মরণের চক্রব্যূহে একা
যেন বেঁচে আছি এক বাতাবিলেবুর গ্রহে, পৃথিবী নামক এক ফুটবল-প্রদেশে। ইউরোপ আর দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল মহামঞ্চের আঁচ তাতিয়ে দিচ্ছে পৃথিবী। অথচ মৃত্যু ফের ওত পেতে ফিরছে সারা দেশে। আবার লকডাউনে অচল, স্থবির, আর সুতো ছাড়া ঘুড়ির মতো হয়ে আছে নগর থেকে গ্রাম। একদিকে মরণের ডঙ্কা আর অপরদিকে ফুটবলের তিরতিরে কম্পন, আমাদের দুই হাতে যেন দুই আদিম পাথর।
মনে হচ্ছিল যেন ঠিকঠাক হয়ে আসছে সবকিছু। ধীরে ধীরে সচল হয়ে উঠছিল সারা দেশ। বৃষ্টিবিহীন সন্তাপ পার হয়ে বৃষ্টিও এল। আমন আর আউশ ধান রোপণের মতো নরম হয়ে উঠেছিল মাটি ও মন। কিন্তু যেন এর জন্যই অপেক্ষা করেছিল মারী, মড়ক, মন্বন্তর। মাত্র দু’সপ্তাহে তরতর করে মহামারীর প্রকোপ আবার পালটে দিল হাওয়া। আবার লকডাউন আসবে, বন্ধ থাকবে কাজ, জীবিকা হয়ে পড়বে অনিশ্চিত, এই ভেবে হুড়মুড় করে ফের শহর ছাড়ল লোকে। এ যেন এক চক্রাকার অলঙ্ঘনীয় বৃত্তে ঢুকে পড়েছে দেশ। জনসমাগম ঠেকাতে লকডাউন করা হয়, অথচ ঢাকা থেকে পড়ি কি মরি করে ছুটতে থাকে নিরুপায় মানুষ। চলাচল ঠেকাতে পুলিশের সঙ্গে এবার মোতায়েন হয়েছে সেনাবাহিনী। একেবারে জরুরি না হলে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ। তবু তো জীবন থাকে, কাজ থাকে, মানুষ পথে নামে, শয়ে শয়ে গ্রেফতারও হয়। শহরের সমস্ত মহাসড়ক মৃত অজগরের মতো নিঃসাড়। মাঝে মাঝে অনিচ্ছুক বৃষ্টি হয়, তাতে কর্পোরেশনের ব্যর্থ ড্রেন থেকে উপচে পড়া জল থইথই করে। সকলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দ্যাখে, কেউ পার হয় না। ক্লান্ত চোখে সকলে মৃত্যুর খোঁজ নেয়। মৃত্যু এখন মৃত্যু নয়, কেবলই পরিসংখ্যান। এরও মাঝে লোকে রাত জাগে, সকালে কাজ নেই, অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই। ঢুলুঢুলু চোখে বাস্তবতা থেকে তাদের বাঁচিয়ে রাখে ফুটবল। ব্রাজিল কি জানে পৃথিবীতে এমন এক দেশ আছে যেখানে বাড়িতে বাড়িতে তাদের পতাকা ঝুলিয়ে রাখা হয়? আর্জেন্টিনা কি জানে যে বোর্হেসের আরেক জাদুপৃথিবী তৈরি হয়ে আছে পৃথিবীর আর এক সীমানায়? যেখানে কোনও কোনও লোকের পেশা আর্জেন্টিনার পতাকা ও লিওনেল মেসির জার্সি বিক্রি করা? সেখানে বহু দালানের রং আকাশি-সাদা? রিকশাচালকের সমস্ত রিকশায় খচিত মারাদোনার ছবি? তাঁর অকাল-বিদায় খচিত হয়ে আছে অশ্রুর আল্পনায়? মারাদোনাবিহীন পৃথিবী কী করুণ হয়ে আছে এখন! গতকাল খবর পেলাম এই দুই দেশের সমর্থকেরা দেশের নানা জেলায় মারামারি করে হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
২.
