এক বছর আগে বইপাড়ায় দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম ঝড়ের (আমফান) দাপটে ভেসে যাচ্ছে বই। গত দশদিন আগে টিভির সামনে বসে দেখলাম সমুদ্রের জলে দীঘাকে ভাসতে। দীঘার পাড়ে ছেলেবেলা-যৌবনকাল কাটানো সত্তরোর্ধ্ব বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তুমি কি কখনও দীঘাকে জলে ভাসতে দেখেছ?’ উত্তর ছিল, ‘না।’
রাজ্যজুড়ে লকডাউন। কোথাও কিছু চলছে না। এই অবস্থায় বাড়ি যাই কীভাবে! আসলে জন্ম কলকাতায় হলেও যখন দীঘার দিকে যাই, তখন যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, ‘কী রে কোথায় যাচ্ছিস?’ উত্তরে বলি, ‘বাড়ি যাচ্ছি।’ কলকাতায় সব কিছু হলেও আমার বাড়ি বলতে জানি পৈতৃক ভিটে দীঘার কাছে ঘৃতপুরা গ্রামে। আর সেই সূত্রেই দীঘার অলিগলি, ঝাউবন, দীঘার পাড়ের গ্রামগুলোকে জানি চিনি।
‘ইয়াস’ দীঘায় তাণ্ডব চালিয়েছে। কেমন আছে সমুদ্রের পাড়ের হোটেল, খাবারের দোকান, ঝিনুক-শাঁখের দোকান, কাজুবাদামের দোকানগুলো। সেই দেখতেই ছুটে এসেছিলাম ‘ইয়াস’-এর তাণ্ডব চলার দু’দিন পরে। সমুদ্রপাড়ে আমাদের একটা হোটেল আছে। এসে দেখি, হোটেলের মধ্যে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে। বেসমেন্টে রেস্টুরেন্ট। সেখানে যেন একটা ছোট সমুদ্র। প্রায় দশ ফুট সিলিং ছুঁয়ে থাকা শান্ত সমুদ্র। সমুদ্রের পাশ দিয়ে এক নতুন রাস্তা তৈরি হয়েছিল। যে-রাস্তা নিউ দীঘা, দীঘা, শংকরপুর, চাঁদিপুর, মন্দারমণি পৌঁছে গিয়েছিল। সমুদ্রের নোনা জলে ঝাপটা এসে লাগত হেঁটে যাওয়া মানুষের চোখেমুখে। সেই রাস্তা ‘ইয়াস’ কেড়ে নিয়েছে। ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে সেই রাস্তা। সমুদ্রের ধরে সাজানো হয়েছিল বিভিন্ন পসরার দোকানঘর। জলের তোড় সেই দোকানের লোহার শাটার ভেঙে ঝিনুক, শাঁখে গড়া মূর্তি ফিরিয়ে নিয়েছে তার জন্মস্থানে। শূন্য-ভগ্ন দোকানঘরগুলোর মালিক অপেক্ষায় সরকারি সাহায্যের। সমুদ্রের পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখছিলাম স্বপ্নভঙ্গের ছবি।
বিট্টু, আমার ভাই। আমার গ্রামে থাকে। দেখা হতে বলে, ‘দীঘায় যা ক্ষতি দেখছ, তা কিছুই নয়। সমুদ্রপাড়ে প্রায় সাত-আটটা গ্রাম জলে ডুবে গেছে। সেই গ্রামগুলোয় এই সময় খাওয়ার মতো জলটুকু নেই। বিস্তীর্ণ এলাকা নোনা জলে ভর্তি। প্রতিদিন এক-একটা গ্রামে চার হাজার লিটার জল পাঠাচ্ছি।’ বিট্টুর সঙ্গে জল, খাবার নিয়ে হাজির জলধা, ভেরিচাউলি, জামড়া, চাঁদপুর ও পন্থেশ্বরী গ্রামে। জমির আল নেই, কেউ বলতে পারবেন না, দেখাতে পারবে না তাঁর জমি কোনটা। চাষের সব জমি নোনা জলের তলায়।
পাকা বাড়ির পাশে মাটির বাড়িটা আর নেই। টালির চাল ভেঙে পড়েছে পাকা বাড়ির পাশে। বাড়িহীন মাটির দালানটায় পড়ে আছে নিস্তব্ধ টেবিল ফ্যান। রাস্তার দু’ধারে শুকাতে থাকে ছেঁড়া কাঁথা, ছোবড়ার গদি, লেপ, বালিশ, তোশক। নোনা জলে ডুবে যাওয়া জমির মাঝে মাল বয়ে নিয়ে যাওয়া ছোট অটো গাড়িটাকে আর মনে হয় পাড়ে নিয়ে আসা যাবে না। পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরের জমানো শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিয়ে ‘ইয়াস’ তার প্রতিপত্তি দেখাল। নির্বাক অসহায় মানুষ তা দেখল।
‘ঝড় আসছে, আপনারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসুন।’ বাড়ির পুরুষ, মহিলা, ছেলে, মেয়ে প্রায় এক বস্ত্রে বেরিয়ে চলে আসে কাছের স্কুলবাড়িগুলোতে। ঝড় চলে গেলেই বাড়ি ফিরে যাবে। ঘরে কাঠের দরজায় তালা লাগিয়ে চলে আসে, নিরাপদ আশ্রয়ে। ঝড় কেটে যাওয়ার পরে গিয়ে দেখে তারা আশ্রয়হীন। তালা লাগানো দরজাটা দাঁড়িয়ে থাকে। আজ তারা প্রায় নিঃস্ব। গরু, ছাগল, পুকুরের মৃত মাছের সঙ্গে বসবাস জীবন্ত মানুষের।
বাড়ির পাশে জমা জল দেখে ভাবছেন ওটা পুকুর, না ওটা একচিলতে জমি! যে জমিতে ফসল ফলায়। এখন দেখলে সত্যিই পুকুর মনে হবে। জলধা, চাঁদপুর হয়ে ঢুকে পড়েছে পন্থেশ্বরী গ্রামে। একটা সময় এই গ্রামে অনেকবার এসেছি। আমার মায়ের জন্মস্থান, তাই ছোটবেলায় এসেছি। ডুবে যাওয়া গ্রামটা ন’দিন পরে আবার মাথা তুলেছে। এক মামার বাড়িতে দাওয়ায় বসে খাওয়ার জল চেয়েছি। পরক্ষণেই মনে হল আমি ভীষণ দামি জিনিস চেয়ে ফেলেছি।
গ্রামের পথ বেয়ে ফিরে আসছি। গ্রামীণ সড়কের দু’ধারে শুকাতে দেওয়া ধানের ওপর পড়ন্ত বিকেলে সোনালি আলো এসে পড়ে। এগিয়ে যাই আরও অনেকটা। ভিজে যাওয়া কয়েক মুঠো চাল ছড়িয়ে রাখে ছেঁড়া ত্রিপলের ওপর। ভিজে যাওয়া বই-খাতা ছেঁড়া মাদুরের ওপর রাখা। সূর্যের রোদ এসে পড়ে। স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাটির চোখে মুখে ভিজে যাওয়া স্বপ্ন লেগে থাকে।