অলিম্পিকের পবিত্র অগ্নিশিখা শেষমেশ পৌঁছেছে টোকিওতে। অতিমারীর কারণে অলিম্পিক পিছিয়ে দিতে হয়েছিল একটি বছর, তাই একটু দেরিতে পৌঁছল এই অগ্নিশিখা। আগামী ২৩ জুলাই অলিম্পিক গেমস-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অলিম্পিক কলড্রন জ্বলে উঠবে এই শিখার ছোঁয়ায়।
চার বছর অন্তর হওয়া অলিম্পিক গেমস— যার মাহাত্ম্য আন্তর্জাতিক খেলার আসরে সবচেয়ে বেশি— তা এবার পাঁচ বছরের ফারাকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে, যেসব খেলা অলিম্পিক গেমস-এর অন্তর্ভুক্ত নয়, তারাও অলিম্পিকে জায়গা পেতে দরবার চালাচ্ছে। এদের মধ্যে দাবা হচ্ছে প্রথম সারির দাবিদার। এবং দাবার গুণ-মান-বৈশিষ্ট্য-চাহিদা বিচার করলে হয়তো এর জুড়ি মেলা ভার।
বহু বহু শতাব্দী প্রাচীন যেসব খেলার কথা আমরা জানি, দাবা তাদের অন্যতম। পৃথিবীর ১৭০টিরও বেশি দেশে দাবা খেলা হয়। অথচ, দাবা এখনও এই প্রতিযোগিতার বাইরে। তাহলে অলিম্পিক গেমস-এর মতো মর্যাদাসম্পন্ন একটি প্রতিযোগিতায় স্থান পাওযার যোগ্যতা কী? দাবা এখনও কেন স্থান পেল না? অবশ্য, দাবার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এবং সারা বিশ্বের প্রচুর তরুণের মধ্যে এই খেলার প্রবণতা নিশ্চয়ই খেলাটির পক্ষেই যাবে।
দাবার অন্তর্ভুক্তির বিপক্ষে যে-যুক্তিটা সবচেয়ে বেশি: দাবা একটি বুদ্ধি ও মানসিক দৃঢ়তার খেলা, কিন্তু এতে কোনও শারীরিক কসরত জড়িয়ে নেই। অথচ, ‘ফিডে’ বা ‘ওয়ার্ল্ড চেস ফেডারেশন’, যা দাবার গভর্নিং বডি— তাকে ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস ফেডারেশন স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ১৯৯৯ সালে অলিম্পিক কমিটি দাবাকে একটি ‘খেলা’ বলে মেনে নিয়েছে। সাধারণ জনমানসে এই বিশ্বাস খুব প্রচলিত, দাবায় মানসিক ভাবে খুব চাপ পড়লেও শরীরের কোনও ধকল হয় না। এই মুহূর্তের যে কোনও বিশ্বখ্যাত গ্র্যান্ডমাস্টারকে প্রশ্ন করলে তিনি বুঝিয়ে দেবেন, একটা টেবিলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তীব্র মনোযোগ প্রয়োগ করতে গেলে, এবং তা টুর্নামেন্টের এতগুলো দিন ধরে বজায় রাখতে গেলে, কতটা শারীরিক সক্ষমতার তুঙ্গে থাকতে হয়। মনঃসংযোগে এক মুহূর্তের বিচ্যুতি হলেও, খেলা হাত থেকে বেরিয়ে যেতে পারে।
ভারতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার সূর্যশেখর গাঙ্গুলিও বলেন, ‘দাবা কেন অলিম্পিক্সের অংশ নয়, তা আমার কাছেও একটা রহস্য। প্রায় সব দেশ দাবা খেলে। খুব কম খেলাই এমন আছে, যাতে এত দেশ অংশ নিতে পারে। কেন অলিম্পিক্সে দাবা থাকবে না, আমি তো তার কোনও যুক্তি খুঁজে পাই না।’
আর্মেনিয়ান-আমেরিকান গ্র্যান্ডমাস্টার লেভন আরোনিয়ান মনে করেন, সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে দাবাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ‘অনেকগুলো কারণ ছিল, কয়েকটা আবার জিও-পলিটিকাল, ভৌগোলিক-রাজনৈতিক, কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরে রাশিয়া বিশ্ব-দাবাকে পুরোপুরি শাসন করতে শুরু করে, তাই দাবা খেলাটা অলিম্পিক্সে জায়গা পেলে, পশ্চিমের দেশগুলোর পক্ষে তা অস্বস্তিকর হত। এখন অবশ্য ব্যাপারটা অন্য, আমেরিকা ও রাশিয়ার সঙ্গে চিন আর ভারতও দাবায় বড় শক্তি হয়ে উঠেছে, তাই এ ব্যাপারে ঠিকঠাক সিদ্ধান্ত নিতে আর বেশি দেরি হবে না।’
