ফরাসি ওপেনে যা যা
নেওমি ওসাকা একটা ম্যাচ জিতেই নাম প্রত্যাহার করে নিলেন। উনি খেলতে রাজি ছিলেন, কিন্তু বলেছিলেন, ম্যাচের পর মিডিয়ার সঙ্গে দেখা করে প্রশ্নের উত্তর-টুত্তর দিতে পারবেন না, কারণ তাঁর মনের শরীর খারাপ। সেই সূত্র ধরে এও বলেন, প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার পর থেকেই, খুব উৎকণ্ঠা হয়। সঙ্গে আছে বিষাদ-অ্যাটাক। আর, এই সব কিছু সামলাতে সামলাতে, আবার টেনিসটাও দুরন্ত খেলতে খেলতে, সাংবাদিকদের বেয়াড়া ও খোঁচওলা প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার সময় তাঁর খুব নার্ভাস লাগে। কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পেল্লায় সমর্থন পেলেন বড় খেলোয়াড়দের— শুধু টেনিস নয়, অন্য খেলার দুনিয়া থেকেও। কিন্তু মুশকিল, গ্র্যান্ড স্ল্যাম টুর্নামেন্টের শর্ত অনুযায়ী, তোমাকে যদি বলা হয় প্রেস মিট-এ যেতে, তুমি সে-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারো না। নেওমিকে তাই প্রথম প্রেস মিট-টায় না-যাওয়ার জন্য জরিমানা করা হল, আর চারটে গ্র্যান্ড স্ল্যাম টুর্নামেন্টের তরফ থেকেই (উইম্বলডন, অস্ট্রেলীয় ওপেন, ইউ এস ওপেন এবং ফরাসি ওপেন) কড়কে দেওয়া হল, এই অসহযোগ চললে সামনে আরও বহুত জরিমানা তো বটেই, সম্ভাব্য সাসপেনশনও। এখন মানসিক ফিটনেস, চ্যাম্পিয়নের চাপ, সাফল্যের বাঁদিক— প্রচুর চোখা বিষয় লোপালুপি চলছে। কিন্তু আসলি প্রশ্ন আলাদা: টেনিস খেলতে গেলে আমায় প্রেসের সামনে বসতেই হবে কেন? চুক্তিতে কেন আদৌ এরকম একটা শর্ত থাকবে? একজন খেলোয়াড় তাবৎ নিয়ম-টিয়ম মেনে কোর্টে খেলবেন নির্ঘাত (যদিও কেন কত্তারা বললে সাদা জামা পরেই খেলতে হবে, বা কেন রেগেমেগে একটা বলকে ব়্যাকেট দিয়ে পেটালে আর সেটা একেবারে অনিচ্ছাকৃত ভাবে এক বল-গার্লের গলায় ঠাঁই করে লেগে গেলে টুর্নামেন্ট থেকে বহিষ্কৃত হতে হবে— এসব প্রশ্ন তোলাই যায়, এবং উঠবেও আজ নইলে কাল), কিন্তু কোর্ট থেকে বেরিয়ে গণমাধ্যমের সামনে আবির্ভূত হওয়াটা বাধ্যতামূলক হবে কেন? আমি কেমন খেললাম, ও কেমন খেলল, যখন মনে হচ্ছিল নিশ্চিত হারছি তখন মনের মধ্যে ক’টা বেহালা, যখন বুঝলাম জিতে যাচ্ছি তখন কোচের মুখ না ঠাম্মার চোখ— এসব সাতকাহন করে বলতে বা আদৌ এগুলো নিয়ে প্রকাশ্যে সশব্দ ভাবতে কারও ভাল তো না-ই লাগতে পারে, এমনকী আত্মসম্মানেও বাধতে পারে। তাহলে এ-জিনিস খেলার আবশ্যিক অঙ্গ হল কী রূপে?
ঠিকই, এখন টিভিতে খেলা না-দেখালে সে খেলার কোনও মূল্যই নেই, আর খেলা শেষ হওয়ার পর যাতে আরও কিছুক্ষণ দর্শক টিভির সামনে বসে থাকে, তার জন্য ম্যাচের খুঁটিনাটি সরাসরি নায়ক বা পরাজিত নায়কের মুখে শোনার টোপ জবরদস্ত। মানতেই হবে, এই ছিপ ফেলার সম্পূর্ণ অধিকার গণমাধ্যমের আছে। কিন্তু খেলোয়াড়ের কেন অধিকার নেই ‘যাব না’ বলার? ফতোয়াটা একটু ফাঁস-দড়ি মার্কা হয়ে গেল না? একটা খেলা হেরে যাওয়ার পর যখন কোহলিকে জিজ্ঞেস করা হয় ‘পরিকল্পনায় কোথায় গলদ ছিল’ বা ক্যাচ-ফেলা-ফিল্ডার কিংবা ছয়ছক্কা-খাওয়া-বোলারকে নিজেদের লজ্জামুহূর্ত ব্যবচ্ছেদ করতে বলা হয়, তাঁরা হৃদয়ের চোয়াল শক্ত করে সব উত্তর জুগিয়ে যান, টাকার কথা ভেবেও, আর ‘এটাই এখন সিস্টেম, ইন্টারভিউ তো ক্রীড়ারই হাত-পা’ ভাবতে ভাবতে। কিন্তু খেলোয়াড়ের প্রকৃত ও একমাত্র কাজ: প্রাণ উগরে খেলা। তাদের এই বাড়তি ধকলটা সইতে হবে কেন? আমার দগদগে ঘা আমি বিশ্লেষণ না-ই করতে চাইতে পারি কয়েক কোটি লোকের সামনে। হেরে যাওয়ার পর আমার নির্জনে হাউহাউ কাঁদতেও ইচ্ছে করতে পারে (সেটাই স্বাভাবিক), জেতার পরেও আমার এক্ষুনি ঘরে গিয়ে পরের খেলা ছকতে ইচ্ছে করতে পারে (বা বন্ধুকে চুমু খেতে), আর জেতা-হারা নির্বিশেষে আমার ব্যক্তিত্বের মধ্যেই অন্য লোকের সামনে হাজির হওয়ার প্রতি অনীহা ইনবিল্ট থাকতে পারে। মনে রাখতে হবে, ‘বাক্স্বাধীনতা’ কথাটার মধ্যে, বাক্য স্ফুরণ না করার স্বাধীনতাও নিহিত। ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা আছে মানেই আমার ভোট দিতে না-যাওয়ার স্বাধীনতা আছে। যখন আমি এক খেলোয়াড়ের কথা না-বলার স্বাধীনতা হরণ করে নিই, তখন তাঁর বাক্স্বাধীনতাকেই, একটি মৌলিক অধিকারকেই আক্রমণ করি। আজ নেওমি যদি শুধু রিপোর্টারদের মুখোমুখি হবেন না বলে টেনিস খেলাটাই ছেড়ে দেন, তাহলে টেনিসবিশ্ব এক অসামান্য খেলোয়াড়কে হারাবে, শুধু আয়োজকদের প্রফিট-কৌশলের প্যাঁচে। টাকা খুব জরুরি, কিন্তু তা খেলার আত্মাকেই বিকৃত করলে মুশকিল।
তারপর রজার ফেডেরার তৃতীয় রাউন্ডে জিতেও নাম তুলে নিলেন। কারণ তাঁকে হাঁটুর কথা ভাবতে হবে, আর ভাবতে হবে উইম্বলডনে জেতার কথা (সেখানে ওঁর জেতার সম্ভাবনা ফরাসি ওপেনের চেয়ে বেশি, কারণ উনি ঘাসের কোর্টে ভাল খেলেন, ক্লে-কোর্টের তুলনায়)। কেউ কেউ বলল, তাহলে বাবা আদৌ এই টুর্নামেন্টটা খেলতে এলে কেন? মাঝখান থেকে তিনটে খেলোয়াড় হেরে মরল। তুমি না থাকলে তারা হয়তো আর একটু এগোতে পারত। আর উইম্বলডন তোমার পক্ষে অতটা জরুরি হলে ফরাসি ওপেনকে কি প্র্যাকটিসের উঠোন ধরেছিলে? সে অধিকার কে দিল? অনেকে বলল, তা কেন, এক খেলোয়াড় যখন খুশি বিপন্ন বোধ করে সরে যেতে পারেন। আবার এমন মন্তব্যও হল: ফেডেরার আসলে বুঝতে পেরেছিলেন তিনি ফরাসি ওপেনে এক সময় জকোভিচের মুখে পড়বেন এবং হারবেন, তা উইম্বলডনের ঠিক আগে ফেডেরারের মনোবলের পক্ষে মারাত্মক সর্বনাশা হবে, কারণ ওই টুর্নামেন্টেও জকোভিচই সম্ভবত হবেন তাঁর কট্টরতম প্রতিদ্বন্দ্বী। এ আন্দাজ যদি ঠিক হয়, তাহলে ফেডেরার যাচ্ছেতাই কাজ করেছেন। ভয় পাওয়ার অধিকারও মৌলিক অধিকার, নিঃসন্দেহে, কিন্তু কাপুরুষতাকে স্ট্র্যাটেজির মর্যাদা দেওয়া যায় না।
মনে রাখতে হবে, ফেডেরারকে অনেকেই মনে করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ টেনিস প্লেয়ার। তাঁর শৈলীও সে-কথা বলে, পরিসংখ্যানও। বিখ্যাত ক্রীড়া-বিশ্লেষক লেখেন, ফেডেরার নাদালের মতো খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলার সময়, পাঁচ স্ট্রোক আগে থেকে পরিকল্পনা করে রাখেন, দাবার মতো, কীভাবে পয়েন্টটা নেবেন, সেই গণিতেই খ্যালেন ও উল্টোদিকের লোকটিকে খেলান (মানে, খেলতে বাধ্য করেন), এবং পাঁচ স্ট্রোক পরে বল অ্যাক্কেবারে তাঁর ঈপ্সিত ও হিসেবমাফিক জায়গাতেই আবির্ভূত হয়। ফেডেরার এখনও পর্যন্ত ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন (২০টা, নাদাল তাঁর সমান, জকোভিচ একটি কম)। হ্যাঁ, অবশ্যই, আগের বার (২০১৯) জকোভিচ তাঁর হাত থেকে অবিশ্বাস্য জেদ ও নৈপুণ্যে উইম্বলডন ফাইনাল ছিনিয়ে নিয়েছিলেন, এবার হয়তো ফেডেরারের শেষ সুযোগ (বয়স ৩৯), তাই সর্বস্ব সুদ্ধু ঝাঁপাতে হবে, বোঝা গেল। কিন্তু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় তো শুধু স্ট্রোকে বা ফোরহ্যান্ডে বা ট্রফি-সংখ্যায় হয় না, পরাজয়কে স্বকীয় কেতায় ফুঁ দিয়ে ওড়ানোতেও হয়। আগুনের মধ্যে গিয়ে অলস ভাবে ঘড়ি দেখতে দেখতে হেঁটে আসাতেও হয়। ফেডেরার যদি দুরুদুরু বুকে অঙ্ক কষে, একটা টুর্নামেন্ট থেকে মানে মানে সরে গিয়ে, অন্যটায় হাঁটুর সেরা জোর প্রয়োগ করে, যেমন করে হোক রেকর্ডটা পেয়ে তড়িঘড়ি আলমারিতে তুলে পাট করে রাখেন, তাহলে তাঁকে দেখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রাণিত হবে কি? আর সে-কাজটায় যদি প্রকৃত নিয়ামক ব্যাপারটি তার হাঁটু না হয়ে, আসলে হয় প্রতিদ্বন্দ্বী জকোভিচের ভয়, এবং এ-খেলা জিতে গেলে জকোভিচের যে বর্ধিত আত্মবিশ্বাস স্টকে থাকবে, তার সঙ্গে উইম্বলডনে লড়তে হওয়ার আতঙ্ক— তাহলে বলতে হবে ফেডেরার ইতিমধ্যেই খেলা হেরে গিয়েছেন, তিনি পানসে শতরঞ্চিতে উপুড় হয়ে শ্বাস টানছেন, সে ক’দিন পরে উইম্বলডনে স্কোরবোর্ড যে-গল্পই টাঙাক না কেন। বিশ্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান যদি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ট্যুরের সময় বলেন ‘উঃ খুব পেটব্যথা করছে তোরা যা আমি শুই, অস্ট্রেলিয়া যখন আমার দেশে আসবে তখন নয় স্পিনিং ট্র্যাকে খেলব’, তাহলে তাঁর হোমগ্রাউন্ডে ডবল সেঞ্চুরির ধারেও কাদার আলপনার মতো লেগে থাকবে চম্পট দিয়ে চামড়া বাঁচানোর গ্লানি। প্রকৃত বীর সঙ্কটে তেতে ওঠেন, আর অসম্ভবকে উল্টো দূরবিনে পুচকে সাইজে দেখতে পারেন, সর্বোপরি লড়াইয়ের স্পিরিটটাকে পাঁজর দিয়ে জ্বালিয়ে রাখেন। উইম্বলডনে যা হবে তখন দেখা যাবে, এখন এই যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছি, বুক চিতিয়ে খেলব, আমার চেয়ে ভাল খেলে কেউ জিতলে তাকে কুর্নিশ জানাব, তারপর পরের টুর্নামেন্টে আবার নতুন একটা দিন, নতুন একটা বিস্ফোরণ— এই হবে চ্যাম্পিয়নের (বা GOAT-এর, ‘গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম’) উপযোগী মনোবৃত্তি। তাঁর থাকবে অলীক রেলা, ক্ষুদ্রতা-পেরনো লীলা। আশা করা যাক ফেডেরার সত্যি সত্যি ভয়ে পালাননি, কারণ সাংঘাতিক সাহস ছাড়া, বিরাট ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকিকে এ-গাল ও-গাল নিয়মিত কুলকুচির অভ্যাস ছাড়া, ওই তুঙ্গ-সাফল্যে চড়া যায় না। কিন্তু যদি তাঁর সিংহ-কলজে সহসা শশক-আক্রান্ত হয়, যদি ‘বরং তবু ইয়ে কিন্তু’ ওজন করতে করতে ও তেরছা চোখে তাকাতে তাকাতে তিনি খিড়কির গলি বেয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়ে থাকেন, তবে জকোভিচ কেবল তাঁর সঙ্গে মন-ডুয়েলে বেধড়ক জিতেছেন তা-ই নয়, ফরাসি ওপেনের সেমিফাইনাল ও ফাইনালে আলট্রা-বিপরীত ও মহত্তম অধ্যায় লিখেছেন। ডাকাবুকো হিম্মত আর আকাশফোঁড় আত্মপ্রত্যয় কাকে বলে, তা ডিকশনারিতে খোঁজার আর দরকার নেই, ওই ম্যাচ দুটো দেখে নিলেই হবে। তার কনট্রাস্টে, পরাক্রম থেকে চ্যুত হয়ে ‘যে জেতে সে-ই সিকন্দর, তাই যেনতেনপ্রকারেণ জিতব’ আওড়ানো, আর যা-ই হোক, ইতিহাসপ্রণম্য রজারবাবুর শোভা পায় না।
চার ঘণ্টা এগারো মিনিটের সেমিফাইনাল, এবং, কী আশ্চর্য, ঠিক চার ঘণ্টা এগারো মিনিটের ফাইনাল— ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ন’ঘণ্টা উচ্চতম পর্যায়ের টেনিস খেলা এবং দুটো ম্যাচেই জয় জকোভিচকে ইন্দ্রজাল কমিকসের হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি সাংঘাতিক ভাল খেলেন সবাই জানত, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, জন্মগত এক নির্ভয়-বর্ম তাঁকে ঘিরে আছে, পৃথিবীর কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিই তাঁকে নোয়াতে পারে না। সত্যিই বোধহয় তিনি খুব খারাপ ডিকশনারি কিনেছেন, যেখানে ভয় উদ্বেগ হতাশা জড়তা অপ্রতিজ্ঞা শব্দগুলো ছাপা নেই। ফাইনালে সবাই যখন ভাবছে, নাদালের সঙ্গে সেমিফাইনালে ওই বন্য মহিষের সংগ্রাম জকোভিচকে হা-ক্লান্ত করেছে এবং দু’সেট পিছিয়ে এমন প্রকাণ্ড টেনশনের ম্যাচ এমনিতেই কেহ জিততে পারে না, তখন তিনি বোধহয় মনের মিহি-মার্জিনেও সিঁদুরে মেঘ দেখতে পাননি। সম্ভবত জকোভিচের সর্বাধিক অলৌকিক কীর্তি: খেলাকালীন ক্রমাগত অতীতকে ডিলিট করতে পারা। আগের গেম বা সেট-এ কী হয়েছে, কে কী পয়েন্ট পেয়েছে, নিজের অবস্থান এখন খাদের-ধারবর্তী না প্রকাণ্ড ভরসা-ভর্তি, তার সঙ্গে তাঁর এখনকার পরিকল্পনা ও চেষ্টার যেন কোনও সম্পর্কই নেই, ফলে তাঁর বর্তমান অতীত দ্বারা প্রভাবিতই নয়, আর হ্যাঁ, ভবিষ্যতের শঙ্কারও তাতে ভূমিকা নেই। এ প্রায় জেন-সন্ন্যাসীদের মতো হৃদি-নিসর্গ: শুধু এই মুহূর্তে বাঁচো। তেএঁটে স্মৃতি মন্থনের প্রয়োজন নেই, রঙিন ফ্যান্টাসি বয়নের দরকার নেই, এখন-ময় হও। জকোভিচও যেন শুধু এইটুকু মনে রেখেছেন, এই সার্ভিসটা যেভাবে রিটার্ন করতে হবে, নিখুঁত সেভাবে রিটার্ন করাটা আমার কাজ, প্রতিপক্ষ ব্রেক-পয়েন্টে পৌঁছেছে কি না (বা আমি ব্রেক-পয়েন্টে পৌঁছেছি কি না), তাতে কিছু এসে যায় না। অতীত বিলুপ্ত, ভবিষ্যত অনাগত, ফলে আমি তো শুধু এই ক্ষণসময়ের নড়াচড়াগুলোতেই মনোযোগী হব, আবার কী? ২০১৯ উইম্বলডন ফাইনালে ফেডেরারের মতো লোক দু-দুটো চ্যাম্পিয়নশিপ-পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছেন, সমগ্র স্টেডিয়াম ফেডেরারের সমর্থনে উত্তাল, এই অবস্থা থেকেও জকোভিচ খেলা জিতেছিলেন। এমন ক্রীড়া-দর্শনে খুব বড় খেলোয়াড়দের আমরা স্নান করতে দেখেছি, শেওয়াগ অনায়াসে ৯৯ থেকে ছক্কা হাঁকিয়ে ১০০-য় যেতেন, স্কোরবোর্ডের সঙ্গে ব্যাট-প্রয়োগের কোনও সম্পর্কই তিনি পুঁছতেন না, আবার উসেইন বোল্ট একশো মিটারের দৌড়ের শেষপ্রান্তে এসে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতেন অন্যরা কে কোথায়, শুধু সেই সিদ্ধান্তের জন্যই যে ফোটো-ফিনিশে তিনি দ্বিতীয় হয়ে যেতে পারেন, তা যেন বোধ-রেডারে ধরে না। জকোভিচ খেলার পর খেলায় সম্ভাব্য বিপদের মুখোমুখি হয়েও যে নির্বিকার দক্ষতায় তুখড় রক্ষণ ও আক্রমণ চালিয়ে যান, তাতে মনে হয় পরাজয় ব্যাপারটার ধারণাই তিনি মনে গঠন করতে অক্ষম, সে-জিনিসটা তাঁর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, প্রতীতি-সাধ্য নয়, কারণ তাঁর সামনে শুধু এই সাম্প্রতিক সেকেন্ড-সমষ্টি রয়েছে, ব্যাস, স্রেফ এই টাটকা টাইম। তাই আগে-পরের ভয়ও নেই, আকাশকুসুমও নেই, দুঃস্বপ্নও নেই, শুধু রয়েছে ব্যাট বল প্রতিভা ও একাগ্রতম প্রয়োগ, মিটে গেল। চারপাশের মানুষ কী বলে চেঁচাচ্ছে, উল্টোদিকের লোকটা লাফাচ্ছে না মুষ্টি ঝাঁকাচ্ছে, নিজের দলের সদস্যদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে কি না, এসবও তাঁর কাছে অদৃশ্য, অস্তিত্বহীন। অবশ্য এ অপার্থিব কাণ্ড বাঙালিদের মধ্যেও কেউ কেউ পারেন, এখনকার রাজনৈতিক আঙিনায় তাঁদের বোলবোলাও। অতীতকে এতটুকু মনে রাখলে, বা গ্যালারির জনসাধারণকে ন্যূনতম পাত্তা দিলে মুকুল রায়কে আলিঙ্গন করে তৃণমূলীদের উচ্চণ্ড উল্লাস সম্ভব হত না, তাঁরাও বাঁচেন শুধু বর্তমানের খামচি-মুনাফায় ও আত্মকেন্দ্র-ঘুরনে, কিন্তু সে অন্য গল্প।