জুন, ২০২১। কোভিডের জন্য ইউরো ২০২০ পিছিয়ে, এই বছর হচ্ছে। দীর্ঘদিন করোনাভাইরাসের দাপটে মানুষের জীবন যখন ধুঁকছে, অর্থনীতি তলানিতে, তখন ইউরোপে, কোভিড-পরবর্তী সময়ে, স্টেডিয়ামে অল্প দর্শক নিয়েই শুরু হয়েছে এই প্রতিযোগিতা। শুধু মৃত্যু, অসুস্থতা, ডাক্তার, নার্স করে কাটানোর দু’বছর পর, বুদাপেস্টের মাঠে আমরা একসাথে ষাট হাজারেরও বেশি দর্শকের, মাস্ক ছাড়া উল্লাস দেখে রোমাঞ্চিত হচ্ছি। হঠাৎ এই আনন্দ-উৎসবে জল ঢেলে দিল, এরিকসনের জ্ঞান হারিয়ে মাঠে অচৈতন্য হয়ে পড়ে যাওয়া।
বেশ খেলা চলছিল, ফিনল্যান্ড বনাম ডেনমার্ক। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ বা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নিয়মিত দেখার জন্য বহু প্লেয়ারের নাম এবং খেলার স্টাইলের সঙ্গে আমাদের আগে থেকেই পরিচয় থাকে। এরিকসন দীর্ঘদিন টটেনহ্যামে খেলেছেন, তখন থেকেই ওঁর খেলার সঙ্গে পরিচয়। ডেনমার্কের লাল জার্সি পরে যখন তিনি বল পায়ে দৌড়চ্ছেন, মনে হচ্ছে, ওই তো আমাদের এরিকসন ছুটছে। একদম ফিট। তাহলে? পরমুহূর্তেই ওরকম ভাবে কী করে জ্ঞান হারালেন? সিপিআর কেন দিতে হচ্ছে? মাটিতে পড়ে থাকা এরিকসন-কে ঘিরে রয়েছেন কেন ডেনমার্কের বাকি সব খেলোয়াড়? ডেনমার্ক অধিনায়ক জড়িয়ে ধরে কী বলছেন এরিকসনের ক্রন্দনরতা বান্ধবীকে? এরিকসন কি বেঁচে নেই? শুধু ফুটবল ফ্যানেরা নয়, সাধারণ মানুষ, যারা গত দু’বছর ধরে নিয়মিত টিভিতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় হাসপাতাল আর মৃতদেহ দেখে দেখে ক্লান্ত, তাদেরও নাড়িয়ে দিয়ে গেছে এরিকসনের এই কোপেনহাগেনের মাঠে নিস্তেজ শুয়ে থাকা। ফুটবল মাঠেও এই একই জিনিস দেখতে হবে? তবে প্রথম বিশ্ব বলেই হয়তো কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট থেকে ওভাবে ফিরিয়ে আনা গেল তাঁকে।
খেলার মাঠে গুরুতর চোট পাওয়াটা নতুন কিছু না, কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ একজন প্লেয়ার দুম করে কোল্যাপ্স করে যাওয়া? একটু খোঁজ নিলে আমরা জানতে পারি, এরকম ঘটনা বেশ বিরল হলেও, মাঝে মাঝেই ঘটে। ঠিক চার বছর আগে, ২০১৭-তে, আইভরি কোস্টের ফুটবলার তিয়তে, মাত্র ৩০ বছর বয়সে চিন-এ একটি ট্রেনিং সেশনে এই কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত হয়েই মারা যান। ২০০৩-এ ক্যামেরুনের ভিভিয়ান ফো-কেও বাঁচানো যায়নি। কী হয় কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে? আচমকা আমাদের হার্ট কাজ করা বন্ধ করে দেয়। শুধু ফুটবলার কেন, সাধারণ মানুষেরও এমন হতে পারে। আর একবার হৃদয় অকেজো মানে, আমাদের পাম্পিং স্টেশন অকেজো। রক্ত পাম্প করা বন্ধ মানে, শরীরের কোথাও রক্ত পৌঁছচ্ছে না, অর্থাৎ অক্সিজেনও পৌঁছচ্ছে না। অক্সিজেন না পেলে ব্রেন বলবে, ভাই আমি এবার কাজ করা বন্ধ করলাম। আর ব্রেন বন্ধ মানে আমাদের সিস্টেম ক্র্যাশ। তাহলে এই ডেড মেশিন বা এই প্রাণহীন দেহকে কি আর জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব? সম্ভব তো হল এরিকসনের ক্ষেত্রে। মুহূর্তের মধ্যে প্রাথমিক চিকিৎসা এবং তারপর ডিফাইব্রিলেটর-এর সাহায্যে ইলেকট্রিক শক দিয়ে দিয়ে ওই মরে যাওয়া হার্ট-কে জাগানো সম্ভব হল। ফ্যাব্রিস মুয়াম্বা-কেও ফেরানো গেছিল! ২০১২-তে ইংল্যান্ডে একটি ক্লাব প্রতিযোগিতায় মাঠের মধ্যে একইভাবে জ্ঞান হারান মুয়াম্বা। ৭৮ মিনিট তাঁর হৃদয় ছিল স্তব্ধ! তারপর ফিরে আসে স্পন্দন।
৭৮ মিনিট বলতে মনে পড়ল জুনিয়রের কথা। প্রথম বিশ্বে এখন চিকিৎসা-ব্যবস্থা এবং তৎপরতা এমন জায়গাতে পৌঁছেছে, বহু মির্যাকল সম্ভব হচ্ছে। আমাদের দেশে বাঁচানো যায়নি জুনিয়রকে। সুদূর ব্রাজিল থেকে খেলতে আসা জুনিয়র, মাত্র ২৫ বছর বয়সে প্রাণ হারান ২০০৪-এ ডিসেম্বরে বেঙ্গালুরুর মাঠে। ফেডারেশন কাপের ফাইনালে, ডেম্পোর হয়ে খেলতে নেমেছিলেন জুনিয়র। ৭৮ মিনিটের মাথায় ধাক্কা লাগে মোহনবাগানের গোলকিপার সুব্রত পালের সঙ্গে। জ্ঞান হারানোর পর আর ফিরে আসেননি জুনিয়র। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট না হার্ট অ্যাটাক কিছু বোঝা যায়নি। প্রাথমিক চিকিৎসা কি ডেনমার্কের মতো ছিল? হাসপাতালে নিয়ে যেতে কি দেরি হয়ে গেছিল? এত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। ২৫ বছরের একটা তাজা প্রাণ আমরা খেলার মাঠে হারিয়ে ফেললাম। ২০২০-তে এই এক কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আমরা হারাই ভারতের প্রাক্তন মিডফিল্ডার কার্লটন চ্যাপম্যান-কে। বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৯। তবে চ্যাপম্যানের মৃত্যু খেলার মাঠে হয়নি।
খেলার মাঠে আহত হওয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত গৌরবময় ব্যাপার রয়েছে। যদিও যুদ্ধ ও খেলা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়, তবু খেলার মাঠের ঘটনার সঙ্গে রণক্ষেত্রের কিছু তুলনা চলে আসেই। বিশেষ করে দেশের হয়ে খেলতে নামলে। অনেকেরই নিশ্চয় মনে থাকবে ১৯৭০-এর বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের সেই ম্যাচ, ইতালি বনাম জার্মানি। ওই ম্যাচটিকে ‘গেম অফ দ্য সেঞ্চুরি’ বলা হয়। ইতালি জেতে, কিন্তু মনে থাকবে জার্মানির বেকেনবাওয়ার-কে। পেনাল্টি বক্সের ঠিক বাইরে ইতালির এক খেলোয়াড়ের করা একটি ফাউলে, মাঠে পড়ে যান বেকেনবাওয়ার। কাঁধে চোট পান, ডিসলোকেশন! এদিকে তখনকার নিয়মে দুটো সাবস্টিটিউট-ই খরচ হয়ে গেছে জার্মানদের। বেকেনবাওয়ার কাঁধে ব্যান্ডেজ বেঁধে পুরো ম্যাচ খেলেছিলেন। গোটা বিশ্বের সামনে নিজের দেশের জন্য কাঁধের ওই যন্ত্রণা উপেক্ষা করে যে-মানুষটি ওরকম ভাবে খেলেন, তাঁকে কি মানুষ ভুলতে পারে? বেকেনবাওয়ার পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং দু’বার বিশ্বকাপ জেতেন। প্রথমে ১৯৭৪-এ, তখন তিনি ছিলেন জার্মান দলের অধিনায়ক, এবং তারপর ১৯৯০-এ, তখন তিনি ছিলেন টিমের কোচ।
কিন্তু এরিকসনের কী হবে? এরিকসনের কেরিয়ার কি শেষ হয়ে গেল? আর কি কোনওদিন মাঠে আমরা দেখতে পাব না ওঁকে? আঘাত পেয়ে যে কত প্লেয়ার হারিয়ে গেছেন, তার লিস্ট করতে বসলে মুশকিল। মাইকেল ওয়েনের চোট পাওয়ার পর আর সেই স্পিড তিনি ফিরে পাননি। ভ্যান বাস্তেন-কে সময়ের আগেই শেষ করতে হয় তাঁর কেরিয়ার। সবই কপাল। কে যে ফিরে আসবেন, আর কে আসবেন না, বলা মুশকিল। দুটি মর্মান্তিক ঘটনার উল্লেখ করছি, যা এখনও চোখ বন্ধ করলে রিপ্লে দেখতে পাই।
ক. ১৯৮২ বিশ্বকাপ— ফ্রান্স বনাম জার্মানি: ব্যাটিসন-কে আহত করেন জার্মান গোলরক্ষক শুমাখার। প্লাতিনি ভেবেছিলেন, ব্যাটিসন বোধহয় আর বেঁচে নেই। পালস ছিল না। কোমায় চলে যান। মাঠে অক্সিজেনও দিতে হয়। কিন্তু ব্যাটিসনের সে-যাত্রা বেঁচে যান, কেরিয়ারও শেষ হয়নি। ১৯৯১ সাল অবধি খেলেন।
খ. ২০০৬ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ— চেলসি বনাম রিডিং: চেলসির গোলরক্ষক পিটার চেক মাথায় চোট পান। খুলি ফ্র্যাকচার হয়। তিন মাস পরে চেক আবার ফুটবলে ফিরে আসেন কিন্তু কেরিয়ারের শেষ ম্যাচ অবধি মাথায় একটা হেলমেট পরে খেলেন।
(ট্রিভিয়া— চেকের বদলে নামেন কুডিচিনি। খেলার শেষের দিকে তিনিও আহত হন। চেলসির ততক্ষণে সব সাবস্টিটিউট খরচ হয়ে গেছে। শেষের কিছু মিনিট গোলকিপিং করেন ডিফেন্ডার জন টেরি।)