দাবায় অবশ্য একটা নিজস্ব অলিম্পিক-স্তরের প্রতিযোগিতা আছে, তাকে ডাকা হয় ‘চেস অলিম্পিয়াড’। ১৯২৭ সালে ফিডে প্রথম চেস অলিম্পিয়াডের আয়োজন করে, আর ১৯৫০ থেকে একেবারে নিয়মিত ভাবে দু’বছর অন্তর এটা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ওয়াইক অ্যান জি এবং ভারতে টাটা স্টিল চেস টুর্নামেন্টের পরিচালক জেরন ফ্যান ডেন বার্গ, অলিম্পিয়াডের গুরুত্ব সম্পর্কে বললেন, ‘সম্প্রতি ফিডে অনেকবার চেয়েছে দাবাকে অলিম্পিক্সে অন্তর্ভুক্ত করতে। শুধু সামার অলিম্পিক্স নয়, উইন্টার অলিম্পিক্সেও। হয়তো সময়টাকে অলিম্পিক্সের কর্তাদের উপযুক্ত মনে হচ্ছিল না। তাছাড়া দাবার অনুরাগীরা সবাই মোটেই চান না, অলিম্পিক্সে দাবা হোক। কারণ এ খেলার নিজের অলিম্পিয়াড আছে, দু’বছর অন্তর তা হচ্ছে, এটা তো নিজেই একটা উৎসব, একটা দারুণ খেলার আসর।’
তবে এখন তরুণ-তরুণীর মধ্যে দাবার বিরাট জনপ্রিয়তার কথাও মাথায় রাখতে হবে। ফিডে ২০২৪-এর প্যারিস অলিম্পিক্সে দাবার অন্তর্ভুক্তির জন্য খুবই দাবি জানিয়েছে, ফল হয়নি। দাবা কেন অলিম্পিক্সে থাকবে, তার সবচেয়ে বড় কারণ সম্পর্কে বললেন গ্র্যান্ডমাস্টার আরোনিয়ান, ‘লক্ষটা কারণ আছে, কিন্তু একটা কট্টর খেলা-সংক্রান্ত কারণ দেখাই। দাবা খেলোয়াড়দের যে এনার্জিটা খরচা হয়, তা অধিকাংশ খেলায় অধিকাংশ খেলোয়াড়েরই হয় না। আর খেলাটা কতদিন ধরে আছে, সেটাও তো দেখতে হবে, সিন্ধু সভ্যতায় চারজনের খেলা হিসেবে শুরু, তারপর পারস্য ও আরব হয়ে ইউরোপে ঢুকে, এখন আমাদের গোটা মানবজাতির ঐতিহ্য এই খেলা। একটা ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের রাগ বা পাশ্চাত্য সিম্ফনির মধ্যে যে গভীরতা, এই খেলায় তা-ই খুঁজে পাওয়া যায়।’
গ্র্যান্ডমাস্টার গাঙ্গুলি মনে করেন, চেস অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণকারীদের দিকে একবার তাকালেই এই প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে যাবে। নরওয়েতে শেষ যে ‘ফিজিকাল’ অলিম্পিয়াড হয়েছিল (তার পরেরটা হয়েছিল অনলাইন অলিম্পিয়াড), তাতে ১৭০টা দেশ প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল। প্যারিস অলিম্পিক্সে দাবাকে নেওয়া হয়নি বটে, কিন্তু দাবি চলতেই থাকবে। সাধারণ মানুষের কাছে দাবা যাতে ঠিকঠাক খেলা হয়ে ওঠে, সেজন্য অলিম্পিক্সে দাবাকে দেখতে পাওয়া জরুরি। ফ্যান ডেন বার্গও এ বিষয়ে একমত। ‘খেলাটার জনপ্রিয়তার পক্ষে অলিম্পিক্সে সুযোগ পাওয়া ভাল। দাবাকে অনেক বেশি লোক তখন সিরিয়াস ভাবে নেবে। আমি নিশ্চিত, সারা পৃথিবীর ক্রীড়ানুরাগীরা অলিম্পিক্সে দাবা অত্যন্ত মন দিয়েই দেখবেন। সময়টা এসে গেছে, এখনই!’