৬৫ বছরের এক বৃদ্ধা আছিয়া বেগম। বৃষ্টিতে দু’ঘণ্টা হেঁটে লালমাটিয়া থেকে আমিন বাজার পর্যন্ত গেছেন। পথে গাড়ি নেই। এক বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন। লকডাউনে তাঁর কাজের কামাই নেই। তিনি জানেন না সরকারি আইনে কী আছে, শুধু জানেন পথে গাড়িঘোড়া নেই। এসব খবরে ভরে থাকে আমাদের খবরের পাতা। আহারের জোগাড় হয়নি, তাই তিন সন্তানকে খুন করেছেন বাবা। কিংবা কাজ না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন মজদুর। এসবের কোনটা সত্য আর কোনটা অতিরঞ্জন আমরা জানি না। কিন্তু এও তো সত্য— ব্যবসাপত্র স্থবির, দিনমজুরের কাছে কাজ নেই, কাজ নেই আরও বহু পেশার মানুষের। অথচ কিছু না থাকলেও খিদে থাকে, খিদের চারপাশে ভিড় করে থাকা মানুষেরা থাকে। আর মাত্র দেড় সপ্তাহ পরে ঈদ। কোরবানির ঈদে জামাকাপড় কেনার হিড়িক থাকে কম। মনযোগ থাকে পশুবাজারে। এবার কী করে বসবে পশুর হাট? মানুষ কি যেতে পারবে পরিবারের কাছে? শহরের চাইতে এখন গ্রামে মহামারীর প্রকোপ বেশি, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর হাসপাতালে উপচে পড়ছে রোগী, মৃতদেহে ভরাট হয়ে যাচ্ছে সমাধিস্থল।
কুষ্টিয়ায় ৭০ বছরের প্রফুল্ল কর্মকার কোভিডে মারা গেছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম কল্পনা। স্বামীর মৃতদেহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শ্মশানে পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে। শবদেহ বাড়িতে নেওয়া যায়নি, কেননা বাড়িতে সকলে কোভিডে আক্রান্ত। বাড়ির লোক কেউ আসতে পারেনি শ্মশানে। কিন্তু শ্মশানে দাহ করার লোক নেই। এর মধ্যে বৃষ্টির দুর্যোগ। কল্পনা কর্মকার স্বামীর মৃতদেহ একাই টেনে টেনে পাশের এক স্কুলের বারান্দায় নিয়ে গেলেন। সমস্ত রাত সেই শবদেহ একা একা আগলে বসে রইলেন। জীবনসঙ্গীর মৃতদেহের পাশে বসে নিঃসঙ্গ কল্পনা কর্মকার সমস্ত রাত বৃষ্টিতে কিছু কি কল্পনা করেছিলেন? এর উত্তর আমাদের জানা নেই। বৃষ্টিতে অশ্রু ঠাহর করা যায় না।
কোনও কোনও খবর মিশ্র অনুভূতি নিয়ে আসে। গুলিস্তানে এক ছোট ভাতের হোটেলে কাজ করতেন এক তরুণ। তাঁকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে শাহবাগ থানায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঢুকে সে এক রোগীর মানিব্যাগ চুরি করেছে। সুবিধা হয়নি। নিরাপত্তারক্ষীরা ধরে তাঁর গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়েছে, ‘আমি চোর। আমাকে চিনে রাখুন।’ এরপর বিচারের কারণে পাঠানো হয়েছে শাহবাগ থানায়। থানার ওসি সাহেব অনুসন্ধানে জানলেন, মানিব্যাগ চুরি করা তরুণের উদ্দেশ্য ছিল না। যে হোটেলে সে কাজ করত, সেটা বন্ধ হওয়ায় সেখান থেকে তার কাজ চলে গেছে। দু’দিন ধরে দানাপানি নেই। ঢাকা মেডিক্যালে ঢুকেছিল চেয়েচিন্তে বা চুরি করে খাবার পাওয়ার আশায়। সেখানে ক্যান্টিন আছে, রোগীদের নানারকম খাবারের বন্দোবস্ত আছে। কিন্তু খাবার খুঁজতে গিয়ে এক রোগীর মানিব্যাগ পড়ল চোখে, এটা নেওয়াই সহজ মনে হল তার। সমস্ত শুনে ওসি সাহেব হাতকড়া খুলে তরুণকে খাবার দিলেন, এরপর কোথাও একটা কাজের সুপারিশ করে তাকে ছেড়ে দিলেন। এই তো আমাদের প্রত্যাশা ছিল। আমার রাষ্ট্রে পুলিশ হবে পাখিদের প্রতিনিধি!
৩.
গত এক সপ্তাহে বই পড়লাম গোটা চারেক, তার মানে অবিরাম, আর সিনেমা দেখেছি ছ’সাতটা। বাকি সময় বিছানায় নির্ঘুম কাটিয়েছি। তবু এসবই অসারতা। সিনেমা দেখে কোনও গান মনে পড়েনি। মগজের ভেতর দিয়ে কেবল জাহাজ ঘুরে যায়, দাঁড় বায় অগণিত পাথরের ইঁদুর! শরীরের ভেতর টের পাই, কোথা থেকে সবুজ রক্ত ঢুকে গেছে, হাতে-পায়ে গজিয়ে উঠছে শৈবাল…
শুনেছি, লোকে বলাবলি করছিল, বৃষ্টি হচ্ছে খুব শহরে, তাদের পথঘাট ডুবে গেছে, বাড়ি ফেরা ডুবে গেছে, ডুবে যাচ্ছে এমনকী পাহাড়ও। আমি দেখিনি। কিন্তু জানি যে বৃষ্টি হয়, হচ্ছে। কেননা আমার বিছানার ওপর দিয়ে নিরাশ্রয় ইহুদিদের মতো হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে পিঁপড়ে, সারি সারি, এক-দুই-তিন-চার…। শুয়ে শুয়ে আমি ডাকি, সাড়া না দিয়ে তারা এগিয়ে যায়। সবাই এগিয়ে যায়, শুধু তাদের লালমাথা নেতা দূর থেকে হেঁকে বলে, ‘চুপ করে থাকো, বয়স ছাড়া আমরা আর কিছু বয়ে বেড়াচ্ছি না, বয়স ছাড়া আর কিছুই বাড়ছে না আমাদের।’
আমি চুপ করে থাকি। তাদের সারি সারি শবযাত্রা দেখে মনে হয়, রাত্রির শো’তে সিনেমা দেখে ফিরছে পিঁপড়েরা, সিনেমা দেখে তারা গাইছে সারি সারি গান। যেখানে তাদের বসতি ছিল কোনওদিন, এখন নেই, সেই ভেজা, আর্দ্র মাটির নিচে, এখন মধ্যরাতে জেগে উঠছে আশ্চর্য থিয়েটার! এই আষাঢ় শেষে, আমিও একদিন পিঁপড়েদের পেছন পেছন চলে যাব…
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র