নিজের সৃষ্টিশীলতার একদম শীর্ষে একদিন দুম করে আঁকা বন্ধ করে দিলেন মানুষটি। ছাত্র, গুণগ্রাহী ও সাধারণ শিল্পমোদীদের কাছে সেটা ছিল এক বড় ধাক্কা। সবাই এসে বোঝানোর চেষ্টা করলে বলতেন, আর আনন্দ পান না এঁকে। এই অনীহার অন্যতম কারণ ছিল দাদার পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শিল্প সৃষ্টি থেমে যাওয়া। সেই আঘাত থেকে আর যেন বেরোতে পারছিলেন না তিনি। তাই যতদিন গগনেন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন, ততদিন আর রং-তুলির সঙ্গে কোনও কথোপকথন শুরু করতে পারেননি অবন ঠাকুর।
১৯৩৮ সালে, গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুর কয়েক মাস পরে, একদিন অবন ঠাকুরের প্রাক্তন ছাত্র মুকুলচন্দ্র দে হাজির হলেন জোড়াসাঁকোয়। নিজের আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে সোজা দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে বসলেন। শুরু করলেন আঁকা। ঠিক যেভাবে, বহু বছর আগে কাজ শিখতে যেতেন ওই বিখ্যাত বারান্দায়। দিনের শেষে, ইচ্ছে করেই, আঁকার জিনিসগুলি ফেলে গেলেন সেই জায়গায়। এভাবে কয়েকদিন যাওয়ার পর অবনীন্দ্রনাথ একদিন নিজের খেয়ালেই হাতে তুলে নেন রং-তুলি। সকালে ফিরে এসে ছাত্র দেখলেন, রাতে একটা ছবি শেষ করেছেন তিনি। এভাবেই শুরু হয় অবন ঠাকুরের জীবনের শেষ অধ্যায়ের আঁকা।
এই পর্যায়ে অবনীন্দ্রনাথের গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ‘কৃষ্ণমঙ্গল’ ও ‘চণ্ডীমঙ্গল’ নামে দুটি সিরিজ। ছবি আঁকায় সাময়িক বিরতির আগে তাঁর শেষ কাজ ছিল ‘আরব্য রজনী’ সিরিজ। সেই সিরিজের ছবিগুলিতে অভিজাত মিনিয়েচার শৈলীর ব্যবহারে যে চরম উৎকর্ষ অর্জন করেছিলেন, সেখান থেকে সরে এসে লোকশিল্পের আঙ্গিকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করলেন এই নতুন সিরিজের দৃশ্যকল্পগুলিকে। ছবি আঁকার ফর্ম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার আড়ালে ‘রাজকাহিনী’, ‘ক্ষীরের পুতুল’ বা ‘খুদ্দুর যাত্রা’র রচয়িতা কি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর মূল গল্পের ভেতর অন্য কোনও কাহিনির সুতো চালিয়ে দিয়েছিলেন, যা এক অর্থে হয়ে উঠেছে সেই সময়ের সমাজ ও রাজনীতির জীবন্ত দলিল?
চণ্ডীমঙ্গলের দুটি খণ্ড— প্রথমটি আখেটিক খণ্ড, যার মধ্যে আছে কালকেতুর গল্প, আর অন্য ভাগটি বণিক খণ্ড, যার মধ্যে আছে ধনপতি আর শ্রীমন্ত সওদাগরের গল্প। আখেটিক খণ্ডের গল্পটিতে ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরের হাতে দেবী চণ্ডী নিজের পূজা ও প্রচার-প্রত্যাশী হন। শাপভ্রষ্ট নীলাম্বর ও তাঁর স্ত্রী ছায়া মর্তে জন্মগ্রহণ করেন ধর্মকেতু ব্যাধের পুত্র কালকেতু এবং তার স্ত্রী ফুল্লরা হয়ে। কালকেতু বড় হয়ে কুশলী শিকারী হয়ে উঠলেন। তাঁর শিকারের ফলে বনের পশুরা প্রায় নির্বংশ হয়ে যেতে লাগল। তখন তাদের আবেদনে কাতর হয়ে দেবী স্বর্ণগোধিকা (গোসাপ) রূপে কালকেতুকে দেখা দিলেন। নানা টানাপড়েনের পর দেবী কালকেতুকে পশু শিকার ছেড়ে দিয়ে গুজরাট নগর স্থাপন করতে বলেন ও সে-কাজে সহায়তা করেন। কালকেতু দেবীর কথা শুনে নগর প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে ভাঁড়ুদত্ত নামে এক ভিলেনের আবির্ভাব। সে কালকেতুকে নানা প্যাঁচে ফ্যালে। তবে শেষে দুষ্টেরর দমন আর শিষ্টের পালন করে, চণ্ডীর কৃপায় কালকেতুর জীবনে হ্যাপি এন্ডিং।
চণ্ডীমঙ্গলের আখ্যানে একটি জাতীয়তাবাদী বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়, যা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ব্যবহার করা হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বিরুদ্ধে প্রান্তিক মানুষকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে। সঙ্গে চণ্ডীকে রূপকার্থে ভারতমাতার স্থান দেওয়া হয়েছে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’ উপন্যাসেও গ্রামজীবনের নানা টানাপড়েনে মঙ্গলকাব্যের রূপক ব্যবহার করেছেন। পরবর্তী সময়ে মহাশ্বেতা দেবীর লেখাতেও কালকেতু আখ্যান উঠে এসেছে শবরদের প্রতি বঞ্চনার প্রতীক হয়ে। সুতরাং বাংলা সংস্কৃতিতে চণ্ডীমঙ্গল সহ অন্য মঙ্গলকাব্য বারবার ফিরে এসেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক বক্তব্যের বাহক হিসেবে। তবে অবনীন্দ্রনাথের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ সিরিজে জাতীয়তাবাদী বক্তব্যের অনেকগুলি স্তর ধরা পড়ে, যা ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের বহুস্তর সমস্যা ও সংঘাতের প্রতিচ্ছবি।
অবনীন্দ্রনাথ যে চণ্ডীমঙ্গলকে বিষয় হিসেবে বেছে নেন, তার আরেকটি কারণ ধরা পড়ে সে সময়ের জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপট থেকে। তখন জাতীয় রাজনীতিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অংশীদারি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছিল। ১৯২০-র দশক থেকেই দেশে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক বৈরিতার পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছিল, ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামে সব সম্প্রদায়ের মানুষের একযোগে অংশ নিচ্ছিলেন না। এই সময়ে চণ্ডীমঙ্গলে উদার সৌভ্রাতৃত্বের অনুশীলনকারী কালকেতু যেন স্বাধীন ভারতের ভাগ্যবিধাতা হিসেবে উঠে এলেন এক রোল-মডেল হিসেবে। কালকেতু যেখানে গুজরাট নগর স্থাপন করছেন, সেখানে জঙ্গল সাফ করে বসতি স্থাপনের জন্য যারা আসছেন, তাঁদের বর্ণনা দিতে কবিকঙ্কণ লিখছেন:
পশ্চিমের বেরুণিয়া আইসে সাফর মিয়া
সঙ্গে তার জন দুই হাজার
রুটি যুত দুই কর সেবে পীর পেকাম্বর
বন কাটে পাতিয়া বাজার ।
এক্ষেত্রে চণ্ডীমঙ্গলে ‘পীর পয়গম্বর’-এর উপাসক অর্থাৎ মুসলমান জনগোষ্ঠীর উল্লেখ একটি উল্লেখযোগ্য সহায়ক রূপে উঠে আসে। কালকেতু সবাইকে সমান ভাবে পান-সুপারি দিয়ে বরণ করছেন তাঁর নতুন রাজ্যে। এ যেন স্বপ্নের স্বাধীন ভারতের ছবি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অংশীদারি নিয়ে যে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছিল, তা প্রশমিত করে এক সমন্বয় ও সহাবস্থানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ভারতের ছবি তুলে ধরতে সাহায্য করে এই মঙ্গলকাব্য। অতুলকৃষ্ণ মিত্রের ‘মা’ নাটকটিতে যে কালকেতুকে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়কে ঐক্য স্থাপনকারী এক জাতীয়তাবাদী নায়কের ভুমিকায় দেখানো হয়েছে, তিনিই যেন ফিরে আসেন অবনীন্দ্রনাথের ধর্মরাজ্যের কল্পনায়।
অবনীন্দ্রনাথের এই ‘চণ্ডীমঙ্গল’ সিরিজে আছে ২৩টি ছবি। তার মধ্যে যেমন আছে আখেটিক খণ্ডের নায়ক কালকেতুর ছবি সহ বনের বিভিন্ন পশুর ছবি, তাছাড়াও অভয়া, অর্থাৎ চণ্ডীকে কেন্দ্রে রেখে গল্পের কিছু নাটকীয় মুহূর্ত আঁকা আছে এই সিরিজে।
এই সিরিজটির ছবিগুলির মধ্যে একটিতে রাজনৈতিক বক্তব্যের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কালকেতুর শিকারের জন্য বনের পশুরা কাতর হয়ে দেবীর কাছে সুরক্ষা প্রার্থনা করছে, সেই দৃশ্যটি ফুটিয়ে তুলেছেন অবনীন্দ্রনাথ। কালকেতুর শিকারের তাড়নায় জঙ্গলে যে প্রাণীরা সঙ্কটে, তাদের মধ্যে অবনীন্দ্রনাথ বাঘ, মহিষ আর গন্ডারের ছবি এঁকে প্রতিটি ছবির সঙ্গে লিখে রেখেছেন কবিকঙ্কণের চণ্ডীমঙ্গলের প্রাসঙ্গিক অংশ। কালকেতুর সঙ্গে লড়াইয়ে সিংহ, বাঘ, মহিষ আর গন্ডার পরাজিত হয় এবং যথারীতি কালকেতু তাদের হত্যা করেন। তখন পশুরমণীরা দরবার করে স্বয়ং চণ্ডীর কাছে। কবিকঙ্কণ লিখছেন:
চণ্ডী জিজ্ঞাসেন পশুগণে।
একা বীর কালকেতু সবার বধের হেতু
প্রতিদিন আইসে এই বনে ।।
বলে বীর মৃগরাজ নিবেদিতে করে লাজ
কালকেতু ভাঙ্গিল দশন।।
কৃপা কর কৃপামই তোমার শরণ লই
জীয়ে মোর নাহি প্রয়োজন।।
বাঘিনী কহেন কথা কালকেতু দিল ব্যথা
স্বামীকে হানিল এক বাণে।
ছিল মোর দুটি পো তাহে মোর মায়া মো
কালকেতু বধিল পরাণে।।
এই ভাবে বুনো মোষ, গন্ডার ও বানর রমণীরা নিবেদন করে নিজেদের স্বামী, সন্তান ও বাসস্থান হারানোর কাহিনি। এই দৃশ্যে অবনীন্দ্রনাথ পশুদের এঁকেছেন ঘোমটা মাথায় আটপৌরে শাড়ি পরা গ্রামের সাধারণ রমণী রূপে। যেন বাংলার গ্রামের নারীরা তঁদের শোকদুঃখের কথা, অভিযোগের তালিকা, আর ত্রাণের প্রার্থনা নিয়ে এসেছেন মা চণ্ডীর দুয়ারে; যিনি স্বয়ং ভারতমাতার প্রতিভূ। তিনি তাঁদের অভয় দিচ্ছেন। তাঁদের ত্রাণের জন্য উপায় বের করছেন; ঠিক ভারতমাতার মতো। যিনি ভারতমাতার প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন, তাঁর কাজে তো এমন জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ প্রত্যাশাই করা যায়। এর সঙ্গে খেয়াল করার: দেশের তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষের দুঃখকষ্টের প্রতি সমবেদনা। অবনীন্দ্রনাথ আরও আঁকছেন কালকেতুর ভাঙা ঘরে বাস করার ইচ্ছে নিয়ে চণ্ডীর আগমনের দৃশ্য। এক কুঁড়েঘরের সামনে সালঙ্কারা দেবীর গোঁজ হয়ে বসে থাকার মধ্যে কালকেতু ও ফুল্লরার দৈনন্দিন জীবনযাপনের অংশীদার হওয়ার ইচ্ছেটা খুব সহজে ফুটে ওঠে। যেখানে দেশমাতা তাঁর দরিদ্র নাগরিকের ব্যথায় সমব্যথী। ‘ফুল্লরার বারমাস্যা’ যেন দেশের আপামর জনসাধারণের জীবনের ছবি।
একই সিরিজে কালকেতু-ফুল্লরার দুঃখ ও কালকেতুর হাতে নিপীড়িত বনের জন্তুদের দুর্দশার ছবি আমাদের দেখিয়ে দেয় যে সাধারণ মানুষের আসল শোষণকারী কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও তার দেশীয় স্তাবক শ্রেণি। কালকেতু পশু হত্যা করেন এবং ফুল্লরা সেই পশুর দেহ থেকে সব অংশ কেটেকুটে বাজারে বিক্রি করেন। সেই অংশে কবিকঙ্কণ লিখছেন:
হাটে ব্যাঘ্রছাল বেচে ফুল্লরা রুপসী।
যত্ন করি লয় তাহা জতেক সন্ন্যাসী ।।
সরভে সরভে ধরি চুয়াইয়া মুণ্ডে।
গন্ডকে ধরিয়া তার খড়্গ লয় ছিণ্ডে।।
ফুল্লরা বেচয়ে খড়গ দরে এক পণ।
ব্রাহ্মণ সজ্জন লয় করিতে তর্পণ।।
এখানে একটা জিনিস খেয়াল করার: বন্য পশুর দেহাংশ বিক্রির যে ব্যবসা, তার মূলে সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষদের ভূমিকা স্পষ্ট। সন্ন্যাসী ও ব্রাহ্মণরা যে ফুল্লরার খরিদ্দার ছিলেন, সেটা দেখিয়েছেন কবিকঙ্কণ। আর এখানে লক্ষ করার, অবনীন্দ্রনাথ ঠিক প্রাসঙ্গিক লাইনগুলিকেই তুলে ধরেছেন ছবিতে।
‘ওরিয়েন্টালিজম’-এর সমালোচকেরা বাংলার তথাকথিত নবজাগরণের চরিত্র বোঝাতে গিয়ে বলেছেন, এই রেনেসাঁসের ফলে কলকাতার ভদ্রলোকেরা নিজেদের জন্য একটি আলাদা পরিসর তৈরি করে ফেলেন, আর সমাজের সাধারণ মানুষের থেকে নিজেদের আলাদা করে সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির সঙ্গে দর-কষাকষির জায়গায় পৌঁছে যান এবং সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতার থেকে দূরে রাখার কৌশল গ্রহণ করেন। এখানেও কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ অনন্য। ‘ভদ্রলোক’-রাজনীতিকদের মুখের কথার বাইরে গিয়ে, গ্রামবাংলার সাধারণ ও প্রান্তিক মানুষের দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের সম্যক পরিচয় এবং তাঁদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার আন্তরিক চেষ্টা বারবার ফিরে আসে এই সিরিজের ছবিগুলিতে। চণ্ডী যেখানে বৃদ্ধা ভিখারিনির রূপ ধরে ধর্মকেতুর বাড়ি ভিক্ষা নিতে আসেন এবং নিদয়াকে পুত্রলাভের ঔষধ দেন, সেখানে যেন বরদাত্রীর প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার ইচ্ছেটাও চোখে পড়ে। গরিবের কুটিরের বাস্তব ছবি ধরা পড়ে অবনীন্দ্রনাথের তুলিতে। দারিদ্র্য অস্বীকার করার চালিয়াতি নেই, অথচ পরিচ্ছন্নতা ও শিল্প-সুষমায় উজ্জ্বল যে পল্লির ছবি তিনি ফুটিয়ে তোলেন, তা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া। সেই ছবি তিনি ধরতে চাইলেন কালীঘাটের পটুয়ার শৈলীতে। এক প্রান্তিক সমাজের কথা যেন বললেন আরেক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিল্পভাষায়। জনগণের শিল্প-শৈলীতে ফুটিয়ে তুললেন যুগ যুগ ধরে নিপীড়িত জনগণের কথা। এই ব্রাত্য জনগণের মধ্যে থেকেই নতুন ভারতের অধিনায়কের অভ্যুদয় ঘটছে, সেই নতুন যুগের কালকেতুকে যেন সাদরে তাঁর সিংহাসনে আহ্বান করতে দেখি আমরা এই সিরিজটিতে।