ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • অগণতান্ত্রিক?


    সিদ্ধার্থ দে (July 10, 2021)
     

    গতবছরের গোড়ার দিককার কথা। কলেজের স্টাফরুমে আড্ডা চলছে। যুক্তিতক্কোর নাগরদোলায় ঘুরছে সিনেমা থেকে রাজনীতি। তা সেই দোলায় ডোনাল্ড ট্রাম্প একবার চড়বেন না তা কি হয়! তিনি আসতেই আড্ডা একটু উচ্চগ্রামে, কথাবার্তা উত্তেজিত। কথাপ্রসঙ্গে  আলটপকা বলে বসেছি, ‘ট্রাম্পের মতো undemocratic president আমেরিকা আগে দেখেনি।’ নেহাৎই হালকা চালে বলা, পাড়ার আড্ডা হলে বিপুল জনসমর্থন একেবারে বাঁধা ছিল। যে লোকটা প্রকাশ্য সভায় চিনাদের গালিগালাজ করতে পিছপা হয় না, নারীবিদ্বেষী মন্তব্যে প্রাত্যহিক আচমন সারে, তাকে অগণতান্ত্রিক বলাটা কি ভুল? কিন্তু বিপদ হল অন্য জায়গায়। এতক্ষণ প্রায় নীরব শ্রোতা হয়ে বসে থাকা আমার এক সহকর্মী — রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা — প্রায় ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, ‘বাজে বকিস না, একটা লোককে অগণতান্ত্রিক বলে লাভ আছে?! আমেরিকা চিরকাল মনে করে যে তাদের গণতন্ত্রই গণতন্ত্রের একমাত্র মডেল, আর কেউ গণতন্ত্রের কিছু বোঝে না। আর সেই পাঠ পড়াবার জন্যেই প্রাচ্যের দুর্বল দেশগুলোকে কব্জা করে। এটা একধরণের colonial মনোভাব। গণতন্ত্র আসলে একটা অজুহাতমাত্র, একটা eyewash!’

    কিছুদিন আগে বাগরাম বিমানঘাঁটি থেকে মার্কিন সেনার ফিরে যাওয়ার ঘটনায় হঠাৎ সেইদিনটার কথা মনে পড়ে গেল। একটু তলিয়ে ভেবে দেখলাম, একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে সেই অধ্যাপিকার  মন্তব্য। সত্যিই তো! এই যে দীর্ঘ ২০ বছরের সংগ্রাম, হাজার হাজার প্রাণ, প্রায় দুই লক্ষ কোটি ডলার খরচ — এসবের প্রধান উদ্দেশ্য তো ছিল এই দুটোই, সন্ত্রাসের দমন আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। তা নইলে আর লাদেন নিকেশ হওয়ার এক দশক পরেও কেন মার্কিন সেনার সেখানে পড়ে থাকা? নিন্দুকেরা যদিও বলবে আমেরিকা আসলে নিজেদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতেই আফপাক বর্ডারের উপর নজরদারি চালিয়ে যেতে চেয়েছিল, আফগানিস্তানের মানুষদের নিয়ে ওদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। কিন্তু সেই যুক্তি যদি আপাতত অগ্রাহ্য করি, তাহলে তো পড়ে থাকছে সেই একটাই কারণ — গণতন্ত্র।

    তা সেই গণতন্ত্র কি আজ আফগানিস্তানে সুপ্রতিষ্ঠিত? এ প্রশ্নের কোনও একবগ্গা উত্তর দেওয়া মুশকিল। গত দুই দশকে সে দেশে নতুন সংবিধান প্রণয়ন হয়েছে, প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মানুষের দ্বারা নির্বাচিত সরকার। নাগরিক জীবনেও তার আলোবাতাস ছড়িয়েছে বইকি! আকাশে উড়ছে ঘুড়ি, ঘরে ঘরে টিভি রেডিও, স্কুল-কলেজে মেয়েদের অবাধ যাতায়াত — ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সময়কালে এই সহজ দৃশ্যগুলোও অকল্পনীয় ছিল। তাহলে তো ‘গল্প হলেও সত্যি’-র রবি ঘোষের মতো মার্কিন সেনার এবার যাওয়ার সময় হল বলাই যায়, তা নিয়ে এত তর্ক-বিতর্ক কীসের? 

    সমস্যাটা অন্য জায়গায়। ২০০১-এ যাদের উৎখাত করে আমেরিকা আফগানিস্তানের দখল নিল, যাদের মদতে সেদেশে আল কায়দার মতো জঙ্গি গোষ্ঠী ফুলেফেঁপে উঠেছিল বলে অভিযোগ, এবং যারা ঘোষিতভাবে সবরকম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধী — সেই তালিবানরা এখন প্রবল শক্তিধর। গত ১০-১৫ বছর ধরে তারা গোকুলে (মানে, পাকিস্তানে) বেড়েছে। দক্ষিণ আফগানিস্তান থেকে তারা এবার ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশে, বিশেষত গ্রামেগঞ্জে, মফস্বল এলাকায়। গত মার্চ মাসের পরিসংখ্যান বলছে, দেশের প্রায় ৫০% ইতিমধ্যে কব্জা করে ফেলেছে তালিবান শক্তি, গণতান্ত্রিক সরকার সেখানে নাম কা ওয়াস্তে। তাদের এই উত্থান এতটাই জোরালো যে, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা প্রায় সকলেই একমত: এই মুহূর্তে তালিবানদের উপেক্ষা করে আফগানিস্তানে কোনওরকম শাসনব্যবস্থা কল্পনা করাই অসম্ভব। এই কঠিন সত্যিটা ঘাগু মার্কিন কূটনীতিকরা অনেক আগেই বুঝেছেন। ২০১৫-এ বারাক ওবামার সময়কাল থেকেই তাই শান্তিপ্রস্তাবের চেষ্টা হয়ে চলেছে। ২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে দোহায় যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আফগান সরকারের অংশগ্রহণ ছাড়াই তালিবানদের সাথে আলোচনা সারলেন, তখন তাদের এই ক্রমবর্ধমান গুরুত্বকেই মান্যতা দেওয়া হল। তালিবানদের দাবিই ছিল,  তারা আফগানিস্তানের নির্বাচিত সরকারের সাথে কোনও সমঝোতায় যাবে না, বরং সরাসরি আলোচনা সারবে আমেরিকার সঙ্গে। বিদেশি শক্তি সরে যাওয়াটাই তাদের কাছে শান্তির একমাত্র সংজ্ঞা, বাকিটা তারা বুঝে নেবে। কাজেই সেই আলোচনায় যে রফাসূত্র বেরোল, তাকে তালিবানরা তো বটেই, আফগান সরকার, এমনকী মার্কিন সেনার অন্দরেও কেউ কেউ আমেরিকার হার বলেই মেনে নিল। নেবে না-ই বা কেন? মার্কিন সেনা প্রত্যাহার আর ৫০০০ তালিবান বন্দির মুক্তির বিনিময়ে কী মিলল? মিলল তালিবানদের ‘আর হবে না স্যার’ গোছের প্রতিশ্রুতি— তারা আফগানিস্তানের মাটিতে এমন কোনও বিদেশি জঙ্গি সংগঠনকে আশ্রয় দেবে না, যা আমেরিকা বা তার মিত্রশক্তিদের ক্ষতি করার চেষ্টা করে! আফগানিস্তানের মানুষের কথা এখানে কোথায়? উপরন্তু, ইউ এন-এর রিপোর্ট বলছে, এই মুহূর্তে অন্তত ৬০০ আলকায়দা জঙ্গি আফগানিস্তানেই রয়েছে। হ্যাঁ, তাই দিয়ে আপাতত আমেরিকাকে উত্ত্যক্ত করা সম্ভব নয়। সেই কারণেই কি তবে আমেরিকার স্বস্তির নিঃশ্বাস, আর যুদ্ধাবসান ঘোষণা? আসলে ২০২০-র এই চুক্তি যতটা না আফগানিস্তানে শান্তি আনার প্রয়াস, তার চেয়ে অনেক স্পষ্টভাবে আমেরিকার নিজেদের পিঠ বাঁচিয়ে পালাবার পথ। চার পৃষ্ঠার চুক্তিপত্রের ছত্রে ছত্রে সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট!

    নিন্দুকেরা যদিও বলবে আমেরিকা আসলে নিজেদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতেই আফপাক বর্ডারের উপর নজরদারি চালিয়ে যেতে চেয়েছিল, আফগানিস্তানের মানুষদের নিয়ে ওদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। কিন্তু সেই যুক্তি যদি আপাতত অগ্রাহ্য করি, তাহলে তো পড়ে থাকছে সেই একটাই কারণ — গণতন্ত্র

    মোদ্দা কথা, প্রেসিডেন্ট যিনিই হোন, ওবামা, ট্রাম্প, বা বাইডেন — আসল চালিকাশক্তি তো আমেরিকার সেনেট। আর সেখানে বেশ কয়েক বছর ধরেই বাম এবং ডান দুই শিবিরই সরকারের উপর চাপ বাড়াচ্ছিল আফগানিস্তান বাবদ খরচ কমানোর জন্য। মনে করে দেখুন, বাইডেন আর ট্রাম্প দুজনেই তাই নির্বাচনী প্রচারে আফগান যুদ্ধ শেষ করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে করা এক জনমত সমীক্ষা অনুযায়ী, ৭৬% মার্কিন নাগরিকও সেনা প্রত্যাহারের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। সেদেশের সাধারণ করদাতাদের ভারী বয়ে গিয়েছে নিজেদের গাঁটের কড়ি খরচ করে ভিনদেশের ‘অচ্ছে  দিন’ সুনিশ্চিত করতে! কাজেই, ফিরে এসো কাকা।

    এখন প্রশ্ন হল, আফগানিস্তানের কী হবে? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা তিনরকম সম্ভাবনার কথা বলছেন। এক, আফগান সরকার আর তালিবান মিলে একরকম সমঝোতায় পৌঁছল এবং ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নির্মাণ করল ভবিষ্যৎ আফগানিস্তানের রূপরেখা। বর্তমান পরিস্থিতি যা, তাতে এই সম্ভাবনা স্পেকুলেটিভ ফিকশনের মতো শোনাচ্ছে। তার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব বরং দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা — গৃহযুদ্ধ। তালিবানরা নাশকতামূলক কাজকর্মের ঝাঁজ ইতিমধ্যেই বাড়িয়েছে কয়েকগুণ, প্রধান টার্গেট: আফগান সেনা। পাশ্চাত্য সাহায্যপুষ্ট এবং ক্ষমতায় থাকতে বদ্ধপরিকর আশরাফ ঘানির সরকারও সহজে জমি ছেড়ে দেবে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। ফল? আরও ভয়াবহ রক্তক্ষয় ও ধ্বংসলীলা। আর তৃতীয় যে ছবিটা সবচেয়ে সম্ভাব্য বলে মনে হচ্ছে, তার ‘সিজন ওয়ান’ আফগানিস্তানের মানুষ আগেই দেখেছে — পুরোপুরি তালিবানদের কব্জায় দেশ। গোয়েন্দা সংস্থাগুলির পর্যবেক্ষণ বলছে, এমনটা হতে ছ’মাসও সময় লাগবে না। তালিবান নেতারা যদিও বারবার দাবি জানাচ্ছেন, ১৯৯৬-এর তালিবানদের সাথে তাদের গুলিয়ে ফেলাটা ঠিক হবে না, তারা এখন কেবলমাত্র একটা জঙ্গিগোষ্ঠী নয়, একটা পরিণত রাজনৈতিক শক্তি, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তাতে যে আফগানিস্তানের মানুষ স্বস্তির শ্বাস ফেলে নরম গদিতে ঘুমোতে যাচ্ছে, এমনটা একেবারেই নয়। বরং ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। ‘সিজন টু’ রিলিজ করার আগেই তাই ভিসা অফিসগুলোর সামনে লম্বা লাইন। আঠারো হাজারেরও বেশি আফগান নাগরিক আবেদন জানিয়েছেন ‘স্পেশাল ইমিগ্র্যান্ট ভিসা’-য় আমেরিকা যাওয়ার। কাবুলের সচ্ছল পরিবারের তরুণ-তরুণীরা পাড়ি জমাচ্ছেন দুবাই বা ইস্তানবুলে। অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাস ইতিমধ্যে ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছে, বেলজিয়ান এবং ফরাসি কূটনীতিকরা দেশে ফিরে গিয়েছেন। ব্রিটিশ দূতাবাস টুইট করে তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরতে অনুরোধ জানিয়েছে। আফগান সরকার যে ক্রমশ একা হয়ে পড়ছে, সেটা বুঝতে বিশেষ মাথা ঘামাতে হয় না। বাইডেন যতই জানান না কেন, তাঁরা সবরকম সহযোগিতা বজায় রাখবেন, ব্যাপারটা জনপ্রিয় বলিউড জুটির বিবাহবিচ্ছেদের পর ভিডিও বার্তায় সাহচর্য ঘোষণার মতো — সত্যিই তা নতুন পথের দিশারি, না কি স্রেফ চোস্ত অভিনয়, সেটা ভবিষ্যৎ বলবে।

    আপাতত কাবুলের আকাশ থমথমে। পালানোর পথ নেই যাদের, সেই লক্ষ লক্ষ সাধারণ নাগরিক ফ্যালফ্যাল চেয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। সঙ্গে চাপা ক্ষোভ — তাহলে এতদিনের এত ক্ষয়ক্ষতির কী মানে হল? এর চেয়ে আমেরিকা না এলেই ভালো হত, নিজেদের ভবিষ্যৎ আমরা নিজেরাই বুঝে নিতাম! আমজনতার একাংশ আবার নির্বাচিত সরকারের দুর্নীতি আর একগুঁয়েমির চোটে উত্ত্যক্ত, সেই ফাঁকে তালিবানরা বেশ কিছু জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমর্থন জুটিয়ে ফেলেছে। সেটা না পেলেও যে তাদের কিছু আসে-যায়, এমনটা অবশ্য নয়! মোট কথা হল, আফগান সেনা যে একা হাতে তালিবানদের ঠেকাতে পারবে না তা একপ্রকার নিশ্চিত। তাহলে কি যুদ্ধবিক্ষুব্ধ এই দেশগুলোর এটাই ভবিতব্য? ক্লাস মনিটরের জুলুমবাজি থেকে বাঁচতে সিনিয়র দাদাদের সাথে ভাব জমাও? হয় কোনও এক শক্তিধর রাষ্ট্র ঠেকা দিয়ে রাখুক, আর তা নইলে দেশকে তুলে দাও উগ্রপন্থী মৌলবাদী শক্তির হাতে? যেমনটা হয়েছিল ইরাকে — হয় সাদ্দাম নয় আমেরিকা? আপাতত এই জটের সমাধানসূত্র বাতলাতে পারছে না, বা চাইছে না, কোনও রাষ্ট্রই। পৰ্দার আড়াল থেকে খালি জল মাপা চলছে। সেই কুশীলবদের মধ্যে অবশ্যই রয়েছে পাকিস্তান, আছে রাশিয়া, চীন, ভারত, এমনকী ইরানও। প্রত্যেকেরই স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে যে! আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিল অংকের সমীকরণে সবারই তাই আপাতত একটাই পলিসি — wait and watch ।

    তাহলে এই সবকিছুর মধ্যে গণতন্ত্র কোথায়? তার কথা কে ভাবছে? ক্যামেরাটা একটু zoom out করে গোটা মঞ্চটার একটা প্যানোরামা যদি নেওয়া যায়, তাহলে সেই ছবিতে শুধুই দর-কষাকষি, কূটনৈতিক টানাপড়েন আর ক্ষমতার পাঞ্জালড়াই। সেখানে গণতন্ত্র রুক্ষ হিন্দুকুশের মতোই ধূসর ব্যাকগ্রাউন্ড মাত্র। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অমুক ভারী গণতান্ত্রিক আর তমুক শুধু ক্ষমতালোভী এসব বলে আমরা নিজেদের কাজ সহজ করি শুধু।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook