ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • জমকালো জালিয়াত


    পিনাকী ভট্টাচার্য (July 3, 2021)
     

    পাহাড়ে চড়াইয়ের সর্পিল-বিপজ্জনক রাস্তা থেকে ঘোড়া/ খচ্চর/ মানুষ মাঝে মাঝে পড়ে যায় নিচের খাদে। মাঝে মাঝেই। অনেকে মারা যায়, কেউ কেউ বরাতজোরে পাথর বা গাছে আটকে বেঁচেও যায়। কোনও খবরে কিন্তু বলা হয় না এদের কথা। যখন কোনও গাড়ি পড়ে যায়, সেটাও খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় বেরোয়। শুধুমাত্র যখন ধ্বস নেমে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়, তখন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বেরোয় খবরটা—  যাতে সবার নজরে পড়ে। ব্যাঙ্কে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি, জালিয়াতি ব্যাপারটাও এইরকম। ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের ভেতরে টুকটাক জালিয়াতি চলতেই থাকে, যা বাইরের মানুষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জানতে পারেন না— যেমন, inactive account-কে active করে দিয়ে সেখান থেকে টাকা তুলে নেওয়া, কিংবা মৃত মানুষের KYC জমা পড়া আর তাঁর ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে সেই টাকা উঠিয়ে নেওয়া, এমনকী বর্তমানের Cheque Truncated System (CTS)-এ যেহেতু চেক ক্লিয়ারিং-এ পাঠানো হয় না, তাই চেক জমা না দিয়ে কিছু জরুরি তথ্য ট্রাঙ্কেট করে দিলেও পয়সা তুলে নেওয়া যায়। এইসব অভ্যন্তরীণ খুচরো পাপ আর জালিবাজি দেখেও, ব্যাঙ্কগুলো কিল খেয়ে কিল চুরির মতো করে হজম করে নেয়। দেওয়ালে ঝোলা ছোট্ট অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্র আর এক বালতি বালি দিয়ে আগুন নেভায়, কেউ সাসপেন্ড হয়, কারও চাকরি যায়— বাইরের লোক কমই জানতে পারে। যখন ব্যাপারটা বন্ধ ঘরের মধ্যে থাকে না, ঘরের ভেতরের ধোঁয়া বাইরে বেড়িয়ে পড়ে, তখন লোকে জানতে পারে আগুন লেগেছে। যতক্ষণে দমকল এসে পৌঁছয়, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। অমলকান্তির মতো দু’একটা ব্যতিক্রম (বা সৃষ্টিছাড়া) মানুষ বাদ দিয়ে সবাই বড়লোক হতে চায়। শর্টকাটে বড়লোক হতে চাওয়া মানুষদের চাহিদার সুযোগ নিয়েই জালিয়াতরা আগুন লাগায়— যেমন, আমেরিকাতে আগুন লাগিয়েছিল চার্লস পনজি, ফ্রান্সে লাগিয়েছিল ভিক্টর লাস্তিগ বা আমাদের দেশে হর্ষদ মেহতা বা আব্দুল করিম তেলগি। ওদের কপাল মন্দ, তাই ধোঁয়া ফাইলবন্দি না থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল।  

    রুপালি পর্দায় ‘বান্টি আউর বাবলি’তে তাজমহল বিক্রির দৃশ্য দেখে যারা হিন্দি ছবির বাড়াবাড়ি নিয়ে ঠোঁট বাঁকায়, তারা হয়তো অনেকে জানে না, অস্ট্রিয়ার ভিক্টর লাস্তিগ ১৯২৫ সালে ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার বিক্রি করে ৭০,০০০ ফ্রাঁ রোজগার করেছিল! মধ্য-যৌবনের আইফেল টাওয়ার তখন অনেকেরই মাথাব্যথার কারণ ছিল, তার আকাশছোঁয়া রক্ষণাবেক্ষণের খরচের কারণে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা সামলাতে অনেকেই তখন আইফেল টাওয়ার ভেঙে ফেলার পক্ষে— খবরের কাগজে এই খবর পড়ে লাস্তিগ, সরকারি সিলমোহর জাল করে ডাক ও তার বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল সেজে, প্যারিসের এক নামী হোটেলে লোহার ছাঁটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিটিং করে। সেখানে ঘোষণা করে, আইফেল টাওয়ার ভেঙে ফেলা হবে আর তার জন্যে সে একটা টেন্ডার ডাকছে। সেই মিটিং-এ উপস্থিত আদ্রে পয়সোঁকে টেন্ডার পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার কাছ থেকে ৭০,০০০ ফ্রাঁ ঘুষ নিয়ে সে অস্ট্রিয়াতে পালায়। ফেরতও চলে আসে কিছুদিনের মধ্যে। এরপর যখন সে বোঝে, লোকলজ্জার ভয়ে পয়সোঁ তার মুখ খুলবে না— তখন আবার নতুন করে আইফেল টাওয়ার বিক্রির পরিকল্পনা করে। লাস্তিগ শিকার করত চটজলদি বড়লোক হতে চাওয়া লোকেদের— যে-কারণে ইউরোপ বা আমেরিকা প্রায় সবজায়গাতেই সফল হয়েছিল লাস্তিগ। 

    ১৯২৫ সালে অস্ট্রিয়ার ভিক্টর লাস্তিগ ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার বিক্রি করে ৭০,০০০ ফ্রাঁ রোজগার করেছিল

    ইতালি থেকে আমেরিকাতে আসা চার্লস পনজি বিভিন্ন জায়গায় ঠোক্কর খেয়ে আর কানাডার বিভিন্ন জেলে দিন কাটিয়ে যখন প্রায় বীতশ্রদ্ধ, তখন তার হাতে একটা চিঠির সঙ্গে ‘ইন্টারন্যাশনাল রিপ্লাই কুপন’ এসে পড়ে। ঝানু জুয়াড়ি পনজি বোঝে, এই কুপন সোনার খনি— কারণ, অন্য দেশের কুপনের বদলে আমেরিকায় বেশি দামের পোস্টেজ স্ট্যাম্প পাওয়া যায়। পনজি অন্য দেশ থেকে কুপন আনাতে শুরু করে আর তার বিনিময়ে বেশি দামের পোস্টেজ স্ট্যাম্প তুলে বিক্রি করতে শুরু করে। ব্যবসা বাড়াতে মূলধন দরকার, তাই সে বিনিয়োগকারী জোগাড় করতে শুরু করে চড়া সুদের বিনিময়ে— যেখানে একাধিক লোকের কাছে টাকা নিয়ে দ্বিগুণ করে ফেরত দিত, তারা লোভে পড়ে ফাঁদে পা দিয়ে আরও লোক জোগাড় করত, আবার সেখানে কিছু লোক টাকা ফেরত পেত— এইভাবে একটা চেন তৈরি হত, যার আদপে শুরু বা শেষ কিছুই নেই। পনজি ধরা পড়েছিল, ১৪ বছরের জেল হয়েছিল তার। পনজি মারা গিয়েছে ১৯৪৮ সালে— কিন্তু পনজি-স্কিম মারা যায়নি— সেই স্কিম এখনও মানুষ মারছে এই বঙ্গদেশে।    

    নানা ধরণের জালিয়াতির ব্যাবসাকে ‘পনজি-স্কিম’ আখ্যা দেওয়া হয় যার নামে, সেই কুখ্যাত জালিয়াত চার্লস পনজি

    হর্ষদ মেহতা নামের সঙ্গে যে ৪০০০ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি জড়িয়ে আছে, তার বিষয়ে বানানো একের পর এক ওয়েব-সিরিজের জনপ্রিয়তা তার সামান্য অংশ নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে ফেরত দিয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মধ্যে কেউ কেউ আজকাল বলে থাকেন যে, হর্ষদ মেহতা জালিয়াত ছিল না, সে ব্যাঙ্ক আর স্টক একচেঞ্জের নিয়মাবলি আর কর্মপদ্ধতির ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যেখানে নির্দেশ দিয়েছিল যে, দুটো ব্যাঙ্ক সরকারি বন্ডের ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে সরাসরি লেনদেন করবে, ব্যাঙ্করা নিজেদের কাজের সুবিধের জন্যে যদি মাঝে দালাল ব্যবহার করে, আর হর্ষদ মেহতা যদি দালাল হিসেবে তার নিজের সুবিধে দ্যাখে, তাকে দোষ দেওয়া যায় কি? সরকারি ব্যাঙ্কদের যেমন টিকি বাঁধা থাকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে, হর্ষদ মেহতার তো সেরকম কোনও দায়বদ্ধতা ছিল না! তাই ওকে কাঠগড়ায় ওঠানো ঠিক কি না— সেটা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জ সেই সময়ে স্টক ডেলিভারি করতে ১৪ দিন সময় নিত, আর এই ১৪ দিনে শেয়ার অনেক ওঠা-নামা করে। তাই কোনও ব্রোকার যদি এই ১৪ দিনের শেয়ারদরের ওঠা-নামার সুযোগ নেয়, তাকে কি সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায়? শেয়ার বাজার কোনও মন্দির নয়— এখানে লোকে যায় স্রেফ টাকা বহুগুণ করার জন্য। সেখানে এত ছিদ্র থাকবে কেন? হর্ষদ মেহতার জন্যে অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে, অনেকে আত্মহত্যা করেছে যেমন, ঠিক তেমনই হর্ষদ মেহতার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাঙ্ক, স্টক এক্সচেঞ্জকে ঢেলে সংশোধন করা হয়, কড়া হাতে আইন প্রতিষ্ঠা হয়।     

    হর্ষদ মেহতার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাঙ্ক এবং স্টক এক্সচেঞ্জকে ঢেলে সংশোধন করা হয়

    আইন কি সত্যিই প্রতিষ্ঠা হয়েছিল? দুর্নীতিকে কি সত্যিই দূরে রাখা গিয়েছিল? যদি যেত, তাহলে হর্ষদ মেহতার কোম্পানির কর্মচারী কেতন পারেখ হর্ষদ মেহতার ন’বছর বাদে আবার  কীভাবে আর এক জালিয়াতি করল, আর এক কেলেঙ্কারির জন্ম দিল? আব্দুল করিম তেলগি কীভাবে আট বছর ধরে ভারতবর্ষের বুকে জাল স্ট্যাম্প-পেপারের দশ হাজার কোটি টাকার সাম্রাজ্য বিস্তার করল— যে স্ট্যাম্প-পেপার সরকারি কাজে ব্যবহৃত হয়? যে লোকটা পাসপোর্ট আর সরকারি নথি জাল করে জেলে গেল, জেল থেকে বেরিয়ে সে সাম্রাজ্য বিস্তার করে ফেলল, কেউ খেয়াল করল না? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৯৩ থেকে ২০০৩-এর মধ্যে এই দেশ ছ’জন প্রধানমন্ত্রীকে দেখেছে, তিনটে সরকার দেখেছে। এর মধ্যে লোকটা নিজের প্রেস বানাল, সেখান থেকে স্ট্যাম্প-পেপার ছাপল এতগুলো বছর, আর কেউ সেটা দেখল না? তিনশো এজেন্ট নিয়ে ছিল তেলগির সাম্রাজ্য— আট বছর ধরে তিনশো লোক চোখে ধুলো দিল, সবাইকে ঠকাল, কারও নজরে এল না? না কি অনেকেই চোখ বন্ধ করে, মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখেছিল? 

    ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’ ছবিতে লিওনার্দো দ্য কাপ্রিও’র চরিত্রটা বাস্তবের আবাগ্‌নেলকে নিয়ে। গ্রেফতারের পর এফবিআই যেভাবে আবাগ্‌নেলকে ব্যবহার করেছে ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের ফাঁকফোকর ভরাট করার জন্যে, সেইভাবে এই দেশে হর্ষদ মেহতাকে ব্যবহার করা যেত না? যে মানুষটা মাত্র ৩৬ বছর বয়েসেই স্টক এক্সচেঞ্জ আর ব্যাঙ্কিং পরিষেবার দুর্বলতাগুলোকে নগ্ন করে দিতে পেরেছিল! 

    হঠাৎ কেউ বড়লোক হতে পারে না। চটজলদি কেউ পয়সা বানাতে পারে না। চেষ্টা না করাই শ্রেয়, কারণ উঠতে গেলে পড়তে হয়। আর পড়লে উঠে দাঁড়ানো খুব শক্ত। তাই মধ্যপন্থাই সবচেয়ে ভাল মনে হয়— হেঁটে চলো ধ্রুপদী খেয়ালে।   

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook