বহু-প্রতীক্ষিত ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিক্স-এ যোগ দেওয়ার জন্য যখন ভারতীয় দল টোকিও পৌঁছচ্ছে, তখন একক প্রতিযোগিতায় (মানে, দলগত নয়) দু’বার অলিম্পিক্স মেডেলজয়ী একমাত্র ভারতীয় যিনি, তিনি পুলিশের জিম্মায়। সুশীল কুমার ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিক্সে ব্রোঞ্জ এবং ২০১২-এ লন্ডন অলিম্পিক্সে রুপো জিতেছিলেন, কিন্তু ২৩ বছরের কুস্তিগির সাগর ধনখড়-এর খুনের ঘটনায় তাঁর যোগ আছে বলে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছে। সুশীলের খুব নাম আছে কুস্তির কৌশল, গতি আর টেকনিকে দক্ষতার জন্য, তিনি আবার আখড়ার রাজনীতির সঙ্গেও ভালই পরিচিত। তাঁর সতীর্থ ও জুনিয়র নরসিংহ যাদব ডোপ-পরীক্ষায় পাশ করতে না পারার জন্য ২০১৬-র রিও অলিম্পিক্স থেকে বাদ পড়েন। তারপরেই যাদব অভিযোগ করেন, সুশীল তাঁর খাবারে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে অলিম্পিক্স টিমে ঢোকার সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। এই অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও, তার পর থেকেই অলিম্পিক মেডেল-জয়ী কুস্তিগির সুশীলের নামের সঙ্গে অপরাধ আর সন্দেহের ধোঁয়াশা জড়িয়ে গেছে।
প্রায়ই অলিম্পিক্সের এই অন্ধকার দিকটা আত্মপ্রকাশ করে— যেখানে খেলোয়াড়ের ঘাম-রক্ত-শৃঙ্খলার ইতিহাস বদলে যায় ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, এমনকী হিংস্রতায়।
দিল্লির ছত্রসাল স্টেডিয়াম থেকে যোজন যোজন দূরে, আমেরিকার ফিগার স্কেটিং রিঙ্ক-এ একজন তরুণ ফিগার-স্কেটার-এর (যে বরফের ওপর স্কেটিং করে) ওপর আক্রমণের গল্প বলা যাক। সালটা ১৯৯৪, সময়টা লিলেহ্যামার উইন্টার গেমস-এর ঠিক ছ’সপ্তাহ আগে। ন্যান্সি কেরিগ্যান যখন প্র্যাকটিস থেকে ফিরছিলেন, তাঁর ডান হাঁটুতে একটা মুগুরের মতো জিনিস দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করা হয়। তার পরের দিনেই ছিল ইউ এস ন্যাশনাল ফিগার স্কেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ। এই প্রতিযোগিতায় জয় মানেই অলিম্পিক্স-এ যোগদানের টিকিট পাওয়া। টোনিয়া হার্ডিং সে-বছর এই প্রতিযোগিতাটি জেতেন এবং অলিম্পিক্সে যাওয়ার সুযোগ পান। কেরিগানও পরে সেই অলিম্পিক্স টিমে জায়গা পান, কারণ ততদিনে তাঁর চোট পরীক্ষা করে ডাক্তাররা বলেছেন, অলিম্পিক্সের আগে তিনি সেরে যাবেন।
এর পরের তিন সপ্তাহে রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পের চেয়েও আকর্ষণীয় সব তথ্য সামনে এল। জানা গেল, যারা কেরিগানের হাঁটুতে মেরেছিল, তাদের ভাড়া করেছিল হার্ডিং-এর প্রাক্তন স্বামী জেফ গিলুলি। জেফ অপরাধ স্বীকার করল। হার্ডিং বললেন, তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। কিন্তু এরপর থেকে দুই সতীর্থের মধ্যে সম্পর্ক আইস-রিঙ্কের বরফের চেয়েও ঠান্ডা হয়ে উঠল। সে-বছর অলিম্পিক্সে হার্ডিং অষ্টম স্থান অধিকার করেন, আর কেরিগান রুপো জিতে আমেরিকার চোখের মণি হয়ে যান।
হার্ডিং পরে ‘সুবিচারের সম্ভাবনা নষ্ট করা’র জন্য অপরাধী সাব্যস্ত হন, অপরাধ স্বীকারও করেন, এবং তাঁকে এই খেলা থেকে আজীবন নির্বাসিত করা হয়। যা ছিল দুর্দান্ত একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তা পরিণত হল এক ভয়ানক শত্রুতায়। মার্কিন কর্তারা ঠিক করেন, আইস-স্কেটিং রিঙ্ক-এ, এই শত্রুতার কোনও জায়গা নেই।
১৯৫৬ সালের অলিম্পিক্স-এ অবশ্য, কুস্তির ময়দান বা স্কেটিং রিঙ্ক নয়, রক্তাক্ত হয়ে গেল ওয়াটারপোলো পুলের জল। সে কথা ভাবলে মনে পড়ে, ভয়ঙ্কর ‘কোল্ড ওয়র’-এর তিক্ত বছরগুলো এবং ‘লৌহ-যবনিকা’র আড়ালের শত্রুতা।
১৯৫৬-র মেলবোর্ন অলিম্পিকের বেশ কিছু মাস আগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল হাঙ্গেরির ছাত্র-আন্দোলন, আর সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই আন্দোলনকে জবরদস্তি দমন করেছিল। হাঙ্গেরির ওয়াটারপোলো দল তার আগের অলিম্পিক্সে সোনা জিতেছিল। মেলবোর্ন পৌঁছনোর পর তারা জানতে পারে, তাদের দেশে ছাত্র আন্দোলনের পরিণতি কী হয়েছে। এমন একটা বিস্ফোরক পরিস্থিতিতে হাঙ্গেরি খেলতে নামে মারকুটে সোভিয়েত দলের বিরুদ্ধে। সাংঘাতিক রেষারেষির এই ম্যাচে, হাঙ্গেরির খেলোয়াড়রা (তাঁরা রাশিয়ান ভাষা জানতেন) এন্তার গালাগালি করছিলেন সোভিয়েতদের, যেরকমটা ক্যাচ ধরার পর বিরাট কোহলি করেন। হাঙ্গেরিয়ানরা মুখে গালাগালি দিচ্ছিলেন, কিন্তু সোভিয়েত খেলোয়াড়রা বিপক্ষের খেলোয়াড়দের মেরে মেরে সেই গালাগালির প্রতিশোধ নিচ্ছিলেন। এই মারামারি রুখতে, দুই দলের মোট পাঁচজনকে রেফারি পুল থেকে বহিষ্কার করে দেন।
একজন তরুণ হাঙ্গেরীয় খেলোয়াড়, আরভিন জাদোর, মার্ক করছিলেন সোভিয়েত খেলোয়াড় ভ্যালেন্তিন প্রোকোপভকে, যিনি খেলার শেষলগ্নে উত্তরোত্তর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলেন। ম্যাচ শেষ হওয়ার হুইসল যে মুহূর্তে বেজে উঠল, আরভিনের চোখের ওপর ভ্যালেন্তিন প্রচণ্ড জোরে মারলেন, দরদর করে রক্ত বেরিয়ে পুলের জল লাল হয়ে গেল। দু’দলের সমর্থকরা ক্ষিপ্তভাবে এগিয়ে যায় পুলের দিকে, অফিশিয়ালরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খেয়ে যান। কিছু প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, জলের মধ্যে দু’পক্ষই এরপর মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে, তাই পুলের জল লাল হযে যায়, আবার কেউ কেউ বলে, অতটা হয়নি, শুধু আরভিন-ই খুব বাজে ভাবে আঘাত পেয়েছিলেন।
হাঙ্গেরি সে-বছর সোনা জেতে এবং মনে করে ঠিকঠাক প্রতিশোধ নেওয়া গেছে। কিন্তু আরভিন জাদোর আর কখনও হাঙ্গেরি ফেরেননি। তিনি চলে যান আমেরিকা। আর ১৯৬০-এর দশকে তিনিই ছিলেন মার্ক স্পিৎজ নামের এক ছোট্ট ছেলের সুইমিং কোচ।
নিজের পারফর্ম্যান্সের সর্বোচ্চ মানে পৌঁছতে ডোপিং-এর জুড়ি নেই। তাই ডোপিং হল বিপক্ষের সবাইকে একদানে নিকেশ করে দেওয়ার উত্তম তরিকা। ১৯৭০-১৯৮০’র দশক ছিল ডোপিং-এর সাহায্যে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে মাঠে আশ্চর্য ফল করার দশক, বিশেষত দৌড় বা লাফ-এর ইভেন্টগুলোয়। তাই সেই সময়ের রেকর্ডগুলোকে এখন একটু সন্দেহ আর অবিশ্বাসের চোখেই দেখা হয়।
এই সময়েই আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক অ্যাথলিটের উত্থান হয়: কার্ল লিউইস। লিউইস ছিলেন সেইসব খেলোয়াড়ের প্রতীক, যাঁরা সফল এবং সৎ। তিনি লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক্সে চারটি সোনা জেতেন, এর আগে শুধু জেসি ওয়েন্স-এর এই অবিশ্বাস্য রেকর্ড ছিল। ১৯৮৮ সালের সিওল অলিম্পিক্স-এ লিউইসের একটাই উদ্দেশ্য ছিল— নিজের কীর্তি ধরে রাখা, একশো মিটার দৌড়-এ আবার সোনা জেতা। তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কানাডার বেন জনসন। ভারতে যাদের বয়স ৪০ বছরের ওপর, তাদের সবার নিশ্চয়ই মনে আছে সেই দৃশ্যটা, যেখানে দর্শক-ভর্তি স্টেডিয়ামে কার্ল লুইসকে হারিয়ে দিচ্ছেন বেন জনসন, আর ফিনিশিং লাইন পেরিয়ে হাত তুলে যেন পৃথিবীর কাছে সগর্বে ঘোষণা করছেন, দৌড়-এর নতুন রাজা এসে গেছে।
ভারতের সেই দর্শকেরা নিশ্চয়ই একথাও মনে রেখেছে, এই ঘটনার তিনদিন পর, একটা গুজব খুব ছড়াতে শুরু করে, আর তারপর টিভিতে ‘সমাচার’-এ, সলমা সুলতান কঠিন মুখ করে ঘোষণা করেন, হ্যাঁ, সত্যিই বেন জনসন ডোপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি, অর্থাৎ নিষিদ্ধ বস্তুর সাহায্যে দৌড় জিতেছিলেন। সেবছর পুজোর সময় প্রায় প্রতিটি মহিষাসুরের মুখের সঙ্গে বেন জনসনের মুখের মিল ছিল। সারা পৃথিবী এক ভয়াল ভিলেনকে খুঁজে পেয়েছিল।
বেন জনসনের মেডেল তক্ষুনি কেড়ে নেওয়া হল এবং তার আগের বছর যে-রেকর্ডটা বেন করেছিলেন সেটাও নাকচ করা হল। ফলে পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত মানুষের তকমাটা কার্ল লিউইসেরই থাকল। পরবর্তীকালে অনেকেই বলেন যে, সেই সময়কার আমেরিকার অনেক অ্যাথলিটই কিন্তু খুব সৎভাবে মেডেল জয় বা রেকর্ড করেনি। এবং এই তত্ত্ব যখন একেবারে তুঙ্গে উড়ছে, তখন হুট করে, কম বয়সেই, ফ্লোরেন্স গ্রিফিথ জয়নার অবসর নিলেন আর ১৯৯৮ সালে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। তবে, পৃথিবীর দ্রুততম নারী হিসেবে এখনও তাঁর রেকর্ড অক্ষত।
এই সব ক’টা ঘটনাই ষড়যন্ত্র, চোরামি, অন্তর্ঘাতের প্রমাণ হিসেবে উন্মোচিত হয়েছে। হয়তো বা আরও অনেক এমন ঘটনা আছে যা প্রকাশিত হয়নি। বিশেষ করে কোল্ড ওয়ার-এর সময়ে। সেইসব ঘটনা বোধহয় চিরকালই গোপন থেকে যাবে।