ভূত দেখেছেন? দেখেননি? সে কী মশাই, রাতের আকাশের দিকে তাকাননি কখনও? অসংখ্য তারার দল আসলে যে অতিকায় (বা, অতি-অতিকায়) অগ্নিগোলক সেটা তো জানাই। এইসব তারা তাদের নিজের নিজের সংসার নিয়ে আছে যোজন যোজন আলোকবর্ষ দূরে (আলোর
বেগে পাঁইপাঁই করে ছুটলে এক বছরে যতটা দূর যাওয়া যাবে, সেটাই হল ‘আলোকবর্ষ’)। সেখান থেকে তাদের নির্গত আলো সহস্র বছর চলার পর এসে পৌঁছচ্ছে আমাদের চোখে। অর্থাৎ আপনি আজ যে-তারার আলো দেখছেন, তার জন্ম হয়েছিল যখন, তখন হয়তো বাংলার মসনদে বল্লাল সেন রাজত্ব করছেন। বখতিয়ার খিলজির জন্মই হয়নি। নালন্দা মহাবিহার খ্যাতির শীর্ষে। বিক্রমশীলও সগৌরবে বিরাজমান। সেই সময়কার আলো আপনি দেখছেন— এ তো একরকমের অতীত (বা ভূত) দর্শনই।
রাতের আকাশে ‘কালপুরুষ’কে লক্ষ করেছেন? যার পোশাকি নাম ‘অরায়ন’? এক হাতে ধনুক আর অন্য হাতে তির বাগিয়ে, কোমরে তরোয়াল ঝুলিয়ে নিজের বিশ্বস্ত দুই কুকুরকে নিয়ে আকাশ জুড়ে আমাদের এই জগৎসংসারকে পাহারা দিয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু আমাদের চোখে ওই উজ্জ্বল একঝাঁক নক্ষত্র যতই একটা মনুষ্য-অবয়ব তৈরি করুক না কেন, তারা পৃথিবী থেকে তো বটেই, একে অপরের থেকেও অনেক অনেক আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে। সবচেয়ে কাছের তারাটির নাম ‘বেলাট্ট্রিক্স’। সে ‘কালপুরুষ’এর বাঁ-কাঁধের তারাটি— পৃথিবী থেকে প্রায় ২৪৩ আলোকবর্ষ দূরে। আর ডান কাঁধের তারার নাম ‘বেতেলজিউস’— সংস্কৃতে যাকে বলে ‘আর্দ্রা’। ৬৪২ বছর ধরে আলোর পিঠে চেপে ছুটলে পৌঁছনো যাবে ওই নক্ষত্রের কাছে।
আর্দ্রা আসলে প্রচলিত অর্থে নক্ষত্র নয়। এক সময় ছিল। কিন্তু এখন জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ। প্রায় এক কোটি বছর ধরে প্রতিনিয়ত হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়ামে রূপান্তর-প্রক্রিয়া চলেছে তার মধ্যে— যেমনটা মোটামুটি সব নক্ষত্রের এই বিপুল শক্তির পিছনের মূল চাবিকাঠি। শুধু নক্ষত্র কেন, এই যে পৃথিবী জুড়ে তাবড় রাষ্ট্রনায়ক তাঁদের বাহুবল প্রদর্শনের জন্য দুমদাম পরমাণু বোমা ফাটান— তার যে এই প্রচণ্ড ধ্বংসশক্তি, সেটাও এই ‘নিউক্লিয়ার ফিউশন’-এর ফলেই। ম্যানহাটন প্রোজেক্টের বিজ্ঞানীকুল, বলা চলে, একটি নক্ষত্রের জন্ম দিয়েছিলেন তাদের ল্যাবে। শুধু ছিল না তার অভিকর্ষ। এই প্রবল বহির্মুখী শক্তির সঙ্গে সমান তালে সামাল দেয় তারাদের অন্তর্মুখী অভিকর্ষবল। ফলে, নক্ষত্রটি পরমাণু বোমার মতো ফেটে পড়ে না। নিজের জ্বালায় জ্বলতে থাকে শুধু।
কিন্তু বয়সের সঙ্গে এই সমস্ত হাইড্রোজেন এক সময় হিলিয়ামে পরিণত হয়, নিরন্তর দহনেরও অন্ত আসে। তখন নিজের অভিকর্ষের চাপেই দুমড়ে-মুচড়ে সঙ্কুচিত হয়ে যেতে থাকে। এই হঠাৎ সঙ্কোচন নক্ষত্রের একেবারে মর্মস্থলের, তার কেন্দ্রের, তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এতদিন ধরে কেন্দ্রের সব হাইড্রোজেন তো পুড়ে হিলিয়াম হয়ে গেছে। কিন্তু রয়ে গেছে তারার একেবারে বাইরের স্তর— যাকে বলে আউটার শেল, সেখানকার হাইড্রোজেন। নক্ষত্রের এই বাইরের স্তরের তাপমান, এমনিতে সেই পর্যায়ে পৌঁছতে পারে না, যাতে হাইড্রোজেনের দহন হয়। কিন্তু তারার এখন শনির দশা এসে উপস্থিত হয়েছে। কেন্দ্রের হাইড্রোজেনের ভাঁড়ে মা ভবানী। ফলে এই সঙ্কোচন-উদ্ভূত উচ্চ তাপমাত্রায় এবার ওই বাইরের স্তরের হাইড্রোজেনে ‘আগুন’ লাগে। ওখানে শুরু হয় ‘নিউক্লিয়ার ফিউশন’। তার জন্য নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্য বেড়ে যায় আর এই গ্যাসীয় স্তরের প্রসারণ ঘটতে থাকে। নক্ষত্র উপনীত হয় তার মৃত্যুর আগের দশায়— তখন সে ‘লাল দৈত্য’ বা ‘রেড জায়ান্ট’— অঙ্ক কষে দেখা গেছে যে সূর্যের যখন এমন ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন মনস্টার’ গোছের দশা হবে, বাড়তে বাড়তে সে গিলে ফেলবে বৃহস্পতি অবধি সব গ্রহকে। পৃথিবীর কথা বাদই দিলাম। তবে চিন্তা নেই, তদ্দিনে, আমাদের যা হাবভাব, মনুষ্যজাতি লোপাট হয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস।
লাল দৈত্য হলে তারার ঔজ্জ্বল্য বেড়ে যায় অনেকখানি। আর্দ্রার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রাতের আকাশের তারাদের মধ্যে উজ্জ্বলতার নিরিখে দশম স্থান ছিল তার। কিন্তু ক্লাসের ভাল ছেলেরাও যেমন মাঝেমধ্যে পিছলে যায়, এর ক্ষেত্রেও তা-ই হল। ২০১৯-এর অক্টোবর মাস নাগাদ বৈজ্ঞানিকদের চোখে ধরা পড়ল আর্দ্রার পদস্খলন। এর ঔজ্বল্যের মান এতকাল ছিল ০.৫, তা কমে দাঁড়াল ১.৬৪-এ। আচ্ছা, ১.৬৪ এর থেকে ০.৫ কীভাবে বড় হতে পারে?
আসলে জ্যোতির্বিজ্ঞানে গ্রহ-নক্ষত্রের ‘অ্যাপারেন্ট ম্যাগনিটিউড’ বা তুলনামূলক ঔজ্জ্বল্যের হিসাবের মাপকাঠিটা একটু উল্টো। গণিতশাস্ত্রে একে ঋণাত্মক-লগারিদমিক পরিমাপক বলা হয়। এইসব হিসেব-নিকেশ শুরু হয়েছিল অনেককাল আগে গ্রিস দেশে। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দেড়শো বছর আগে, হিপ্পারকাস নামে এক জ্যোতির্বিদ, খালি চোখে যেসব নক্ষত্র দেখা যায় তাদের একটা লিস্টি বানিয়েছিলেন— ঔজ্জ্বল্যের ক্রমানুসারে। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটির ঔজ্জ্বল্য তিনি দাগিয়েছিলেন ১, আর সবচেয়ে ম্লান তারাটিকে নম্বর দিয়েছিলেন ৬। অর্থাৎ যদি একটি তারার ঔজ্জ্বল্যর মান হয় ৫, আর অন্য একটি নক্ষত্রর ঔজ্জ্বল্য হয় ০.৫, তাহলে নিশ্চিন্তে আপনি বলতে পারেন যে দ্বিতীয়জন পড়াশোনায় ঢের ভাল। এ ব্যাপারে যে সুয্যিদেবই ক্লাসের ফার্স্টবয়, সে ব্যাপারে কারও সন্দেহ নেই। সূর্যের ঔজ্জ্বল্য -২৬.৭২। আর যদি শুধু রাতের আকাশের কথা ধরা হয়, তাহলে এ ব্যাপারে এগিয়ে ‘সিরিয়াস’ বা ‘লুব্ধক’ (চাঁদমামা, গুরু বৃহস্পতি এদেরকে হিসাবের বাইরে রেখে যদি শুধু অনন্ত নক্ষত্রবীথির কথা ধরি)। লুব্ধক হল কালপুরুষের পায়ের কাছে প্রভুর আদেশের অপেক্ষায় থাকা শিকারি কুকুরের মাথার নক্ষত্রটি।
‘আর্দ্রা’ কয়েকমাসের মধ্যে ম্লান হয়ে যাওয়ায় নজর কেড়েছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। ক্লাসের ভাল ছেলের এমন কম নম্বর পাওয়া তো মোটেই কাজের কথা নয়। তবে কি…? একটা সন্দেহের কথা মাথায় ঘুরছিল সকলের। তবে কি সেটাই সত্যি হতে চলেছে? ‘নক্ষত্রপতন’? বা, যার পোশাকি নাম, ‘সুপারনোভা’?
সুপারনোভা হল তারার মৃত্যুশয্যা। জ্বলতে জ্বলতে যখন একটা নক্ষত্র খাক হয়ে যায়, সম্পূর্ণ নিভে যাওয়ার আগে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কাঁপিয়ে দিয়ে যায় চারপাশ। এই প্রবল বিস্ফোরণের নামই ‘সুপারনোভা’। কিন্তু সব তারার মৃত্যু এভাবে হয় না। কপালে কী আছে, সেটা পুরোপুরি নির্ভর করে তারার ভরের উপর। হিসেব কষে দেখা গেছে, যদি তারার ভর সূর্যের চেয়ে আটগুণ বা তার বেশি হয়, তবেই তার ভাগ্যে থাকবে রজনীকে সচকিত করে সুপারনোভা হয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার সুযোগ। আর যদি সেই নক্ষত্রের ভর হয় সূর্যের ভরের কুড়িগুণেরও বেশি— তাহলে সুপারনোভা-অন্তে জন্ম নেবে সেই বহু আলোচিত ‘ছ্যাঁদা’— আকাশের গায়ে ‘কৃষ্ণগহ্বর’ বা ‘ব্ল্যাক হোল’। নইলে খুশি থাকতে হবে ‘নিউট্রন স্টার’ হয়ে। আর যে-সমস্ত নক্ষত্রের ভর সূর্যের মতো, বা তার থেকে আটগুণের কম, তারা লোহিত দানব অবস্থার শেষে পরিণত হবে ‘শ্বেত বামন’ বা ‘হোয়াইট ডোয়ার্ফ’-এ। সুপারনোভা বিস্ফোরণের জন্য যে প্রবল (কোটি কোটি পরমাণু বোমা ফাটার শামিল) শক্তির জন্ম হয়, তার ফলে ওই তারার বুকে জমে থাকা বিভিন্ন মহার্ঘ ধাতু ছিটকে বেরিয়ে পড়ে সেখান থেকে— বাইরে একটা থলি নিয়ে দাঁড়ালে লাভের সমূহ সম্ভাবনা!
বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করলেন, ‘আর্দ্রা’রও মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। এই ম্লানতা আর বুঝি প্রভু ক্ষমা করবেন না। কিছু বছরের মধ্যেই রাতের আকাশে প্রায় সূর্যের মতো উজ্জ্বল একটি সুপারনোভা দেখার আশায় বুক বাঁধলেন সবাই। কিন্তু কথায় বলে, রাখে হরি, মারে কে! কয়েকমাস যেতে না যেতেই আর্দ্রা আবার তার আগের ঔজ্জ্বল্য ফিরে পেতে শুরু করল। তাহলে অ্যাদ্দিন ধরে এমন বিষণ্ণতার কারণ কী?
বিশ্বের বহু বৈজ্ঞানিক কারণ খোঁজা শুরু করলেন। অনেক গবেষণার শেষে দু’রকমের মত পাওয়া গেল। একদল বললেন, কোনওভাবে নক্ষত্রটির উপরের স্তর ঠান্ডা হয়ে গেছিল। অন্যদল বললেন, এসব কিছুই নয়—তারাদেরও পেটে গ্যাস হয়, ওরাও বাতকম্ম করে থাকে। আর্দ্রার পেট থেকে অমনই একখানা গ্যাসের বুদ্বুদ ফেটে পড়েছিল একেবারে বাইরের স্তরে এসে। এ তো আর আমার-আপনার নয়, একেবারে লোহিত দৈত্যর বায়ুত্যাগ। সেই বিস্ফোরণের ফলে পেটের ভিতরের কিছু মালমশলাও ছিটকে পড়েছিল বাইরে। সেই সমস্ত ‘স্টারডাস্ট’ই জমা হয়েছিল পৃথিবী আর আর্দ্রার দৃষ্টিপথে। মেঘের মধ্যে দিয়ে দেখলে আমাদের সূর্যকে যেমন ম্লান দেখায়, ঠিক সেভাবেই ওই ধুলোর মেঘ কমিয়ে দিয়েছিল আর্দ্রার উজ্জ্বলতা।
জ্যোতির্বিদরা এমন অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়ে উৎসাহিত হলেন বিষয়টির কারণ তলিয়ে দেখার জন্য। কিন্তু বাদ সাধল কোভিড মহামারী। একের পর এক মানমন্দির বন্ধ হয়ে গেল। ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার সুবিশাল টেলিস্কোপ ‘স্ফিয়ার’ও বন্ধ হল একসময়। এর মাধ্যমেই বেতেলজিউসের বায়ুরোগের কারণ খুঁজছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিগুয়েল মন্তার্গিজ। সে কাজে বাধা পড়ল। ফলে অনেকটাই অজানা রয়ে গেল আর্দ্রার এমন ব্যবহারের কারণ। কিন্তু মিগুয়েল একটি বিষয়ে খুশি। বেতেলজিউসের মৃত্যুর গুজবে একটু মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি। শেষমেশ যে সেই জল্পনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আরও অন্তত একলক্ষ বছর বাঁচার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এই নক্ষত্র, তাতেই তাঁর আনন্দ। বলেছেন, আর্দ্রা তার খুব পছন্দের নক্ষত্র। পুরনো বন্ধু। শত্তুরের মুখে ছাই বাঁচুক আরও অনেকদিন। আর মাঝেমধ্যে দেখাক এমন ভেল্কি— তারকার বাতকম্মের মতো!