১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, ২৮ বছর বয়সি খেলনা-নির্মাতা বুধন শবর তাঁর স্ত্রী শ্যামলীকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার বড়বাজারে যাচ্ছিলেন। সেখানে তাঁর মামাশ্বশুরের বাড়ি। একটা দোকানে পান খাওয়ার সময় বুধনকে গ্রেপ্তার করেন বড়বাজার থানার অফিসার-ইন-চার্জ অশোক রায়। বুধনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এক বছর আগে পুরুলিয়া-বড়বাজার রোডে একটি বাস ডাকাতির সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন।
এর পরের কয়েক দিন, পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন বুধনকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। খাবার বা জল, কিছুই তাঁকে দেওয়া হয়নি। শেষে, ১৯৯৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বুধনের কুঠুরিতে দেখা যায় তাঁর ঝুলন্ত দেহ। পুলিশ দাবি করে, গলায় নিজের গামছা জড়িয়ে বুধন আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল, গ্রেপ্তার হওয়ার সময় বুধনের কাছে কোনও গামছা ছিল না।
এইটি ও সরকারি নথি, বয়ানে নানা গরমিল এবং গ্রেপ্তার করার ও হাজতবাসের রীতিনীতি (ময়না তদন্ত ধরে) অনুসরণ না হওয়ার প্রমাণের ভিত্তিতে, ১৯৯৮-এর জুলাই মাসে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রুমা পাল পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি বনাম পশ্চিমবঙ্গ সরকার মামলায় এক সোজাসাপ্টা অন্তর্বর্তী রায় দেন।
সেই রায়ে বলা হয়, এটি যে পুলিশি নির্যাতনের ফলে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, অপরাধীদের ধরার জন্য পুরো ঘটনার তদন্ত করুক সিবিআই এবং এর সঙ্গে জড়িত পুলিশ ও জেলকর্মীদের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার ব্যবস্থা নিক এবং তাঁদের পুরুলিয়া থেকে বদলি করা হোক। এর পাশাপাশি, বুধনের পরিবার, অর্থাৎ তাঁর স্ত্রী, মা-বাবা ও পুত্রকে রাজ্য সরকার ক্ষতিপূরণ দিক।
নানা দিক থেকে এটি ছিল এক যুগান্তকারী রায়। সমগ্র ভারতে ডিনোটিফাইড ট্রাইবাল কমিউনিটিজ বা ডিএনটির (বিমুক্ত জাতি সম্প্রদায়) প্রতি প্রশাসনিক কর্তারা পদ্ধতিগত ভাবে যে অত্যাচার ও নির্যাতন করে এসেছেন, তার উদ্দেশে অভিযোগের আঙুল তোলে এই রায়। খেড়িয়া শবররা পশ্চিমবঙ্গের এমন তিন উপজাতির অন্তর্গত, যাদের ‘জন্ম-অপরাধী’ বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। এই ছাপ আইনি অনুমোদন পায় ১৮৭১ সালে, যখন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এই জঘন্য, ক্রিমিনাল ট্রাইবজ অ্যাক্টটি (অপরাধী উপজাতি আইন) পাশ করিয়ে নেয়।
এই আইনবলে, ভারতের প্রায় ২৩৭টি যাযাবর জাতি ও উপজাতিকে অপরাধী বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা লাভের পাঁচ বছর পর, ৩১ অগস্ট ১৯৫২ সালে, ভারত সরকার এদের বিমুক্ত জনজাতি বলে ঘোষণা করে। কিন্তু বংশ-পরম্পরা ক্রমে অপরাধী জনজাতি সম্পর্কে কিছু প্রথাগত, সাম্রাজ্যবাদী ধারণা থেকে কেন্দ্র মুক্ত হতে পারেনি। তাই ১৮৭১ সালের আইন পরিবর্তন করে ১৯৫২ সালে আনা হয় হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার্স অ্যাক্ট (স্বভাবগত অপরাধী আইন)। তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম দাগটা রয়েই গিয়েছে, সামাজিক ও আইনি ক্ষেত্রে এক পক্ষপাতদুষ্ট ধারণার শিকার হয়ে। কিন্তু রুমা পালের এই রায় সব জনজাতি এবং সংবাদমাধ্যমকে এক মঞ্চে নিয়ে আসে এবং পুলিশের এতদিনকার উদ্ধত আচরণের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। দুর্ভাগ্য এই যে, পুলিশের আচরণে এখনও কোনও ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়নি।
১৯৯৮-এর মে মাসে লেখক ও সমাজকর্মী মহাশ্বেতা দেবী এবং বিশিষ্ট উপজাতি বিশেষজ্ঞ ডক্টর গণেশ দেভি আহমেদাবাদের ছারানগর সফর করেন। ঘটনাচক্রে, মহাশ্বেতা দেবী উপজাতি সংক্রান্ত বিষয়ে বিশারদ হওয়ার পাশাপাশি বুধন শবর মামলায় ব্যক্তিগত ভাবেও যুক্ত ছিলেন। বিমুক্ত জনজাতিদের নিয়ে আন্দোলনের লক্ষ্যে, তাদের শিক্ষার হার নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এই দুজন দেখেন, ছারা এবং বানজারাদের মধ্যে শিক্ষার হার সব থেকে বেশি। ছারানগর সফর করার ঠিক আগে স্থানীয় পুলিশচৌকিতে এই দুজনকে দু’ঘণ্টারও বেশি সময় আটক করে রাখা হয়। আহমেদাবাদের পুলিশ ছারাদের উৎপাত হিসাবে দেখতেই অভ্যস্ত। তাদের কাছে ছারানগর দুষ্কৃতীর স্বর্গরাজ্য। তারা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, দুজন সজ্জন ব্যক্তি সেখানে যেতে আগ্রহী কেন?
এ বছরের এপ্রিলে আহমেদাবাদ পৌঁছনোর পর, যখনই কোথাও বলেছি আমাদের সফরসূচিতে ছারানগরও আছে, তখনই সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। আমাদের বলা হয়, ‘আরে ওখানে তো সবাই মদ কিনতে যায়।’ এক কথায় বললে, ছারানগর একটি বিচ্ছিন্ন এলাকা, মানসিক ভাবে যার অবস্থান আহমেদাবাদ নামের আলোকোজ্জ্বল মেগাসিটি থেকে অনেক দূরে।
সেখানে যখন পৌঁছলাম, মনে হল একটি অপরিকল্পিত শহুরে বস্তিতে এসে পড়েছি। ভারতের বহু ছোট শহর অনেকটা এইরকমই। আবার একেই ঘিরে রয়েছে বেশ বর্ধিষ্ণু এক সিন্ধি পাড়া। সেখানে এক-একটা বিশাল বাড়ি আর তাদের উঁচু দেওয়াল দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল, অবাঞ্ছিত প্রতিবেশীদের বার্তা একটাই, ‘তফাত যাও।’
