তখন মার্বেল পেপার কিনতে পাওয়া যেত হরেক রঙের। বেশ পাতলা, ফিনফিনে, মসৃণ আর চকচকে কাগজ। তা দিয়ে বইয়ের বাহারি মলাট হত, স্কুলের কর্মশিক্ষার নানা মডেল হত, আবার রথের রংচঙে দেয়ালও হত দিব্যি। আট আনাতেও একফালি কিনতে পাওয়া যেত এমনকী। আর এক টাকা সামর্থ্য থাকলে তো কথাই নেই, একখানা আস্ত মার্বেল পেপার বগলদাবা করে গর্বিত মুখে পাড়ার রাস্তা দিয়ে বাড়ির পথ ধরা যেত। লাল, হলুদ, সবজে, নীল, কালো, কত রঙেই না পাওয়া যেত সেসব কাগজগুচ্ছকে! আজ আর যায় কি না জানি না অবশ্য।
মার্বেল পেপারের কথা উঠল যদিও রথের ব্যাপারে। বর্ষাকালে যে রথ আসবে, সে আর কে না জানে! আর সেই উপলক্ষে পাড়ার সব কচিকাঁচাদের রথ ক’দিন ঘড়ঘড় শব্দে দখল নেবে ছোটখাটো অলিগলি’র, এও বেশ জানা কথাই। যেটা কেউ আগে থেকে জানে না, সেটা হল এই যে, কার রথ কেমন সাজ নিয়ে বেরোবে। এ-ব্যাপারটা আমরা কেউই কারও কাছে ফাঁস করতাম না, যতই বন্ধু হই না কেন। বরং কেউ জিগ্যেস করলে ঠোঁট উল্টে বলতাম, ‘না রে, এবারে আর সাজাচ্ছি না বেশি’। অথচ বাড়িতে ঢুকলেই মেঝেয় সাজসরঞ্জাম বিছিয়ে থাকতে দেখা যাবে।
এখন এত যে গোপনীয়তা, আদতে শেষমেশ কিন্তু দেখা যেত, সকলের রথ-সাজানোই হরেগড়ে প্রায় একরকম হয়েছে। আর হবে না-ই বা কেন! সকলেই মধ্যবিত্ত, সকলেই পাড়ার একই দোকান থেকে একটু কাগজ আর টুকিটাকি কিনেছে, আর রথও সকলের তিনফুটিয়া। এর মধ্যে কত আর আলাদা হবে কেউ? হ্যাঁ, কারও হয়তো কাগজের শেকল জড়ানো আছে রথের গায়ে, কারও রথের টঙের পতাকাটা কাগজের বদলে কাপড়ের, কেউ নারকেল দড়ির বদলে রথ টানার জন্যে উপহারের মোড়ক থেকে রাংতার ফিতেয় টান দিয়েছে, এই অব্দি। বাকি সব এক। ওই একের মধ্যে আলাদা হওয়াতেই তখন যে কতখানি আনন্দ লুকিয়ে ছিল, আজ আর মেপেজুকে বলতে পারব না।
রথের দিন দশেক আগে থেকেই পাড়ার নানা দোকানে রথ রাখা থাকত। সাধারণ কাঠের রোগাসোগা দুর্বল রথ সব। কেউ কুট্টি সাইজের, কেউ একটু বড়। এসব দোকানেরা হত কেমন, তারা হয়তো কেউ সারা বছর মুদি, কেউ সারা বছর বইপত্র, আবার কেউ সারা বছর মণিহারি। কিন্তু এই সিজন থেকে সেই সিজন-এ বাড়তি পসরা সাজাতে ভুল হত না। রথের বেলায় রথ, বিশ্বকর্মা পুজোর বেলায় ঘুড়ি আর লাটাই, আবার দোল-এর সময়ে রং আর আবির। ছোট আর মধ্যবিত্ত পাড়ায় উদ্বৃত্ত ব্যবসার এই রঙিন অবকাশ ছাড়ত না কেউই। আমাদেরও সেসব দোকান থেকেই রথ কিনে দেওয়া হত। সে-রথের নড়বড়ে চাকা, খরখরে গা-হাত-পা। চারপাশ খোলা সেই রথকে তো দিন তিনেকের মধ্যে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরামের ঘর বানিয়ে তুলতে হবে, নাকি? তাই মার্বেল পেপার ছড়িয়ে থাকত আমাদের মেঝে জুড়ে।
গড়িয়ায় বাড়ি তখন। বারো পা হাঁটলেই রথতলা, সেখানে দিন পনেরো জুড়ে রথের বিরাট মেলা বসে। কত কী বিক্কিরি হয়! পুতুল থেকে গয়না, গাছপালা থেকে আসবাব, হরেক জিনিসে সেজে ওঠে পথের দু’ধার। আর থাকে নানান ধরনের খাওয়া-দাওয়া। পাঁপড় তো পরম্পরা। সে বাদ দিয়েও পাওয়া যেত না এমন খাবার নেই। জিলিপি থেকে বেগুনি-আলুর চপ, শোনপাপড়ি থেকে আম-লেবু-জলপাইয়ের আচার, সব পাওয়া যাবে সেখানে। তা সেই মেলা থেকেই ছোট্টখাট্টো তিন ঠাকুরকে কিনে এনে ভারি যত্নে বসানো হত রথের এক-এক তলায়। তারপর তিনমহলা রথের এ-থাম থেকে ও-থাম টেনে দেওয়া হত মার্বেল পেপারের দেয়াল। হয়তো জগন্নাথ পেলেন নীল দেয়ালের ঘর, সুভদ্রা লাল দেয়ালের, আর বলরামের ভাগে পড়ল হলুদ দেওয়াল। আর ওই যে বললাম, বাড়তি বাজেট থাকলে নানা রঙের কাগজিয়া শেকল ছড়িয়ে পড়ত রথের চুড়ো থেকে মাটি অবধি। সে যে কী শোভা!
কিন্তু এত যে আয়োজন, এসব কিছুর চিরশত্তুর হয়ে বৃষ্টি শেষমেশ নামবেই, এও ছিল আমাদের জানা। রথ মানেই আকাশ ঘন কালো হতে শুরু করবে সকাল থেকে, হয় দুপুর নয় বিকেলের দিকে পাড়া ঝাপসা করে ঝামরে নামবে ঝমঝম বৃষ্টির দল। আমরা তাই সকাল-সকাল একদফা রথ টেনে নিতাম। যেন অভিজাত মর্নিং ওয়াক। আর সেই চলার পথে বন্ধুদের সকলের সঙ্গেই দেখা হয়ে যেত। তাদের রথের দিকে আড়চোখে এমনভাবে তাকাতাম, যেন হয়নি কিছুই। এ-তাকানো অবশ্য সকলেই আয়ত্ত করেছিলাম ওই বয়সে।
বিকেলের পর হত মুশকিল। বাবা বা মায়ের ভাঙা ছাতা মাথায় বেরিয়েছি সকলে রথ টানতে, কারও মার্বেল পেপার ভিজে নেতিয়ে একদিকের দেয়াল খসে পড়ল, কারও রাংতার দড়ি হাতছাড়া হল জল লেগে, আবার জগন্নাথের সামনে রাখা ছোট রেকাবির গুটিকয় নকুলদানা গলে গিয়ে একশা হল কারও। এসব কোল্যাটেরাল ড্যামেজে কিন্তু আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়াতাম। দু’পিস নকুলদানা ধার দেওয়া, বা বাড়ি থেকে একছুটে একফালি মার্বেল পেপার আর গঁদের আঠা এনে দিয়ে তড়িঘড়ি নতুন দেওয়াল তোলা, এ আমাদের প্রতিবারের ব্যাপার ছিল। বিপদ যে মানুষকে সম্প্রদায়ে পরিণত করে, সেটা আমরা সে-বয়সেই বুঝতে পেরেছিলাম।
আমার রথ অবশ্য আরেকটু বাড়তি আনন্দ দিয়ে যেত প্রতিবার। সেই কথায় আসি বরং। পাড়ার রথ তো প্রথমদিন হয়ে গেল। কিন্তু একদিনে তো আর রথ শেষ হয় না, সে চলবে সেই উল্টোরথ পর্যন্ত। আমার মাসি’র বাড়ি চেতলায়। সারা বছর মাসি-মেসো আর ছোট বোনকে যে-পাড়ায় থাকতে দেখতাম, সেই পাড়াই চেহারা বদলে ফেলত রথের দিনগুলোয়। রথতলা যেমন সেজে উঠত ছোটখাটো উৎসব হয়ে, রাসবিহারী মোড় থেকে চেতলা পর্যন্ত রাস্তার দু’ধার হয়ে উঠত এক আলাদা পৃথিবী। তাকে আর চেতলা বলে চেনা যেত না তখন। তা হত কী, রথের এই ক’দিনের মধ্যে এক কি দু’খানা দিন আমরা মাসির বাড়িতে কাটাতামই। একটু আড্ডা হইচইও হবে, আবার দু’বেলা জমিয়ে মেলায় ঘোরাও হবে।
চেতলার মেলায় পসারা’র যে-ব্যাপ্তি, তা অবশ্য লিখে শেষ করা দুঃসাধ্য। বরং বলতে পারি উট বা জমি বিক্কিরি হত না। বাকি প্রায় সব কিছুই দেখেছি। কথা-বলা কাকাতুয়া থেকে জলে-চলা ক্যানেস্তারার ভটভটি, সব। কেনার সাধ্য আর থাকত কই অত কিছু, কিন্তু সন্ধের পর টিপটিপে রাস্তায় পায়ের ছাপ ফেলে, আলতো মাথা ভিজিয়ে সেই মেলার এ’পাশ ও’পাশ ঘুরে দেখার আনন্দই ছিল অনেকখানি। আমি আর বোন মাসির হাত ধরে, বা কাছাকাছি হলে একা একাই দেখতাম সেসব।
একবার দেখলাম এক ব্যাপারী ভারি মজার জিনিস বেচছেন। এক বিঘত লম্বা প্লাস্টিকের একজন মেয়ে। নাহ, কেবল পুতুল নয়, সে তো কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলে মেলা ভর্তি হয়ে আছে। ইনি এনেছেন এক অন্য ব্যাপার। সেই পুতুলের গায়ে পলিথিনের ছোট্ট প্যারাসুট জড়ানো আছে, যা তার পিঠের সঙ্গে সস্তা সুতো দিয়েই বাঁধা। সঙ্গে গুলতির চেয়ে একটু বড় একখানা জিনিসও বেচছেন। সেই গুলতির মাথায় পুতুলটাকে ফিট করে আকাশের দিকে তাক নিয়ে ছুড়ে দিচ্ছেন অনেক উপরে। আর তাঁকে ঘিরে দাঁড়ানো বাচ্চারা, আমরা, দেখছি, সে-পুতুল দিব্যি বাধ্য মেয়ের মতো ফুলকো প্যারাসুটের মধ্যে বর্ষার বাতাস ভরে নিয়ে দুলতে দুলতে নেমে আসছে সেই ব্যাপারীরই অপেক্ষমান হাতে। এ তো বড় কম মজার ব্যাপার নয়!
সে-বছর আমি আর বোন বায়না ধরলাম, রথে আর কিছু চাই না, কিন্তু ওই প্যারাসুট-পুতুল আমাদের দিতেই হবে। ভাগ্যিস জাগতিক দাম বেশি ছিল না তার, আমাদের দুই মা মিলে এক সন্ধেবেলা কিনে দিলেন দু’খানা। সেদিনও বৃষ্টি পড়ছে খুব। টিমটিমে সব আলোর তরল ছায়া লেগে ভেজা রাস্তাঘাট গলে যাচ্ছে আরোই। তারই মধ্যে তাকে বাঁচিয়ে ফিরে এলাম মাসির একতলা বাড়ির আওতায়। তারপর কেবল বৃষ্টি থামার অপেক্ষা। মিনিট দশেকের জন্যে সে থামলেও আমি আর বোন বাড়ির ছোট্ট চৌকো উঠোনে গিয়ে আকাশের নীলচে মেঘলা বর্গক্ষেত্রের দিকে ছুড়ে দিচ্ছি তাকে, আর সেও সিল্যুয়েট-পরি হয়ে স্বপ্নের মধ্যে ভাসমান নেমে আসছে যেন। প্রাণ নেই তার শরীরে, অথচ কত সহজেই সে আমাদের দুই ভাইবোনকে সম্মোহন করে ফেলেছিল, সেই অলীক বর্ষাকালে।
আমার সে-সম্মোহন বেশিদিন সইল না যদিও। সেবার রথেই, নিজের পাড়ায় ফিরে আসার পর, আরও এক বৃষ্টির জমাট সন্ধেবেলা পাড়ার আকাশে তুলে দিয়েছিলাম তাকে। নিয়মমাফিক রুটম্যাপ মেনে হাতের পাতায় ঠিক নেমে আসবে, এই ভেবে। কিন্তু সেদিন সে আর নামল না। মনে আছে, এমন অবাক আমি বহুদিন হইনি। যার পিঠে বাঁধা আছে প্যারাসুট, যার শরীরে প্রতিষ্ঠিত আছে নিষ্প্রাণ, সে আমার এত মায়া কাটিয়ে গেল কোথায়? বর্ষার মেঘ তাকে খেয়ে নিল, নাকি উড়িয়ে নিল রথের ভেজা বাতাস? কে জানে…
সেদিন অনেক দেরিসন্ধে অবধি তাকে পাড়ার পথে পথে খুঁজেছিলাম, ছাতার আড়াল ছাড়িয়ে। যখন ভিজে চুপ্পুস হয়ে গেছি, তখনও তাকে পাইনি। আর মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে, ছোট্ট একটা পুতুল এভাবে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। সেই থেকে আর আকাশের দিকে ছুড়ে দিইনি কাউকে। নেমে আসার ভরসায়। বরং বারবার নিজেকেই ছুড়ে দিয়ে লুফে নিতে শিখে গেছি কখন। যেদিন আর নেমে আসব না নিজেকে তাক করে, বুঝব, বর্ষার আকাশ আমাকে ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে, হারিয়ে যাবার…
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র