, যেখানে ব্যাটম্যানের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। এর সাথে তিনি লেখেন ‘হোয়াটএভার হ্যাপেনড টু দ্য ম্যান অফ টুমরো?’ যেখানে প্রথমবারের জন্য সুপারম্যানের মানবিক দিকটি দেখানোর প্রচেষ্টা হয়েছে। তাঁর লেখার প্রভাব দেখা যায় ফ্র্যাঙ্ক মিলার, গ্র্যান্ট মরিসন, নিল গাইম্যান, অ্যালেক্স রস, প্রমুখ বরেণ্য শিল্পীদের মধ্যে।
‘ওয়াচমেন’ সম্বন্ধে আলোচনা সম্পূর্ণ হবে না, যদি না সেটার আর্ট নিয়ে কথা ওঠে। কমিক্স মাত্রই লেখা আর রেখার মেলবন্ধন। এই গ্রাফিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু বেশি রকমের সত্যি। ডেভ গিবন্স খুব নৈপুণ্যের সাথে প্রতিটা বইয়ের পাতাকে ন’টা সমায়তনের আয়তক্ষেত্রে ভাগ করেছেন, যেখানে প্রত্যেকটা আয়তক্ষেত্র হল একটা কমিক প্যানেল। এরকম বিভাজনের ফলে বইয়ে একটা চমকপ্রদ প্রতিসাম্য (symmetry) এসেছে।
ন্যারেটিভের দিক থেকে দেখতে হলে এইরকম বিভাজন গল্প পড়ার গতি এবং প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে। যাঁরা কমিক্স পড়েন না, তাঁদের পক্ষেও ঘটনার প্রবাহ বুঝতে পারা খুব সহজ হয়ে যায়। তাছাড়া একটা পাতায় প্লট অনেকটা এগিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু এইটুকু করেই গিবন্স থেমে যাননি। অনেকক্ষেত্রেই এই প্রতিসাম্য ভেঙেছেন। সেইখানে, দুটো বা তার বেশি আয়তক্ষেত্রকে একত্রিত করে আঁকা হয়েছে একটাই প্যানেল।
এইরকম প্যানেলিং-এর জন্য গিবন্স গল্পের কোনও একটা ঘটনা বা বিষয়ের উপর বেশি গুরুত্ব দিতে পেরেছেন। এতে গল্পে নাটকীয়তার মাত্রা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। গিবন্স চেয়েছিলেন বইয়ের আর্ট-স্টাইল এতটাই অনন্য হবে যে, লোকে একটা প্যানেল দেখেই বলতে পারবে, এটা ওয়াচম্যানের ছবি।
যদি আর্ট-স্টাইলের কথা ওঠে, তা হলে আলোচনা করা যায় ছায়া আর আলোর বৈপরীত্য নিয়ে, যাকে আঁকা এবং ছবি তোলার পরিভাষায় বলা হয় ‘কনট্রাস্ট’। ছায়ার সুনিপুণ ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়েছে একটা রহস্যজনক এবং রোমাঞ্চকর পরিবেশ, ঠিক যেটা ‘নোয়া’ (Noir) সিনেমাগুলোয় দেখা যেত। আগেই বলেছি, ‘ওয়াচমেন’ তো আদতে একটি ডিটেকটিভ রহস্যোপন্যাস, অতএব noir-এর স্টাইল দেখতে পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কমিক্সের লাইন-আর্টও তথাকথিত আমেরিকান কমিক্স আঁকার পন্থাকে অনুসরণ করেনি। তুলি বা ব্রাশপেন ব্যবহার না করে, গিবন্স ধরেছেন শক্ত নিবের ইংকিং কলম, যাতে এক-একটি রেখা বেশি সরু-মোটা না হয়ে, ঠিক একই প্রস্থের হয়। এইরকম লাইন আঁকার পদ্ধতি দেখা যায় অ্যার্জ-এর (Herge, টিনটিনের স্রষ্টা) ligne claire স্টাইলে, কিন্তু, সেখানে আবার কালি দিয়ে সাধারণত ছায়া আঁকা হয় না।
এছাড়াও গ্রাফিক উপন্যাসটার রঙের ব্যবহার অনন্য। ১৯৮০-এর দিকে কমিকবুক রং করা মহা ঝামেলার ব্যাপার ছিল। একদম প্রথমে আর্টিস্ট (পরবর্তী কালে এই কাজ করতেন পেন্সিলার এবং ইঙ্কার) পেন দিয়ে সাদা কাগজে পেন্সিল স্কেচের উপর কালি দিয়ে লাইন-আর্ট এঁকে নিতেন। এরপর অনেক ক্ষেত্রে আলাদা ভাবে লেটারার আনা হত, যাঁর কাজই হল, কমিক বেলুনের মধ্যে লেখাগুলো পরিষ্কার করে লেখা। তারপরে আসতেন কালারিস্ট, যিনি দায়িত্ব নিয়ে প্রতিটা প্যানেলে রং-এর নির্দেশ লিখে রাখতেন। শেষের ধাপ হল এই পাতাগুলোকে ছাপাখানায় নিয়ে যাওয়া, যেখানে একদল কর্মচারী সেই কালারিস্টের নির্দেশ অনুযায়ী রংগুলো প্রয়োগ করবেন। আমেরিকাতে, সেই সময় শুধুমাত্র একটা ছাপাখানা ছিল, ওয়ার্ল্ড কালার প্রেস, যেখানে এই কাজটা করা হত।
এইরকম জটিল পদ্ধতির মধ্যেও, কালারিস্ট জন হিগিন্স নিজের ছাপ রেখে যেতে পেরেছেন। তখন আমেরিকার কমিক্সের বাঁধাধরা রঙের প্যালেট ছিল লাল, নীল আর হলুদ।
কিন্তু, হিগিন্স, যিনি এর আগে ব্রিটেনের কমিক্স ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেছেন, ব্যবহার করলেন সেকেন্ডারি তিনটে রঙের প্যালেট— বেগুনি, কমলা এবং সবুজ। এর ফলে তখনকার দিনের সমস্ত কমিক্সের থেকে ওয়াচমেনের চেহারা একদম আলাদা। প্যানেলগুলোতে সেকেন্ডারি রঙের পরিমিত ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু যেভাবে গিবন্স কোনও বিষয়ের উপর গুরুত্ব বেশি দেওয়ার জন্য প্যানেলিং-এর প্রতিসাম্য ভেঙেছেন, ঠিক সেই ভাবে, হিগিন্স সেকেন্ডারি রংগুলোর মাঝে প্রাইমারি রং ঢুকিয়ে বিশেষ বিশেষ এলিমেন্টের উপর পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
এই লেখা, রেখা আর রঙের মাহাত্ম্যে প্রায় ৪০ বছর পরেও ‘ওয়াচমেন’ অন্যতম প্রভাবশালী কমিক্স। সুপারহিরো জঁর (genre)-এর উপর এইরকম সমালোচনামূলক কাজ এতদিনে আর একটাও বেরোয়নি। এখন সুপারহিরোরা পাতা ছেড়ে সিনেমা আর টিভির পর্দায় বিরাজমান। কিন্তু এইসব আধুনিক অতিমানবের প্রতি অ্যালান মুরের সমালোচনা এখনও প্রযোজ্য, প্রাসঙ্গিক।
ঋণ:
উইকিপিডিয়া, ব্রিটানিকা
ইউটিউব চ্যানেল – kaptainkristian
Riesman, A. (2019, October 18). The Forgotten Story of Watchmen’s Unsung Hero. Retrieved August 23, 2021, from https://www.vulture.com/2019/10/watchmen-colorist-john-higgins.html
Watchmen: An Oral History. (2005, October 21). Retrieved August 23, 2021, from https://ew.com/books/2005/10/21/watchmen-oral-history/