ছারানগর সফরের সময় ছারা সম্প্রদায়ভুক্ত আতিশ ইঞ্জরেকর ও চেতনা রাঠোর এই বিভাজনটি আমাদের নজরে আনেন। এই এলাকায় এখন বহু পরিযায়ী শ্রমিকেরও বসবাস। তাদের থাকার জায়গা এমনিতেই কম, কিন্তু ছারানগরে থাকার ফলে, এলাকার বদনামের ভাগী হতে হচ্ছে তাঁদেরও। যেতে যেতে কিছু বারোয়ারি কালীমন্দিরও চোখে পড়ল। আহমেদাবাদের অন্য কোথাও এটা দেখিনি। কোনও কোনও বাড়ির প্রবেশদ্বারেও ছোট ছোট মন্দির দেখলাম। আতিশ জানালেন, এদের বলা হয় ‘খাম্বি।’ পরিবার ও বংশের পূর্বপুরুষদের প্রতি এগুলি উৎসর্গীকৃত। প্রকৃতি ও পূর্বপুরুষ পুজো করার এই খণ্ডচিত্র থেকে বোঝা গেল, ছারা উপজাতির নিজস্ব দেবদেবী থাকলেও, তাদের ধর্ম হিন্দুধর্মের মধ্যেই মিলেমিশে গিয়েছে।
কিন্তু গুজরাতে এখন যে সংকীর্ণ হিন্দু পরিচিতির বিপণন চলছে, তাতে এই সহাবস্থান বেশ অস্বস্তিকর। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে মদ উৎসর্গ না করলে, ছারা সম্প্রদায়ের যে কোনও অনুষ্ঠান, সে বিবাহই হোক আর শ্রাদ্ধই হোক, অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ছারাদের হোলির সময় বিশেষ পদ হিসাবে থাকে ঝলসানো গোমাংস এবং অপর্যাপ্ত মদ। ভাবুন একবার! এই সবই হচ্ছে কি না গুজরাতে, যেখানে গোহত্যা ও মদ বিক্রি, দুই-ই নিষিদ্ধ।
সফর শেষ হল ছারানগরের ঠিক বাইরে, একটা খোলা জায়গায় এসে। ভগ্নপ্রায় বাড়িঘর দিয়ে ঘেরা এই ভিখারি কলোনিটি রাজ্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা দপ্তরের অধীন। আমাদের গাইডরা কিছুটা অবাকই হল, যখন বললাম আমাদের রাজ্যে এমন কোনও দপ্তরের নামই শুনিনি। গেটে পুলিশ প্রহরা থাকায়, ভেতরে ঢোকা সহজ ছিল না। কিন্তু মিষ্টি কথায় চিঁড়ে তো ভিজবেই। তবে গেটের মুখে মোবাইল ফোন ও ক্যামেরা জমা দিতে হল। রক্ষীরা হয়তো ভেবেছিলেন, তাঁরা যা রক্ষা করছেন, তার সামনে আমরা মূর্তিমান বিপদ। ভাঙাচোরা বাড়িটি এক সময় স্কুল ছিল।
ছেলেবেলায় আতিশ আর চেতনা এখানেই পড়তে আসতেন। ছারানগরে আর কোনও খোলামালা জায়গা না থাকায়, বাড়িগুলির সামনে বিশাল মাঠটা ছিল আশীর্বাদের মতো, ঠিক যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা। তবে সেখানেও এখন প্রবেশ নিষেধ। গোটা এলাকাই মনে হয় পাণ্ডববর্জিত। পাশেই পুলিশচৌকি, যেখানে একটু উপর থেকে ছারানগরের উপর নজরদারি চালানো যায়। এই চৌকিতেই ১৯৯৮ সালের মে মাসে মহাশ্বেতা দেবী ও গণেশ দেভিকে কয়েক ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়।
সে-বার ছারানগরে ঢোকার অনুমতি মেলার পর মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে আলাপ হয় ছারা সম্প্রদায়ের অন্যতম সদস্য দকসিন বজরঙ্গীর। তাঁদের সম্প্রদায় কী চায়, জিজ্ঞেস করায়, তিনি দাবি করেন একটি গ্রন্থাগারের। ছারানগরে প্রাথমিক শিক্ষার হার শতকরা ১০০ ভাগ। কিন্তু বহুকাল ধরে রটে যাওয়া এক বদনামের শিকার হয়ে এই সম্প্রদায় সব রকম শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে বাধা পাচ্ছে। ছারানগরের বাইরে কলেজে পড়ার সময় এই ভেদাভেদ সম্পর্কে আরও অবহিত হন দকসিন। তিনি ভেবেছিলেন ছারানগরে গ্রন্থাগার এলে বিশ্বের অনেকগুলি জানালা খুলে যাবে। এর পাশাপাশি এই লাইব্রেরি, সমমনস্ক মানুষদের একত্র হওয়ার মঞ্চ গড়ে তাঁদের নিজেদের কথা বলার সুযোগ করে দেবে। মহাশ্বেতা দেবী নিজের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায় প্রচুর বই কিনে এই সম্প্রদায়কে দান করেন। যা ছিল একতলার একচিলতে ঘর, দোতলায় উঠে একটা তলা জুড়ে তা হয়ে যায় লাইব্রেরি। সেই থেকে জায়গাটি হয়ে ওঠে ছারানগরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের হৃদ্পিণ্ড।
এই লাইব্রেরিতেই অধিষ্ঠান বুধন থিয়েটারের। ১৯৯৮ সালের জুলাইয়ে বিচারপতি রুমা পালের সেই রায়ের পর, দকসিন সেই ঘটনা নিয়ে একটি নাটকের খসড়ার কাজ আরম্ভ করেন। যদিও নাটক লেখা বা পরিচালনার কোনও প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না। ‘বুধন’ শীর্ষক পথনাটিকাটি আত্মপ্রকাশ করে ১৯৯৮ সালের ৩১ অগস্ট, ডিনোটিফিকেশন ডে’তেই (বিমুক্ত জনজাতি দিবস)। নাটকটি অভিনীত হওয়ার পর দেশে-বিদেশে যথেষ্ট খ্যাতি আকর্ষণ করে। সেই প্রথম মিডিয়াও ছারানগর সম্পর্কে ইতিবাচক ভূমিকা নেয়। নাটকের সেই স্ক্রিপ্ট আজ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত। এইভাবেই জন্ম বুধন থিয়েটারের। ৩১ অগস্ট দিনটি এখন বিমুক্ত জনজাতি স্বাধীনতা দিবস হিসাবেও ধরা হয়। এর পর থেকে মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে প্রথম দেখা এবং সেই নাটকের প্রথম অভিনয় বুধন থিয়েটারের কর্মকাণ্ডকে প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। এই থিয়েটার ছারা সম্প্রদায়ের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য বিমুক্ত ও প্রান্তিক জনজাতিকেও বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে নাটক হল যোগাযোগ ও জনমত গঠনের এক শক্তিশালী মাধ্যম। এইভাবেই একদিন গড়ে উঠবে দেশজ নেতৃত্ব।
দকসিনকে জিজ্ঞেস করি, ‘কিন্তু থিয়েটারই কেন?’ উত্তরে তিনি ছারা সম্প্রদায়ের যন্ত্রণার দিনযাপন এবং তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের চালচিত্র তুলে ধরেন।
অন্যান্য যাযাবর সম্প্রদায়ের মতো ছারারাও নৃত্য-গীতে পারদর্শী: গর্বা নাচই হোক আর মেহেন্দির মতো প্রচলিত রীতিই হোক, সবই তাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। দকসিন কিছুটা দুষ্টুমির সঙ্গেই বললেন, ‘তবে এইসব শিল্পকলার পাশাপাশি আর একটি বিষয়েও তারা ওস্তাদ ছিল। এটি হল ‘চোরি কি কলা।’’
তিনি এর একটি উদাহরণও দেন। সেখানে নৃত্য-গীত-অভিনয়ের পোশাকের মধ্যে এই গোপন বিদ্যাও ঢুকে পড়েছে। ছারা মহিলাদের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি ঘাগরার মধ্যে হুকিংয়ের যন্ত্রপাতি লুকোনো থাকত, যাতে চুরি করা মালপত্র অনায়াসে আটকানো যেত। এর ফলে তাঁদের হাঁটার কায়দাও বদলে যেত। ঘাগরার কুঁচিতে টেলিভিশন সেটও লুকিয়ে ফেলা যেত! এটা পরীক্ষিত সত্য। কারণ, যতই সন্দেহ হোক, কার সাহস হবে কোনও মহিলাকে ঘাগরা তুলে দেখাতে বলার! দকসিন বললেন, ‘ছারানগরে বিমুক্ত জনজাতিদের একটি জলজ্যান্ত জাদুঘর হোক, যেখানে এই সব জিনিস সংরক্ষিত হবে।’
ছারা পরিবারগুলিতে লড়াই-ঝগড়া লেগেই থাকে। দকসিনের মতে, ‘এগুলিও যথেষ্ট নাটকীয়। এখানে আঙ্গিক ও বাচিক অভিনয়ের রীতিনীতি পুরোমাত্রায় পালিত হয়।’ রাস্তায় লোকে পাগড়ি পরে বেরোয় কারণ বলা তো যায় না কার মাথায় কখন, কোথা থেকে বোতল, লাঠি বা পাথর এসে লাগবে! আর হোলির সময় চোখা চোখা গালি বিনিময় সাবেকি সঙ্গীতেরই অঙ্গ। এই নিয়ে দো-আঁশলা পরিবারগুলির মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। দকসিন এমন বহু লড়াই-তর্কের সাক্ষী হলেও, তাঁর মনে পড়ে না যে এই সব বিষয় কখনও আদালতে গিয়েছে। সব ঝুটঝামেলা সম্প্রদায়ের মধ্যেই মিটিয়ে ফেলা হয়। এ যেন সেই উপজাতির শিকড়েই ফিরে যাওয়া, যেখানে নিজেকে মেলে ধরার আনন্দই প্রধান, যেখানে সবাই নিজের নিজের প্রভু। ছারাদের জিনেই রয়েছে শিল্পকলা। তাই বিমুক্ত জনজাতি, তাদের নানা অসুবিধা এবং তার সঙ্গে যুক্ত যে কোনও বিষয় তুলে ধরতে থিয়েটারই সব থেকে স্বাভাবিক মাধ্যম।
চ্যালেঞ্জ রয়েছে অন্য জায়গায়। নয়ের দশক পর্যন্ত ছারানগর পড়ে ছিল এক অন্ধকার যুগে। লোকে এখানে আসত শুধু চুরি করতে বা মদ্যপান করতে। ছারানগর তখন এক যুদ্ধক্ষেত্র, হিংসায় নয়, বদনামের ভাগী হয়ে। আবার এই পাড়া থেকেই উঠে এসেছেন বহু কোটিপতিও। দকসিনের প্রশ্ন, ‘এত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এবং ছারা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এত অভিযোগের পরেও কেন রাজ্য সরকার এইসব মদের ঠেক ভাঙছে না। তা হলে যুক্তি একটাই। এগুলো থাকায় তাদেরই লাভ।’
কোনও রাখঢাক না করেই দকসিন বললেন, ‘ছারা সম্প্রদায় খিচুড়ি রাঁধে। সেটা খায় রাজ্য। আমাদের জন্য থাকে পোড়া অংশটুকু।’ দকসিনের ভাই আমেরিকায় গিয়ে যথেষ্ট সফল। অথচ দেশে থেকেও, দকসিন ছারানগর বাদে গুজরাতের অন্য কোথাও জমি কিনতে পারবেন না। কারণ জমি লেনদেনের সময় নথিপত্রে নিজের জাতের উল্লেখ থাকতেই হবে।
এতদিন ধরে দাগী হয়ে থাকা একটা জায়গাকে সৃজনশীলতার মঞ্চে রূপান্তরিত করা বড় সহজ ছিল না। কিন্তু সমর্থন ও সহযোগিতা এল সম্প্রদায়ের ভিতর থেকেই। বিশেষ করে তারা যখন দেখল বুধন থিয়েটার তাদেরই জীবনের জলছবি। সাহায্য এল সব দিক থেকে। কেউ নিজেকে জড়ালেন ব্যক্তিগত স্তরে আবার কেউ পাড়ায় অভিনয়ের জন্য জায়গা দিয়ে। দকসিন সোজাসাপ্টা বলেই দিলেন, ‘আমার সম্প্রদায়ের মানুষই আমার প্রথম দর্শক। এর ফলে নিজেদের মধ্যে মর্যাদাবোধ এবং জনমত গঠনের ক্ষেত্রে সক্রিয়তা বাড়বে।’
