লাতিন আমেরিকান লিটারেচারের এই ব্যাপারটা খুব টাফ। মিঠি সাহিত্য পড়তে ভালবাসে বলেই কম্পারেটিভ লিটারেচর নিয়ে ভর্তি হওয়া। তুলনামূলক সাহিত্য ব্যাপারটা পরীক্ষা নামক বস্তুটার জন্য যে অন্য সব সাবজেক্টের মতোই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে, তা জানলে মিঠি কখনওই এই বিষয়টা নিয়ে ভর্তি হত না। সাহিত্য পড়া এক জিনিস আর সাহিত্যের তত্ত্ব নিয়ে কচকচি করে নম্বর তোলাটা পুরো ডিফারেন্ট। মিঠি ঠিক করেছে কম্পারেটিভে গ্র্যাজুয়েশনটা কোনওরকমে পার করতে পারলে, হয় সাবজেক্ট চেঞ্জ করে সম্পূর্ণ অন্য কিছু পড়বে, আর নয়তো বাবাকে বলবে বিয়ে দিয়ে দিতে। যে সাহিত্য ওর ভালবাসার জিনিস, তাকে ও এইভাবে ছকে বাঁধা পড়াশুনো করে নষ্ট হতে দেবে না কিছুতেই।
লাইব্রেরিতে মুখ গুঁজে পড়তে পড়তে হঠাৎ অস্থির লাগল মিঠির। যত পরীক্ষা এগিয়ে আসছে, তত কম কনসেনট্রেট করতে পারছে ও। আর ততই রাগ হচ্ছে ওর। ভিতরে ভিতরে ভীষণ রাগে কাঁপছে মিঠি। অথচ কার উপর যে রাগ, তাই বুঝতে পারছে না ও। অথচ চিকু, যে আসল ছিটেল মাল, সে এখন দিব্যি লক্ষ্মী মেয়ের মতো জার্মান ভাষা শিখছে, কম্পিউটারের একটা কোর্সে ভর্তি হয়ে গেছে আর কী কী যে করছে তা চিকুই জানে। মাধ্যমিকের পর পরই যেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেছিল, এখন ঠিক তার উল্টো ওর আচরণ। রেজাল্ট বেরোবার আগে এখনও ওর কাজের বিরাম নেই। এখন আবার অভিমন্যুর পরামর্শে কোথায় একটা ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে ভর্তি হবার জন্য নাচছে। মামণিও হয়েছে তেমন। চিকু মুখ থেকে কথা খসানোর অপেক্ষা শুধু। মামণি সঙ্গে সঙ্গে কোথায় কোর্স করায় খোঁজ করে, ফর্ম ফিল-আপ করে ফি জমা দিয়ে এসেছে।
অভিমন্যু যেন একেবারে জাদু করে ফেলেছে চিকুকে। এর মধ্যে অন্তত চার-পাঁচদিন ওদের বাড়িতেই এসেছে অভিমন্যু। চিকুর ধারণা ওর বন্ধু বলেই অভিমন্যু ওদের ফ্ল্যাটে আসে। আসল ব্যাপার জানলে চিকু বোধহয় কেঁদে অনর্থ বাধাত। এর মধ্যে অন্তত তিনদিন মিঠির খোঁজে ওর ডিপার্টমেন্টে এসেছে অভিমন্যু। মিঠির জন্য স্পেশালি এসেছে তা অবশ্য বলেনি। এমন ভাব দেখিয়েছে, যেন এই পথ দিয়ে যাচ্ছিল— জাস্ট একবার ডিপার্টমেন্টে ঢুঁ মারল এরকম আর কি! মিঠির বন্ধুরাও অভিমন্যুকে চেনে, কারণ বাপ্পার বাড়িতে যে পার্টি হয়েছিল, সেখানে চিকু ঝুল্লি ধরে ওকেও নিয়ে গেছিল। তার থেকে ও মিঠিদের গ্রুপটার সবার ‘অভিদা’ হয়ে গেছে। আগের সব দিনগুলোই অভিমন্যু এসে ক্যান্টিনে বসে গিয়েছে। একদিন কফি হাউসেও গেছে সবাইকে নিয়ে। কিন্তু যতই ভান করুক, মিঠির চোখকে ও ফাঁকি দিতে পারেনি। ও আসলে ভিড়ের মধ্যে থেকে মিঠিকেই দেখে। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে ওর চোখ অনুসরণ করে যায় মিঠিকে। মিঠির ঘনিষ্ঠদের মধ্যে দু’একজন ব্যাপারটা আঁচ করেছে। তৃণা তো সেদিন বললই— ‘মিঠি, ওই যে তোর হিরো আসছে।’ ওমা, সামনে দেখে অভিমন্যু মিটি মিটি হেসে ওদের দিকে আসছে।
অথচ তাজ্জব ব্যাপারটা হল ছেলেটা আমেরিকা থেকে এসেছে বিয়ে করতে। প্রথমদিন চিকুকে পৌঁছতে এসে মামণিকে কথা প্রসঙ্গে জানিয়েও ছিল ছেলেটা। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। পাত্রীর বাড়ি সল্টলেকের কোথাও। ছেলেটার বিয়ের বাজার অবধি করে ফেলেছে ওর দাদু-দিদিমা। এসব কথা মিঠির বন্ধুরা না জানতে পারে, মিঠির তো জানতে বাকি নেই। চিকু তো পারলেই গলগল করে অভিমন্যু প্রসঙ্গে গল্প করে যায়। এর সঙ্গে ওদের বাড়িতেও গেছিল একদিন। অভিমন্যুর দিদিমাই নাকি এসব গল্প করেছেন। আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছেন, চিকুর বাড়িতে কে কে আছে? দিদি কত বড় ? কী পড়ছে? এসব খবরে দরকারই বা কী বুড়ির? এক যদি না…। একটা বাঁকা হাসি খেলে গেল মিঠির ঠোঁটে— বুড়ি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে নাতি বাগদত্তাকে ছেড়ে অন্য আরেকজনের পিছনে ছুটছে। সেই জন্যই এত গোয়েন্দাগিরি। আবার কায়দা করে বলেওছে চিকুকে, ‘অভির তো কোনও বোন ছিল না। এখন তোমরাই ওর দুটি বোন হলে। ও বউ নিয়ে চলে যাবার পরও আমার নাতনিদের নিয়মিত দেখতে চাই কিন্তু আমি।’
এইসব শোনার পর আরও জেদ চেপে গেছে মিঠির। ছেলেটা পাকা খেলোয়াড়। বিয়ের সব ঠিকঠাক হয়ে যাবার পরও যে অনায়াসে একটা অচেনা মেয়ের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে পারে, সে উওম্যানাইজার ছাড়া আর কী? ওর দিদিমাও নিশ্চয়ই ভাল করেই জানে এই স্বভাবের কথা। মিঠি ঠিক করেছে ছেলেটা যদি খেলতে চায়, ও-ও খেলাবে। বুঝিয়ে দেবে, আমেরিকায় চাকরি করে শুনে ফিদা হয়ে যাবে, তেমন মেয়ে ও নয়।
মিঠি লক্ষ করল লাইব্রেরিতে বসে এক ফোঁটাও কনসেনট্রেট করতে পারছে না, উল্টে শুধু অভিমন্যুকে জব্দ করার চিন্তাই মাথায় আসছে। সবে সাড়ে চারটে বাজে। ও এখন বাড়ি যেতেও চায় না। বাড়ি গেলেই তো অন্য আরেকজনের মুখোমুখি। চরম অস্বস্তি। মিঠির চেয়ে তারই বেশি। ওকে এবার দেখা থেকেই এরকম হচ্ছে। ঘরে-বাইরে সর্বত্র একটা অ্যাবসার্ড সিচুয়েশন। কী যে করে মিঠি! আগের বার ও যখন এসেছিল, তখন মিঠি অনেক ছোট। সেবার ওর বউ আর ছেলেও ছিল সঙ্গে। তিলক সেবার মিঠিদের বাড়ি ওঠেওনি। অবশ্য মিঠিরা তো তখন এই ফ্ল্যাটে থাকত না। তালতলার ঘুপচি দু’ঘরের বাড়িতে তিলককে কল্পনাই করতে পারে না মিঠি। তিলককে আগের বার সেভাবে খেয়ালই করেনি ও। বরং ওদের গাবলুগুবলু ছেলেটাকে গাল-টাল টিপে খুব আদর করেছিল দু’বোন। তিলকের বউটাও ভাল। তবে মামণির বসানো সংস্করণ। শুধু একটু আহ্লাদী-আহ্লাদী। মামণির বোনকে মিঠি আগেও দেখেছে। যখন মামণি জুঁইমাসি হিসেবে ওদের বাড়িতে আসত, তখন থেকে। পরে মামণিকে যখন বাবা বিয়ে করল, তখন মামণির বোনকে মাসিমণি বলে ডাকতে শেখানো হয়েছিল মিঠি-চিকুকে। মামণিই শিখিয়েছিল। মাসিমণির মনটা ভাল। এবারও অনেক উপহার পাঠিয়েছে তিলকের হাত দিয়ে ওদের জন্য। তিলক আসার অনেক আগে থেকেই ওরা জানত ‘মেসোমণি’ এবার একা আসছে। ওদের বাড়িতেই উঠবে। ওর নিজের বাড়ি কোথায় একটা গ্রামে। কলকাতায় থাকার জায়গা বলতে হয় মামণির মা-বাবার বাড়ি, নয়তো ওদের বাড়ি। মামণির বাবা-মা বুড়ো হয়েছে, বিদেশ থেকে আসা জামাই-এর দেখভাল করার মতো সেট-আপই নয় ওদের। তাছাড়া তিলক বাবার ছাত্র। অতি প্রিয় ছাত্র। ইনফ্যাক্ট বাবা এবার ওর আসার অপেক্ষায় আক্ষরিক অর্থেই দিন গুনছিল— তিলক এলে ডাক্তার দেখাতে যাব ওর সঙ্গে, তিলকের কাছে চিকুর ব্যাপারে পরামর্শ করব, মিঠির পড়াশুনো কোন লাইনে এগোবে সে-ব্যাপারে তিলকই আইডিয়াল সাজেশন দিতে পারবে— হরবখ্ত এরকম কথা ছিল বাবার মুখে। তিলককে দেখার জন্য মিঠিদেরও যে আগ্রহ ছিল না তা নয়। চিকুর কথা জানে না, চিকু যে কী ভাবে একা ওই জানে— আর এখন বোধহয় অভিমন্যু জানে ৷ কিন্তু চিকু কি জানে তলে তলে অভিমন্যু কী করছে? আগের দিনও ইউনিভার্সিটি এসে আড্ডা দিয়ে ওঠার মুখে বলল— ‘আমি যে এখানে তোমাদের সঙ্গে এখানে গল্প করতে এসেছি এটা আর চিকুকে বলার দরকার নেই।’ চালু মাল। ঠিক জানে চিকু জানলে কেঁদে-কেটে অনর্থ করবে। মিঠির ভারি বয়েই গেছে অভিমন্যু আসার কথা চিকুকে বলতে। সারা দিনে ক’টাই বা কথা হয় চিকুর সঙ্গে। বলতে যে একেবারে ইচ্ছে হয়নি এমন নয়। বরং সুযোগ হয়নি। তাছাড়া আজকাল মিঠি নিজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়েই জেরবার হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে তিলক আসার পর থেকে ও ভিতরে ভিতরে খুব ডিস্টার্বড বোধ করছে। মিঠির কি অদ্ভুত কোনও মানসিক রোগ হয়েছে? ওর সমবয়সি কোনও ছেলেকে ওর ভাল লাগছে না। কতজন ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করেছে, প্রেম নিবেদন করেছে। মিঠির সে সব ঘটনা হয় ন্যাকা-ন্যাকা, নয়তো অতিনাটকীয় মনে হয়েছে। অথচ তিলককে দেখার প্রথম দিন থেকেই অসম্ভব আকর্ষণ বোধ করছে ও। মনে হয়েছে তিলক যদি ওকে বাচ্চা মেয়ে ভেবেও জড়িয়ে ধরত— চিকুকে যেমন ধরে বলেছিল ‘কত বড় হয়ে গেছিস’, তেমন হলে দারুণ লাগত। মিঠির ক্ষেত্রে তিলক অবশ্য সে ধারও মাড়ায়নি। শুধু মাথার চুলগুলো একটু নেড়ে দিয়ে বলেছিল— ‘আর তুমি তো পুরোদস্তুর লেডি হয়ে গেছ, মিঠি।’ তিলকের গলায় সেই বিস্ময়, আলতো হাতের সেই স্পর্শ, মনে করলেই শরীরে ঢেউ ওঠে মিঠির। ও আর পারছে না। তিলককে অনেকবার ছোটখাটো হিন্ট দিয়েছে। বলেছে, ‘আমি তোমাকে ‘মেসোমণি’ বলে ডাকব না, তিলকদা বলেই ডাকব।’ তিলক ভিতরে ভিতরে অবাক হয়েছে কি না ঠিক বুঝতে পারেনি। সামান্যক্ষণ চুপ করে থেকে খুব স্বাভাবিক গলায় ও বলেছিল— ‘বেশ, তোমার যদি আমাকে দাদা বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়, না হয় তাই বলো।’ তিলক নিজে কিছু না বললেও প্রভাতের কানে ‘তিলকদা’ ডাকটা যেতেই তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন— ‘একী! মাসির স্বামী দাদা হয় কোন সম্পর্কে! তোরা এখনকার ছেলেমেয়েরা সম্পর্কের মূল্য দিস না একেবারে।’
মিঠি কিছু না বলে চুপ গেছিল, তারপর থেকে ও আর তিলককে সম্বোধনই করে না। ‘খেতে এসো, মামণি খাবার দিয়েছে’ অথবা ‘তোমার কি কাগজটা পড়া হয়ে গেছে? নেব একটু?’ এমন ঠারেঠোরেই কথাবার্তা চালায়। তিলকের সঙ্গে ওর খুব বেশি কথা হয় না ঠিকই, কিন্তু যতক্ষণ বাড়িতে থাকে তিলককে দৃষ্টি দিয়ে বিদ্ধ করে। তিলকও বোধহয় আঁচ করে কিছু, ও সবসময় খুব এমব্যারাসড হয়ে থাকে বলে মনে হয় মিঠির। মিঠি লাইব্রেরিতে বসেই ঠিক করল, দু’একদিনের মধ্যে তিলকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবে। কীভাবে বলবে ভাবতে ভাবতে বেশ মশগুল হয়ে গেছিল মিঠি। হঠাৎ ওর চমক ভাঙল। ‘মিঠি, এই মিঠি’— তৃণার গলার আওয়াজ। লাইব্রেরির রিডিং রুম বলেই ফিসফাস করে কথা বলছে তৃণা। চাপা উত্তেজনার আভাস ওর চোখেমুখে। ‘বাইরে তোর জন্য ওয়েট করছে,’ দরজা দিয়ে লাইব্রেরির বাইরের দিকটা দেখাল ও। পাঁচটা প্রায় বেজেও গেছ। আর বেশিক্ষণ পড়তে পারত না মিঠি। বই জমা দিয়ে ব্যাগের মধ্যে খাতা-বই পুরে বাইরে এল ও। নাথুর ক্যান্টিনের পাশে অভিমন্যু দাঁড়িয়ে আছে। অভিমন্যুকে দেখিয়ে দিয়ে তৃণা হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেছে। মিঠিকে দেখে এগিয়ে এল অভিমন্যু, ‘তোমার একটু সময় হবে মিঠি? আমার কতগুলো জরুরি কথা ছিল।’
জানাই ছিল। এরকম যে হতে পারে, আগাগোড়াই আন্দাজ করেছিল মিঠি। ভাবলেশহীন মুখে ও বলল, ‘বলুন। এই ক্যান্টিনে বসবেন?’
‘এখানে?’ একটু ইতস্তত করছে ও। ‘নাহ, এখানে ঠিক হবে না। বরং আমরা ওইদিকে পুকুরটার ধারে গিয়ে বসতে পারি, তোমার আপত্তি না থাকলে।’
পুকুরের পাড়টা বাঁধানো। ধারে ধারে কতগুলো বেঞ্চ। ঘাটটায় কয়েকটি ছেলে খেলার শেষে স্নান সেরে নিচ্ছে। পুকুরের পাড়ে একটা নিরিবিলি কোণ দেখে বসেছে ওরা। ‘বলুন কী বলবেন?’
একটু চুপ করে যেন ভেবে নিচ্ছে অভিমন্যু কী বলবে। ‘আসলে… মানে আমি ঠিক কী করে বোঝাব জানি না, তুমি জানো আর কয়েকদিন পরেই আই অ্যাম গেটিং ম্যারেড। কিন্তু সেদিন যদি চিকু ওভাবে জলের ধারে ঝুঁকে বসে না থাকত তাহলে হয়তো কিছুই ঘটত ন। মিঠি, তুমি বুঝতে পারছ, আমি কী বলতে চাইছি?’ কাতর ভাবে ও তাকাচ্ছে মিঠির দিকে।
‘না, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কী ঘটেছে? কী ঘটার কথা বলছেন?’
অভিমন্যু মুখ নামাচ্ছে। ‘মিঠি, আই থিংক ইউ নো— তোমাকে দেখে সব গণ্ডগোল হয়ে গেছে আমার। আই লাইক ইউ আ লট মিঠি। ইনফ্যাক্ট আই অ্যাম ডেসপারেটলি ইন লাভ উইথ ইউ। মিঠি, তুমি বলতে পারো আমি এখন কী করব?’ ভেঙে পড়া গলা অভিমন্যুর।
ও কি এরকম প্রায়ই বলে থাকে বিভিন্ন মেয়েকে? তা ঠিক মনে হচ্ছে না মিঠির। কী-ই বা বলতে পারে মিঠি এখানে? কী বলা উচিত? সেটাই বলল ও, দূরের দিকে তাকিয়ে— ‘আমি জানি না আমি কী বল। এত পরে এসব ভেবেই বা লাভ কী?’
‘মিঠি, তুমি কি আমার বন্ধু থাকতে পারো না? আমি কি বিয়ে ভেঙে দেব? যদি তুমি বলো, আমি কমলিকাকে বুঝিয়ে বলব। প্লিজ মিঠি!’
‘আমি বললে আপনি বিয়ে ভেঙে দেবেন?’ অন্য দিকে তাকিয়ে বলছে ও— ‘কেন, আমি কি আপনার কাছে সত্যিই এত ইম্পর্ট্যান্ট? আমি কেমন মেয়ে জানেন কি আপনি? কতটুকু জানেন আমার সম্পর্কে?’
‘জানি না, কিছুই জানি না।’ অস্থিরভাবে ঘাড় নাড়ছে অভিমন্যু— ‘শুধু আমি জানি, তোমাকে দেখলে আমার ভাল লাগে, তোমার সঙ্গে কথা বলতে, তোমার সঙ্গে থাকতে, তোমার কথা ভাবতে আমার ভাল লাগে। তুমি কি আমাকে একটুও পছন্দ করো না মিঠি?’ অভিমন্যুর চোখদুটো হঠাৎ জলে ভরে উঠেছে— ‘মিঠি, তোমার মতো আমারও খুব অল্প বয়সে মা মারা গেছেন, বাবাও একইসঙ্গে। কিন্তু বিশ্বাস করো, এত হেল্পলেস আমার কখনও লাগেনি। তোমাকে দেখার পর থেকে যেমন লাগছে। তুমি আর কিছুদিন আগে এলে না কেন মিঠি?’ দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে অভিমন্যু।
এই আবেগ মিথ্যে হতে পারে না, মিঠির মন বলছে। কী অদ্ভুত এক ফুট দূরত্বে বসে এই যুবকের কান্না। এ কথা সত্যি যে, অভিমন্যুকে অপছন্দ করে না ও। কিন্তু তিলক আসার পর মিঠির জগৎটাও বদলে গেছে চিরদিনের মতো। অভিমন্যুকে কি ও ভালবাসতে পারত? মিঠি বুঝতে পারছে না। অভিমন্যু কেন ধরেই নিচ্ছে ক’দিন আগে দেখা হলেই সবকিছু অন্যরকম হতে পারত? মিঠির ক্ষেত্রেও কি ব্যাপারটা তাই? অভিমন্যু আর ক’দিন আগে এলে কী হত? কী হতে পারত মিঠি আর ভাবতে চায় না। কী হলে কী হতে পারত, তা ভাবা এখন অর্থহীন। জীবন জুড়ে আকস্মিকের ঢেউয়ে ভেসে চলেছে মিঠি, অভিমন্যু হয়তো বা তিলকও। এসব আর ভাববে না মিঠি।
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর মিঠিই প্রথম কথা বলল— ‘উঠুন, আপনার বাড়িতে সবাই চিন্তা করবেন।’
অভিমন্যু ওর দিকে সরাসরি তাকিয়েছে— ‘তুমি জবাব দিলে না?’
‘কী?’
‘আমাকে তোমার একটুও ভাল লাগেনি, না? কিছু চাই না, শুধু এটুকু জানতে চাই।’
‘কী হবে জেনে?’ মিঠি চোখ নিচু করল। ‘আমি আপনাকে অপছন্দ করি না।’ একটু থেমে ও আবার বলল, ‘আমি অন্য আরেকজনকে ভালবাসি।’
‘ও, আমি বুঝতে পারিনি।’ ও উঠে দাঁড়িয়েছে সঙ্গে সঙ্গে— ‘আই অ্যাম সরি। তোমাকে অনেক কথা বললাম। কিছু মনে কোরো না।’
অভিমন্যু একটা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি ফিরে গেছে। খুব শ্লথ পায়ে বাড়ি ফিরছে মিঠি। মনটা ভারী হয়ে গেছে।
***
চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলেই মিঠি দেখল বসার ঘরে সোফায় বসে তিলক একটা গল্পের বই পড়ছে। ওহো, মামণির তো আজ বাবাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবার কথা। অনেক দিন আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। মনেই ছিল না মিঠির। তিলক যেতে চেয়েছিল, মামণিই বারণ করেছে । ড্রাইভ তো মামণিই করবে, তিলক এদেশে ড্রাইভিং-এ অভ্যস্ত নয়। তবে আর তিনজন মিলে ডাক্তারের কাছে যাবার কী দরকার! চিকুকে ওর জার্মান ক্লাস থেকে একদম তুলে ফিরবে মামণিরা। তিলকের সঙ্গে দু’একটা কথা বলেই নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল মিঠি। ভীষণ কান্না পাচ্ছে ওর। ঘরের নীলাভ লাইট ল্যাম্পের আলোয় ফুলে ফুলে কাঁপতে লাগল মিঠি।
কতক্ষণ এভাবে শুয়েছিল মিঠি জানে না। হঠাৎ তিলকের গলার শব্দে ওর সম্বিত ফিরল। ‘মিঠি, মিঠি’— তিলক ডাকছে। কী গভীর আর কী মোহময় ওর গলাটা। নিচু খাদের নরম স্বরের ওই উচ্চারণ পাগল করে দিচ্ছে মিঠিকে। মিঠি জবাব দিচ্ছে না। আরও ডাকুক তিলক, চোখ বুজে বালিশ আঁকড়ে শুয়ে আছে মিঠি। ‘মিঠি’, আরও কাছে আসছে তিলকের কণ্ঠস্বর— ‘ইজ এনিথিং রং? কিছু হয়েছে তোমার?’ উদ্বিগ্ন শোনাচ্ছে গলা। বিছানার কাছে এসে একটু ইতস্তত করছে তিলক। খুব অসহায় দেখাচ্ছে মিঠিকে। এই বয়সি মেয়েদের অনেক ধরনের প্রবলেম হতে পারে। সমস্যাগুলোর কথা মেয়েরা মায়েদের খুলে বলে বোধহয়। জুঁইয়ের সঙ্গে মিঠির সম্পর্ক খুব স্বাভাবিক— তবু ওদের মধ্যে কোথাও যেন একটা দূরত্ব রয়েছে যা অতিক্রম করা যায় না। এই ক’দিনে তিলক টের পেয়েছে সেটা। মিঠি আর চিকু দু’বোনের মধ্যেও খুব বেশি ভাব নেই। জুঁই আর শিউলিরই মতো একটু আলগা আলগা ভাব। অবশ্য জুঁই আর শিউলিকে তিলক এই বয়সে দেখেনি। এমনও হতে পারে ওদের মধ্যে আগে খুব ভাব ছিল। পরে দূরে সরে যাবার জন্য তিলকের নিজের দায়িত্বও কম নয়। সাত-পাঁচ নানা কথা মাথায় ঘুরছে তিলকের। বালিশে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কেঁদে যাচ্ছে মিঠি। কতই বা বয়স হবে ওর? বড়জোর উনিশ কি কুড়ি! মিঠির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অদ্ভুত একটা মায়া বোধ করছে তিলক। নিশ্চয়ই অনেক দুঃখ মনের মধ্যে জমা করে রেখেছে ও। বললে কিছু হালকা হবে কি বোঝাটা? একটু অনিশ্চিত ভাবে তিলক খাটের একপাশে বসল। সাবধানে ওর চুলের উপর রাখল একটা হাত— ‘মিঠি, কোনও ব্যাপারে কষ্ট পাচ্ছ কি? যদি আমাকে বললে মনটা একটু হালকা হয়, তবে…’ কথাটা অসমাপ্ত রাখল তিলক। কী বলবে বুঝতে পারল না ঠিক।
মিঠি পাশ ফিরে তাকিয়ে আছে তিলকের দিকে। টকটকে লাল চোখদুটো অনেকক্ষণ কেঁদে ফোলা-ফোলা। তিলকের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু যেন খুঁজছে ও। একটু অস্বস্তি হচ্ছে তিলকের। অস্বস্তি ঢাকার জন্য তিলক একটু জোর করেই বলল, ‘ইউনিভার্সিটির কোনও বন্ধুর সঙ্গে মন কষাকষি হয়েছে?’
ঘাড় নাড়ছে মিঠি, ‘নাহ, ইউনিভার্সিটির নয়।’
ছোট্ট করে বলল ও— ‘তবে?’
‘আরেকজন আছে।’ মিঠি নামটা বলল না। অভিমন্যু এ বাড়িতে বেশ কয়েকবার এসেছে। মামণি বা চিকুর মুখে ওর নাম শুনে থাকতে পারে তিলক। তাছাড়া নামে কী এসে যায়? তিলকও কৌতূহল দেখাল না। শুধু ছোট্ট করে বলল, ‘সে কী বলেছে তোমাকে? ভালবাসে না তোমাকে?’ ঘাড় নাড়ল মিঠি। ‘না, ঠিক তার উল্টো কথাই বলেছে— ভালবাসে।’
‘তবে?’ তিলক একটু অবাকই হয়েছে।
‘তবে কী?’ মিঠির গলার স্বরে ঝাঁজ— ‘ভালবাসলেই কি সব প্রবলেম সলভ্ড?’
‘তুমি ওকে ভালবাস না?’ তিলক এবার কিছুটা রহস্য সমাধানের ভঙ্গিতে বলছে।
‘জানি না। ওকে আমার খারাপ লাগে না। কিন্তু…’ মিঠি চোখ নামাচ্ছে।
‘কিন্তু কী?’
‘আমি আরেকজনকে ভালবাসি।’ স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে বলল মিঠি।
‘সে তোমাকে ভালবাসে না?’
একটা জটিল ধাঁধার সহজ সমাধান দেবার চেষ্টা করছে তিলক। আবার উপচে পড়ছে জল মিঠির চোখ দিয়ে— ‘জানি না, আমি কিছু জানি না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি কিছুই বোঝো না, বুঝতে পারো না!’ ওর কথার ভঙ্গিতে কিছু একটা ছিল। মুহূর্তে মিঠির চুলের মধ্যে থমকে গেছে তিলকের আঙুল। একটা অজানা আশঙ্কা হঠাৎ উঁকি দিয়ে গেল মনের মধ্যে। তবে কি…?
সেই মুহূর্তে তিলকের সব আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে মিঠি দু’হাতে টেনে নিচ্ছে ওর মাথায় রাখা তিলকের ডান হাত। কান্নাভেজা মুখ ঢাকছে তিলকের হাতের পাতায়। ওর চোখের জল, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস… সব বড় বেশি সত্যের মতো সজোরে আছড়ে পড়ছে তিলকের হৃদ্পিণ্ডের ঠিক মধ্যেখানে। তড়িতাহতের মতো উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল তিলক। মিঠি সজোরে ধরে রেখেছে ওর হাত। ‘জবাব তোমার কাছে আছে। জবাব না দিয়ে তুমি কোথাও যাবে না।’ ক্রুদ্ধ আহত অভিমানে টসটস করছে মিঠির মুখ। সত্যি, কী বোকা তিলক! অনেক আগেই তো বোঝা উচিত ছিল। তিলককে ‘তিলকদা’ বলে ডাকতে চেয়েছিল মেয়েটা। ও ওর দৃষ্টি দিয়ে বিদ্ধ করেছে তিলককে প্রতিদিন। ইঙ্গিত দিয়েছে তিলকের প্রতি ওর মনোভাবকে। তিলক অস্বস্তি পেয়েছে তবু বুঝেও বুঝতে চায়নি নিঃশব্দ ইশারা। এখন কীভাবে ওকে ঠেকাবে তিলক? নিজের সর্বশক্তি জড়ো করে উঠে দাঁড়াচ্ছে তিলক, হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছে মিঠির হাত থেকে— ‘অসম্ভব কথা বলছ মিঠি, এ হয় না, হতে পারে না।’ ও কাঁপছে থরথর করে। ‘তুমি আমার কন্যাসমা মিঠি। তাছাড়া আই অ্যাম আ ম্যারেড ম্যান উইথ আ সান।’
মিঠি জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে তিলকের দিকে— ‘বাবা যখন মামণিকে বিয়ে করেন, তখন বাবাও অলরেডি ম্যারেড ছিলেন, আমরা দুই বোনও ছিলাম। বাবার সঙ্গে মামণির ষোলো-সতেরো বছরের তফাত। সেটা ভুলে যেও না।’ তীক্ষ্ণ, কাটা-কাটা ভাবে বলা কথাগুলো তিরের মতো বিদ্ধ করছে তিলককে। ওর মুখ উত্তেজনায় লাল হয়ে গেছে— ‘মিঠি, প্লিজ স্টপ দিস। সব কথা আর কখনও মুখে এনো না। তোমার বয়স অল্প, নর্মাল লাইফ লিড করো, স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে শেখো।’
‘চুপ করো। আর যাই করো, আমাকে জ্ঞান দিও না। মুখের উপর ‘না’ বলতেও সাহস লাগে, সেই সাহসের অভাব অন্য কিছু দিয়ে ঢেকো না প্লিজ।’ মিঠি উত্তেজিতভাবে বলল— ‘আমার যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। আমি কথা দিচ্ছি, এই নিয়ে আর একটা কথাও বলব না আমি।’
তিলকের হাতটা সজোরে ঠেলে দিল মিঠি। তিলক নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল, বেরিয়ে আসছে ঘর থেকে।
‘শোনো,’ মিঠি ডাকল, তিলক ঘুরে তাকিয়েছে ওর দিকে— ‘আমার একটা রিকোয়েস্ট রাখবে? প্লিজ! আর কখনও কিছু বলব না তোমাকে।’
‘কী?’
‘আজকের সন্ধের কথাটা মামণিকে বোলো না। কথা দাও। বাবার শরীর খুব খারাপ। আমাকে নিয়ে কারুর উদ্বেগ বাড়ুক আমি চাই না। আমি নিজেকে নিজে সামলে নিতে পারব। তোমাকে আর ডিস্টার্ব করব না। আই অ্যাম গিভিং ইউ মাই ওয়ার্ড।’
‘তুমি না বললেও বলতাম না। আমি প্রত্যেকের প্রাইভেসির মূল্য দিই। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।’ তিলক কোনওমতে কথাগুলো বলল।
ফিরতে বেশ রাত হল প্রভাতদের। ডাক্তারের কাছে অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছে। বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তার অনেক সাবধানবাণী শুনিয়েছেন। সেই জন্য প্রভাতের মনটা একটু বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে। সুচেতনা কখনওই নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেন না। তবু ভিতরে চিন্তাগ্রস্ত বলে তিনি বাড়ির থমথমে আবহাওয়াটা খেয়াল করতে পারলেন না। মিঠি প্রচণ্ড মাথা ধরেছে বলে খেতেই এল না। তিলকও খাবার নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে উঠে পড়ল। প্রভাতের তো বটেই, এসব ঘটনা সুচেতনারও দৃষ্টি এড়িয়ে গেল। খাওয়া-দাওয়ার পর তিলক বহুক্ষণ বারান্দায় বসে রইল। মাথায় অনেক চিন্তা খেলা করছে।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র