আশ্রয় ও প্রশ্রয়
ময়মনসিংহের মেছোবাজার অঞ্চলে দাদু একটা বেশ বড় দোকান দিয়েছিলেন। কাটা কাপড়ের দোকান, অর্থাৎ যেখানে থান থেকে মাপমতো কেটে কাপড়ও বিক্রি করা হয়। দোকানের নাম ‘জগদ্ধাত্রী ভাণ্ডার’। দুটো দেওয়াল জুড়ে আলমারিতে কাপড় সাজানো, মাঝখানে নিচু বড় একটা চৌকিতে গদি-তোশক পাতা, সেইখানে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে জ্যাঠামশাই বসতেন। দু’তিনজন কর্মচারী বিক্রিবাটা সামলাত। খুব যে বিক্রি হত তা নয়, আর বেশিরভাগই ছিল বাকির খরিদ্দার। ওই বয়সে আমার আদর ছিল খুব। সারাদিনে আমার চার দাদা বা আরও অনেকেই আমাকে কোলে বা কাঁধে নিয়ে বা সাইকেলের রডে চাপিয়ে বাইরে ঘুরিয়ে আনত। রান্না করার জন্য বামুনঠাকুর সুদর্শনও আমাকে ভারি ভালবাসত। তার কাঁধে কত যে চেপেছি! কারও কাঁধে চড়ার আনন্দই ছিল আলাদা। জ্যাঠামশাইও মাঝে মাঝেই আমাকে সাইকেলের রডে চাপিয়ে জগদ্ধাত্রী ভাণ্ডার নিয়ে যেতেন। বেজায় পেটুক ছিলাম বলে আমার দুষ্টুমি সামাল দেওয়ার ওষুধ ছিল হাতে মিষ্টি ধরিয়ে দেওয়া। জ্যাঠামশাইও আমাকে নিয়ে গিয়ে বালুসাই বা রসগোল্লা দিয়ে বসিয়ে রাখতেন। দোকান-লাগোয়া সামনের চওড়া বারান্দায় দুটো সেলাইমেশিন নিয়ে বসত দুজন দর্জি। একজন ছিল সুরেশ, আর একজনের নাম ঠিক মনে পড়ছে না, তবে তাকে ওস্তাগর বলা হত মনে আছে। এই দুজনের সঙ্গেই আমার ছিল ভারি ভাব। জগদ্ধাত্রী ভাণ্ডারের দুটো দোকান পরেই ছিল বাণীকণ্ঠকাকুর স্পোর্টসের দোকান। বাণীকণ্ঠকাকু ছিলেন অতিশয় সুপুরুষ, ফর্সা, সপ্রতিভ। জগদ্ধাত্রী ভাণ্ডারে গেলে আমি টুকটুক করে বাণীকণ্ঠকাকুর দোকানে গিয়েও হানা দিতাম। অবাক হয়ে দেখতাম ব্যাটবল আর কত কী! হকিস্টিকের কদর ছিল খুব, তা খেলার জন্য ততটা নয়, যতটা মারপিট করার জন্য। বাঙালদের রক্ত এমনিতেই একটু গরম, স্বাভাবিক কথাবার্তা কওয়ার সময়েও অনভ্যস্ত কানে মনে হবে ঝগড়া করছে। ইন্ধন পড়লে তো কথাই নেই। রাগ হলে বাঙালদের প্রিয় থ্রেট হল, ‘কাইট্যা ফালামু’! শুনেছি, ময়মনসিংহের গাঁ-গঞ্জের চাষিদের মধ্যে কাজিয়া এবং খুনোখুনি ছিল জলভাত। অবশ্য সেটা মোটেই সাম্প্রদায়িক ছিল না। কাজিয়া হত ব্যক্তিগত কারণে, এবং সেই কারণ হয়তো তেমন গুরুতরও নয়। আর এই কারণেই ময়মনসিংহ ছিল ফৌজদারি মামলার পীঠস্থান। আমার বিচক্ষণ দাদু সেইজন্যই তাঁর প্র্যাকটিসের জন্য ময়মনসিংহকে বেছে নিয়েছিলেন। আর তাতে সোনাও ফলেছিল। অচিরেই দাদু কেওটখালি অঞ্চলে বেশ কিছু চাষের জমি আর শহরে দুর্গাবাড়ি অঞ্চলে পেল্লায় পাকা বাড়ি তৈরি করে ফেলেছিলেন। শুনেছি দাদু কোর্ট থেকে তাঁর হ্যাটভর্তি টাকাপয়সা নিয়ে এসে ঠাকুমার আঁচলে ঢেলে দিতেন, আর ঠাকুমা তা তুলে রাখতেন সবুজ রঙের একটা মজবুত লোহার সিন্দুকে। সিন্দুকের চাবিটাই ছিল প্রকাণ্ড এবং ভারী। আর দাদুর কাছারিঘরে প্রতিদিনই ভিড় করত তাঁর মক্কেলরা। প্রায়ই দেখা যেত, মারদাঙ্গা করে মাথায়-গায়ে ক্ষতস্থানে কোনও পরিচর্যা না করে রক্তসমেত এসে হাজির হত, আদালতে হাকিমকে দেখাবে বলে। মানুষ যে কত কী ভাবতে আর করতে পারে!
যাদের পিসি নেই তাদের মতো দুর্ভাগা জগতে কমই আছে। আমার চার-চারটে পিসি এবং আমি আজীবন এই চতুর্মুখ আশ্রয় ও প্রশ্রয়ের শিকার। এমন নয় যে পিসিদের নিজস্ব ছেলেপুলে ছিল না, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা যে ভাইপো-ভাইঝিদের কী উথালপাতাল ভালবাসতে পারেন তা আমার চার পিসিকে দেখে বুঝেছি। শুধু ভালবাসাই নয়, পুরো দখলদারিও থাকত তার মধ্যে। বড়পিসি সুমতি কলকাতাবাসী, মেজো সরযূবালা থাকতেন মুন্সীগঞ্জে, সেজো পরিমল চট্টগ্রামের কাছে ফেনীতে, ছোটপিসি চিন্ময়ীর তখনও বিয়ে হয়নি। ছোটপিসি রোগা, ফর্সা, সুন্দরী এবং একটু গম্ভীর প্রকৃতির। তা হবে নাই বা কেন, তিনি সেই আমলের গ্র্যাজুয়েট। পড়াশুনোয় বেজায় ভাল। তখন মেয়েদের মধ্যে গ্র্যাজুয়েট খুঁজে পাওয়াই ভার। আমার খুব আবছা ছোটপিসির বিয়ের কথা মনে আছে। কলকাতার এক অভিজাত পরিবারের ডাক্তার পাত্রের সঙ্গে বিয়ে। হবু পিসেমশাই দেখতেও ভারি হ্যান্ডসাম। আমাদের বিশাল উঠোনে বাঁশ দিয়ে বিয়ের মণ্ডপ বানানো হল। আমার বয়স তখন বোধহয় বছর তিন-সাড়ে তিন। টুকটুক করে গিয়ে আমিও মণ্ডপ বানানোর কাজে একটু হাত লাগানোর চেষ্টা করেছিলাম। বাড়ি লোকে লোকারণ্য। জীবনে প্রথম সেই কোনও বিয়ে দেখার আবছা অভিজ্ঞতা আমার আজও মনে পড়ে। ছোটপিসি বিয়ের পরই বরের সঙ্গে নাকি অনেক দূরের দেশ বর্মায় চলে যাবেন। ছোটপিসির এই চলে যাওয়াটা আমার মোটেই মনঃপূত হয়নি। বাড়িতে প্রবল কান্নাকাটি পড়ে গিয়েছিল। আমারও মন বেজায় খারাপ, ছোটপিসির কোলে-কোলেও তো আমি কম ঘুরিনি। শেষ অবধি অবশ্য ছোটপিসির বর্মাযাত্রা ঠেকানো যায়নি।
বড়পিসি কলকাতা থেকে বড় একটা ঘন-ঘন আসতে পারতেন না, কিন্তু মেজোপিসি আর সেজোপিসি প্রায়ই তাঁদের ছেলেপুলেদের নিয়ে ময়মনসিংহে আসতেন, আর কী যে হইহই আর মজা হত তখন! পিসিদের মধ্যে আমি একটু ভয় পেতাম সেজোজনকে। কারণ সেজোপিসি ছিলেন বেজায় রাগী। নিজের ছেলেপুলেদের তিনি দরকারমতো খুব পেটাতেন। তাঁর ছয় সন্তানের মধ্যে গোরা আর কৃষ্ণা এই দুই ভাইবোন ছিল আমার চেয়ে একটু ছোট, বাকিরা বড়। মেজোপিসির দুই মেয়েই অনেক বড়। এই দুই দিদির মধ্যে বড়জন বিভাদিদি ময়মনসিংহে আমাদের বাড়িতে একটু বেশি থাকতেন। তাঁর সঙ্গে আমার বেজায় ভাব ছিল। আর সেজো পিসির খ্যাতি ছিল রান্নায়, তিনি নানা নতুন রেসিপি জানতেন আর রাঁধতেনও চমৎকার। সেজো পিসেমশাই প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ফেনী কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক। জারডিন মেনজিস কোম্পানির ওভারশিয়ার ছিলেন আমার বড়পিসেমশাই সুধন্যমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। সেজোজন ছিলেন স্কুলশিক্ষক।
পিসিদের কথা এত করে বলার কারণ, এই দুনিয়ায় আমার যে কয়েকটা ভালবাসার আকর আছে তার মধ্যে এই চারজনকে না ধরলে চলবে না। বিশেষ করে মেজোপিসি। তাঁর দুই মেয়ে, কিন্তু ছেলে ছিল না বলেই বোধহয় আমার ওপর অত টান ছিল। নব্বই পেরিয়ে তাঁর প্রয়াণ ঘটে, আর ততদিনই তাঁর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র