আবার কলকাতায় চলে এলাম। ছবি শেষ হয়ে গেছে। দুবছরের অক্লান্ত পরিশ্রম গেছে গুরুর মাথার ওপর দিয়ে। বাইরে থেকে আমরা যারা ছবি দেখি তারা টিকিট কেটে ছবি দেখতে যাই, আর ভালো লাগলে প্রশংসা করি কিংবা খারাপ লাগলে নিন্দে করি। কিন্তু কি অবস্থার মধ্যে ছবি করে মানুষ, আতা আমাদের দেকবার কথা নয়, আমরা জানতে চাইও না।
এও ঠিক উপন্যাস লেখার মতো। মাথার ওপর দিয়ে কত শোক-তাপ, কত অশান্তির ঝড় বয়ে যায়, তবু সপ্তাহে-সপ্তাহে উপন্যাসের কিস্তি লিখে যেতেই হয়। সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে ঠিক তা পৌঁছে দিতে হ্য় সম্পাদকের দপ্তরে। তারপর বই ছাপা হয়ে যাবার পর নিন্দেও শুনতে হয়, প্রশংসাও শুনতে হয়। কিন্তু কে খবর রাখে, কেমন অবস্থায় তা লেখা হয়েছিল। রাতে যখন সবাই ঘুমোচ্ছে, তখন লেখক ঘুমুচ্ছে কি না, তার খোঁজ রাখবার প্রয়োজন কারই বা আছে?
আমি নিজের চোখে দেখেছি গুরু দত্তের অবস্থা। অন্য কোনও ছবির পরিচালককে অত ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখিনি। তবে সব ছবি যেমন সমান নয়, সব ছবির পরিচালকও তেমনি এক মানুষ নয়। যেমন এক নয় সব লেখক। অনেক লেখকই তো ধীরে-সুস্থে লেখেন, কাটাকাটি করেন, তারপর সমস্ত বইটা লেখা হয়ে গেলে পত্রিকায় ছাপতে দেন। কেউ-কেউ বা তিন-চার মাসের মতো লিখে এগিয়ে রাখেন। কিন্তু ডস্টয়ভস্কির মতো কিংবা ওয়াল্টার স্কটের মতো লেখকও তো আছেন, যাঁরা দেনা পরিশোধ করার তাগিদে মাথার ওপর আগ্নেয়গিরি নিয়ে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের নিদর্শন রেখে গেছেন।
কিন্তু লেখকদের কথা থাক, আগে গুরুর কথা বলি।
আড়াই বছর ধরে ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবি তৈরি হয়েছে, আড়াই বছর ধরে অমানুষিক অশান্তির সমুদ্রে সে যেন হাবুডুবু খেয়েছে। বাবার হঠাৎ মৃত্যু, নিজের আত্মহত্যার চেষ্টা, সুন্দরবনে শিকার করতে গিয়ে একজনের খুন হতে-হতে বেঁচে যাওয়া, ছেলের মৃত্যুতুল্য অসুখ, পারবিবারিক গোলযোগ, ইনকাম ট্যাক্সের ঝামেলা, নিজের বাড়িতে অন্য এক দম্পতিকে রাখায় তাঁর স্ত্রীর অন্য একজনের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া— এগুলোর কথাই মোটামুটি মনে পড়ছে। তারপর আছে একজঙ্কে গাড়ি চাপা দেওয়ার মামলা, একজন অভিনেতাকে ইনকাম ট্যাক্স না-দেওয়ার জন্য রীতিমতো জামিন হওয়া। আরো যে কত কি ঘটনা, তা সব কি এতদিন পরে মনে থাকে কারো? তার অপর আছে ঘুম না হওয়া। গুরু যে এত ঝঞ্ঝাট সহ্য করে এতদিন কেমন করে বেঁচে ছিল, সেইটেই বোধহয় আশ্চর্যের ব্যাপার। গুরুকে যখন ওই সব অবস্থার মধ্যে ছবিতে অভিনয় করতে দেখতুম, হাসতে দেখতুম, গল্প-আলোচনা করতে দেখতুম, তখন আমি তার সহ্য-ক্ষমতা দেখে অবাক হয়ে যেতাম। বুঝতাম তার বাইরের হাসি মাখানো মুখখানা অনেক চোখের জল ঢাকবার প্রলেপ। ওই প্রলেপ দিয়েই সে অনেক বিনিদ্র রজনীর ব্যথা চেপে রাখে।
বাইরের থেকে আমরা কেউ তাকে প্রশংসা করি কিংবা অহংকারী বলে নিন্দে করি। কিন্তু মনের ভেতরে উঁকি দিতে সুযোগ পায় কজন?
গুরু একদিন হঠাৎ বললে— ‘মিথুন-লগ্ন’ ছবিটা করলুম না শুনলে আপনি হয়তো খুব মুষড়ে পড়বেন—
বললাম— তাহলে আপনি আমাকে চিনতে পারেননি। আমিই আপনাকে বাঙলা ছবি করতে বারণ করেছিলাম, আপনার বোধহয় ঠিক মনে নেই—
গুরু বললে— কেন করলুম না জানেন? কারণ ভেবে দেখলাম আমি বাংলা করলে বড্ড খরচ করে ফেলব। আমার তো হিন্দি ছবি করার হাত।
বললাম— তা না করেছেন ভালোই করেছেন, কিন্তু আপনি যদি বাংলা ছবিতে অভিনয় করতে রাজি থাকেন তো আমি তার ব্যবস্থা করতে পারি—
গুরু বললে— যদি তেমন ভালো পরিচালক হয় তো নিশ্চয়ই রাজি হব—
সত্যিই গুরুর বড় ইচ্ছে ছিল বাংলা ছবিতে অভিনয় করবার। শেষ পর্যন্ত সব ঠিকও হয়ে গিয়েছিল। এখানকার ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’ ছবির চুক্তিতে সইও করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন হল না, তা পরে বলব।
ইতিমধ্যে আমি কলকাতায় এসে পৌঁছেছি। গুরু তখন ছবির এডিটিং নিয়ে ব্যস্ত। দিন-রাত এক করে এডিটিং-রুমে লুঙ্গি পরে কাজ করে। ছবির পরিচালককে পর্যন্ত ঘরে ঢুকতে দেয় না। সকাল থেকে রাত। এক-একদিন রাত দুটো-তিনটে বেজে যায়। স্টুডিওর সবাই বাড়ি চলে যায়। শুধু গুরুর পেছনে-পেছনে থাকে রতন।
কাজ করতে-করতে গুরু শুধু হঠাৎ একবার ডাকে— রতন—
রতন বোঝে। তাড়াতাড়ি একটা সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দেয়। মুহুর্মুহু সিগারেটের প্যাকেট নিঃশেষ হয়ে যায় তার। আর নিঃশেষ হয়ে যায় গ্লাস।
যখন রাত্রে বাড়ি ফিরে আসে তখন আর চৈতন্য নেই তার। ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবির মধ্যেই সে একাকার হয়ে গেছে তখন।
কিন্তু গীতা? আমরা গীতাকে ওই অবস্থার মধ্যে রেখেই চলে এলাম। গীতা বাড়িতে নেই, এক গুরু কোনোরকমে রাতটা কাটায় বাড়িতে। তারপর স্টুডিওর ভেতরে নিজের ঘরটার মধ্যে ঢুকে চুপ করে থাকে। কাজের দিনেও যায়, ছুটির দিনেও। স্টুডিওই তার একমাত্র শান্তি। এই সব সময়ে আমিই একমাত্র তাঁকে শান্তি দিতে পারতাম।
কিন্তু সেই আমিও চলে এলাম। আর একজন যে শান্তি দিতে পারত গুরুকে, সে হল ওয়াহিদা রেহমান। যে মেয়েটিকে সে হায়দ্রাবাদের নির্জন নিরিবিলি থেকে একেবারে খ্যাতির শিখরে পৌঁছিয়ে দিয়েছিল। তারও একটু কৃতজ্ঞতা ছিল গুরুর ওপর। গুরু না হলে কে তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে এমন করে বিখ্যাত করে তুলত। কিন্তু তখন তার কাছে আসা বারণ! গুরুর জীবন থেকে সে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিল। কেন সে অশান্তির সূত্র হয়ে একটা দম্পতির সংসার নষ্ট করবে?
যা হোক, এমনি যখন গুরুর অবস্থা তখন হঠাৎ একদিন ট্রাঙ্ক কল বোম্বাই থেকে। কি সংবাদ? না আগামী ২৪ জুন বোম্বাইতে ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর ‘প্রিমিয়ার শো’ দেখানো হবে। আপনি চলে আসুন। সূর্য লাডিয়াও আসবে। তার সঙ্গে আপনি চলে আসবেন।
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত