আগে লোকে পুরী যেতে পারত না, এখন সস্তায় স্পেসে যাচ্ছে। হবেই, নাসা ক’দিন অন্তর বিজ্ঞাপন দেবে অই আমাগো বদখৎ দেখতে আকাশগাড়ি মঙ্গলে নেমে মাটি খোবলাতে নেগেছে, বা জুপিটারে কাত হয়ে সন্ধের ঝোঁকে অবলোকন করছে এক আকাশে ৭৯টা চাঁদ, আর কোটিপতিরা এ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ‘এই ছেড়ে দিল ছেড়ে দিল নেপচুনের বাস, পাঁচটা সিট ফাঁকা, নো ঝালমুড়ির ঝাঁকা’ নূতন ধমাকা লাগাবেন না? প্রকাণ্ড কম্পিটিশন চলেছে, জেফ বেজোস মহাশূন্যে যাবেন বলে যেই না পাঁজি দেখে শুভলগ্ন ঘোষণা করেছেন, তার ন’দিন আগে রিচার্ড ব্র্যানসন হুড়ুম করে ঘুরে এলেন, কখন গুঁড়ি মেরে ফিনিশ-লাইনের পাশটিতে বসে ছিলেন কেহ টের পায়নি। ইলন মাস্ক এখনও কোত্থাও যাবেন বলছেন না, কিন্তু ‘এই প্ল্যানেটে জন্ম যেন মঙ্গলগ্রহে মরি’ ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। এঁরা সকলেই আজ নয় কাল মানুষের জন্য খুলে দেবেন মাত্র কয়েক কোটি (বা কয়েক লাখ, শেষে কয়েক হাজার) খরচা করে স্পেস-জার্নির, মিনিট তিন-চার জানলা দিয়ে নেত্র ফেড়ে পৃথিবী গ্রহটিকে উলটো দূরবিনে দেখার সুযোগ, চাঁদে যাতায়াতের রকেট-ফ্লাইটও নাকি বচ্ছরপাঁচের মধ্যে চালু, এর মধ্যেই কারা টিকিট কেটে আকুল। তিনজন কোটি-কোটি-কোটিপতি অ্যাত্ত টাকা নিয়ে কী করবেন বুঝতে না পেরে (নোটের নৌকো বানিয়ে জলে ছাড়লে নর্দমা ব্লক হয়ে যাবে, কর্পোরেশন-হাঙ্গাম) মানুষের মজাভোগের নয়া দিগন্ত রচলে কারও কিছু বলার নেই, মিত্তল তাঁর ছেলের অন্নপ্রাশনে যদি রাবড়ির খাল কাটেন বা বাবু-কালচারের পাণ্ডারা পোষা বেড়ালের বিয়েতে শতেক বেলজিয়ান আয়না ভেঙে রুনুঠুনু নহবত-গৎ তোলেন, আমরা ভেবে করব কী?
কোথায় হরিপদ বা অ্যান্ড্রু বা শলোকভ ফ্যান্টাসি পাকাবে আহা হানিমুনে একটু চন্দ্রমধুরিমা মেখে এলে কেমন হয়, লেখক এখনই নভেলে কেরানি-চরিত্র ঢুকিয়ে দেবেন যে অফিস করতে যাবে সিধে শুক্রগ্রহে আর পাশের কনুইবাজকে খিঁচোবে ‘সরে দাঁড়ান না মশাই, একটা ধূমকেতুর ন্যাজের ঝাপটা লাগল আর অমনি আপনি গায়ে হুমড়ি?’, তা নয়, লোকে এই বড়লোকদের খামখেয়ালকে হেভি নিন্দেমন্দ করছে। আরে, পশ্য হে পামর, নর-জাতের প্রতিনিধি হয়ে তাঁরা এবার মহাকাশের পার্মানেন্ট দখল নিচ্ছেন, ক’দিন পর রজনী-গগন দেখতে গেলে নক্ষত্রের পাশাপাশি পয়েন্টিং করতে হবে মাস্কের ৪৮৩টা বেজোসের ২২৯টা ব্র্যানসনের ১৩২টা উপগ্রহ, স্পেস-স্টেশনে ঠঙাঠং শ্রম-চাকরি পাবে আমাদের বেকার বাহিনী, যে এনআরআই-রা আঙুল ও ইগো ফুলিয়ে কলাগাছ করেছেন তাঁরা ঈর্ষা-জুলজুল তাকাবেন মার্স সেক্টর-সেভেনের জমি-মালিকদের পানে, কেউ শনিতে সস্তায় ফ্ল্যাট পাচ্ছিলেন কিন্তু সেরেফ কুসংস্কারের বশে নিলেন না। এই সাই-ফাই জমানা অবিলম্বে ধরাধামে টাঙাবার গ্যারান্টি দিচ্ছেন যে মহাত্মারা, তাঁদের ট্রোল করছি আমরা কী মর্মে? কেউ বলছেন, একটা রকেট ছাড়লে যে-পরিমাণ পরিবেশ দূষণ হয় তা ভয়াবহ, বছরে দুশো-তিনশো অ্যায়সা যাত্রা পৃথিবীকে কালিঝুলি বিষগ্যাসে পিষে মারবে। কেউ শ্রাগাচ্ছেন, ধুর ওরা যাচ্ছে নিতান্ত কাগজ-কলমে মহাশূন্যে, এ মাত্তর ৫০ মাইল ও ৬২, সেখানে একটু সিটবেল্ট খুলে উড়াল-উড়াল খেললেই স্পেস-ট্র্যাভেল হয় না। কেউ চিল্লাচ্ছেন, এতগুলো মহাযন্ত্র ভেঙেচুরে এক সময় যে বিপুল ব্যোম-জঞ্জাল ছড়াবে, সর্বনাশা। অবশ্যই অনেকে গরগরাচ্ছেন, সারা পৃথিবী প্যানডেমিকে মরছে, থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে আপার-কাট সহ্য চলেছে ডেলি কা ডেলি, আর এই হল ওঁদের ফুর্তি দর্শাবার সময়? কেউ মনে করাচ্ছেন, পৃথিবীর আবহাওয়া বদলাচ্ছে ভয়ানক ভাবে, এখানে অভাবিত বন্যা, সেখানে রেকর্ড উত্তাপ-তরঙ্গ, আগে এ নিয়ে কিছু করুন! তা, এঁরা দিচ্ছেনও সে-সব খাতে অকাতরে মোটকা চাঁদা, তাছাড়া পৃথিবী এ-শিশুর বাসযোগ্য না থাকলে হয়তো এঁদের আঙুল ধরে সত্যিই থিতু হতে হবে অন্য কোনও স্থলভাগে, তখন স্ট্যাচু পূজিত হবে সকল কূটকচালি পেরিয়ে। সত্যি সত্যি যে-আপত্তি আমাদের মনে মুন্ডু বাড়াচ্ছে তা ক্লিশে ও চিরন্তন, এতগুলো টাকা দিয়ে তো হতে পারত ৯৮৭৩ কোটি টিউকল ৮৭৫৬ কোটি প্রাইমারি স্কুল ৪২৮৩৩৪ কোটি বাস্তুহারার এক-কামরার ফ্ল্যাট। যখনই মারণাস্ত্রের পিছনে কোনও রাষ্ট্র বেধড়ক খরচা করে, যখনই মেগাস্পিডের রেলগাড়ি, জলের তলায় রেস্তরাঁ, ফোল্ডিং ছাদের স্টেডিয়ামের বিজ্ঞাপন, তখনই আমরা সেই ধ্রুপদী হিসেব খুলে বসি, অন্য খাতে খরচা বাগালে কত লোক খেয়ে বাঁচত, কত লোক জীবনদায়ী ওষুধ পেয়ে।
আপত্তিটা, এবং তা থেকে উত্থিত প্রশ্নাবলি, যত প্রাচীন হোক, মনোযোগযোগ্য। চাল না কার্নিভাল? ডাল না ডিজিটাল? যে-মানুষের টাকা প্রয়োজন ও বিলাস পেরিয়েও উপচে পড়েছে অনেকটা, তার মৌলিক অধিকার ভেঙে কি বাধ্য করা যায় কোটি উলঙ্গ রোদবর্ষাধ্বস্ত সহ-মানুষের কল্যাণে তা ব্যয় করতে? যে-রাষ্ট্রে দলে পালে ঝাঁকে লোক বেঘর ক্ষুধার্ত, তারা কি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আদৌ উদযাপন করার অধিকারী? নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে কেন লতা গাইবেন, যখন রাস্তায় রাস্তায় এত আলো দেওয়া যায়নি যাতে ছিনতাই ও ধর্ষণ কমে? এর একটা ফটাস-উত্তর চলে আসে, প্রবন্ধে বা বক্তৃতায় তা অনায়াসে ছলকানোও যায়, কিন্তু বাস্তবে তা মেনে চলা প্রায় অসম্ভব। যদি সত্যিই আমরা অনুভব করতে পারতাম আফ্রিকায় জলের বদলে পেচ্ছাপ খেয়ে বাঁচা শিশুটির তিক্ততা, বা কলুটোলার মোড়ে ক্যানসারে ভোগা আট বছরের মেয়েটির ফুলে-ওঠা মনস্টার মুখ, আর সেই মুখের দিকে তাকিয়ে বুক-ফেটে-যাওয়া তার মা-বাপের কল থেকে জল ভরার খর-দুপুর, যদি সত্যিই ফি-বচ্ছর পুজো নাগাদ বানের তোড়ে সহস্র মানুষের নাড়ির টানের সর্বস্ব ভেসে যাওয়ার দৃশ্য টিভি থেকে হৃদয়ে ছেপে নিতে পারতাম, তাহলে আমাদিগের সুটান টি-শার্ট, সুইগি-তে বিরিয়ানি, দার্জিলিং ম্যাল-এ সড়সড়ে সেলফি কিছুতে জন্মাতে পারত না। নিশ্চয়ই পুরনো জামাগুলো দিই গরিবদের, কোভিডাক্রান্তদের অক্সিজেন জোগাড়ে কিছু টাকা ট্রান্সফার করেছিলাম নেটব্যাঙ্কিং’এ, অবশ্যই নিগৃহীতা নারীর হয়ে মোমবাতি-মিছিলে মাঝেসাঝে হাঁটি, শ্রদ্ধা করি তাঁদের যাঁরা গোটা জীবনটা আদিবাসী বা যৌনকর্মী বা ফুটপাথিয়াদের স্বাচ্ছন্দ্য-বিধানে উৎসর্গ করেছেন, কিন্তু নিজেরা কোমল সোফার গড়াগড়ি ছেড়ে মাইনের অর্ধেকটা প্রতিমাসে অচেনা সমষ্টির উন্নয়নে ঢেলে দিতে পারি না। যখন কোটিপতিরা তা করেন না, আমরা তাঁদের গাল দিই, আর ভাবি অত্ত টাকা থাকলে আমরাও আর স্বনিরাপত্তার কথা না ভেবে, ঠিকই বিলিয়ে দিতাম। তা গা-বাঁচানিয়া যুক্তি, বেজোস বা মাস্ক-কে খিস্তি করার অধিকার আমাদের নেই, যখন সাধ্যমতো দানটাও আমি আবশ্যিক মনে করি না, বরং দিয়ে ফেললে আত্মমহত্ত্বে অনিঃশেষ পুলকিত হয়ে পড়ি।
চারপাশে তাকিয়ে এ সত্য আমাদের বুঝতেই হবে, বিশ্বও আবহমান কাল এই ‘খেতে পায় না সোমালিয়া, তা বলে আমি খাব না কোর্মা-কালিয়া?’ দর্শনে বিশ্বাসী। তা না হলে, অলিম্পিক্স আয়োজনও করা যায় না, ইউরো কাপ, উইম্বলডন, ক্রিকেট বিশ্বকাপও নয়। যে-লোকটা টেলিস্কোপে চোখ রেখে ব্ল্যাক হোলের ঠিকুজি আবিষ্কার করছে, যে-লোকটা সমুদ্রে ডুব দিয়ে অক্টোপাসের জীবনবৃত্তান্ত নথিবদ্ধ করছে, যে-লোকটা অনাবিষ্কৃত জঙ্গলে ঢুকে নয়া ম্যাপ আঁকছে, যে-লোকটা নালন্দা বা হরপ্পা খুঁড়ে পুরাকাণ্ড উন্মোচনের চেষ্টা করছে, তাদের সব্বার সনিষ্ঠ প্রোজেক্ট সপাটে বাতিল হয়ে যায়। উন্মত্ত টাকা খরচা করে ‘জুরাসিক পার্ক’ও বানানো যায় না, ‘ক্রাউন’ ওয়েব সিরিজও নয়, এমনকী হ্রস্ব-বাজেটের ‘পথের পাঁচালী’ও নয়, কারণ ফিল্ম-ভাষায় বিপ্লব পরে হবে, আগে নিশ্চিত করো দুর্গারা চিকিৎসার অভাবে মা’র কোলে মরবে না, হরিহরকে রোজগার করতে টইটই ঘুরতে হবে না। এও খুব জোরে মনে রাখার: আচমকা যদি অলৌকিক দৈববাণী ঘটে: সমস্ত মানুষ খেয়ে-পরে বাঁচবে ও সেরে যাবে তাবৎ কুষ্ঠ, কিন্তু তার বদলে হৃত হবে সকল সংস্কৃতি বিনোদন শিল্প-ইতিহাস প্রযুক্তি-বিপ্লব (মানে ‘সভ্যতার শ্রেষ্ঠ অর্জন’), বিশ্বে তুঙ্গ-ডাঁই থাকবে তরকারি লাবড়া পেনিসিলিন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তারকভস্কি ইন্টারনেট পারফিউম তেন্ডুলকর পিকাসো চির-লুপ্ত, সমগ্র দিন শুধু মাটি-খোঁড়া ও উপকারী বৃক্ষরোপণ, সন্ধে হলে সাম্য ও সুবিচারের আশ্বাসে সুশ্বাস ত্যজিয়ে স্বপ্নহীন নিদ্রা— তাহলে, বহু ভেবেচিন্তেও, আমরা এই সানুগ্রহ অফার গ্রহণ করব কি? না, কারণ আমরা মনে করি, চিরকালই দু’রকম পৃথিবী বয়েছে, বয়ে চলেছে, বয়ে চলবে, যেখানে কিছু লোক বায়োলজিকাল বাঁচাটাও বাঁচবে না, কিন্তু কিছু লোক আত্মিক বাঁচা বর্ণময় করার সহস্র রসদ পাবে। একদিকে ন্যায়, একদিকে রস, আমাদের দু’তর্জনী ধরে প্রাণপণ টানছে। দু’দিকেরই উন্নয়ন মেরামত সমৃদ্ধি, আমাদের মতে, সমান প্রয়োজন। সত্যি বলতে, টিকে-থাকার গত্ত পেরিয়ে অন্য-শিবিরকেই আমরা অধিক নকুলদানা অর্পণ করি, কারণ প্রতি মুহূর্তে পিলপিল মানুষের কীটদশার জ্ঞান ভারী সিন্দুকের নীচে সচেতন গোর না দিতে পারলে, একটা সার্থক অণুকাজও সারতে পারব না, গণিত গুলিয়ে যাবে, কাব্যে মাত্রা ভুল হবে।
এ আকাশ-পাঁইপাঁই সংবাদে তাই মৃদুহাস্যে হোয়াটসঅ্যাপ-চিত্রের প্রতীক্ষাই বিধেয়। মানুষ পপকর্ন খেতে খেতে ছায়াপথে রকেট-জগিং’এ গেলেও বিশ্ব জুড়ে কোটি কোটি লোক হাউহাউ করে মরে যাবে, না-গেলেও। নিজের পুঁজ ও ভাগ্যের দহনকালে মুখ তুলে অভিনব যানের সরল-ধোঁয়া দেখে সর্বরিক্ত মানুষের কিস্যুই ভাবান্তর হবে না। আবার বিশ্বের অধিকাংশ ইতিহাস-লিখিয়ে ও বাস্তব-চিন্তকও তাঁদের মন-রশ্মিকে দেখবেন সেই মহাকাশাখ্যানের দিকেই ধাবিত হতে, রুগ্ন পাঁজরা-বেরোনো হাঁপানি-বৃদ্ধের কালো হাঁয়ের গর্তে নয়। আসুন দিন গুনি, কবে মঙ্গলগ্রহের মেন রাস্তার নাম মমতা সরণি না মার্ক্স অ্যাভিনিউ, সেই আঙুল-বিতর্কে ভোট বিলোতে পারব!
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী