ওই অসভ্য মেয়েছেলেগুলোর গা ঘেঁষে সকাল সকাল হা-হা-হি-হি করতে ভাল লাগে?’ মনোযোগ দিয়ে জুতোর ফিতে বাঁধছিলেন দত্তবাবু, ওই অবস্থাতেই বললেন, ‘কাকে কী বলো রত্না? তুমি যাদের অসভ্য মেয়েছেলে বলছ, জানো তাঁরা কে? ওই যে ওপাশের মোটা মতন মহিলা, উনি একটি কলেজের প্রিন্সিপাল, ওদিকের লম্বা মতন যিনি, তিনি তো সদর হাসপাতালের ডাক্তার। আর ওই অল্পবয়সি মেয়েটি— সুমনা , ও তো একটা নামকরা স্কুলের টিচার। এদের তুমি…! তাছাড়া ওখানে অনেক পুরুষমানুষও আছে।’
— থামো তো! নিশ্চয়ই এদের কোনও কাজ নেই, তাই সকালবেলাতেই হা-হা-হি-হি করতে বেরিয়ে পড়ে।
— ঠিক ভাবে কথা বলো। তুমিও জানো, ওকে বলে লাফিং থেরাপি। তুমিও যেতে পারো, কতবার তো বলেছি!
রোজ সকালেই মুখ-হাত ধুয়ে হাঁটতে বেরোন দত্তবাবু, শেষে ওই লাফিং ক্লাবে এসে যোগ দেন। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে খানিক গল্পগাছা করে বাড়ি ফেরা। গিন্নির অভ্যাস বেলা পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে থাকা। কিছু বললেই আজকাল বলেন, ‘সারাজীবন অনেক ভোর-ভোর উঠেছি। আর নয়!’ কোনও রকম স্বাস্থ্যবিধি তিনি মানতে নারাজ। যেটা করা বারণ সেগুলিই করেন, যা খাওয়া বারণ সেটাই খান, কারও কথাই শোনেন না। সুগার লেভেল, প্রেশার লেভেল সর্বদাই হাই, মেজাজও তিরিক্ষে। কারও সঙ্গেই ওঁর বনে না।
দত্তবাবু কিন্তু একদম উল্টো প্রকৃতির, বেশ হাসিখুশি, আড্ডাপ্রিয়, বন্ধুবৎসল মানুষ। বহুবার দত্তবাবু চেষ্টা করেছেন গিন্নিকে একটু সামাজিক করে তুলতে, পারেননি। এখন বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। যা পারে করুক, যতদিন তবু ছেলেমেয়েরা ছোট ছিল একটু সামলে ছিল, এখন তারাও তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত। এখন রত্নার সব নজর যেন কর্তার উপরেই। বড্ড ঠোঁটকাটা, আর সন্দেহপ্রবণ মহিলা। ওঁর এরকম স্বভাবের জন্যই এই আবাসনের অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা ওঁকে ভয় পান, এড়িয়ে চলেন। পারতপক্ষে কেউই দত্তবাবুর ফ্ল্যাটে আসতে চান না।
২.
দত্তবাবু বেশ উঁচু পোস্টেই চাকরি করেছেন সারাজীবন। বদলির চাকরি। নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছিল, সঙ্গে নিয়ে যেতেন। পরে, তাদের পড়াশোনার সুবিধার জন্য এই আবাসনে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। সত্যি বলতে, তাঁর অবসর নেওয়ার আগে শেষ দশটা বছর একাই দত্তগিন্নিকে সবদিক সামলাতে হয়েছে। তখন দত্তবাবু ছিলেন শিলিগুড়িতে, মাসে একদিনও আসা হত না অনেক সময়। দুটি নাবালক ছেলেমেয়েকে বলতে গেলে রত্না একা হাতেই মানুষ করেছেন। একটা অচেনা শহরে অজানা মানুষদের মধ্যে থাকা, তাঁকে অতি সাবধানী করে তুলেছিল। তারপর এক সময় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল, ছেলেও ভাল চাকরি পেয়ে দিল্লি চলে গেল। বড্ড যেন একা হয়ে পড়লেন দত্তগিন্নি। একটু খিটখিটে, বদমেজাজি, বাতিকগ্রস্ত। কেন কে জানে, রত্নাদেবীর যত রাগ দত্তবাবুর ওপরেই। উনি যদি কারও প্রশংসা করেন তাহলে বিপদ, কোনও কিছুকে খারাপ বললেও মুশকিল।
প্রতিবারের মতো এবারেও শীত পড়তেই লাফিং ক্লাবের মেম্বাররা পিকনিক করার জন্য উঠে পড়ে লাগল। অন্যান্য বছর গাড়ি-টাড়ি বুক করে লাফিং ক্লাবের মেম্বার আর তাদের ফ্যামিলির সবাই মিলেই হইহই করে বাইরে কোথাও যাওয়া হয়। এবারে ঠিক হল, আবাসনের মাঠেই পিকনিক হবে, সব্বাই ইনভাইটেড। দত্তবাবু অবশ্য পিকনিকে একাই যান। অনেকদিন আগে একবারই রত্না যোগ দিয়েছিলেন। গাড়ি করে মাইথন যাওয়া হয়েছিল। সে কী কেলেঙ্কারি! বাসে বসার সিট নিয়ে অন্য মহিলাদের সঙ্গে ঝগড়া জুড়ে দিলেন রত্না, সারাদিন মুখ গোমড়া করে রইলেন, সারা পিকনিকে কারও সঙ্গে কোনও কথা বললেন না।
৩.
পিকনিকের মিটিং শেষ করে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে হাঁটা দিলেন দত্তবাবু, সঙ্গী একই ব্লকের চয়ন সেন। সেনবাবু বললেন, ‘এবার তো কম্পাউন্ডের ভেতরেই হচ্ছে, বৌদিকে আনুন না।’
একটু হেসে উত্তর দেন দত্তবাবু, ‘ওর কথা ছাড়ুন ভাই, আসবে না কিছুতেই, জানেনই তো সব!’
— আমি একবার বলে দেখব?
— কী লাভ!
— তবু, একবার চেষ্টা তো করা যাক, এবার তো আর বাসের জানলা নেই।
— হয়তো অন্য কিছু নিয়ে লেগে পড়বেন।
— দাদা, কিছু মনে করবেন না, ওঁকে দেখছি তো এত বছর, আমার কিন্তু মনে হয়… আপনার দিক থেকেও কোথাও একটা ত্রুটি ছিল… ঠিক জানি না, ওঁর যত রাগ যেন আপনার উপরেই!
— হয়তো। আসলে জীবনের অনেকটা সময় একাই ছিল তো। কে জানে! আপনি বলে দেখতে পারেন, খুব ইচ্ছে হলে।
৪.
রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে-মুছতে দত্তগিন্নিকেই আসতে হল দরজা খুলতে। দত্তবাবু বাথরুমে। দরজা খুলেই দেখেন তিনতলার চয়ন সেন। চয়ন একগাল হেসে বললেন, ‘ভাল আছেন বৌদি? দাদা কই? ভেতরে আসতে বলবেন না?’
কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবে রত্না বলেন, ‘আসুন না, উনি তো একটু বাথরুমে গেছেন। ওঁর তো আবার একটু সময় লাগে। বসুন।’
— না, মানে, ওই পিকনিকের বাজার করতে যাওয়া হবে, তাই। তা বৌদি, এবার তো ভেতরেই হচ্ছে পিকনিক, আপনিও আসুন না।
একে তো সকাল-সকাল খেজুরে আলাপের চেষ্টা, তার ওপর লাফিং ক্লাবের পিকনিক। রত্না মুখ বেঁকিয়ে বলেন, ‘ওসব আমার ঠিক ভাল লাগে না। উনি তো যাচ্ছেনই।’
— না, সে বললে কি হয়! সবাই যোগ দেন, শুধু আপনিই আসেন না। এবার কিন্তু নো ছাড়াছাড়ি বৌদি।
আসতেই হবে? কেন? মামদোবাজি নাকি? যার ইচ্ছে সে যাক। জোরাজুরি আসছে কোত্থেকে? এমনিতেই লোকটাকে সহ্য হয় না, কেমন যেন গায়ে-পড়া! রত্না কথা ঘোরাতে বলেন, ‘চা খাবেন তো?’
— না, না। কিচ্ছু লাগবে না বৌদি, এইমাত্র চা খেয়েই বেরোলাম। তা আসছেন তো পিকনিকে?
রত্না আর নিজেকে আটকাতে পারেন না। বলেই ফেলেন, ‘মাপ করবেন, সারাদিন ধরে ওই ঢঙি মহিলাদের রঙ্গ দেখতে পারব না। আমি তো অমন ডিজে বাজিয়ে নাচতে পারব না, অন্যের কোলে শুয়ে হা-হা-হি-হি করতেও পারব না।’ চয়ন তীব্র অস্বস্তিতে চুপ করে যান। লোকে ঠিকই বলে, দুর্মুখ মহিলা বটে! কিন্তু তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘সে সবাই কি আর এক ধরনের হয়! কিন্তু আমি তো শুনেছি, আপনিও নাকি এক সময়ে ভাল গান গাইতেন!’
— আমি? গান! কে বলল আপনাকে?
দত্তগিন্নি হকচকিয়ে যান। বুড়ো এসব গল্পও করেছে নাকি! ঠিকই, এক সময়ে রীতিমতো ওস্তাদের কাছে নাড়া বেঁধে ক্লাসিক্যাল গান শিখেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রসঙ্গীতেও ডিপ্লোমা করেছিলেন, যেমন সব বাঙালি বাড়ির মেয়েরাই করে। মন্দ গাইতেন না, সেই সময়ে যুববাণীতে দু’একবার অডিশনও দিয়েছিলেন। গান শুনেই তো দত্তবাবু বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু সে-সব কবেকার কথা! শেষ গান বোধহয় গেয়েছিলেন কুড়ি বছর আগে ছোট ননদের বাসরে, তাও সবার জোরাজুরিতে। কবেই তো সে-সবের পাট চুকে গেছে!
রত্নাদেবী একটু বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন, সেনবাবুর গলার স্বরে সম্বিত ফেরে।
— তাহলে আসছেন তো?
— তার আগে বলুন তো, এ-কথা আপনি কী করে জানলেন? আপনাদের দত্তবাবু বলেছেন?
‘তা না হলে জানব কী করে!’ চয়ন মিথ্যে বলেন। সব মেয়েরাই গান শেখে, এই ভেবেই তাসটা খেলেছিলেন তিনি। লেগে গেছে। ‘প্রতিভা কি লুকিয়ে রাখা যায় বৌদি! দত্তদাকে একাই গান শোনালে হবে, আমরাও একটু প্রসাদ পাই।’
৫.
রত্না বোতলে জল ভরতে গিয়ে খেয়াল করলেন, জল ভরে উপচে পড়ছে। ভেজা জামাকাপড় মেলতেই ভুলে গেলেন। তাড়াতাড়ি রান্নাবান্না সেরে অনেকদিন পর ধুলো ঝেড়ে বের করলেন পুরনো গানের সিডিগুলো, আলমারির মাথায় তুলে রাখা সিডি প্লেয়ারটাও। একটা সিডি চালালেন, চললই না। অনেকদিন না ব্যবহার করলে যা হয়। সিডি প্লেয়ারটাও তো কম দিনের হল না। সম্ভবত মেয়ের কোনও এক জন্মদিনে নাচের জন্য কিনে দিয়েছিলেন দত্তবাবু। ভাল করে পরিষ্কার করে দ্বিতীয় সিডিটা চালালেন। চলল। জগজিৎ সিং-এর গজল, ‘তুম ইতনা জো মুসকুরা রহে হো’।
সারা ঘর যেন সুরে ভেসে যেতে লাগল। রত্নাদেবীকেও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগল বন্যার জলের তোড়ের মতো। ঘর অন্ধকার করে বিছানায় চুপ করে শুয়ে শুনতে লাগলেন। এত সুর, এত গান, এতদিন কেমন করে ভুলে ছিলেন!
৬.
অনেক বেলায়, দত্তবাবু বাড়ি ফিরে চমকে গেলেন, কোথায় যেন কী একটা বদল হয়েছে। গিন্নি কেমন যেন অন্যমনস্ক। খাবার টেবিলেও বিশেষ কথা বললেন না, নিঃশব্দে খেয়ে উঠে গেলেন। কী ব্যাপার কে জানে! দুপুরে একটু গড়িয়ে নেওয়া দত্তবাবুর বহু দিনের অভ্যাস। ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল, কোথা থেকে একটা গানের সুর ভেসে আসছে না? তাঁর বাড়িতে গান! টিভির আওয়াজ ছাড়া কিছু শোনা যায় না তাদের বাড়িতে, সেখানে গজল!
ঘর থেকে বেরিয়েই বুঝতে পারলেন, গানটা ভেসে আসছে গিন্নির বন্ধ ঘর থেকেই। পায়ে-পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন দরজায়, হাত ছোঁয়াতেই দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে গেল। দেখলেন গানটা বাজছে সিডি প্লেয়ারে, আর খাটের উপর আধশোয়া হয়ে নিচু গলায় তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গানটা গাইছেন রত্না। দত্তবাবু স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। বিয়ের আগে ওঁর গান শুনেছিলেন বটে, বাসরঘরেও। কিন্তু সে তো সব মেয়েই গায়! ব্যাস, আর কখনও গান শোনার অবসর হয়নি, গিন্নিও শোনাননি। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যাওয়ার পর থেকেই তো শোওয়ার খাট আলাদা হয়েছিল, পরে ঘরও, এখন ফ্ল্যাটের দুই ঘরে দুজনে থাকেন। এতদিন পর গিন্নির ঘরের বন্ধ দরজার সামনে এসেও দাঁড়িয়ে থাকেন চুপ করে, ঢুকতে পারেন না।
নিজের ঘরে ফিরে এসে খাটে চুপ করে বসে থাকেন দত্তবাবু। সত্যি, কোনওদিন ওই মহিলার ভাল লাগা, মন্দ লাগা নিয়ে মাথাই ঘামাননি। সংসারের জোয়ালে জুতে দিয়ে নিশ্চিন্ত থেকেছেন। চাকরি করেছেন, ক্লাবে গেছেন, দেদার আড্ডা মেরেছেন। মাসের শেষে শুধু খরচের টাকাটা ফেলে দিয়েছেন।
স্ত্রীর ঘরের দরজায় হাত দিতেই ক্যাঁচ করে শব্দ হল, সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে সিডি প্লেয়ারটা বন্ধ করে দেন রত্না। দরজায় দত্তবাবুকে দেখে বলেন, ‘কিছু বলবে?’
— বন্ধ করলে কেন, বেশ তো গাইছিলে, গাও না!
রত্নাদেবী সোজাসুজি তাকালেন স্বামীর দিকে, বহুকাল পরে। সেই দৃষ্টিতে বিস্ময় আর প্রশ্ন দুটোই মিশে আছে। আজকাল সারাদিনে আর ক’টা কথাই বা হয় দুজনে! যা হয় সবই দরকারি কথা, গান তো অনেক দূরের ব্যাপার!
তাঁদের কোনওদিন হনিমুন হয়নি। বিয়ের দু’বছর পর প্রথমবার মেয়ে কোলে যখন দিঘা বেড়াতে গেছিলেন, তখনই একবার গান শুনিয়েছিলেন দত্তবাবুকে, সমুদ্র সৈকতে বসে। তারপর আর কোনওদিন দত্তবাবু উৎসাহই দেখাননি। আজ এতকাল পরে গান শুনতে চাইছেন? রত্না খাট থেকে নামতে নামতে বলেন, ‘তুমি চা খাবে তো? ড্রইংরুমে বোসো। আমি করে আনছি।’
— আরে বাবা, ব্যস্ত হতে হবে না, চা পরে দিলেও হবে! গানটা গাও না, খুব ভাল হচ্ছিল।
দত্তবাবু ঢুকে নিজেই হাত বাড়িয়ে চালিয়ে দিলেন সিডি প্লেয়ারটা। মুহূর্তে গোটা ঘরটা ভরে গেল জগজিৎ সিং-এর গজলের সুরে, ‘হামসফর বন কে হাম, সাথ হ্যায় আজ ভি/ ফির ভি হ্যায় এ সফর, আজনবি— আজনবি!’
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী