আমি যখন প্রথমবার ‘ধন্যি মেয়ে’ দেখেছি, তখন ছবিটার বয়স ৩-৪ বছর— মানে প্রথম মুক্তি পাওয়া সালের হিসেবে। আর আমি তার চেয়ে বছর আষ্টেকের বড়। মানে ১১-১২ হব! এ রাজ্যের সিনেমা পরিবেশনার বাজারে মোটামুটি ১৯৮০-র দশক অবধি এই চলটা ছিল। একটা বড় বা মাঝারি হিট সিনেমা মুক্তি পাওয়ার আড়াই-তিন বছর পরে আবার হলে ফেরত আসত। বিশেষ করে খাস কলকাতার একটু বাইরের সিনেমা হলগুলোয় এসব ছবি আরও হপ্তাখানেক বেশ জাঁকিয়েই চলত। এমনকী, মাঝেমধ্যে হলের বাইরে ‘হাউসফুল’ বোর্ডও ঝুলত। আমি, মা, পিসি আর আমার বোন তো ব্ল্যাকে টিকিট কেটে ‘ধন্যি মেয়ে’ দেখেছিলাম ‘অনন্যা’য়। টবিন রোড আর বনহুগলির মাঝামাঝি খুব চালু হলটা আজ প্রায় বছর কুড়ি বন্ধ। পুরোদস্তুর ভেঙে ফেলার কাজটা এই সবে শেষ হয়েছে। বাসস্টপটার নাম এখনও অনন্যাই। ১৯৭১-এ ‘ধন্যি মেয়ে’ মুক্তি পাওয়ার বছরখানেক পরে শুরু হয়েও অনন্যা উঠে গেল! আর ‘ধন্যি মেয়ে’র হাফসেঞ্চুরি হয়ে যাচ্ছে এবারেই! এবং শুধু হাফসেঞ্চুরি নয়— সিনেমা দেখানোর বাংলা চ্যানেলে টি আর পি-র হিসেবমতো এখনও ব্যাপক ‘ব্যাটিং’! মানে অপরাজিত ৫০।
এই ছবিটার পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়— গোটা টলিউড যাঁকে আমৃত্যু ‘ঢুলুদা’ বলে ডেকে এল— ডাক্তার বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুলের ছোটভাই। যে বনফুল এক শিল্পী মালাকার হিসেবে বাংলা ছোটগল্পের বাগানে আশ্চর্য অলৌকিক সব ফুল ফুটিয়েছেন, তাঁর ভাই হওয়ার সুবাদে বাংলা সাহিত্য দুনিয়ার বহু তালেবর বট-অশ্বত্থদের তাঁদের ভাগলপুরের বাড়ির উঠোনে খুব কাছের মানুষ হিসেবে লুঙ্গি-গামছা-গেঞ্জি আর নিমের দাঁতনে দেখেছেন। সাহিত্যের হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিয়েছেন। বিশ্বভারতীতে ইন্টারমিডিয়েট পড়তে গিয়ে শান্তিদেব-শৈলজারঞ্জনদের গানের দলে, নন্দলালের আঁকার দলে ভিড়ে গিয়েছিলেন। বনফুলের ভাই হিসেবে স্বয়ং রবি ঠাকুরকে গায়ে পড়ে ‘বিরক্ত করার’ প্রশ্রয়টুকুও জুটে গিয়েছিল! যদিও তিনি পড়তেন বিজ্ঞান। কারণ ডাক্তারবাড়ির ছেলে যখন, মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়াটা ছিল তাঁর পারিবারিক কর্তব্য। ডাক্তারি পড়বেন বলে ভর্তি হয়েওছিলেন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু কপালের ঠিকানা যদি টলিউড হয় তো ঠেকাবে কে! ওখানে পড়তে পড়তেই দেখে ফেললেন বিমল রায়ের ‘উদয়ের পথে’! সাহিত্য, শিল্প, ডাক্তারি সব গেল ঘেঁটে। অরবিন্দ পড়া ছেড়ে ভর্তি হয়ে গেলেন টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ার লাইট-অ্যাকশন-কাটের জ্যান্ত ফিল্মি স্কুলে। সেখানে কোনও সিলেবাস নেই, নেই কোনও কোর্স ফি-ও। আলো বয়ে, ট্রলি ঠেলে, ওস্তাদ টেকনিশয়ানদের সেকেন্ড-থার্ড-ফোর্থ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে শাগরেদি করতে করতেই এখানে কাজ শেখা হত।
অরবিন্দ সেই স্কুলে এলেন বিমল রায়ের মতো পরিচালক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। বিমল রায় হতে পারুন বা না-পারুন, তিনি অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় হয়েছিলেন। মূল ধারার সিনেমাতেও নিজের একটা ব্র্যান্ড তৈরি করে নিয়েছিলেন। বক্স অফিসের সব ফর্মুলার সঙ্গে আপোস করে ঘোর বাণিজ্যিক সিনেমা তৈরি করতে গিয়েও, তিনি তাঁর আকৈশোর কুলীন সাহিত্যের সঙ্গে গা ঘষাঘষি, শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক জীবন আর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব, তুখড় টনটনে সঙ্গীতের কান, আর জিন-সূত্রেই পাওয়া ঝলমলে কৌতুকবোধ বিলকুল হাপিস করে দিতে কখনওই পারতেন না। তিনি যখন ‘ধন্যি মেয়ে’র কাজে হাত দিচ্ছেন, টালিগঞ্জ তখন তাঁকে একজন সফল পরিচালক হিসেবেই মান্যি করে। এবং এই সাফল্যটা এসেছে বাংলা সিনেমার চেনা স্টার-সিস্টেমকে এতটুকু রেয়াত না করেই। এমনিতেই বাংলা জনপ্রিয় সিনেমা তখন ১৯৫০-’৬০-এর সুন্দর-স্বর্ণালী-সন্ধ্যা পেরিয়ে এসেছে। কোথাও কোনও মাধবী-রাতের দেখা নেই। উত্তমকুমারের শরীরে-মুখে আচমকা বয়সের ছাপ। সুচিত্রা সেন পুরোদস্তুর অন্তরালে চলে যাওয়ার আগে তখন যেতে-পারি-কিন্তু-কেন-যাব গোছের দোলাচলে ঘেঁটে আছেন। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় সেখানে তারকার আলো ছাড়াই বক্স অফিসকে আলোকিত করার রাস্তা দেখাচ্ছেন।
‘ধন্যি মেয়ে’র ঠিক আগের ছবি ‘নিশিপদ্ম’তেই তিনি উত্তমের রোম্যান্টিক নায়কের ইমেজ ভেঙেচুরে একজন দুর্ধর্ষ চরিত্রাভিনেতাকে খুঁড়ে বের করেছিলেন। ‘ধন্যি মেয়ে’তেও উত্তমকুমার-সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে তিনি আবার একদম অন্যরকম ছাঁচে ঢাললেন! জনপ্রিয় বাংলা ছবির চিরকালের আইকন উত্তম, আর বাঙালির জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রিয়তম আইটেম ফুটবল— এই দুটো ব্যাপারকে তিনি এই ছবিটায় অ্যায়সা গাঁটছড়া বেঁধে দিলেন, বিয়ে ভাঙার বিশেষজ্ঞ কোনও দুঁদে উকিলও সে মামলায় দাঁত ফোটাতে পারবে না।
‘নিশিপদ্ম’-তে তবু তার কাহিনিকারের নাম ছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও সেখানে অরবিন্দ খোদার ওপর খোদকারি করেছিলেন। উত্তম-অভিনীত যে অনঙ্গ দত্ত চরিত্রটি ‘বুঝলে নটবর, তুমিও যাবে না, আমিও যাব না’ বলে বাংলা সিনেমায় চিরদিন থেকে গেলেন, বিভূতিভূষণের ‘হিংয়ের কচুরি’ গল্পটার কয়েকশো কিলোমিটারের মধ্যে তিনি ছিলেনই না। ‘অনঙ্গ’ পুরোদস্তুর মেড ইন টালিগঞ্জ— মেড বাই ঢুলুবাবু! আর দেবাংশু মুখোপাধ্যায়ের যে আড়াই-তিন পাতার ‘লাউড স্পিকার’ গল্প থেকে ‘ধন্যি মেয়ে’র জন্ম, সেখানে শুধু গ্রামের শিল্ড ফাইনালে মারামারি আর মাইক পাকড়ে ন্যাড়ার রানিং কমেন্ট্রির সুতোটুকু ছিল।
এই সুতো ছাড়ানোর ভারটা অরবিন্দ এখানে দিয়ে ছিলেন দাদার প্রাণের বন্ধু পরিমল গোস্বামীর পুত্র, রস-লেখক হিমানীশ গোস্বামীর ওপর। সহ-চিত্রনাট্যকার হিসেবে হিমানীশ তাঁর বিলিতি ঘরানার ‘ড্রাই হিউমার’, তার সঙ্গে কিছু বিদেশি রসিকতার পাঞ্চ মিলিয়ে যে চিত্রনাট্যটা খাড়া করেছিলেন, ঢুলুবাবু জায়গামতো সেটাকে বাঙালিয়ানার ঠিকঠাক অনুপানে ডুবিয়ে-ভিজিয়ে সাইজ করে নিয়েছিলেন। তবে চটচটে চোখের জল, প্যাচপ্যাচে সেন্টিমেন্ট নয়, বরং এক মুচমুচে, ফুরফুরে, গড়পড়তা বাংলা সিনেমার তুলনায় অনেক চোখা স্মার্ট কমেডির ফয়েলে মোড়া গোটা ছবিটাই। ক্রেডিট টাইটেলে চণ্ডী লাহিড়ীর কার্টুন থেকেই সেই স্মার্টনেসের ছোঁয়া। গল্পের ন্যাড়া এখানে শুধু ফুটবল ম্যাচের রিলে করে না— গোটা হাড়ভাঙা গাঁয়ের ইতিহাস-ভূগোল, এর-ওর বাড়ির হাঁড়ির খবর, কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি, গসিপ-গুজব, সবটাই সে রিলে করে করে বলে। রিলে মাস্টার বন গয়া কথক ঠাকুর ওরফে সূত্রধর, বা একই অঙ্গে সেকালের বাংলা ধারাবিবরণীর স্মৃতি-জাগানিয়া অজয়-পুষ্পেন-কমল ভট্টাচার্য আর একালের কাগুজে পেজ-থ্রি।
ন্যাড়ার কমেন্ট্রি থেকেই আমাদের জানা হয়ে যায়, হাড়ভাঙা গ্রাম এখন তেতে আছে ল্যাঙ্কেশ্বর স্মৃতি শিল্ড ফাইনাল নিয়ে। যেখানে হাড়ভাঙা ইলেভেন তাদের হোম গ্রাউন্ডেই মুখোমুখি হবে কলকাতার সর্বমঙ্গলা স্পোর্টিং ক্লাবের। এই শিল্ড ফাইনাল, আর তার আগুপিছু ঘটনার ন্যারেটিভ নিয়েই পুরো ছবিটা। স্ক্রিপ্টের গড়নটাও অনেকটা ফুটবল মাঠের টিম সাজানোর মতোই। কাহিনির সেন্টার সার্কলে বাঙালির ফুটবল প্যাশন। ছবির থিম সং-এর লিরিকেই লেখা হয়ে গেছে একটা গোটা জাতির সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের ঘোষণা— ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’। ময়দানের একদিকে টিম হাড়ভাঙা। তার আসলি ক্যাপ্টেন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট গাঁয়ের একদা-জমিদার গোবর্ধন চৌধুরী। তাঁর বাবার নামেই শিল্ড। আর সেই শিল্ড তিনি গ্রামের বাইরে কিছুতেই যেতে দেবেন না। জমিদারি চলে গেলেও, তিনিই এখনও এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তার নিজস্ব মোসাহেবের দল আছে। তাছাড়া গাঁয়ের বহু লোকের টিকি বাঁধা আছে তাঁর বন্ধকির খাতায়। মায় গ্রামের কুলপুরোহিত তোতলা ভট্চাযের টিকিটাও। এই গোবর চৌধুরীরই বাপ-মা মরা ভাগ্নি মনসা। অনেকটা দস্যি, ঈষৎ জঙ্গি এবং খানিকটা জংলি! সেও অবশ্যই টিমে আছে। তবে কোচ-ক্যাপ্টেনের বাতলে দেওয়া ফর্মেশনের বাইরে সে গোটা হাড়ভাঙা জুড়ে ‘লিবেরো’ খেলে বেড়ায়! ন্যাড়ার রানিং কমেন্ট্রি-মাফিক পুরো হাড়ভাঙা গ্রামটাই মনসার খেলার মাঠ। মামাবাড়ির অনাদরের ডিফেন্স-এর একটু সামনে আর অবহেলার মাঝমাঠের একটু পেছনে দাঁড়িয়ে, মামা-মামির ফসকানো যে কোনও লুজ বল ধরে মেয়েটা তুমুল ড্রিবলিং করে যায়।
এই চরিত্রটার জন্য ঢুলুবাবু প্রথমে বেছেছিলেন স্বভাব-দস্যি মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়কে। কিন্তু মৌসুমী তখন মুম্বইয়ে তাঁর কেরিয়ার নিয়ে খুব ব্যস্ত। হাতে অনেক কাজ। ডেট দেওয়া সম্ভব ছিল না। নায়িকার সন্ধানে ‘ধন্যি মেয়ে’র ইউনিট যখন হন্যে, তখনই কলকাতার নিউ থিয়েটার্সে ইন্টারভিউ দিতে এলেন পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউটের সদ্য পাস-আউট, প্রবাসী বাঙালিনি জয়া ভাদুড়ী। তাঁর পরীক্ষকদের একজন ছিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। ঢুলুবাবুর জহুরি চোখ খুঁজে নিল তাঁর মানসী মনসাকে। তার পরেরটুকু তো ইতিহাস! ‘যা যা বেহায়া পাখি যা না’-র মতো অমন কোমল অভিমানী গানে লিপ দেওয়া থেকে শুরু করে, দারোয়ানের লাঠি কেড়ে নিয়ে বেসুর ভাসুর উত্তমকুমারের নাকের ডগায় ঠক করে ঠুকে তারপর ঢিপ করে প্রণাম— বাঙালি সেই যে জয়ার প্রেমে পড়ে গেল, গত ৫০ বছর ধরে বলিউডে তিনি বাংলার ‘নিজের মেয়ে’ হয়েই রয়ে গেলেন।
তবে টিম হাড়ভাঙার প্রতি মনসার কমিটমেন্ট নিয়ে যদি একটু সন্দেহ থেকেও থাকে, কলকাতার কালীপতি দত্তের সর্বমঙ্গলা স্পোর্টিং ক্লাবের ইন-স্পিরিট নিয়ে কোনও কথা হবে না। এই টিমের মালিক, স্পনসর, মেন্টর সবটাই একজনই— শ্রীযুক্ত কালীপতি দত্ত— মানে উত্তমকুমার। কালীপতির ছোটভাই বগলা, মনসার প্রেমিক-কাম পতি হলেও, বগলার সঙ্গে তার একটা দুষ্টুমিষ্টি গোছের ফুটবল-রোম্যান্স থাকলেও, ছবির আসল পয়েন্ট অফ অ্যাট্রাকশন হল, কালীপতি বনাম মনসার ‘বিগ ফাইট’— প্রায় ডার্বিও বলতে পারেন। বগলা মাঠে সর্বমঙ্গলা ক্লাবের এক নম্বর স্ট্রাইকার হতে পারে, কিন্তু ছবির কাহিনির হিসেবে কালীপতি উত্তমই যেন একই অঙ্গে পেলে-মারাদোনা-মেসি। এইখানটায় চিত্রনাট্যে একটা মজার খেলা আছে। কালীপতিদের সংসারের পেনাল্টি বক্সে মনসা অবশ্যই একটা আপাত-আপদ। তার মামা গোবর চৌধুরীর বয়ানে, একটা জীবন্ত বল বা বিপজ্জনক সেন্টার— যে কোনও ডিফেন্সই যা নিয়ে ঘেঁটে থাকবে! আর মনসার নিজের হিসেবে সে যেন অনেকটা ‘ফলস নাইন’-এর ভূমিকায়! মানে আসলে স্ট্রাইকার নয়, কিন্তু পরিস্থিতির চাপ, মামার স্ট্র্যাটেজি তাকে ‘অপোনেন্ট’, মানে শ্বশুরবাড়ির গোলবক্সে ধাক্কাধাক্কি করতে পাঠিয়ে দিয়েছে।
আর এই জায়গাটাতেই এথিক্যাল আপত্তি ছিল কালীপতি দত্তের। এমনিতে কলকাতার কালীপতি আর হাড়ভাঙার গোবর চৌধুরীর মধ্যে আর্থিক, সামাজিক ফারাক কলকাতা থেকে হাড়ভাঙার দূরত্বের চেয়ে অনেক বেশি। কালীপতি ‘বিজনেস ম্যাগনেট’। নিজের ঝাঁ-চকচকে অফিস, পি.এ.। লেডি স্টেনো স্টাইপিস নেওয়ার ইন্টারভিউ ছিল শিল্ড ফাইনালের দিনেই। ওদিকে গোবর চৌধুরী জমিদারি হারিয়ে এখন গেঁয়ো জোতদার-মহাজন। তেজারতি কারবারের পাশাপাশি মজুতদারি কালোবাজারির দু’নম্বরি ধান্দায় হাত পাকিয়েছেন। গোবর্ধনরূপী জহর রায়ের চারপাশে গোমস্তা-মোসাহেব, গ্রামের ভেঙে পড়া অর্থনীতি কূটকচালির কালো। আর কালীপতিকে ঘিরে মার্কেন্টাইল পুঁজি, শহরের সুখ, প্রগতি, উন্নয়নের আলো! কিন্তু বাড়ির অন্দরমহলে দুজনেই পাক্কা পেট্রিয়ার্ক! মেজাজে-মহিমায় সমান ফিউডাল! তাঁদের কথার ওপর কোনও কথা হবে না। তবে তফাতটা ওই মনের ক্লাসের! গোবর্ধন এক্স-জমিদার হয়েও কিপটে-কুচুটে, ছোট মনের মানুষ। আর ‘সেল্ফ-মেড’ কালীপতি সাচ্চা স্পোর্টসম্যান। দুটো হাঁটুই ফুটবলকে দিয়ে দেওয়ার পরেও, তাঁর হৃদয়খানা ফুটবল মাঠের মতোই মস্ত, উদার, সবুজ। আর তাঁর শোওয়ার ঘর যেন বাংলা ফুটবলের জ্যান্ত যাদুঘর! কিংবা মোহনবাগানের ক্লাব-তাঁবু। সেখানে দেওয়ালে সার দিয়ে সাজানো শিবদাস, বিজয়দাস, গোষ্ঠ পাল, উমাপতি কুমারদের ছবি। রোজ সকালে ঠাকুরঘর (এটাও সম্পন্ন হিন্দু-বাঙালিয়ানার একটা অহং-চিহ্ন) থেকে বেরিয়ে কালী দত্ত এই ফুটবল-আইকনদের ছবিতে পরম ভক্তিভরে পেন্নাম ঠোকেন। আসলে ফুটবল তাঁর কাছে আর একটা ধর্মবিশ্বাস। তাই মাঠের খেলায় ডজন গোলে হেরে ভূত গোবর চৌধুরী যেভাবে বন্দুকের ডগায় জবরদস্তি বগলা আর মনসার বিয়ে দিয়েছিলেন, সেটা কালী দত্ত-র মনে হয়েছিল অধর্ম, আনস্পোর্টিং, অফসাইডে গোল! আবার পরিত্যক্ত ফাইনালের রিপ্লে-র দিন কালী দত্ত যখন বুঝে যাচ্ছেন, তাঁর ভাইয়ের বউয়ের প্ল্যান বি-র দৌলতেই গোবর্ধনের বহিরাগত ভাড়াটে ফুটবলার দিয়ে বাজিমাত করার চাল বানচাল হয়ে গেছে, তখন তিনিই তো আসল হিরোর মতো বন্দুক উঁচিয়ে, শত্রুপুরীর দরজা ভেঙে, মামার বেদম ঠেঙানির হাত থেকে ‘ড্যামসেল ইন ডিসট্রেস’ মনসাকে উদ্ধার করে আনেন। মাঠের পয়লা নম্বর স্ট্রাইকার বগলা, বিপক্ষের পেনাল্টি-বক্সে দাদার এই সুপার-অ্যাকশনে স্রেফ দর্শক।
যে হতভাগ্য পাঠক ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিটা একবারও দেখেননি, তিনিও নিশ্চয় এতক্ষণে বুঝে গেছেন কালী দত্তর চরিত্রটা অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় উত্তমের জন্য একেবারে টেলর-মেড করে বানিয়েছিলেন। এবং তাঁর এটাও আন্দাজ ছিল, উত্তমের অভিজ্ঞতা আর স্ক্রিন-প্রেজেন্সের সুবাদে পর্দায় চরিত্রটা আরও কতটা খুলে যাবে! তবু ‘ধন্যি মেয়ে’র ‘প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ’-এর ট্রফিটা যে জয়া আর উত্তম মিলেই ভাগাভাগি করে নিয়ে যেতে পারেন না, তার কারণ ময়দানে আরও দুজন খিলাড়ির উপস্থিতি। এঁদের একজন মিসেস কালী দত্ত সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, যাঁর দুর্ধর্ষ কমেডি সেন্স আর টাইমিং বাংলার অনেক আচ্ছা আচ্ছা পুরুষ কমেডিয়ানদের কাত করে দেয়। এখানে তিনি দুরন্ত মার্কার-এর মতো উত্তমের যাবতীয় ফিউডাল দাপট, পৌরুষ, সেই সঙ্গে ফুটবল-আদিখ্যেতাকে একদম বোতলবন্দি করে রাখেন।
আর একজন হাড়ভাঙা গ্রামের তোতলা পুরোহিত ভট্চায মশাইয়ের ভূমিকায় রবি ঘোষ। ঢুলুবাবু এ ছবিতে বাঙালির সংস্কার-বিশ্বাসের তেকাঠিতে দু’দুটো সলিড ভলি মেরেছেন! এক, দত্তবাড়ির ঠাকুরঘরে গুরুদেবকে দিয়ে ফুল-বেলপাতা-গঙ্গাজল সুদ্ধ চামড়ার ফুটবলের পুজো! আর দুই, ‘ধর্মের খেলার রেফারি’ পুরোহিতকে সত্যিকারের ম্যাচে রেফারি সাজিয়ে নামিয়ে দেওয়া। বাদবাকিটা পুরুত-রেফারি রবি ঘোষের হাতযশ। ‘চ্যাপলিনেস্ক’ শব্দটা আমরা স্থানে-অস্থানে দুমদাম ব্যবহার করি। কিন্তু এই গোটা ফুটবল ম্যাচের পর্বে টিকি-বাঁশি-হাফপ্যান্ট- তোতলামি— সবসুদ্ধ যে অলৌকিক এনার্জিতে ভর করে তিনি গোটা মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, তাতে তার চেয়ে দর্শনীয় পুরো ম্যাচে আর কিছু ছিল না। মাঠের ভেতর রবি ঘোষের প্রায় সংলাপহীন এক-একটি অভিব্যক্তির ক্লোজ আপ, আর মাঠের বাইরে মোনোলগ-এ গোবর্ধন জহর রায়ের প্রতিক্রিয়া যেন একদা বার্সায় মেসি-নেইমারের যুগলবন্দি। দর্শকের হেসে খুন হওয়াটা সেখানে বাধ্যতামূলক।
সবটা মিলিয়ে, ছবির কনটেন্ট ও গড়নে ফুটবলকে এতটা সম্পৃক্ত করে কোনও সিনেমা ‘ধন্যি মেয়ে’র আগে বা পরে বাংলায় তৈরি হয়নি। আর কোন সময়ে ছবিটা তৈরি করছেন অরবিন্দ? ওপার বাংলায় তখন ইয়াহিয়া খানের ঘাতক-সেনার গণহত্যার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ চলছে। আর এই বাংলায় সত্তরের দশককে মুক্তির দশক বানানোর স্বপ্ন বুকে নিয়ে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছে। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার ডাকের ওই দিনগুলোয়, ঢুলুবাবুর ইউনিট কলকাতা ছেড়ে হাওড়ার জগৎবল্লভপুরে ঘাঁটি গাড়ছে। ছবির প্রযোজক-পরিবেশকের নিজের গ্রামই হয়ে উঠছে ‘ধন্যি মেয়ে’র হাড়ভাঙা। সেখানে ঝুকঝুক করে মার্টিন রেল চলে। ‘বউ কথা কও’ বলে পাখি ডাকে। তার পাশে অযথা বারুদ, অকারণ রক্ত, অনাবশ্যক মৃত্যুকে পাশ কাটিয়ে পর্দায় জন্ম নিচ্ছে গ্রাম আর শহরের ইচ্ছাপূরণের এক যমজ রূপকথা। ৫০ বছর পেরিয়েও যার গায়ে সময়ের এতটুকু মরচে বা মালিন্যের দাগ নেই।