এটা কিন্তু সম্ভব হয়েছে। জাতীয় স্তরে প্রশংসা পাওয়া ছাড়াও আজ বুধন থিয়েটারের মধ্যে আশার আলো দেখতে পান অন্যান্য বিমুক্ত জনজাতিও। বুধন থিয়েটারের লক্ষ্যই হল বিমুক্ত জনজাতি সম্প্রদায়গুলি বা ডিনোটিফাইড ট্রাইবাল কমিউনিটিজ থেকে এমন কিছু মানুষ তুলে আনা, যাঁরা একদিন তাদের সমাজে রাজনৈতিক ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবেন। গুজরাতে বাস করে চল্লিশটি বিমুক্ত জনজাতি। বুধন চায়, সেখান থেকে অন্তত চারশো নেতা উঠে আসুক। এই মুহূর্তে বুধন এমন চল্লিশজনের সঙ্গে কাজ করছে। প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর ফিরে গিয়ে এঁরা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে এই শিক্ষা চারিয়ে দেবেন। এর পর স্বাভাবিক ভাবেই এই সব সম্প্রদায়ের কণ্ঠস্বর আরও জোরালো হবে এবং সমাজের মূলস্রোতের পথে তারা আরও কয়েক কদম এগিয়ে যাবে। এতে দক্ষিণপন্থীদের কী প্রতিক্রিয়া হবে, তাই নিয়ে তারা মোটেই ভাবছে না। কিছুটা নিস্পৃহ ভাবেই দকসিন বললেন, ‘ওদের কাজ হল শিল্প ও সম্প্রদায়ের পরিসরগুলো বন্ধ করা। আমরা সেগুলো খুলে দিই।’
দকসিনের চিন্তাভাবনা আরও একটি ব্যাপারে স্বচ্ছ। তাঁর মতে ফ্যাসিস্ট শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে গেলে ঠিক তাদের মতোই শক্তিশালী সংগঠন গড়া এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ হওয়া দরকার। ‘শুধু ফ্যাসিস্টরা এটা ব্যবহার করে দেশকে ধ্বংস করতে আর আমরা একে কাজে লাগাব দেশকে গড়তে।’ এই সৃষ্টিশীল কাজ যাঁরা করছেন, এমন বহু সংগঠনের সঙ্গে দকসিন আজ যুক্ত। ডিএনটি অ্যাকশন গ্রুপের সক্রিয়তার কারণেই মহারাষ্ট্র পুলিশের কিছু অফিসার সাসপেন্ড হয়েছেন। এই ক্ষেত্রে কাজ করছে এমনই দুটি সংস্থা, ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স গ্রুপ এবং ডিএনটি (ডিনোটিফাইড) অধিকার মঞ্চ। দ্বিতীয়টির জাতীয় আহ্বায়ক দকসিনই।
ডিএনটি সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য পুরুলিয়ায় মহাশ্বেতা দেবী যে সোসাইটি গড়েছিলেন, তাকে নবজীবন দিয়েছে বুধনই। এখন এই সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়ে সেখানে নানান কাজ হচ্ছে।
২০০৬ সালে যখন ডিএনটি কমিটি গঠিত হয়, তখন মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন, ‘ছারা সম্প্রদায় একদিন ডিএনটি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে।’ সেই দিন আজ সমাগত! ২০১৬ সালের জুলাইয়ে মহাশ্বেতা দেবী মারা যান। শেষ বার তিনি যখন ছারানগরে আসেন, তাঁকে দকসিন জিজ্ঞাসা করেন, ‘এবার আমাদের করণীয় কী?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘মেলা করো।’ সেই মেলা, হাজারও স্বরকে একত্র করে সেই উদযাপন, এখনও চলছে।
গুজরাতের তেজগড়ে আদিবাসী আকাদেমিতে মহাশ্বেতা দেবী স্মারকে একটি সহজ অথচ গভীর বার্তা দেওয়া আছে। ‘হর সপনে কো জিনে কা অধিকার হ্যায়’ (প্রত্যেক স্বপ্নের বেঁচে থাকার অধিকার আছে)। বুধন থিয়েটারে প্রতিদিন সেই স্বপ্নের একই সঙ্গে পুনর্নবীকরণ ও পুনরুজ্জীবন লাভ হচ্ছে।
ছবি সৌজন্য বুধন থিয়েটার