এখন পরীক্ষার মরশুম। সবাই যেন আমার দিকে আজকাল কেমন সন্দেহের চোখে, কেমন বিরক্তির চোখে তাকাচ্ছে– আমি শিক্ষক, আমি সেই শ্রেণির মানুষ, যে-শ্রেণিকে আমার ভাইপো আপাতত অপছন্দ করে। সারাদিনের মধ্যে বেশিরভাগ সময়টাই তার কেটে যায় ল্যাপটপের সামনে বসে– তার সব শিক্ষকেরা, ক্লাসের সমস্ত বন্ধুরা, যত ভিডিও গেমের দল, সবাই ওই যন্ত্রটির মধ্যেই থাকে কিনা! আমরা তো ওর কাছে তুচ্ছ– ওর ঘরের মশাগুলোর মতো, বা ওর প্রয়োজনের ওই সিলিং ফ্যানটার মতোই, অবজ্ঞার পাত্র। যে-ঘরে ও বাসা বেঁধেছে, সে-ঘরের পর্দা সারাদিন সারারাত টানা থাকে, আর পাঁচটা বাচ্চার মত ওর জীবন থেকেও বাইরের পৃথিবীটা হারিয়ে গেছে।
মাঝে মাঝে পরীক্ষা নিয়ে ওকে নানা প্রশ্ন করি; ‘ব্লেকের এই কবিতাটায় সবাই হাসছে কেন রে? মঙ্গলগ্রহে কি মানুষ থাকতে পারে? হিমালয়ের সৃষ্টি কীভাবে হয়েছিল?’ উত্তরে ও কী লিখেছে, আমি কখনওই জানতে চাই না। অনলাইন বিদ্যালাভ এবং পরীক্ষা দেওয়ার প্রায়-প্রহসনের চাপে ওর যে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছে, আমার উত্তর জানতে না চাওয়ার কারণ শুধু এটাই নয়। মাঝে মাঝে মাথা ঝাঁকাই। ও জিজ্ঞেস করে, কেন। ঘর থেকে টেনে ওকে বারান্দায় যখন নিয়ে যেতে সক্ষম হই (অবশ্যই দু’জনেই সেখানে দাঁড়ানোর সময়ে মাস্ক পরতে ভুলি না), তখন প্রশ্ন করি, ওর বাড়িটা যে রাস্তার উপর, সে রাস্তাটার নাম কী? ওর মনে আছে– কুরিয়ার বা জোম্যাটোর কর্মচারীদের আমাদের বলতে শুনেছে ও।
‘শ্রীমা সরণি’, উত্তর আসে।
‘শ্রীমা কে?’ আমি প্রশ্ন করি, ‘আর এই রাস্তাটার নাম তাঁর নামে কেন?’
ও জানে না।
ওর লেখাপড়ার একটা বইতেও ও নিজের গল্প পায় না– ও কোন শহরে থাকে, সে শহরের নামটা কোথা থেকে এসেছে, সেখানকার আবহাওয়া এরকম কেন। ওর নিজের শহরের একজন ঐতিহাসিক চরিত্রেরও নাম ও জানে না। অনেক ভাবনাচিন্তার পরে বলে, ‘ঋদ্ধিমান সাহা’। বোঝাই যাচ্ছে, ওর ইতিহসের বইগুলো ওকে ভুল শিখিয়েছে, ‘বিখ্যাত মানুষ’ আর ‘ঐতিহাসিক চরিত্র’-কে গুলিয়ে দিয়েছে।
অতএব আমি কয়েকটা প্রশ্ন তৈরি করতে শুরু করলাম। এ প্রশ্নগুলোর হাত ধরে হয়তো উত্তরবঙ্গকে একটু অন্যভাবে কল্পনা করা যাবে।
১। আমরা তো পশ্চিমবঙ্গে থাকি। তা হলে এই জায়গাটাকে উত্তরবঙ্গ কেন বলা হয়?
২। কবে থেকে এর নাম উত্তরবঙ্গ?
৩। ‘শিলিগুড়ি’ নামটার মানে কী? এ নামের পিছনে ইতিহাসটা কী?
৪। উত্তরবঙ্গে এতগুলো জনবসতির নামের শেষে ‘গুড়ি’ শব্দটা আছে কেন? যেমন, জলপাইগুড়ি।
৫। একটা নদীর নাম বালাসান কেন? এর উৎস কোথায়?
৬। দার্জিলিং-এর নামের পিছনে ইতিহাসটা কী?
৭। কার্শিয়ং স্কুল টাউন হয়ে উঠল কীভাবে?
৮। এ অঞ্চলে চা-বাগানের সংস্কৃতি কবে জন্ম নিল?
৯। হিল কার্ট রোডের এই নাম কেন? এই রাস্তা বানানো কবে শুরু হয়েছিল, শেষই বা হল কবে?
১০। উত্তরবঙ্গে কোন কোন ভাষায় কথা বলা হয়?
১১। রাজাভাতখাওয়া বলে একটা জায়গার নাম শোনা আছে? এই অদ্ভুত, অপ্রত্যাশিত নামটা এল কোথা থেকে?
১২। তিস্তা নদীর অনন্য রংটি আসে কোথা থেকে?
১৩। কালিম্পং-এর প্রাচীন নামটি কী? তা থেকে এর ইতিহাসের ব্যপারে কী বোঝা যায়?
১৪। গোর্খাল্যান্ড কী? পাহাড় অঞ্চলে এত মানুষ একটি ভিন্ন রাজ্যের দাবিতে লড়ছেন কেন?
১৫। এমন কোনও মাছ খেয়েছন, যা শুধু এই অঞ্চলেই পাওয়া যায়? সে মাছ কোন নদী থেকে ধরা হয়েছে?
১৬। কামতাপুরী ভাষা কেন, উপভাষা নয় কেন?
১৭। উত্তরবঙ্গের কোনও মানুষের মূর্তি কখনও উত্তরবঙ্গে দেখতে পেয়েছেন? কেন পাননি, তা কখনও ভেবেছেন?
১৮। নকশালবাড়ি ঠিক কোথায়? ভারতের ইতিহাসে তার গুরুত্ব কী?
১৯। উত্তরবঙ্গের তিনজন লেখকের নাম করুন।
২০। এই অঞ্চল নিয়ে লেখা তিনটে উপন্যাসের নাম বলতে পারবেন?
২১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনও গল্প, কবিতা, বা নাটকের কথা বলতে পারবেন, যা উত্তরবঙ্গে লেখা?
২২। এই অঞ্চলে ক’টি জেলা আছে?
২৩। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে কি কোনওদিন উত্তরবঙ্গের কোনও মানুষ উপাচার্য হয়েছেন?
২৪। চিকেন’স নেক বা মুরগির গলা কাকে বলে?
২৫। এ অঞ্চলের কোনও ঐতিহাসিক সৌধের কথা জানেন?
এই এলোমেলো প্রশ্নগুলো দিয়েই শুরু করা যাক, এগুলোর উত্তর ইন্টারনেটে খুঁজে পেতেও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এসব প্রশ্ন শুধু ‘টুরিস্ট’-দের জন্য নয়, যাঁরা এখানে পাহাড় আর জঙ্গল ‘এনজয়’ করতে আসেন, এবং আর কোনও বিষয়েই জানার আগ্রহ তেমন দেখান না। এ প্রশ্ন আমাদের জন্যেও, যারা এখানে থাকি। শুধু মমতাজ মহলের ইতিহাস নয়, আমাদের জানলার বাইরের ইতিহাসটুকু জানতে পারলেও আমাদেরই মঙ্গল হতে পারে।
আর, যদি সম্ভব হয়, উত্তরবঙ্গের একখানা গান গাইতে শিখে নেবেন কোনও এক দিন?
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র