ইগনিয়াস শব্দের শেকড় লাতিন ভাষায়, যার অর্থ আগ্নেয়। আর ভূতত্ত্বের ভাষায়: গলিত লাভা থেকে তৈরি যাহা কিছু। সেই আগুনের ছোঁয়াচ পেয়েছিলেন এক তরুণী সরকারি কর্মী। আইএএস অফিসার হিসেবে প্রথম পোস্টিং পেয়েছেন বিহারের অজ পাড়াগাঁয়ে। হাজারও সমস্যায় জর্জরিত আশির দশকের ভারত। জল নেই, বিদ্যুৎ নেই, রাস্তা নেই, কুয়ো নেই, কাজ নেই, শিক্ষা নেই, স্বাস্থ্যের অধিকার নেই-এর ভারত। আর সেখানে একরোখা টানটান শিরদাঁড়ার এক কন্যে গড়তে চলেছেন নতুন ভারত। সেই প্রথম পোস্টিং-এর বড়কাগাঁও ব্লকের ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসারের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত ইগনিয়াস নামের এক আদিবাসী ছেলে। প্রতিদিন সে ২২ কিলোমিটার দূরের একটা গ্রাম থেকে হেঁটে-চলে নয়, দৌড়ে আসে আর্জি জানাতে। গ্রামের মানুষের হয়ে। আর্জি, একটা কুয়ো বানিয়ে দিন সরকার! জল নেই অনেক গ্রামে। রোগাটে, তেজি অফিসার মেয়েটি অফিসের হরেক লোকের কথা অমান্য করে নিজেই যান কুয়োর সাইটগুলোয়। পথ চেনায় ইগনিয়াস, জিপের সামনে ছুটে চলে হরিণের মতো। ক্ষিপ্র, আশাবাদী। আর জেদি মেয়ে ক্যাশবাক্স সামলে, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, ওভারসিয়ার, ইঞ্জিনিয়ারকে সঙ্গে সেই পথে এগিয়ে গিয়ে জল আবিষ্কার করে চলেন বিহারের প্রত্যন্ত গাঁয়ে-গাঁয়ে।
প্রথম জীবনে এমন আঁচ পাওয়ার কথা লিখেছেন অনিতা অগ্নিহোত্রী, তাঁর নতুন বইয়ে, যার নাম ‘রোদবাতাসের পথ’। এমন আরও আরও অগুন্তি ঘটনার সাক্ষী এই বই। যে-বইয়ের অক্ষরে অক্ষরে জেগে আছে তৎকালীন ভারতীয় পরিকাঠামোর পরিচয়। যে-কাঠামো কেবল যেমন-তেমন চললেই হয় গোছের মনোভাবে বিশ্বাসী। কাজের চেয়ে অজুহাতে যার ভরসা বেশি। কিন্তু তেমন কাঠামোয় অনিতা অগ্নিহোত্রীর মতো আরও বেশ কিছু ব্যতিক্রম তো ছিলেনই, না হলে তো আর দেশটা চলত না। এই বই সেইসব দিনকাল বর্ণনা করে।
কিন্তু একটা বই কেবল কিছু না-পারাকে পারায় উত্তীর্ণ করার জন্য ভাল-খারাপ হয় না। একটা বই আরও অনেক কারণে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এই বইটি প্রাসঙ্গিক কারণ, আমরা বুঝতে পারি, সফল-মেয়ে হওয়া সহজ কথা নয়। আরও সহজ নয় সেই মেয়ের ভারতীয় সিস্টেমের সঙ্গে সমানে-সমানে লড়াই চালিয়ে নিজের পদের অধিকার এবং মেয়ে হওয়ার অধিকার বজায় রাখা। অনিতা অগ্নিহোত্রীর অভিজ্ঞতার পর অভিজ্ঞতা বুঝিয়ে দেয়, এদেশে পুরুষের সমকক্ষ হওয়া মানে পুরুষের চেয়ে আরও দু’গুণ বা তিনগুণ বাড়তি হয়ে উঠতে পারা। ভরসা-বিশ্বাস অর্জনের চেয়েও বড় হল, প্রমাণ করে দেখানো। এবং সরকারি কাজ সামলে ক্রমাগত এই প্রমাণ দাখিল করা কঠিন, খুব কঠিন। জেদি মেয়ে অবশ্য পিছপা নন। আর এই নাছোড়বান্দা মনোভাবই সম্ভবত কিছুদিন অন্তর-অন্তর ধরিয়ে দেয় বদলির চিঠি। অথচ এই মায়ের সন্তানেরা জ্বরে মায়ের স্নিগ্ধ পরশ পায় না, স্কুলের পরীক্ষার আগে মায়ের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়, রাতে একলা জেগে থাকতে থাকতে চোখের কোণে জল নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তাহলে ভারতীয় নিয়ম অনুযায়ী এ মেয়ে তো ব্যর্থ! মা হিসেবে, সমাজের সবচেয়ে বড় মেডেল থেকে তিনি বঞ্চিত। তবু সে মেয়ে ৩৬ বছর ধরে সিস্টেম বদলানোর চেষ্টায় নিয়োজিত থেকেছেন।
এই বইয়ের আত্মায় যা প্রোথিত আছে তা হল, নিজ কর্তব্যে একনিষ্ঠ থাকার সাধনা। এবং কোনও পরিস্থিতিতেই নীতি থেকে এক চুল না সরে আসার জেদ। এবং তাঁর এই কাজে ও জীবনে সহযোগী হিসেবে পেয়েছেন যাঁকে, তিনিও একই রকম কর্তব্যনিষ্ঠ এবং নীতিবাগীশ। ফলে জীবন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। তবু পরিস্থিতির সঙ্গে সমঝোতা করা হয়নি। আর তাই এই বইয়ের সার কেবল একজন লেখকের জীবন-কথা নয়, এর নির্যাস পাঠককে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
এছাড়াও এই বই ভারতীয় সিস্টেমের একটা নথি। কীভাবে কপোর্রেট হয়ে উঠতে চায় রাষ্ট্র। কীভাবে কয়লা-মাফিয়া হরণ করে নেয় শ্রমিকের জীবনের হীরক-মুহূর্ত সব, কীভাবে পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েকে দাঁতে দাঁত চেপে পাঠাতে হয় হোমে, কীভাবে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর জন্য এক সকালে তিন ছেলেকে হারিয়ে বসে এক দরিদ্র পিতা— এসবেরই নথি এই বই।
কিন্তু বইটি আরও একটা দিক দেখায় জীবনের। তা হল, শত খারাপের মধ্যে হাজারও সুন্দর কীভাবে ছুঁয়ে যায় মনকে। কেমন করে মনকে দ্রব রাখতে হয়, যাতে মহানদীর উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে, বনজ্যোৎস্নায় জঙ্গল খুঁড়ে বের করতে হয় পথ, আর সেই সব অভিজ্ঞতা কেমন সুললিত গদ্যে-পদ্যে-ছন্দে ধরা দেয় অক্ষরের জালে।
এই বই সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ, পূণর্তার বই। আবার এই বই নিজেকে নিয়ত প্রয়োগের পরেও অপূর্ণতার আর কিছু আফশোসের বই। এই বই নিজেকে যাচিয়ে নেওয়ার বই।
বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী প্রণবেশ মাইতি। অপূর্ব এই প্রচ্ছদেও ধরা রয়েছে বইয়ের ভাব। রোদ-বাতাস-বৃষ্টিতে নানা চড়াই-উৎরাইয়ের ছোঁয়াচ।