আমি এমন একটা বাড়িতে জন্মেছি যেখানে মানুষ আর জীবজন্তু মিলিয়েই একটা পরিবার তৈরি হয়েছে। জীবজন্তুর প্রতি অত্যাচারের ধারণাটাই আমি সহ্য করতে পারি না। রাস্তার কুকুর-বেড়ালদের প্রতি যে ব্যবহার করা হয় বা তাদের যেভাবে অবহেলা করা হয়, তা মেনে নেওয়া কঠিন। একটু বড় হয়েই দেখেছি, মা বিরাট ব্যাগে ঠেসে ঠেসে খাবার ভরে, সেই ভারী ব্যাগ টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে, পাড়ার এবং রবীন্দ্র সরোবর এলাকার প্রায় সমস্ত রাস্তার কুকুরদের খাইয়ে আসত। মায়ের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে গিয়ে কুকুরদের খাওয়ানোর স্মৃতিগুলো আমার খুব প্রিয়। মায়ের পক্ষে এই কাজটা সহজ ছিল না। মর্নিং-ওয়াকারদের সঙ্গে রীতিমতো তর্ক-বিতর্ক, কথা-কাটাকাটি করে এই কাজটা করতে হত, কারণ তাঁরা কিছুতেই চাইতেন না যে কুকুরদের এইভাবে খাওয়ানো হোক। তাঁরা ভাবতেন কুকুর-বেড়ালগুলো মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে খাবার খেয়ে নিক, যেন তারা গাছ এক-একটা।
এই অতিমারীর সময়, রাস্তার কুকুর-বেড়ালদের খাওয়ানোর কাজটা আরও কঠিন হয়ে উঠল, কারণ বেশিরভাগ পার্ক বন্ধ ছিল। মা বেশ কয়েকবার থানার গিয়ে পুলিশের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে বেড়াল-কুকুরদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছে, যাতে এই নির্দোষ প্রাণীগুলো না খেতে পেয়ে না মরে। কারণ, এই অতিমারীর জন্য, ওরা অন্যান্য যেসব জায়গা থেকে খাবার পেত, সেগুলোও তো বন্ধ। যেসব হোটেল তাদের বেঁচে যাওয়া খাবারদাবার এদের খেতে দিত, সেগুলো মাসের পর মাস বন্ধ ছিল। কোভিড আসার পর মানুষ অনেক দায়িত্বশীল আর সহমর্মী হয়ে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু এটাও আমাদের মনে রাখা দরকার যে রাস্তার এই কুকুর-বেড়ালগুলো আমাদের সমাজেরই অঙ্গ। এদের বেঁচে থাকার জন্য আমাদের সাহায্য প্রয়োজন, বিশেষত, যখন এই অতিমারীর কারণে আমাদের গোটা সিস্টেমটাই বদলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
বাড়ি থেকে যখনই কোথাও বেড়াতে যাই, মা সবসময় বলে অনেকগুলো বিস্কুটের প্যাকেট সঙ্গে রাখতে, যদি রাস্তায় কোনও কুকুর-বেড়াল দেখতে পাই! অতিমারীর তীব্রতার আগে আমি উত্তরবঙ্গ গিয়েছিলাম। এই সময়টায় পথেঘাটে যত কুকুর-বেড়াল দেখেছি আর খাইয়েছি, আমি আর আমার বন্ধু তাদের বাঙালি ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলার নামে নামকরণ করছিলাম। যেমন, অমিতাভ, গৌতম, সৌদামিনী, এরকম আরও অনেক।
আমার একটা অভ্যেস আছে, কুকুর-বেড়ালদের সঙ্গে এমন করে কথা বলি, যেন তারা মানুষ। এই কাণ্ড দেখে আমার বন্ধুরা বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যেত, কারণ আমি রাস্তাঘাটেই একটুও লজ্জা না পেয়ে এভাবে কথা বলতাম। ওদের অস্বস্তি দেখে আমি বদলাইনি, বরং ওরা এখন আমার পাল্লায় পড়ে শিখেছে, জন্তুদের ভালবাসতে। এখন আমি গর্ব করে বলতে পারি, ওরা অন্তত নিজের বাড়ির কাছাকাছি কুকুর-বেড়ালদের খেতে দেয়ই।
আমার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পুরো সময়টায় এমন একজন মানুষের দেখা পেয়েছি, যাঁর সঙ্গে আমার এব্যাপারে মিল। আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং সবচেয়ে আশ্চর্য শিক্ষক, ডক্টর রিমি বি চ্যাটার্জি, বা রিমিদি। উনি নিয়মিত আর্টস-ক্যাম্পাসের চারপাশের কুকুরদের খাওয়ান এবং উদ্ভট সব গল্প করেন ওদের সঙ্গে। সত্যি কথা বলতে কী, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু পড়ুয়ার মধ্যে এই প্রবণতাকে গেঁথে দেওয়ার বেশ কিছুটা কৃতিত্ব ওঁর। আমার মতে, ছোট ছেলেমেয়েদের মনে এই ধারণাটা তৈরি করা খুব জরুরি যে, কোনও সময়ই জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুর হওয়া উচিত নয়। খুব দুঃখের বিষয়, কিছুদিন আগে অবধি জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে কোনও আইন ছিল না। যাদবপুরের এক বন্ধুর সঙ্গে একদিন আলোচনা করছিলাম, সে কীভাবে যাদবপুরের পড়ুয়া আর ক্যাম্পাসের বেড়াল-কুকুরদের মধ্যে সম্পর্কটাকে ব্যাখ্যা করবে।
ও আমাকে খুব সুন্দর করে বোঝাল, ক্যাম্পাসের বেড়াল-কুকুররা কেন নিশ্চিতভাবেই ক্যাম্পাসেরই অঙ্গ। ‘যাদবপুরের গল্পসল্প ক্যাম্পাসের ‘ডগোজ’ আর ‘ক্যাটোজ’দের ছাড়া কোনওভাবেই সম্পূর্ণ হবে না। আসলে, ওরা আমাদের কলেজ-লাইফের সঙ্গে খুব আলতো কিন্তু মজাদার ভাবে বুনে রয়েছে। তুমি হয়তো চার নম্বর গেটে বসে চা খাচ্ছ, আর একটা বেড়ালছানা আচমকা তোমার কোলে চড়ে বসল এবং দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল। ডন তো তার প্রিয় জায়গা ‘ওয়ার্ল্ড ভিউ’ বইয়ের দোকানে বসে সবাইকে লক্ষ করে। আবার কেউ হয়তো তাকিয়ে ঝিলের ধারে একদল কুকুরছানাকে দেখতে পেল, তারা মহাফুর্তিতে খেলাধুলো করছে।’—শিঞ্জিনী পাল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী।
শিঞ্জিনী ডন-এর কথা বলল। ডন ছিল ক্যাম্পাসের খুব খুব পুরনো কুকুর, তার বয়সের গাছ-পাথর ছিল না। ও তিন-পায়ে অল্প অল্প লাফিয়ে ঘুরে বেড়াত। সব্বাই ওকে চিনত আর পছন্দ করত। বছর কয়েক আগে যখন ডন মারা গেল, যাদবপুরের সবাই এমন ভেঙে পড়েছিল যে ডনের খবরে সোশ্যাল মিডিয়া ভরে গিয়েছিল। যাদবপুরের পড়ুয়ারাও অনেকেই চেষ্টা করে, যাতে ক্যাম্পাসের কুকুরছানাদের একটা ঠিকঠাক বাড়ি মিলে যায়।
একটা মজার ব্যাপার বলি, আমার মা-বাবার যখন নতুন বিয়ে হয়েছিল, তখন থেকেই, রাস্তার কোনও বেড়ালকে উদ্ধার করে ওরা নিজেদের খাটের তলায় লুকিয়ে রাখত, কেউ যেন জানতে না পারে! আমার তো মনে হয়, দু’জনের এই একটা জায়গায় খুব মিল থাকায় বোধহয় এত বছর বিয়েটা টিকে গেল। জীবজন্তুর প্রতি, আর তাদের উদ্ভট আচরণের প্রতি উৎসাহ আমার মা-বাবার বাঁধনের মূল সূত্র। ফলে, রক্তে বোনা এই বৈশিষ্ট্যগুলো যে আমার মধ্যে জেগে উঠবেই, তাতে আশ্চর্য কী! ২০১৫-২০১৬ নাগাদ আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে রাস্তার দুটো বেড়ালছানাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম। তারা এমন ছোট্ট ছিল যে আমার হাতের চেটোয় ধরে যেত, আর ভাল করে হাঁটতেও পারত না। ওদের মা রাস্তায় গাড়িচাপা পড়েছিল, আর ছানাদুটোকে রাস্তায় ফেলে এলে ওরা যে বাঁচবে না, তা আমি বেশ বুঝেছিলাম। মা ওদের নাম দিয়েছিল, গুপি আর বাঘা।
আমার ছোটবেলাটা তাই কিছুটা ছিল ‘আমার পরিবার ও অন্য জীবজন্তুরা’ গোত্রের, আর আমার বড়বেলাটাও সেই রকমই। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, এছাড়া অন্য কোনওরকম জীবন আমি চাইও না। জীবজন্তুর প্রতি ভালবাসাটা আমি সংক্রামক রোগের মতো ছড়িয়ে দিতে চাই মানুষের মধ্যে, যাতে তারা এদের আরও একটু ভালবাসে আর মায়ার চোখে দ্যাখে।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র