ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আক্রান্ত: পর্ব ৫


    অপরাজিতা দাশগুপ্ত (July 2, 2021)
     

    পর্ব ৪

    স্নান সেরে একটা বারমুডা আর টি-শার্ট গায়ে অভিমন্যু এল বারান্দায়। এই বারান্দাটা আগে সাইজে ছোট ছিল। এবার এসে দেখছে একধাপ সিঁড়ি নামিয়ে ছোট্ট একটা ঝুলবারান্দা করা হয়েছে এটাকে। বাগানের দিক এটা। গাছগুলো বেশ বড় হয়ে পুরোদস্তুর বাগানের চেহারা নিয়েছে। অদিতি খুব যত্ন করেন বাগানের। প্রতিদিন মালি আসে গাছের পরিচর্যা করতে। রঙ্গন, টগর, কাঁঠালিচাঁপা, হাসনুহানা, করবী— অনেক রকম ফুল ফুটে আলো হয়ে থাকে বাগানটা। সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ। বিকেলের আলো প্রায় মরে এসেছে। চা খেতে খেতে অভিমন্যু বলল, ‘দাদু, এই বারান্দার এক্সটেনশনটা কিন্তু সুপার্ব হয়েছে। ঠিক মনে হয় শহর থেকে দূরে বাগানবাড়িতে বসে আছি।’

    শুভঙ্কর গলা খাঁকারি দিলেন, ‘হ্যাঁ, প্রথমে ভেবেছিলাম ওদিকের বারান্দাই তো যথেষ্ট বড়। এটা আর বাড়িয়ে কী হবে! তারপর মনে হল, পশ্চিমের বারান্দাটাই সংস্কার করা যাক। আমিও তো এখন পশ্চিম দিগন্তের যাত্রী। এই দিনান্তবেলার আলোর রেশটুকু বড় মোহময়।’

    কথা বলার আর্টটা দাদুর মজ্জাগত, অভিমন্যু না ভেবে পারে না।

    অদিতি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঝঙ্কার দিলেন— ‘এই মানুষটার স্বভাবই হচ্ছে ভারী ভারী কথা বলে ঘরের আবহাওয়াটা ভারী করে দেওয়া। বাদ দে ওসব। কাজের কথা বলি। আজ কমল এসেছিল (কমলিকাকে এখন অদিতি ছোট করে কমল বলে ডাকছেন)। অনেক গল্প হল।’

    ‘কেন এসেছিল?’, অতর্কিতে প্রশ্নটা বেরিয়ে এল অভিমন্যুর মুখ থেকে।

    ‘ওমা, ও কী কথা? আজ বাদে কাল যে মেয়ে বাড়িতে বউ হয়ে আসবে, সে কি কারণ ছাড়া বাড়ি আসবে না?’

    ‘না, আমি ঠিক তা বলিনি।’ অভিমন্যু শুধরে নিচ্ছে, ‘মানে নিজেই হঠাৎ এল, না তুমি আসতে বলেছিলে?’

    ‘আজ তুই বেরিয়ে যাবার পর ফোনে কথা হচ্ছিল। তখন বলল আজ ছুটি নিয়েছে। বিকেলে পার্লারে যাবে। আর কীসব টুকিটাকি কেনার আছে। তখন আমি চলে আসতে বললাম।’ অদিতি বললেন।

    ঠিকই আন্দাজ করেছিল অভিমন্যু। আজকাল অদিতি প্রায়ই এরকম গোয়েন্দাগিরি করেন। অভিমন্যু বেরোলেই কমলিকার বাড়ি ফোন করে খোঁজ নেন, ওদের বাড়ি গেছে কি না। কমলিকার বাড়ি যাওয়া দিদানের পছন্দ না অপছন্দ, তাও সঠিক বুঝতে পারে না অভিমন্যু। অভিমন্যু ইদানীং প্রায়ই বেরোয়, কোনওদিনই বাড়িতে বলে যেত না বন্ধুদের সঙ্গে বেরোলে। এখনও বলার প্রয়োজন অনুভব করে না। দাদু বা দিদানও কখনও জিজ্ঞেস করতেন না। এখনও করেন না। কিন্তু দিদান এখন কমলিকার কাছে খবর নেন অভি ওখানে আছে কি না। আজ কমলিকাকে দুপুরে ডেকে এনে গল্প করাও আসলে দেখতে চাওয়া, অভি কমলিকার সঙ্গেই আছে কি না। কেন জানে না অভিমন্যু একটু বিরক্ত বোধ করল। বেশ কয়েক বছর ধরে আমেরিকায় একা থেকে থেকে তার একটা তীক্ষ্ণ প্রাইভেসির বোধ তৈরি হয়েছে। এখন পান থেকে চুন খসলেই তার ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে বলে মনে হয়। ভাল না, সবে যৌথজীবন শুরু করতে যাচ্ছে, এ সময় এসব বেখাপ্পা বোধগুলো একটুও ভাল না — আলগা ভাবে চিন্তা খেলা করে গেল মাথায়। 

    আজকাল অদিতি প্রায়ই এরকম গোয়েন্দাগিরি করেন। অভিমন্যু বেরোলেই কমলিকার বাড়ি ফোন করে খোঁজ নেন, ওদের বাড়ি গেছে কি না। কমলিকার বাড়ি যাওয়া দিদানের পছন্দ না অপছন্দ, তাও সঠিক বুঝতে পারে না অভিমন্যু। অভিমন্যু ইদানীং প্রায়ই বেরোয়, কোনওদিনই বাড়িতে বলে যেত না বন্ধুদের সঙ্গে বেরোলে। এখনও বলার প্রয়োজন অনুভব করে না।

    ‘খুকুর কাপড়গুলো দেখালাম ওকে। বিয়ের বেনারসিগুলো, কাঞ্জিভরম, বোমকাই, তসরটা। সবই বিয়ের পর দিয়ে দেব ওকে। শাশুড়ির শাড়ি তো ওরই পরার কথা।’ অদিতি স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে বললেন।

    শুভঙ্কর কখন যেন উঠে গেছেন। ‘খুকুর সব গয়নাগুলো এখনই দেব না। ওগুলো লকারে রাখা থাক, যেমন আছে। শুধু লোহা বাঁধানোটা খুকুর নাম করে দেব, ওটা তো শাশুড়ির দেওয়ার কথা। নতুন গয়নাই দিচ্ছি গড়িয়ে। কমলের মা-বাবাও দেওয়া-থোওয়ার ব্যাপারে কার্পণ্য করবেন না মনে হয়।’ একটু থেমে অদিতি আবার বললেন, ‘তোর সঙ্গে ওদেশে যাক। মানিয়ে নিক। খুকুর বাকি গয়নাগুলো আস্তে আস্তে দেব ভেবেছি। তুই কী বলিস?’

    ‘সে তুমি যা ভাল মনে করো। আমি কী বলব! আমি ঘরে গিয়ে একটু শুচ্ছি।’ অভিমন্যু চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়েছে। অদিতি একটু তেরছা চোখে পর্যবেক্ষণ করার ভঙ্গিতে দেখছেন ওকে। দরজার কাছে পৌঁছনোর আগেই দিদানের গলা কানে এল অভির।

    ‘অভি, তুমি বড় হয়েছ, নিজের ভাল-মন্দ বুঝতে শিখেছ। তবু একটা কথা বলি। আর এক মাসও যার বিয়ের দেরি নেই, তার অন্য লোকের বাড়ি গিয়ে পড়ে থাকাটা ভাল দেখায় না। তা সে যে-ই হোক না কেন!’

    ***

    আশ্চর্য! কী করে বুঝলেন দিদান? পর্দা ফেলে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে তবু ঘুম আসছে না অভিমন্যুর। আজকের সব ঘটনাগুলোই মনের মধ্যে খেলা করছে। চিত্রলেখা বলে ওই পাগলিটাকে যেদিন বাড়ি পৌঁছে দেওয়া থেকেই সূত্রপাত হয়েছে গণ্ডগোলটার। মেয়েটার মনটা বড় ভাল। তবে ছিট যে একটু আছে তাতে সন্দেহ নেই। সেই প্রথমদিন থেকেই ওর একটা অদ্ভুত দাবি কাজ করছে অভিমন্যুর প্রতি। সমবয়সি বন্ধুবান্ধব বিশেষ নেই চিত্রলেখার, যা বুঝেছে অভিমন্যু। কিন্তু একদম অসমবয়সি অভিমন্যুর প্রতি হঠাৎ কেন যে এমন আকর্ষণ বোধ করছে মেয়েটা! অন্তত পনেরো-ষোলো বছরের বড় হবে অভিমন্যু ওর থেকে। নাকি আরও বেশি? অথচ অভিমন্যুকে ওর সঙ্গেই সর্বক্ষণ কথা বলতে হবে। শুধু ওরই সঙ্গে। অভিমন্যু যেন ওর নিজস্ব খেলার পুতুল। এই ক’দিনে রোজ দিনে তিন-চারবার করে ফোন করে ও। একটা পুঁচকে মেয়ের সঙ্গে কাঁহাতক আর বকবক করতে পারে অভিমন্যু! ও এমনিতেই খুব কম কথা বলে। ওই প্রান্তে একাই বকবক করে মেয়েটা ওর নিজের কথা, পারিপার্শ্বিক, স্কুল, বাবা, সৎমা-র (যাকে ওরা ‘মামণি’ বলে) কথা বলে। কেন যেন বেজায় রাগ ওর সৎমার উপর। অথচ ভদ্রমহিলা মোটেই খারাপ না। কোন একটা কলেজে পড়ান। খুব আলাপী। প্রথমদিন ওদের বাড়িতে যাবার পর দিব্যি ওকে তুমি-তুমি বলে কথা বলতে লাগলেন। খুব স্নেহের সঙ্গে। অথচ কতই বা বয়স হবে ওঁর! বড়জোর চল্লিশ। তাহলে অভিমন্যুর চেয়ে আট-ন বছরের মাত্র বড়। চিত্রলেখা, যার ডাকনাম চিকু, মোটেই সহ্য করতে পারে না ওঁকে। ওর একটা নিজস্ব জগৎ আছে। কিছুটা কল্পনা, কিছুটা বাস্তবের মাটিতে পা দিয়ে চলে ও। ওদের চত্বরে একটা বিশাল কম্পাউন্ডওয়ালা পাঁচিল ঘেরা বাড়ি দেখিয়ে সেদিন বলেছে, ‘এই বাড়িটায় আমার বিলেতের দাদা-বৌদি থাকে।’

    ‘বিলেতের দাদা-বৌদি মানে? বিলেতে থাকেন? তাহলে এখানে থাকেন বলছ কেন?’ অভিমন্যু প্রশ্ন না করে পারেনি।

    ‘আহ, অত বকবক করো কেন? যখন আসে তখন থাকে। কোনও ষোলো-সতেরোর কিশোরীর মনের মধ্যে এমন কল্পনার পৃথিবী গড়তে আগে দেখেনি অভিমন্যু। মেয়েটার মধ্যে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আছে। বিলেতের দাদা-বৌদির ব্যাপারটা পরে চেক করে দেখেছে অভিমন্যু চিত্রলেখার দিদির কাছে। ও বলেছে ওটা নাকি টালিগঞ্জের কোন ফিল্মস্টারের পরিত্যক্ত বাড়ি। কেয়ারটেকার রয়েছে। কিন্তু ফিল্মস্টার নিজে কখনও আসেন না। চিত্রলেখা অবশ্য ঘুণাক্ষরেও জানে না এ নিয়ে যে কথা হয়েছে ওদের মধ্যে। এমনিতে ও খুব বলে ওর দিদির কথা। দিদি ওকে আগে খুব বকত। সেদিন অভিমন্যু বারণ করে দেবার পর থেকে নাকি আর একটুও বকেনি দিদি। ‘দিদি তোমাকে খুব ভয় পায়, জানো তো? সেদিন বলছিল, বাবা, কী গম্ভীর! চশমার ফাঁকে যেন রাশভারি প্রোফেসর। হিহি।’ খুব হাসছিল চিত্রলেখা। অভিমন্যুর হৃৎপিণ্ড হঠাৎ থমকে গেছিল। এর আগে ক’দিন ভিতরে ভিতরে অদম্য কৌতূহল পাক খাচ্ছিল অভিমন্যুর মনে। সেদিন ওকে দেখার পর থেকেই। কেন ও জানে না। মেয়েটি ঠিক কী ভাবছে ওর সম্পর্কে? ভিতরে ভিতরে কেমন যেন একটা অস্বস্তি। ওর নাম মন্দাক্রান্তা। সংস্কৃত ভাষার একটা ছন্দের নাম। ডাকনামটা আরও সুন্দর— মিঠি। চিত্রলেখাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে যখন বাড়ি পৌঁছে দিতে গেছিল তখন দরজা খুলে দিয়েছিল মিঠিই। ওর সঙ্গে অল্প কিছু কথার পরই প্রথমে ওদের মামণি ফিরে এসেছিলেন। তারপর বাবা। বেশিক্ষণ মিঠিকে দেখার সুযোগ পায়ইনি অভিমন্যু। একনাগাড়ে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ও যদি কিছু মনে করে? ওর বাবা-মাও খারাপ ভাবতে পারতেন। তাছাড়া নিজেকেই নিজে শাসন করছিল অভিমন্যু— ছিঃ! একজন মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে। সব দেখেশুনেই মত দিয়েছ তুমি। এখন বিয়ে করতে কলকাতায় এসে সম্পূর্ণ অচেনা একটা বাচ্চা মেয়ের দিকে ঝুঁকতে লজ্জা করে না তোমার?

    সেদিন বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে উঠে এসেছিল অভিমন্যু। একফাঁকে যখন আর কেউ ছিল না, তখন মন্দাক্রান্তাকে সাবধান করে দিতে ভোলেনি— ওর বোন একটু ডিস্টার্বড রয়েছে, ওরা যেন বকাবকি না করে। বরং একসময় বুঝিয়ে-সুঝিয়ে একজন কাউন্সেলরের কাছে নিয়ে যাওয়াই ভাল। চুপ করে শুনেছিল মিঠি। কোনও মন্তব্য করেনি। বেশ কয়েকদিন পরে কথাপ্রসঙ্গে চিকু বলেছিল মিঠির কী মনে হয়েছে অভিমন্যুকে দেখে।

    অন্ধকার ঘরে শুয়ে অভির সে-কথা মনে পড়ল আবার। এ ক’দিন বারবার দেখা হচ্ছে মিঠির সঙ্গে। কারণে- অকারণে। কিন্তু কখনওই একা নয়। চিকুই বারবার ডেকে আনছে অভিমন্যুকে। আজকে সন্ধেয় তোমাকে আমার বাড়ি আসতেই হবে। কোনও ওজর-আপত্তি শুনতে চায় না চিকু। তার অভিমন্যুকে তাই এর মধ্যে বারবার যেতে হয়েছে ওদের বাড়ি। আর তখনই সবিস্ময়ে অভিমন্যু বুঝতে পেরেছে, ওই বাড়িতে যেতে ওর ভাল লাগছে। ওখানে মিঠি আছে। এই পনেরো দিনে কমলিকার সঙ্গে ওর দেখা হয়েছে দু-তিনবার। তার কারণ কমলিকা নিজেই খুব ব্যস্ত। ‘আর ক’টা দিন। তারপর তো ছেড়েই দিচ্ছি চাকরিটা। তারপর উই ক্যান হ্যাভ সাম আস টাইম টুগেদার।’ একটু অ্যাপোলোজেটিকালি বলেছে কমলিকা।

    ‘ইউ শুড নট বি সো অ্যাপোলোজেটিক। চাকরি চাকরিই, যতদিন সেটা করা হচ্ছে। আফটার অল উই হ্যাভ আ হোল লাইফ টু বি উইথ ইচ আদার।’ অভিমন্যু হেসে বলেছিল। কিন্তু মনে মনে হাঁফ ছেড়েছিল, রোজ কমলিকার সঙ্গে দেখা করার জন্য সল্টলেক ছুটতে হচ্ছে না বলে। কমলিকাকে ওর ভালই লাগে, কিন্তু ওকে খুব একটা মিস করে না অভিমন্যু। যার সঙ্গে বিয়ের পর পুরো জীবন কাটাবার কথা, তার সঙ্গে দেখা হবার কোনও তাগিদ অনুভব করছে না বলে, মনে মনে বিব্রতই বোধ করছে ও। বরং কমলিকা এসেছিল শুনে আজ একটু উদ্বেগই হল, যেটা হওয়া আদৌ উচিত ছিল না। উচিত-অনুচিতের সংজ্ঞা এখন পুরোপুরি গুলিয়ে গেছে অভিমন্যুর। এই যে মিঠি বলে মেয়েটার চোখদুটো ওকে এত টানছে, এটা কি আদৌ হওয়া উচিত ছিল? অথচ টানছে যে, তাও তো নিজের কাছে অস্বীকার করতে পারছে না অভিমন্যু। যাদবপুরের ফ্ল্যাটটা থেকে থেকে মনে আসছে। বসার ঘরের পর্দা উড়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মিঠিদের ঘরটা। সেখানে দু’বোনের দুটো পড়ার টেবিল। একটা টেবিলল্যাম্প জ্বেলে পড়তে বসেছে মিঠি। পরনে একটা নীল রঙের সালোয়ার কামিজ। শ্যামলা রঙের বেণী বাঁধা মিঠির মুখখানায় কোথায় যেন একটা বিষণ্ণতা মাখানো। একটু আগেই এক বন্ধুর বাড়ি দেখা হয়েছে মিঠির সঙ্গে। সেই বন্ধুর বাড়ি মিঠি আর চিকুর নেমতন্ন ছিল। চিকু প্রায় জোর করেই নিয়ে গেছে অভিমন্যুকে। মিঠির সায় ছিল কি না জানে না অভিমন্যু, তবে আপত্তিও নিশ্চয়ই ছিল না। হলুদ-জংলা প্রিন্টের স্কার্ট আর টপ পড়েছিল মিঠি। একটা মিষ্টি ঢলঢলে লাবণ্যে ভরা ওর মুখখানা। দোহারা চেহারা। চোখের পড়ার মতো কিছু নয়। কমলিকার মতো নিখুঁত সুন্দর বা স্মার্ট আদপেই নয় মিঠি। তবু কেন যে মিঠি আর পাঁচটা মেয়ের চেয়ে আলাদা? সেটাই গভীর ভাবে ভাবছে অভিমন্যু। এই অন্ধকার ঘরেও সব কিছু খুব বেশি স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে ও। ও ধরা পড়ে গেছে। তিরিশ পার হলে যখন আর প্রেম হবে না মনে করে দাদু-দিদানের পছন্দের মেয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিল, ঠিক তখনই প্রেমে পড়ে গেছে ও একটা হাঁটুর বয়সি মেয়ের। সমস্ত মন জুড়ে শুধু মিঠি। টের পেল হাফপ্যান্টের তলায় কাঠিন্য জাগছে শরীরে। অন্ধকারে মুখ বালিশে গুঁজে সমস্ত সর্বদেহান্তকরণে ও ডাকতে লাগল— মিঠি, মিঠি, মিঠি…।

    ***

    তিলক আজ কলকাতায় ফিরেছে। দিনকয়েক ও দেশের বাড়িতে গেছিল। ওর দেশ লাভপুরের কাছে একটা গ্রামে। বাবা-মা মারা গেছেন বহুকাল হল। কলেজে পড়বার সময় থেকেই দাদাদের অন্নে প্রতিপালিত সে। যখন যাদবপুরে পড়তে আসে সেই সময় থেকেই তিলক বাড়িছাড়া। বাবা-মা চলে গেলেও দাদা-বৌদিদের সঙ্গে ভালই সম্পর্ক ছিল তিলকের। গ্রামের স্কুলে মাস্টারি করতেন বটে তিলকের বাবা, কিন্তু এলাকায় তাদের জমিজমাও বিস্তর। তাদের গ্রামে আগে মাত্র দু-তিনটে পাকাবাড়ি ছিল। তার মধ্যে তিলকের বাবার বাড়িটা ছিল দোতলা। অর্থকষ্ট জিনিসটা সেভাবে কখনও বোঝেনি তিলক। পড়াশোনায় সে বরাবরই মেধাবী। যাদবপুরে হস্টেলে থেকে পড়ার ব্যাপারে দাদারা কখনওই আপত্তি করেনি। অবশ্য সে সময়ে নিজের উদ্যোগেই খানতিনেক টিউশনি করত তিলক। নিজের কলকাতায় থাকার খরচটা চালিয়ে নিত। কলেজে পড়াকালীনই বাবা মারা যাওয়ার পর স্বাবলম্বনের একটা জেদ তৈরি হয়েছিল। তিলকের দুই দাদাই চেয়েছিল তিলকও দেশে থেকে মাস্টারি করুক। আট কিলোমিটার দূরে কলেজেও পড়াতে পারত সে ইচ্ছে হলেই। কিন্তু ততদিনে শহরের জীবন তিলকের মন বদলে দিয়েছে। স্থায়ীভাবে গ্রামে বাস করা আর সম্ভব ছিল না। বিয়ের পর সুদর্শনাকেও গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে হয়েছিল। অবশ্য সে নাম কা ওয়াস্তে। নাহলে দাদা-বৌদিরা ক্ষুণ্ণ হত। কয়েক দিন পরেই কলকাতায় ফিরে এল তিলকরা। তখন সামনে জার্মানি যাবার প্রস্তুতি। নতুন দেশে নতুন সংসারজীবনের আকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ শিউলি। বিদেশে চলে যাবার পর সেভাবে আর দেশের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ নেই। কালেভদ্রে দু’একটা চিঠি-চাপাটি। বিজয়ার পর অবশ্য নিয়ম করে তিলক চিঠি দেয় একটা। শিউলিও লেখে দু’এক লাইন। যদিও সেভাবে ও ওই মানুষগুলোকে চেনেই না। রোদ্দুরকে দেখাতে একবার যখন এল তখন নবজাতকের ছবি নিয়ে তিলকই একবার দেখা করে এসেছিল দাদাদের সঙ্গে। খুব খুশি হয়েছিল দাদারা— ব্যাটা একমাত্র বংশধর বলে কথা। সোনার আংটি দিয়েছিল দুই দাদা মিলে। দাদাদের সব মেয়ে।

    সুচেতনা আজ তাড়াতাড়ি কলেজ থেকে ফিরেছেন। তিলক যদি কোথাও বেরোতে চায়, তবে ওকে নিয়ে যেতে হবে। যদিও গাড়ি চালাতে ভালবাসেন, তবু সুচেতনার মাঝেমধ্যে মনে হয়, একজন ড্রাইভার থাকলে ভালই হত। নিদেনপক্ষে পার্ট টাইম। কিন্তু পার্ট টাইম ড্রাইভারদের ধরাবাঁধা সময় থাকে। সুচেতনার কলেজে এক-একদিন এক-এক সময়ে ক্লাস। কোনওদিন সকালে, কোনওদিন দপুরে। তার উপর এখন পরীক্ষার মরশুম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সব অন্য অনেক কলেজের মতোই তাঁদের কলেজেও বি.এ., বি.এস.সি., বি.কম. এসব হরেক রকম পরীক্ষার সিট পড়ে। তখন পরীক্ষার ইনভিজিলেশন ডিউটি দেওয়াটাও তাঁর অত্যাবশ্যক কাজের মধ্যেই পড়ে। এত রকম সময় অ্যাডজাস্ট করে কোনও পার্ট টাইম ড্রাইভার কাজ করবে না। ফুল টাইম ড্রাইভার রাখা তাঁদের সাধ্যের বাইরে। কাঁধে বিশাল লোনের বোঝা, প্রভাতের চাকরিও প্রায় শেষের মুখে। সুচেতনার চেনা পরিচিত অনেকেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার পাশাপাশি টিউশনি করেন। সুচেতনা বা প্রভাত কখনও প্রাইভেটে ছাত্র পড়িয়ে অতিরিক্ত অর্থ রোজগার করার কথা ভাবেননি। অবসর সময়ে ভাল বই পড়ে অথবা নিজেদের পড়াশুনোর কাজ করেই কাটাতে চেয়েছেন। দুজনে রোজগার করলেও সুচেতনা খুব সাবধানে সংসার চালান। মিঠি, চিকু দুজনের পড়াশুনো, নিজের পায়ে দাঁড়ানো পর্যন্ত একটু সাবধানে চলতেই হবে। ওদের বিয়ের জন্যও নিয়মিত ভাবে সঞ্চয় করেন সুচেতনা। যদিও বিয়ে যে করতেই হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। ওদের যা ভাগ্যে আছে, তাই ঘটবে। ভবিতব্যকে যে খণ্ডানো যায় না, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝেন সুচেতনা।

    আজ দশটা থেকে একটা অবধি পরীক্ষার ডিউটি ছিল। দুটো নাগাদ বাড়ি ঢুকে গেলেন সুচেতনা। অন্যদিন ভাত খেয়ে বেরোন। কিন্তু আজ হেভি ব্রেকফাস্ট করে গিয়েছিলেন। আজ তাঁর পরে প্রভাত বেরিয়েছেন, মেয়েরাও। প্রভাতের মোটামুটি বাঁধা রুটিন। তিনি সকালে দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া সেরে কাঁধে সাইড ব্যাগ ঝুলিয়ে ইউনিভার্সিটির দিকে রওনা দেন। প্রভাত প্রোফেসর হয়ে গেছেন অনেকদিন। তাঁর ক্লাসের চাপ বেশি নয়। লেকচারার থেকে রিডার অবধি ক্লাস বেশি থাকত তুলনামূলক ভাবে। এখন তাঁর দিনে একটা কি দুটোর বেশি ক্লাস থাকে না। বাকি সময়টা ডিপার্টমেন্টে নিজের ঘরে বসে বিভিন্ন লেখালিখির কাজ করেন প্রভাত। বিষয়ের বই ছাড়াও বেশ নিয়মিত ভাবেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালেও তাঁর প্রবন্ধ বেরোয়। যত দিন যাচ্ছে এই প্রোফেশনাল কমিটমেন্টগুলো বাড়ছে। বাড়ছে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাজকর্মও। সিনিয়র অধ্যাপক হবার সুবাদে। ডিপার্টমেন্টের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ধরনের কমিটির সঙ্গে জড়িত তিনি। সেই সংক্রান্ত দায়দায়িত্বও কম নয়। ক্লাস বা মিটিং না থাকলে সাধারণত প্রভাত ডিপার্টমেন্টে নিজের ঘরেই কাজকর্মে বুঁদ হয়ে থাকেন। অধ্যাপক হিসেবে তাঁর নিজস্ব ঘরে কিছুকাল হল কম্পিউটারও বসেছে। ইদানীং নেট সার্ফিং করা তাঁর প্রিয় অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিদেশে থাকা বন্ধুবান্ধব, প্রিয়জনদের সঙ্গে প্রভাতের যোগাযোগ হয় ৷ তবে তার চেয়েও বেশি ভালবাসেন বিভিন্ন ওয়েবসাইটে গিয়ে পছন্দের বিষয়গুলি নিয়ে জানতে।

    মাঝেমধ্যেই প্রভাতের মনে হয়, সাইবার বিপ্লব সত্যিই পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞানভাণ্ডারকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। শুধু একবার মাউস ক্লিকের অপেক্ষা। এই নতুন নেশায় মজার পর থেকে প্রভাত লক্ষ করছেন, তিনি প্রকৃত অর্থেই ঘরকুনো হয়ে গেছেন। আগে মাঝেমধ্যেই ইউনিভার্সিটি চত্বরে বিভিন্ন আড্ডার ঠেকে তাঁকে দেখা যেত। কিন্তু এখন প্রভাত পারলে সারাদিনই ডিপার্টমেন্টে তাঁর নিজস্ব ঘরটিতে কাটান। ঘরেই ক্যান্টিনের লোক খাবার দিয়ে যায়। বেশিরভাগ দিনই ডিম-টোস্ট বা রুটি-ঘুগনি, কোনও কোনও দিন চাউমিন। শীতের দিনে চারটে আন্দাজ প্রভাত বেরিয়ে পড়েন। যাতায়াতের পথে চেনা মুখ দেখলে মিলনের দোকানে বসেন একটু। চা খেতে খেতে দু’একটা কথা হয়। বেশ লাগে প্রভাতের। গরমের দিনে অন্তত পাঁচটার আগে প্রভাত ঘর থেকে বেরোন না। গল্পগাছার পরও ছ’টার বেশ আগেই সাধারণত বাড়ি পৌঁছে যান। কতটুকুই বা সময় লাগে বাড়ি যেতে! টুকটুক করে হেঁটেও দশ মিনিটের বেশি নয়। কোনওদিন বাড়ির জন্য টুকিটাকি কিছু কেনার থাকলে সুচেতনা আগে থেকে বলে রাখেন। সেসব দিনে ইউনিভার্সিটির ভিতর দিয়ে একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত অবধি হাঁটেন প্রভাত। দু’নম্বর গেট দিয়ে বেরিয়ে এইট-বি’র বাজার থেকে কিনে নেন সবজি কি ফল। যদিও বাজার করাটা তাঁর নিত্যকর্মের মধ্যে পড়ে না। তাঁর সংসারের অন্য সব কিছুর মতোই বাজার করার ভারও সুচেতনাই নিয়েছেন। বছর ছয়েক আগে যাদবপুরে এই ফ্ল্যাটে আসার পর থেকে প্রভাতদের সংসারের ছিমছাম ব্যাপারটা আরও বেড়েছে। বাজার-হাট সবই ভীষণ কাছে। মিঠিও তাঁর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর থেকে তারও হাঁটা পথ। চিকুর স্কুলও দু’স্টপেজের দূরত্বে এবং সেখানে যাবার জন্য চিকুর বাঁধা রিকশা আছে। এখানে আসার পর চিকুকে এই স্কুলে দেওয়া হয়েছে ওর তালতলার স্কুল ছাড়িয়ে, মূলত কনভিনিয়েন্সের জন্য। শুধু সুচেতনার কলেজটাই যা একটু দূরে হয়ে গেছে। তালতলার পুরনো বাসাতে থাকলে সুচেতনার যাতায়াতের সুবিধা হত। সুচেতনার অবশ্য এ জন্য কিছু যায় আসে না। গাড়ি নিয়ে কলেজ গেলে এই দূরত্ব কোনও দূরত্ব নয়। শুধু নিজে চালাতে হয়, এই যা। গাড়িটা কেনার পর শুধু যে কলেজ যাবারই সুবিধা হয়েছে তা নয়, এখন বাজার-হাট-দোকান সর্বত্র সুচেতনা গাড়ি নিয়েই সুবিধে পান। মাসকাবারি বাজারের জন্য ফাঁড়ির ওপাশে ফুডমার্টে যান সুচেতনা। ওখানকার ছেলেগুলো চেনে, ব্যাগভর্তি জিনিস হাসিমুখে তুলে দেয় গাড়িতে। সবজি আর মাছ কেনেন যাদবপুর বাজারে। প্রভাতের প্রিয় লঙ্কার আচার কেনবার জন্য অবধি নির্দিষ্ট জায়গা আছে তাঁর।

    শীতের দিনে চারটে আন্দাজ প্রভাত বেরিয়ে পড়েন। যাতায়াতের পথে চেনা মুখ দেখলে মিলনের দোকানে বসেন একটু। চা খেতে খেতে দু’একটা কথা হয়। বেশ লাগে প্রভাতের। গরমের দিনে অন্তত পাঁচটার আগে প্রভাত ঘর থেকে বেরোন না। গল্পগাছার পরও ছ’টার বেশ আগেই সাধারণত বাড়ি পৌঁছে যান। কতটুকুই বা সময় লাগে বাড়ি যেতে! টুকটুক করে হেঁটেও দশ মিনিটের বেশি নয়। কোনওদিন বাড়ির জন্য টুকিটাকি কিছু কেনার থাকলে সুচেতনা আগে থেকে বলে রাখেন।

    দুপুরে বাড়ি ফিরে স্নান সেরে সুচেতনা একবার ভাবলেন, এসি চালাবেন কি না। গতবছর হিট ওয়েভ চলার সময় এসি-টা কিনতে বাধ্য হয়েছিলেন সুচেতনা। কোন ঘরে লাগাবেন, তাঁদের নিজেদের শোবার ঘরে, নাকি মেয়েদের ঘরে, ভাবতে ভাবতে শেষ অবধি ঠান্ডা মেশিনটা গেস্টরুমেই লাগিয়েছিলেন সুচেতনা। যার যখন ইচ্ছে, এসে একটু ঠান্ডা হাওয়া খেয়ে যাবে। আর গেস্টরুমটার পশ্চিমে জানলা। রোদও পড়ে সবচেয়ে বেশি। ভাগ্যিস লাগিয়েছিলেন! নয়তো এবারে এসে তিলকের কষ্ট হত খুব। শীতের জায়গায় থেকে অভ্যস্ত, গরমে ভীষণ কাহিল হয়ে পড়ে বেচারা। এবার এসে ওর গ্রামের বাড়ি যাওয়া অবধি যে তিনদিন ছিল, তার মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই খুব কাজে লেগেছে এসি-টা। রাত্রে তো বটেই, দুপুরেও অনেকক্ষণ এসি চালিয়েছিল তিলক। ভাবতে ভাবতেই একটু চঞ্চল হলেন সুচেতনা। এখনও ফিরল না তিলক। আড়াইটে বাজে। অথচ আজ দুপুরেই ওর ফেরার কথা। সেজন্যই তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছেন সুচেতনা, যাতে তিলককে দরজা বন্ধ দেখে অপেক্ষা করতে না হয়। অবশ্য সুচেতনা একটু দেরিতে ফিরলেও কোনও অসুবিধে ছিল না। ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে প্রভাতের কাছ থেকে চাবি নিয়ে আসতে হত তিলককে। ওকে সেরকম বলাই আছে। তবুও যতই বন্ধু বা আত্মীয় হোক, তিলক এ বাড়িতে অতিথি। সে চাবি খুলে টেবিলে চাপা দিয়ে রাখা খাবার নিজে নিজে তুলে খাবে— এটা সুচেতনা হতে দিতে পারেন না। প্রভাতের একটা মানসম্মানের ব্যাপার আছে গৃহকর্তা হিসেবে। তাছাড়া কয়েকদিন বাদে গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরবে— তিলকও নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত থাকবে। তাকে যতটা পারা যায় আপ্যায়ন করাই উচিত। তিলক কি এসে খাবে, নাকি ও স্টেশন থেকেই খেয়ে আসছে— কিছুই বুঝতে পারছেন না সুচেতনা। একটা ফোন করলেও তো পারত! সুচেতনা বা প্রভাত সেলফোন ব্যবহার করেন না। প্রভাত ও-জিনিসের প্রয়োজনই নেই মনে করেন। সুচেতনা যেটুকু সময়ে বাড়ির বাইরে থাকেন, সেটুকুর জন্য পয়সা নষ্ট করে সেলফোন কেনার মানে হয় না। তাছাড়া কিনলে মিঠিকেই আগে একটা কিনে দিতে হয়। উঠতি বয়সের মেয়ে, ওর বন্ধুবান্ধব সকলেরই সেলফোন আছে। ওকে না দিয়ে নিজে আগে কী করে কিনবেন— এইসব সাতপাঁচ ভেবে শেষ অবধি আর কেনা হয়নি। মিঠি-চিকুকে অল্প বয়স থেকে দেখছেন, কন্যাসমা বলে কাছে টেনে নিয়েছেন। তবু ওরা যে তাঁর নিজের মেয়ে নয়, এই ভাবনাটা ভিতরে ভিতরে কোথাও রয়ে গেছে বোধহয়। মিঠি নিজের সন্তান হলে কি ওর সেলফোন নেই বলে নিজেও কিনবেন না এমন আজগুবি ভাবনা মাথায় আসত? আজকাল আর নিজেকেই নিজে ভাল বুঝতে পারেন না সুচেতনা। যেমন এখন তিলকের জন্য অসম্ভব চিন্তা হচ্ছে তাঁর। এদেশে ট্রেন সময়মতো চলে না, যে কোনও সময় রাস্তাঘাটে গণ্ডগোল হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এসব জেনেও অকারণ টেনশনে ভুগছেন তিনি। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে তিলক সকালের ট্রেনই ধরেনি। এতদিন পরে ওর দাদারা নিশ্চয়ই ওকে আর একটা দিন থেকে যেতে বলেছেন। কিন্তু বেরোবার সময়ও তিলক বলে গেছে, ‘এমার্জেন্সি কিছু না হলে দুপুরের মধ্যে ফিরছিই। আমার খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে দিও। যত বেলাই হোক, এসে খাবই।’ এসব ভেবে এখন হঠাৎ ভয়ানক চিন্তা হতে লাগল সুচেতনার। যদি তিলকের কিছু হয়, তবে শিউলিকে কী করে মুখ দেখাবেন তিনি? বুকের মধ্যে থেকে সম্পূর্ণ অকারণ বিজগুড়ি কাটছে ভয়, তিলকের অমঙ্গল আশঙ্কায় ঢিবঢিব করছে বুক। সকালের খাবার পর থেকে আর কিছুই খাননি সুচেতনা তবু খিদে-তেষ্টা কিছুই বোধ হচ্ছে না তাঁর। দুপুরের রোদ আড়াল করবার জন্য সব ঘরের ভারী পর্দা টেনে দিয়েছেন সুচেতনা। তিলকের ঘরে এসি চালিয়ে রেখেছেন যাতে তেতে না থাকে। ঘর আর বারান্দা করে ক্লান্ত সুচেতনা ক্লান্তভাবে সোফায় বসে পড়লেন। একটা ফোন করে খবর দিতে পারল না তিলক? ওর কি একবারও মনে হল এখানে কেউ ওর জন্য চিন্তা করতে পারে! ভাবতে ভাবতে চোখ ফেটে জল আসছে। অদ্ভুত একটা অসহায় কষ্টে ভিতরে ভিতরে ছটফট করছেন সুচেতনা।

    ঝোড়ো কাকের মতো তিলক ফিরেছে। চুলগুলো উসকোখুশকো। কিটব্যাগ নামিয়ে রাখতে রাখতে ও বলল, ‘সরি, অনেক দেরি হয়ে গেল। ট্রেন ক্যানসেল হয়ে গেছিল।’

    ‘তোমার ঘরে যাও। এসি চালিয়ে দিয়েছি।’ সুচেতনা নিজের আবেগকে প্রাণপণ সম্বরণ করে বললেন। আগে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে তারপর খাবে।

    তিলক একবার তাকাল। এবার দেশে আসার পর সুচেতনা লক্ষ করেছেন, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রেখেছে ও। চুলগুলোও বেশ লম্বা লম্বা। এখন অবিন্যস্ত চেহারায় ওকে হঠাৎ দেখলে একটু খ্যাপাটে সাধক বলে ভ্রম হচ্ছে। তিলক একটু কাতরভাবে বলল, ‘স্নান পরে হবে। ট্রেন ধরার সময়ে স্নান সেরেই বেরিয়েছি। ট্রেন জার্নির ধকলে মাথাটায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। তোমার কাছে কোনও পেইন রিলিভিং বাম আছে জুঁই?’

    ভারী পর্দা-টানা ঘরে আবছায়া অন্ধকার। বাইরের পোশাক ছেড়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে নিয়েছে তিলক। অম্রুতাঞ্জনের শিশি নিয়ে ঘরে ঢুকছেন সুচেতনা, ‘আমি মালিশ করে দিচ্ছি।’ তিলকের মৃদু আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন সুচেতনা। তিলক ওর হাত দিয়ে স্পর্শ করছে সুচেতনার হাতকে। নিজের ভিতরের এতক্ষণের চাপা আবেগকে আর বশে রাখতে পারছেন না সুচেতনা।

    ‘তুমি ফিরছিলে না কেন তিলক? আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল, খুব রাগ হচ্ছিল তোমার উপর।’

    ‘তোমার মুখ দেখে বুঝতে পেরেছি জুঁই। কী করব বলো, তুমি তো জানো এখানে ফেরার উপর কারও হাত নেই। ট্রেন যে ক্যানসেল হবে, তা তো আমি জানতাম না।’

    ‘মনে হচ্ছিল তোমার জন্য যেন অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করে আছি।’ অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখ বেরিয়ে গেল সুচেতনার।

    তিলক এবার বেশ অবাক হয়েছে। বিস্মিতভাবে ও বলল, ‘তুমি কি কখনও আমার অপেক্ষায় ছিলে জুঁই? আমার তো মনে হয় আমাদের না-হওয়া সম্পর্কের মধ্যে একটা অনন্ত অপেক্ষা রয়েছে। সেটা শুধুই আমার তরফে।’ তিলক একটু থামল, একটু যেন দ্বিধাগ্রস্ত বলবে কি বলবে না। তারপর বলল, ‘জুঁই একটা জিনিস ভেবেছিলাম তোমাকে কোনদিনও বলব না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না বলেই বা কী হবে? আস্তে আস্তে তো আমরা সকলেই বুড়ো হয়ে যাব, আমাদের এসব ছোট-বড় পাওয়া এবং না-পাওয়াগুলো নিয়েই। তার চেয়ে জানিয়ে দেওয়াই ভাল। এই এতগুলো বছরে এমন একটা দিনও যায়নি যখন আমি তোমার কথা ভাবিনি। তুমি আমার বউ-এর দিদি বলে নয়। ইউ নো, হোয়াট আই মিন। সেই যে যাদবপুরে ঝিলের পাড়ে তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলে, মনে আছে? সেই দিন থেকে তুমি আমার সঙ্গে কোথাও একটা রয়ে গেছ।’ একটু থেমে তিলক আবার বলছে, ‘শিউলিও জানে সে কথা। ইন ফ্যাক্ট, ও আমাকে বিয়ের কয়েক মাস পর জিজ্ঞেসও করেছিল।’

    মুখ নামিয়ে শুনছেন সুচেতনা। শিউলি তাহলে পুরো ব্যাপারটাই জানে? ‘কী বলেছো তুমি শিউলিকে?’

    ‘যা সত্যি তাই বলেছি। ও জানতে চেয়েছিল, আমার মনে তোমার জন্য একটা বিশেষ জায়গা আছে কি না। আমি অস্বীকার করিনি। অস্বীকার করেও লাভ হত না।’ তিলক করুণ হাসছে, ‘মেয়েরা এসব জিনিস ইনস্টিংক্ট দিয়ে বোঝে বলে আমার ধারণা।’

    ‘কেন বললে তুমি? কেন ওর মনটা ভেঙে দিলে?’ সুচেতনা আর্তনাদের মতো বললেন।

    ‘না বললে কি বাড়তি লাভ হত বলো? ও তো প্রথম থেকেই আঁচ করেছিল, আমার মনে তোমার জন্য বিশেষ জায়গা আছে। আর শুধু এটুকুই তো, তাই না? তোমার সঙ্গে আমার তো সেই অর্থে কোনও সম্পর্ক হয়নি জুঁই। ইন ফ্যাক্ট, আই হ্যাভ নেভার টাচ্‌ড ইউ বিফোর টুডে। খাতা-বই এক্সচেঞ্জ করতে গিয়ে কখনও হয়তো আঙুলে আঙুলে স্পর্শ হয়েছে। কিন্তু আজ যেভাবে তোমার ওই আঙুলগুলো নিয়ে খেলছি, সেরকম কি হত যদি না তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে আসতে?’

    কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে তিলকের আঙুল খেলা করে যাচ্ছে সুচেতনার আঙুলে। সুচেতনা বাধা দিচ্ছেন না, সম্মোহিতের মতো শুধু তাকিয়ে আছেন তিলকের দিকে। ইউনিভার্সিটির সেই তিলকের চেয়ে উনিশ-কুড়ি বছর পরের এই পুরুষ অনেক বেশি আকর্ষণীয়। বিদেশে স্বচ্ছল জীবনে অভ্যস্ত তিলকের নির্মেদ চেহারা, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, লম্বা চুল, এক অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তিত্ব দিয়েছে তিলককে।

    ‘শিউলি কি এবার এইজন্যই এল না?’ সুচেতনা জিজ্ঞেস করছেন।

    তিলক হাসল, ‘তুমি যা ভাবছ তা নয়। শিউলি আজ নয়, অনেক বছর ধরে জানে সব। কিন্তু আমি তো ওকে কম দিইনি জুঁই। সংসার, সন্তান— কোনও দিক থেকে বঞ্চিত করিনি ওকে। বাইরের সবার চোখেই আমরা আদর্শ দম্পতি। তুমি আমার মনে যে জায়গায়, তাকে কোনওদিন স্পর্শ করতে পারবে না ও। তুমি আমার অধরা দেবীপ্রতিমার মতো, যে আমার মানসলোকের বাসিন্দা।’

    চকিতে বিদ্যুৎপ্রবাহ ছুটছে সুচেতনার শরীরে। একই সঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে, শিউলি আজ বহু বছর হল তাঁর থেকে দূরে সরে গেছে। তার মানে শিউলির সঙ্গে তিলকের বিয়ে নামক বস্তুটি ঘটিয়ে সুচেতনা যে-চালটি খেলাচ্ছলে দিয়েছিলেন, তা প্রথম থেকেই ধরা পড়ে গেছিল শিউলির কাছে। কিন্তু দিদি হিসেবে তিনি কি সত্যি কোনও অন্যায় করেছিলেন? তিলকের ডাকে নিজে সাড়া দিতে পারেননি বলে নিজের ছোটবোনের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। তাই তো শিউলির আজ প্রবাসে সুখী দাম্পত্য, ফুলের মতো সুন্দর সন্তান। বদলে নিজে তিনি কী পেলেন সুচেতনা? বিয়ের সময় থেকে প্রভাত শর্ত দিয়েছিলেন, নিজস্ব আর কোনও সন্তানের কথা ভাবতে পারবেন না সুচেতনা। তাতেই সানন্দে সম্মত হয়েছিলেন তিনি। সানন্দে কি? প্রভাতের মা-হারা মেয়েদুটিকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন— তাও যেমন সত্য, তেমনই মাঝে মাঝেই যে হাহাকার উঠে আসে এ জীবনে নিজের জঠরে কোনও সন্তান ধারণ করা হল না, বোঝা গেল না তিল তিল করে নিজের সৃষ্টি করা সন্তানের বড় হয়ে ওঠা দেখতে কেমন লাগে, অনাস্বাদিতই থেকে গেল প্রকৃত মাতৃত্বের স্বাদ, তা তাঁর চেয়ে বেশি কে জানে? অথচ এও তো সত্যি যে, প্রভাতের সঙ্গে প্রেমের ও বিয়ের পরের পর্বেও সম্পর্কের মূল ধারকতন্তুটি ছিল যৌনতা। তীব্র এবং প্রবল কামতাড়িত যৌনতাবোধ তাঁদের যৌথ জীবনরচনার প্রেরণাদায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। তা নিজের কাছে অস্বীকার করতে পারেন না সুচেতনা। এখন সবই কেমন অলীক বোধ হয়। কতটুকুই বা স্থায়ী হয়েছিল প্রভাতের সঙ্গে তাঁর দাম্পত্য সম্পর্ক? এখন তো সম্পর্কের মধ্যে যৌনতা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। প্রভাত অসুস্থ হয়ে পড়ার পর আজ কতদিন শারীরিক ঘনিষ্ঠতা হয়নি সুচেতনার সঙ্গে! সুচেতনা আর প্রভাতের সম্পর্কে শারীরিক আগ্রহ কাজ করে না, মিলন প্রত্যাশায় আর উন্মুখ হয়ে থাকে না শরীর। যে কোনও শরীরী সম্পর্কই বোধহয় এরকমই। শরীরে-শরীরে ঘর্ষণে তীব্র জ্বলে ওঠার পর ধিকিধিকি হয়ে জ্বলে অবশেষে নিভে যাওয়া। নিভে যাওয়া শরীর ইদানীং টের পান সুচেতনা। সঙ্গমক্লান্ত শরীরের এই শান্তি, এই ছাই হয়ে যাওয়া কামনাবোধকেই ভবিতব্য বলে ধরে নিয়েছিলেন তিনি, মেনেও নিয়েছিলেন।

    কিন্তু আজ অন্যরকম হয়ে গেল সবকিছু। তিলকের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, ওর কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ বুঝতে পারলেন— অনেককাল বাদে তাঁর শরীর জেগে উঠছে প্রবলভাবে। ন্যায়-অন্যায়ের সীমারেখার বাইরে, ঔচিত্য-অনৌচিত্যের তোয়াক্কা না রেখে এই আকস্মিক জেগে ওঠার মধ্যে ভাঙনের অভ্রান্ত চিহ্ন দেখতে পেলেন সুচেতনা।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook