আমি ভাগ্যবান, গত দু’বছরে আমার পরিবার বা ঘনিষ্ঠ পরিজনের কাউকে হারাইনি। তা সত্ত্বেও বহু মৃত্যু দেখেছি। শববাহী গাড়িরা একের পর এক মৃতদেহ— হ্যাঁ, এক নয়, একাধিক— নিয়ে চলেছে, এক সময় এই দৃশ্য পথ হাঁটলেই দেখা যাচ্ছিল। এবং আমরা যেন সেই মৃত্যুমিছিল নিয়ে আর বিচলিতও হয়ে ওঠা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কি ভয়ানক বিগত দেড় বছরের এই বাস্তব!
মৃত্যু আমার কাছে একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি শোকের প্রক্রিয়াটা আঁকড়ে বসে থাকি, কেননা যাঁরা চলে গেছেন তাঁদের কোনওভাবে কাছে ধরে রাখার আমার কাছে এটাই একমাত্র উপায়। কিন্তু এই অতিমারীতে মৃত্যু এতটাই ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠেছে যে আমাদের মধ্যে মৃত্যুর ক্ষেত্রে প্রায় নির্লিপ্ত একটা অসাড়তা কাজ করে চলেছে। এই ভাবনায় আমি একা নই— আমার বেশ কিছু বন্ধুরা একই কথা বলেছে। কোভিড, এবং তার পরিণামে মৃত্যু সংক্রান্ত কথাবার্তা যেন প্রায় হেলায় বলা হয়ে উঠেছে— যেন অকিঞ্চিৎকর কোনও বিষয়ে কথোপকথন।
গতকাল সন্ধ্যায় আমার এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলাম, বহুদিন পর। সম্প্রতি তার এক নিকটাত্মীয়ার মৃত্যু হয়। কিছু মাস আগে তার দিদিমা মারা যান, এবং খুব ঘনিষ্ঠ এক পারিবারিক বন্ধুরও মৃত্যু হয়। মানিয়ে নিতে পারছে কীভাবে? ওর কথায়, ‘আমি ঠিক আছি, শুধু এই বছর এই এত মৃত্যুতে কিছুটা ক্লান্ত।’
প্রথম বছরে মৃত্যুর ক্ষেত্রে এই ঔদাসীন্য দেখা যায়নি; সবাই ভীষণ আতঙ্কে দিন-রাত কাটিয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে আমরা চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রেও মৃত্যুর মতন এক স্থায়ী, অপরিবর্তনীয় বাস্তবকে ধীরে-ধীরে মেনে নিচ্ছি, এবং তা যে স্বাভাবিক, সেই ভাবনায় ক্রমশ স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠছি। জানি না, মনোভাবে এই বদল সাময়িক কি না, কিন্তু তরুণ মনে এটা কি ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, তা কল্পনা করে নিতে পারি। এই মনোভাব বেড়ে ওঠার বয়সের মনস্তত্ত্বকে সম্পূর্ণ অন্য দিশায় পরিচালিত করতে পারে।
ভালবাসা এবং মৃত্যু— মানুষের ইতিহাসে বহুচর্চিত, বহু লেখার উপাদান, আচ্ছন্ন করে রাখা দুটো বিস্ময়কর বিষয়বস্তু। এ সত্ত্বেও, আজ যখন কোভিড-পরবর্তীকালে এক নতুন যুগে পা রাখছি আমরা, মৃত্যুর বহুলতায় মৃত্যু যেন তার তাৎপর্য হারাতে বসেছে। যদি মৃত্যু—জীবনের সবচেয়ে বড় বিচ্ছেদ— সমাজে তার গুরুত্ব হারাতে বসে, তবে কি ভালবাসার ক্ষমতা, সম্পর্কস্থাপনের ক্ষমতারও অবনতি ঘটবে? এই অতিমারীর প্রভাব যাদের মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কাটবে, তাদের ক্ষেত্রে এই কয়েক বছর, তাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান, অনুভূতিপ্রবণ বছরগুলোতে এই মনোভাবের প্রতিফলন কীভাবে ঘটতে পারে? এর মানে কি আমরা ধীরে-ধীরে গভীর সম্পর্ক তৈরি করা বন্ধ করে দেব? আমার মনে হয়, যদি আমরা মৃত্যুকে ভয় পাওয়া বন্ধ করে দিই, বা তাকে এক ধরনের ঔদাসীন্যে দূরত্বে রাখতে সক্ষম হই, আমরা ভালবাসার ক্ষমতা হারাব। তখন আর কোনও এমন অসাধারণ ভালবাসা থাকবে না যা মৃত্যুভয়কে অতিক্রম করে যেতে পারবে, কেননা মৃত্যু তার তাৎপর্য হারাবে। হয়তো আমি বড্ড বাড়িয়ে ভাবছি, এবং আমার ভাবনাকে প্রায় ‘ব্ল্যাক মিরর’-এর কোনও এপিসোডের চিত্রনাট্যে রূপান্তরিত করছি, কিন্তু সেই চিত্রনাট্যও আদতে বাস্তবসম্মত।
ভালবাসা এবং মৃত্যু— মানুষের ইতিহাসে বহুচর্চিত, বহু লেখার উপাদান, আচ্ছন্ন করে রাখা দুটো বিস্ময়কর বিষয়বস্তু। এ সত্ত্বেও, আজ যখন কোভিড-পরবর্তীকালে এক নতুন যুগে পা রাখছি আমরা, মৃত্যুর বহুলতায় মৃত্যু যেন তার তাৎপর্য হারাতে বসেছে। যদি মৃত্যু— জীবনের সবচেয়ে বড় বিচ্ছেদ— সমাজে তার গুরুত্ব হারাতে বসে, তবে কি ভালবাসার ক্ষমতা, সম্পর্কস্থাপনের ক্ষমতারও অবনতি ঘটবে? এই অতিমারীর প্রভাব যাদের মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কাটবে, তাদের ক্ষেত্রে এই কয়েক বছর, তাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান, অনুভূতিপ্রবণ বছরগুলোতে এই মনোভাবের প্রতিফলন কীভাবে ঘটতে পারে? এর মানে কি আমরা ধীরে-ধীরে গভীর সম্পর্ক তৈরি করা বন্ধ করে দেব?
আমি মনোবিদ নই, কিন্তু মৃত্যু যদি সত্যিই এত সহজ হয়ে ওঠে, যদি কাউকে হারানো এতটাই দৈনন্দিন হয়ে ওঠে, আমরা আদৌ গভীর আবেগের সম্পর্ক স্থাপন করব কেন? এই বাস্তব জেনে-বুঝেও যদি আমরা প্রাণ দিয়ে ভালবাসি, তাহলে তো বলতে হয় আমরা সবাই মর্ষকামী, তাই না? না কি, আসলে ব্যাপার ঠিক এর উল্টোটাই; জীবনের মূল্য, প্রতিটা মুহূর্তের মূল্য সম্বন্ধে ভীষণভাবে সচেতন হয়ে উঠব আমরা, বুঝব তা কতটা অনিত্য, এবং আমাদের ভালবাসার ক্ষমতাও ঠিক ততটাই বেড়ে যাবে? আমাদের হয়তো আরও সত্যিকারের ‘আমরা’ করে তুলবে এই অতিমারীর নানা অনুভব। বা হয়তো সম্পূর্ণরূপে আমাদের আসল চেহারাটা লুকিয়ে ফেলায় বাধ্য করবে, ডার্ক হিউমার এবং অগভীর কচকচিতে হারিয়ে যাবে আমাদের প্রকৃত আবেগগুলো। এমনি-এমনি ‘মিম’ সংস্কৃতি এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।
আমার মনে হয়, আমাদের জীবন এই দুই দিকের যে কোনও একটা দিকেই ঢলতে পারে, তবে বিভিন্ন লোকের ক্ষেত্রে তার মাত্রার তফাত নিশ্চয়ই হবে। আশা করা যাক, আমাদের জীবন সত্যিই ‘ব্ল্যাক মিরর’-এর ভয়ানক পর্ব হয়ে উঠবে না।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র