নামই হয়ে গেল তার হাফ প্যাডেল। অলিম্পিকে যদি হাফ প্যাডেল সাইকেল রেস হত, নিঃসন্দেহে দেশের জন্য সোনা আনত শুভ। এমনই তার দক্ষতা।
আর হবে না-ই বা কেন, সময় তো সে কম কাটায় না ওইভাবে! মানে, সাইকেলের খাঁচাটার মাঝে আটকে পড়া বাদুড়ের মতো ঝুলে থেকে। বাবা কারখানা থেকে ফিরে সাইকেলটা রাখলেই হল। অমনি শুভ সুট করে বেরিয়ে পড়বে সাইকেলটা নিয়ে। তারপর আর তাকে পায় কে! আগে তো শুধু পাড়ার মাঠেই গোল গোল ঘুরত। এখন পাড়া ছাড়িয়ে চলে যায় এপাড়া-ওপাড়া-বেপাড়া। এমনকী পৌরসভার গণ্ডি ছাড়িয়ে পঞ্চায়েত এলাকার ক্ষেতচেরা রোডেও চলে যায় কোনও কোনও দিন। তখন সামনে শুধু দিগন্ত। আকাশ আর মাটি যেখানে সরলরেখায় ছুঁয়ে আছে একে অপরকে। শুভর মনে হয়, ওখানে পৌঁছতে পারলেই সে হাতের কাছে পেয়ে যাবে আকাশটাকে। তখন সে সাইকেল তুলেই দেবে আকাশে। ভেসে পড়বে উড়ন্ত কলের মতো।
কিন্তু দেরি করে ঘরে ফিরে যখন পাছায় ছপটির বাড়ি খায়, তখন চিৎকার করতে থাকে, ‘আর হবে না, আর হবে না। আর মেরো না মা গো। আর…।’
তবে তার বাবা ভীষণ ভাল। মায়ের হাত থেকে ছপটিটা কেড়ে নিয়ে বলে, ‘আর হবে না কেন রে? তুই না বড় হয়ে সাইক্লিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখিস!’
সত্যিই তো! শুভ একদিন এই রকম হবে। দেয়ালে টাঙানো ওই ছবিটার মতো। যেন জলজ্যান্ত একটা রোবট বসে আছে সাইকেলের ওপর। হাতে গ্লাভস, পায়ে জুতো, টাইট ফিট কস্টিউম। আর মাথায় এলিয়েনদের মতো হেলমেট। যেন এক ছাঁচে তৈরি একটা মডেল। তার পেছনে উত্তাল গ্যালারি। গতির চোটে ঘষা ছবির মতো লাগছে দর্শক-সমর্থকদের।
শুভর বাবা ওকে একটা ছোট সাইকেল কিনে দিতে চেয়েছিল। ওর মাপে। কিন্তু শুভই রাজি হয়নি। কারণ সে তার মান নামাতে চায় না। বরং সে-ই বড় হয়ে উঠতে চায় তাড়াতাড়ি আর চড়ে বসতে চায় সিটের ওপর। তার তো আর বেশি দেরিও নেই। তার বন্ধুরা বেশির ভাগই তো ফুল প্যাডেল চালাতে পারে। সে-ই যা একটু বাড়ছে কম। চিন্তা নেই। কমপ্ল্যান খাচ্ছে সেও নিয়মিত!
কিন্তু হলে কী হবে, সাইকেল রেসে শুভই জেতে বরাবর। সে হাফ প্যাডেলেই যা চালায়, বন্ধুরা ফুল প্যাডেলেও পারে না। এই বছরেই তো পাড়ার ক্লাবে স্পোর্টস হল। সাইকেল রেস ছিল না। কিন্তু শুভর কথা ভেবেই সাইকেল রেস রাখা হল লিস্টে। আসলে গোটা পাড়াই মুগ্ধ শুভর সাইকেল-প্রেম দেখে। তাই আর কি!
আর হলও তাই। শুভ হাফ প্যাডেলেই বাজিমাত করল। এমনকী বয়সেরও কোনও বাধা ছিল না। রীতিমতো ক্লাবের বড় ছেলেরাও নাম দিয়েছিল। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন সেই শুভই। হাফ প্যাডেলেই। এরপর যদি তার নাম হয়ে যায় হাফ প্যাডেল, দোষ কি কাউকে দেওয়া যায়!
শুভ যে ফুল প্যাডেল পারে না, তা কিন্তু নয়। সে সিটের ওপর সোজা হয়ে বসে দিব্যি সাইকেল চালাতে পারে। শখের ঘোরাঘুরিতে কোনও বাধা নেই তাতে। কিন্তু ওভাবে তো আর রেস দেওয়া যায় না। কারণ প্যাডেল পা ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আবার ঘুরে পায়ের কাছে ফিরে এলে তবেই সে চাপ দিতে পারে। এভাবে তো আর গতি তোলা সম্ভব নয়।
ওর স্কুলের বন্ধু সমু সমাধানও বার করেছে একটা। সে মাপজোখ নিয়ে দেখেছে মাত্র পাঁচ ইঞ্চির জন্য শুভ প্যাডেলে পা পাচ্ছে না। সমু করেছে কী, শুভর চটির তলায় পাঁচ ইঞ্চি চওড়া একটা সুখতলা লাগিয়ে দিয়েছে। থার্মোকলের। হালকা অথচ কার্যকরী। টিভির প্যাকিং বাক্সে পেয়েছিল জিনিসটা।
সেই চটি পায়ে দিয়ে সাইকেলে চড়ে তো শুভর মহাফুর্তি! প্যাডেল আর মোটেই পা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে না। দিব্যি চাপ দিতে পারছে নাগাড়ে। আর তেমনি উঠছে গতিও। যদিও সড়গড় হতে সময় একটু লেগেছিল শুভর, কিন্তু সড়গড় হওয়ার পর সবার আগে সে সমুকেই পরাস্ত করল ফুল প্যাডেলে। তাতে সমুর মতো আনন্দ আর কেউ পায়নি। আসলে তো তার-ই উদ্ভাবনী বুদ্ধির জয়। সৃষ্টির কাছে পরাস্ত হওয়ার চেয়ে বড় সুখ স্রষ্টার আর নেই।
সমু তার সুখতলা চেঁছে-ছুলে রং করে আরও নিখুঁত করে দিল। চটির রঙে রং। কালো। দূর থেকে আর বোঝাই যায় না। এমনকী খেয়াল না করলে কাছ থেকেও না। মনে হয় দুই বন্ধু দিব্যি পাশাপাশি সাইকেল চালিয়ে দিগন্তরেখার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে হয়তো তখন চাঁদের মতো ঠান্ডা একটা সূর্য। সরাসরি তাকানো যায় তার দিকে। চোখে চোখ রেখে বলা যায়, একটু দাঁড়াও, আসছি!
সমুও উৎসাহিত হয়ে বলে, ‘চল তবে ধরি।’
‘চল, চল ধরি। আজ দুজনে মিলে সূর্য ধরি।’
সূর্যও তেমনি। ওদের দেখেই চোঁ-চাঁ করে নামতে শুরু করেছে মাটির দিকে। আর এদিকে গতি তুলেছে শুভ। আড়ালে যাওয়ার আগেই সে ধরবে ওকে। যেন মরণপণ করেছে ছেলে। সমুর চালাকির ওপর নির্ভর করে সে রেসে নেমেছে সূর্যের সঙ্গে। হয়তো একথা জেনেই যে, এ দৌড় সে জিতবে না। আসলে তো প্রতিদ্বন্দ্বিতা সূর্যের সঙ্গে নয়। লড়াইটা তার নিজেরই সঙ্গে। নিজের অপূর্ণতার সঙ্গে। তাই হয়তো নিজেই নিজেকে হারানোর জেদে পাগল হয়ে গেছে শুভ। গতি তুলেছে পাগলের মতো।
সমু পিছিয়ে পড়ে অসহায় স্বরে ডাকে, ‘শুভ, অত জোরে চালাস না। দাঁড়া।’
কিন্তু শুভ ততক্ষণে বহুদূর এগিয়ে গেছে সূর্যের দিকে। যদিও সূর্য মাটি ছুঁয়ে ফেলেছে। কমে গেছে তার আলো। যেন সব আলো সে গুটিয়ে নিয়েছে নিজের ভেতর। তাই শুধু সে নিজেই তখনও আলোকিত। বাকি সব ঢাকা পড়েছে কালচে ছোপে। মাটি, রাস্তা, দু’পাশের ক্ষেত। আর শুভ।
সমু ডুবন্ত সূর্যের দিকে এগোতে থাকে, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে থেকে-থেকে বন্ধুর নাম ধরে লম্বা ডাক দেয়, ‘শুভ…!’
তারপর অন্ধকার নেমে আসে চারিদিক কালো করে। শুভর মতো সমুও হারিয়ে যায় গ্রামের রাস্তায়। কোনও দিকে আর সে দিশা পায় না এগোনোর। এমনকী পিছোনোরও। গ্রামের অন্ধকার শহরের মতো নয়। কোথাও তার ছেঁড়াফাটা নেই যে, উঁকিঝুঁকি দিয়ে পার পেয়ে যাবে। অগত্যা সমু অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তার ধারে। কাঁদো-কাঁদো মুখ করে।
অনেকক্ষণ পর একটা তীব্র আলো সগর্জনে এগিয়ে আসে তার দিকে আর থেমে যায় তার একদম কাছে এসে। আলোর আড়াল থেকে একটা চেনা কণ্ঠ বলে, ‘কী করছিস এখানে দাঁড়িয়ে?’
সমুর কাকা। বাড়ি ফিরছে না দেখে খুঁজতে বেরিয়েছে।
এরপর শুভকে খুঁজে পেতে আর সময় লাগে না। সে বাঁকের মুখে রাস্তার পাশে ক্ষেতের মধ্যে পড়েছিল সংজ্ঞাহীন হয়ে। কিন্তু শুভর আর সে রাতে বাড়ি ফেরা হয় না। কারণ পড়ে গিয়ে তার পা ভেঙেছে। সোজা তাকে নেওয়া হয় হাসপাতালে। সেখান থেকে তিনদিন পর সে বাড়ি আসে পায়ে প্লাস্টার নিয়ে।
সমু দেখতে আসে। শুভর বিছানার পাশে বসে সাবধানে। প্লাস্টার আলতো ছুঁয়ে বলে, ‘ব্যথা?’
শুভ হেসে বলে, ‘না।’
‘পড়ে গেলি কী করে?’
‘কী জানি! মনে হল ম্যাজিক দেখলাম!’
‘ম্যাজিক!’
শুভ তার সেই অলৌকিক রেসের গল্প বলে সমুকে। সূর্য তখন অর্ধেক গেঁথে গেছে মাটিতে। মাত্র অর্ধেকটাই তার সে দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে। আর বুঝতে পারছে, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে মিলিয়ে যাবে চোখের সামনে থেকে।
শুভ তখন সর্বশক্তি দিয়ে প্যাডেলে চাপ দেয়। উল্টোদিক থেকে তীব্র বেগে ধেয়ে আসে বাতাস। সেই বাতাসের স্রোত এক সময় মনে হল তাকে শূন্যে তুলে নিয়েছে। তার সাইকেলের চাকা আর মাটিতে নেই। সত্যি-সত্যিই বাতাসে ভেসে পড়েছে তার সাইকেল। আর সে রকেটের বেগে ধেয়ে যাচ্ছে সূর্যের দিকে। মনে হচ্ছে সে ধরেই ফেলবে তাকে। আর তখনই হঠাৎ খুলে যায় তার থার্মোকলের সুখতলা। সে আছড়ে পড়ে মাটিতে।
সমু বিষণ্ণ স্বরে বলে, ‘ওহ! তাহলে তো আমারই দোষ!’
‘তোর দোষ কী রে! তোর জন্যই তো আরেকটু হলে আমি ধরে ফেলেছিলাম ব্যাটাকে।’
‘কিন্তু এখন তো পা ভেঙে বিছানায় পড়লি!’
‘ভাবিস না। সেরে যাব শিগগিরই। তারপর আবার যাব। যাবি তো আমার সঙ্গে, সমু?’
সমু অনিশ্চিত স্বরে বলে, ‘যাব!’
কিন্তু সমু আর যায় না। তার বাবা হঠাৎ বদলি হয়ে যান। তারা ভাড়াবাড়ি ছেড়ে সপরিবারে চলে যায় কোথাও। শুভ ঠিক জানেও না কোথায়।
তারপর বহু বছর আর দুই বন্ধুর যোগাযোগ নেই। শুভ ভাবে সমু নিশ্চয়ই বড় বিজ্ঞানী হয়েছে এতদিনে। অনেক কিছু হয়তো আবিষ্কার করেছে তার সেই জুতোর সুখতলার মতো। আর সমু ইন্টারনেটে শুভকে খোঁজে। ভাবে নিশ্চয়ই অনেক নাম করেছে এতদিনে। সূর্যের মতো মেডেলে মেডেলে ভরিয়ে ফেলেছে বাড়ি। হয়তো দেশের হয়ে সোনার সূর্য ধরতে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছে শুভ। কিন্তু তার কোনও নামগন্ধও সে খুঁজে পায় না গুগলে। এমনকী ফেসবুকেও সে নেই।
এতদিনে একটা স্মার্টফোন কিনতে পেরেছে শুভও। সেও এবার সমুকে খোঁজে ফেসবুকে। আর খুঁজে পায় সহজেই। উজ্জ্বল-হাসিমুখ পরিবারের ছবিতে ছড়াছড়ি সমুর প্রোফাইল। বিয়ে করেছে। বাচ্চাও ধরে আছে কোলে। ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাট। গাড়ি করে এদিক-সেদিক ঘোরার অসংখ্য ছবি।
ভাবে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবে। কিন্তু পাঠায় না। মেসেঞ্জারে বার্তা! তাও না। শেষে ভাবে সরাসরি কল করবে মেসেঞ্জারে। কিন্তু শুভ সেই জোরটাও অনেক চেষ্টা করে জুগিয়ে উঠতে পারে না। অথচ রোজ রাতে শুভ ঘুমোনোর আগে মোবাইল ঘাঁটে। ঘাঁটতে ঘাঁটতে একবার না একবার সমুকেও দেখে সে। তারপর আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তার তাঁবুর ভেতর পাতা ক্যাম্পখাটে।
সেদিনও ঘুমোতেই যাচ্ছিল, হঠাৎ অদ্ভুত শব্দে বেজে ওঠে মোবাইল ফোনটা। তুলে দেখে তার স্ক্রিন জুড়ে সমুর গোটা পরিবার। সবাই তার দিকে চেয়ে আছে হাসিমুখে। যেন বলছে, ফোনটা ধরো! কথা বলো!
শুভ ফোনটা ধরে। কেমন যেন ভয়ে ভয়ে বলে, ‘হ্যালো!’
ওপাশে সমুর উচ্ছ্বাস-ভরা গলা, ‘কী রে, কেমন আছিস? নেটে তোকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। অবশেষে ফেসবুকে তোকে পেলাম। সেও তো মনে হয়…!’
অনর্গল কথা বলে যায় সমু। শুনে যায় শুভ। কতক্ষণ পর সমু থামে। দম নিয়ে বলে, ‘সাইকেল চালাস?’
শুভ বেশ কিছুক্ষণ নিরুত্তর থাকে। তারপর বিষণ্ণ স্বরে বলে, ‘চালাই!’
‘চালাস! কোথায় কোথায় চালিয়েছিস? বিদেশে গেছিস?’
‘না।’
‘তবে?’
বিকট এক নীরবতার পর শুভ বলে, ‘আমি সার্কাসে সাইকেল চালাই।’
‘মানে?’
শুভ বলে, ‘ছবি পাঠাচ্ছি দেখে নে।’
সমুর মোবাইলে শুভর ছবি ঢোকে।
চকরা-বকরা, রংচঙে পোশাক পরা এক ক্লাউন। ঝুমকোওলা টুপি আর নকল নাক পরে সাইকেল চালাচ্ছে। উচ্চতা বড়জোর চার ফুট হবে। যেমন সে শেষ দেখেছিল তাকে। সেই ছোটবেলায়, যখন সে স্বপ্ন দেখত, বড় হয়ে একদিন বিশ্বজয় করবে ফুল প্যাডেল সাইকেল চালিয়ে!
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী