সাতের দশকের কবি হওয়া সত্ত্বেও ছয়ের দশকের কয়েকজন কবির সঙ্গেই আমার যত অন্তরঙ্গতা আর তার মোদ্দা কারণ বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। শেষ কৈশোরে যখন ‘উলুখড়’ কাগজ বার করতে শুরু করলাম তখন একদিন একজন, সম্ভবত অরূপরতন বসু, বললেন ‘তোমরা শিবপুরে থাকো বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে চেনো না! যাও একদিন আলাপ করে এসো।’ বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের লেখা এদিক-ওদিক পড়েছি, তবে বলতে দ্বিধা নেই সেরকম আগ্রহ তৈরি হয়নি। যেমনটা হয়েছিল ভাস্কর চক্রবর্তীর বেলায়। পরের দিনই দুই বন্ধু, আমি আর প্রিতম মুখোপাধ্যায়, ঠিকানা জোগাড় করে হাঁটি-হাঁটি চললাম ব্যাতাইতলায়, ৪০৯ শরৎ চ্যাটার্জি রোড। প্রথম দিন দেখা হল না। বলা হল উনি কলেজে পড়ান, বর্ধমানে, রবিবার সকালে থাকবেন। রবিবার আবার হাজির হলাম। সাল-তারিখ কিছুই মনে নেই, কিন্তু সেদিনটা আমাদের জীবনে এক বিশেষ দিন। আড়াইতলার সেই ‘বিশেষ’ ঘরে তারপর কত-কত রবিবার সকাল, ছুটির দিনের সন্ধে। ওখানেই আমরা পাই সুব্রত চক্রবর্তীকে, ভাস্কর চক্রবর্তীকে, মানিক চক্রবর্তীকে, একবার কি দু’বার দীপক মজুমদারকেও। শামশের আনোয়ারের সঙ্গে ওখানেই দেখা হয়েছিল কি না মনে পড়ে না। প্রথম দিনই খুব অন্তরঙ্গ মেলামেশামিশি হল, কবিতা হল আর সেদিনই জানলাম তরুণ কবি, অর্থনীতির অধ্যাপক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত একজন চলচ্চিত্রকারও বটে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনই বানিয়ে ফেলেছেন ছোট ছবি ‘সময়ের কাছে’। মনে আছে, আড়াই-তিন ঘণ্টা আড্ডার পর ফেরার পথের অনেকটা তিনি আমাদের এগিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন কি জানতাম তারপর পঞ্চাশ-একান্ন বছর ধরে চলবে আমাদের এই গা ঘষাঘষি! ক্রমে ক্রমে পারিবারিক আত্মীয় হয়ে উঠবেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত! পরে এমনও হয়েছে সুব্রতদা কি ভাস্করদা এসেছেন বুদ্ধদেবদার বাড়ির সকালের আড্ডায়, আব্বুলিশ বলে মধ্যাহ্নভোজের বিরতির পর আড্ডা আবার শুরু হয়েছে আমাদের বাড়িতে। কবিতা-গানের সেই আড্ডা গড়িয়ে চলেছে বহুদূর। একবার আমাদের বাড়িতে বুদ্ধদেবদা আর ভাস্করদার মধ্যে অন্ত্যাক্ষরী প্রতিযোগিতা হয়েছিল রবীন্দ্র সংগীতের। কেউ কাউকে হারাতে পারেননি। খেলা থেকে গিয়েছিল গোলশূন্য অমীমাংসিত। নিজেদের তৎকালীন জীবনের ছাঁচ নিয়ে একটি অনবদ্য গদ্যরচনায় বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত লিখেছেন:
‘সুব্রত, ভাস্কর, শামশের, আমি— আমরা কেউই কিছু হতে চাইনি। খবরের কাগজগুলোর অফিসে তখন ম-ম করছে ডাকসাইটে কবি, লেখকদের দল। আর নীচের, আরও নীচের ছোটো রাস্তা, মেজো রাস্তা, বড়ো রাস্তায় লাইন দেওয়া ছোটো কবি, মেজো কবি, বড়ো কবিদের ওপারে রূপকথার কলকাতায় কয়েকজন অদ্ভুত কবি দাঁড়িয়ে থেকেছে যাদের কিছু হওয়ার কোনো বাসনাই নেই। একদিন সেই রাস্তার ওপরেই ঝুপ নেমে এল ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে ভাস্কর বলল ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ আপনাকে উৎসর্গ করছি। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম, তাকিয়ে দেখি ভাস্কর নেই। দেখতে পেলাম সিঁথির বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ছে ভাস্কর। খটাস খটাস করে এসে ওর বাবা দরজা খুলে দিচ্ছে। আর তাকিয়ে আছে ভাস্করের দিকে, যেন অচেনা গ্রহের কোনো মানুষ।
সুব্রত, ভাস্কর আর শামশেরের মতন হুল্লোড়বাজ, বিষণ্ণ আর উদাসীন কবি আমার এখনও দেখা হয়নি। চলে যাওয়ার আগে সুব্রত বলেছিল থ্যাঙ্ক ইউ। কাকে যে থ্যাঙ্কস্ জানিয়েছিল জানি না। শামশের কিছু বলতেই পারেনি। ভাস্কর এক প্যাকেট চারমিনারের সবগুলো সিগারেট একের পর এক জ্বালিয়ে নিয়ে উঠে পড়েছিল হাসপাতালের শেষ বিছানায়।
মাঝে মাঝে ঘুমের ভেতর খালাসিটোলার বিশাল কাঠের দরজা ঘরর-ঘরর করে খুলে যায়। দেখি অদ্ভুত এক আলোর মধ্যে বসে আছে ভাস্কর, তার পাশে সুব্রত, তার পাশে শামশের।’ (‘হুল্লোড়বাজ, বিষণ্ণ আর উদাসীন চার কবি’, ‘নতুন কবিসম্মেলন’, শারদীয় ২০১৮ )
২
বাড়িতে সাংগীতিক পরিবেশ ছিল। সন্ধেবেলায় মায়ের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত গানের চর্চা হত। সব ভাইবোনের যোগদান বাধ্যতামূলক। আবার ছোটমামা, সংগীত ও শরীরচর্চাকারী উদীয়মান তরুণ কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত ছিলেন বুদ্ধদেবের কিশোরবেলার আইডল। গরমের বা অন্য কোনও ছুটিতে হাজরা রোডে মামার বাড়িতে গেলে বুদ্ধদেবের শোবার জায়গা হত ছোটমামার সঙ্গে। অনন্যোপায় সমরেন্দ্র রাত্রে হ্যারিকেনের আলোয় সদ্যরচিত কবিতা শোনাতেন অনন্যোপায় ভাগ্নে বুদ্ধদেবকে। আর কবিতার বীজ বোনা হতে থাকত বুদ্ধদেবের চেতনায়, মননে। তারও আগে বাবা যখন মফস্সলের ডাক্তার, বাবার সহকারীর সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’ দেখে আপ্লুত হয়ে মোহগ্রস্তের মতো সেই দিনই পরের শো দেখেন। জাগরূক হল চলচ্চিত্রের প্রতি আকর্ষণ। মায়ের গানের আসরে চোখ বুজে গান শুনতে-শুনতে এবং গাইতে-গাইতে ইমেজের ছোঁয়া পান। বয়সকালে, এই সেদিনও বুদ্ধদাকে দেখেছি চোখ বুজে গান গাইতে। চোখ বুজে গান গাইলে বা শুনলে বুদ্ধদা অনেক ছবি দেখতে পেতেন, যা তাঁর লেখালিখি বা ছবি বানানোয় সাহায্য করত। মামুর কাছে কবিতা শুনতে-শুনতে কবিতা লিখতেও শুরু করলেন বুদ্ধদেব। ছাপাও হতে লাগল ছোট-বড় কাগজে। মাত্র উনিশ বছর বয়সে প্রকাশিত হল ‘গভীর এরিয়েলে’, বুদ্ধদেবের প্রথম কবিতার বই। তখন তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে অর্থনীতির উজ্জ্বল ছাত্র। স্কটিশ চার্চেই পেলেন অধ্যাপক তরুণ সান্যালকে, যাঁর বাড়িতে ডাঁই করা পাশ্চাত্য সংগীতের রেকর্ড। বুদ্ধদেব ইচ্ছেমতো শুনতে যেতেন সেইসব রেকর্ড আর বুঁদ হয়ে যেতেন। মোৎজার্ট আর বাখ তাঁর খুব পছন্দ, বেশি পছন্দ মোৎজার্ট। কবিতা, চলচ্চিত্র আর সংগীতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেলেন বুদ্ধদেব। অর্থনীতির প্রতিও ছিল গভীর ভালবাসা। স্নাতক হবার পর বাবার কাছে পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়ার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন। বাবা আদৌ আমল না দেওয়ায় ভর্তি হলেন এমএ ক্লাসে। বরানগরের কাঁটাকলে হত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ক্লাস। মাঝে মাঝে নামতেন সিঁথির মোড়ে ভাস্কর চক্রবর্তীর বাড়ির উদ্দেশে। সেই সময়েই সামান্য টাকা জমিয়ে নির্মাণ করেন প্রথম ছোট ছবি ‘সময়ের কাছে’। নায়িকা মীনাক্ষী দত্ত। প্রশংসিত হয় সে ছবি আবার এমএ-র ফলও বেশ ভাল হয়। প্রিয় মানুষ ও কবি আলোক সরকারকে পরীক্ষার ফল জানাতে গেলে উনি একটা সাদা কাগজ ধরিয়ে ওঁরই কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপকের পদে আবেদন করতে বলেন। অধ্যাপনার ইচ্ছেও ছিল। অতএব বুদ্ধদেব চললেন শ্যামসুন্দর।
প্রকৃতির কোলে পুরুলিয়ার আনারায় জন্ম হয়েছিল বুদ্ধদেবের। তারপর অনেকদিন পর্যন্ত ডাক্তার বাবার রেলের বদলির চাকরিতে প্রকৃতির মধ্যেই লালিত হয়েছেন তিনি। শ্যামসুন্দরে আবারও তিনি ফিরে পেলেন শৈশব, প্রকৃতি। আর পেলেন ‘অসামান্য হৃদয়বান মানুষ’ আলোক সরকারকে। স্মৃতিচারণায় বুদ্ধদেব লিখছেন:
‘সেই শ্যামসুন্দর কলেজের হস্টেলে আলোকদা আর আমি পাশাপাশি কতদিন থেকেছি। হ্যারিকেনের আলোয় আলোকদা কবিতা পড়ছেন আমি শুনছি, আমি কবিতা পড়ছি আলোকদা শুনছেন। একসময় রাতের খাবারের ডাক পড়ত। পাশাপাশি চাটাইয়ে বসে দিনের পর দিন খেয়েছি আমরা।’
শ্যামসুন্দর থেকে হাওড়ায় বাড়ি আসার পথে কখনও কখনও নেমে পড়তেন সুব্রতর বাড়িতে। সুব্রত চক্রবর্তী তখন বর্ধমান রাজ কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। অধ্যাপনা বেশিদিন করা হল না বুদ্ধদেবের। ছায়াছবির জগৎ তীব্রভাবে টানছে তাকে। পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি করতে হবে যে করেই হোক।
৩
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের দ্বিতীয় বই ‘কফিন কিংবা সুটকেশ’ ‘উলুখড়’-এর প্রথম প্রকাশনা। ছাপা হয়েছিল বউবাজারের সনাতন শীল লেনের এক ছাপাখানায়। প্রচ্ছদ পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়, ‘উলুখড়’-এর পক্ষে প্রকাশক প্রিতম মুখোপাধ্যায়। কপিরাইট আমার। উৎসর্গ ‘শোভনা মা-কে’। দাম ছিল তিন টাকা। প্রথম বই ‘গভীর এরিয়েলে’র নামকরণ ও কাব্যভাবনায় জীবনানন্দের প্রভাব ছিল ঠিকই, কিন্তু পরের বই ‘কফিন কিংবা সুটকেশ’ একেবারে অন্যরকম। ভাষা একেবারেই নতুন ও মৌলিক। বিষয় চারপাশের সমাজজীবন থেকে উঠে আসা। মনে রাখতে হবে, সময়কাল ১৯৬৩-১৯৭২। মুক্তির দশকের ডাক শহর-গ্রাম সর্বত্র। আন্দোলন আর আন্দোলন-বিরোধী আন্দোলন দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে মানুষকে। তার ওপর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, অনর্গল শরণার্থী। বুদ্ধদেব লেখেন ‘মৃত আশুকে’, ‘এপ্রিল ‘৭১’, ‘সে, মানে, একজন’, ‘একদিন’। বইয়ের শেষ কবিতা ‘তৈরি হও’— ‘যখন কফিন কিংবা সুটকেশ যেকোনো একটা বেছে নিতে/ বলা হয়েছে তোমাকে’। এরই পাশাপাশি বুদ্ধদেব লেখেন ‘সিনেমা’— ‘দ্রুত পরে নিলে বুট, হাঁটতে শুরু করলে একাই, কাঁধে/ তোমারই সেই পুরোনো ক্যামেরা আর রেড ফিল্টার’।
অধ্যাপনার পাশাপাশি বুদ্ধদা কিছু ডকুমেন্টারি বানান এই সময়। ‘ঢোলের রাজা ক্ষীরোদ নট্ট’ ছবিটি খুব প্রশংসা পায়। শরৎচন্দ্রের জীবন নিয়েও ডকুমেন্টারি করেন। এছাড়া ফিল্মস ডিভিশনের কিছু নিউজ রিল। আস্তে আস্তে পূর্ণাঙ্গ ছবি তৈরির স্বপ্নটা বাস্তবায়িত করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। ১৯৭৬ সালে বুদ্ধদা বিয়ে করেন। বউদি কুন্তলা দাশগুপ্ত তখন দক্ষিণ কলকাতার একটি স্কুলে পড়াচ্ছেন। ১৯৭৬-এর শেষেই সম্ভবত বুদ্ধদা চলে আসেন দেশপ্রিয় পার্কের ২৯ নম্বর যতীন দাস রোডে (এখন বুদ্ধদেবদার হাওড়ার বাড়ি আর দেশপ্রিয় পার্কের এই বাড়ি— দুটোই বহুতল হয়ে গেছে)। এই সময়েই শ্যামসুন্দর কলেজ ছেড়ে যোগ দেন কলকাতার সিটি কলেজে। পরে অধ্যাপনার নৌকো ভাসিয়ে সম্বল করেন শুধুমাত্র চলচ্চিত্র পরিচালনা। শুরু হয় জীবনের কঠিন লড়াই। ১৯৭৬ সালেই প্রকাশিত হয় ‘হিমযুগ’। ‘হিমযুগ’-এর কবিতায় বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত মনুষ্যেতর প্রাণিকুল ও অ-প্রাণ বিষয়ের মাধ্যমে তৎকালীন সামাজিক পরিবর্তনের দিকে পাঠককে সজাগ করেন। তখন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস শাসন চলছে, মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে জরুরি অবস্থা। ‘হিমযুগ’-এর কবিতার নাম একদিকে যেমন ‘হ্যাঙার’, ‘প্রেশার কুকার’, ‘চামচ’, ‘বুকশেলফ’, ‘দাঁত’ আবার অন্যদিকে ‘মাগুর মাছ’, ‘লাল পিঁপড়ে’, ‘গাধা’, ‘খচ্চর’, ‘হাতি’, ‘বাঘ’। বাংলা কবিতায় নতুন দিগন্ত। পাঠকের নজর কাড়ে। ১৯৭৭ সালে বুদ্ধদা প্রথম ফিচার ছবি ‘দূরত্ব’র কাজ শুরু করেন। ‘দূরত্ব’ যথেষ্ট সম্মান লাভ করে এবং বুদ্ধদেবের কাছে চলচ্চিত্র অনেক বেশি ব্যস্ততা দাবি করে। ১৯৮০ সালে বেরোয় ‘ছাতাকাহিনী’। ‘ছাতাকাহিনী’র কবিতার মধ্য দিয়ে শহুরে জীবনের যান্ত্রিকতা ও অপ্রেম প্রকাশ পায়। এই বইয়ের অনেক কবিতাই আমার প্রিয়। তার মধ্যে ‘হয়তো’ ও ‘ছাতাকাহিনী’ কবিতা দুটি উদ্ধৃত করছি—
হয়তো
হয়তো আবার দেখা হবে। হয়তো তখন আমরা ভুলে যেতে-যেতে
আঁকড়ে রয়েছি ধরে ভুলে যাওয়াটুকু
হয়তো আমার দিকে চেয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসবে দু-চোখের মণি
হয়তো তোমার দিকে চেয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসবে দু-চোখের মণি
মণিহীন, অন্ধ কোটরাগত চার চোখে তখনও ঝলসে উঠবে অপমান
মানুষী ছিলে না তুমি কোনোদিন, আমিও কি মানুষ ছিলাম!
ছাতাকাহিনী
ছাতা বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। একটা ছাতার পিঠে
ভর দিয়ে চলেছে আর-একটা ছাতা,
একটা ছাতার কাঁধে
হাত রেখে চলেছে আর-একটা ছাতা। বাস স্ট্যান্ডে
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে, অপেক্ষা করে, আজও যখন
এল না সেই ছাতা, ছোট ছাতা রাগে হতাশায় অপমানে
মিলিয়ে গেল আরও অনেক ছাতার ভিড়ে। দূরে
মাথার ওপর আছে
অত্যদ্ভুত বিশাল সাদা ছাতা। কোথাও কিছু নেই হঠাৎ
এল ঘুরঘুট্টি মেঘ, জুড়ে বসল
সেই সাদা ছাতার গায়ে। গিজগিজ করে ছাতারা
দাঁড়িয়ে পড়ল
এক-একটা জায়গায়, দাঁত কিড়মিড় করে একটা ছাতা
ছুটে এল
আর-একটা ছাতার দিকে, একটা ছাতা টুঁটি চেপে ধরল
অন্য একটা ছাতার। সারাদিন ঘুরে, ঘুরে-ঘুরে শেষ ছাতাও
বাড়ি ফিরেছে এখন। অন্ধকার একটা কোনায় চুপচাপ
দাঁড়িয়ে আছে সে, আর
তার সমস্ত শরীর থেকে জল ঝরছে, ঝল ঝরছে, জল ঝরছে।
৪
‘হিমযুগ’ থেকেই কবি বুদ্ধদেবের রচনাকে অ্যান্টি পোয়েট্রি বা প্রতি কবিতার তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। বুদ্ধদেবের তা মোটেই পছন্দ হয়নি। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন:
‘শুরুর দু-এক বছরের আড়ষ্টতা, প্রিয় কবিদের ছায়া আমাদের লেখালিখি থেকে সরে যাবার পর, আমার সময়ের কয়েকজনের মতো আমিও নিজস্ব ভঙ্গি খুঁজে পেয়েছিলাম, পরে অনেক আলোচকই তাকে Anti Poetry বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। এই ভাবেই লেখা হয়ে যেতে লাগল সেই সব। তার মধ্যে জড়িয়ে যেতে লাগল সময়, চারপাশের মানুষ, তাদের বেঁচে বর্তে থাকার কথা। ভূতগ্রস্ত সেই লোকগুলো কখনো হাস্যকর রকমের গম্ভীর কখনো হীনমন্যতায় ভোগা এবং স্বার্থপর, প্রতিবাদহীন, দুঃখী, ব্যর্থ ও দয়ালু। তাদের বেঁচে থাকায় আমি যেমন কেঁচো, গাধা, আরশোলা, হাতি ইত্যাদির ছায়া দেখেছি। তেমনই দেখেছি অ-প্রাণ বিষয় ও বস্তু যেমন হ্যাঙার, মেশিন, চামচ, চুরুট প্রভৃতির ছায়া।’
ইতিমধ্যে ‘নিম অন্নপূর্ণা’ নির্মিত, প্রদর্শিত ও পুরস্কৃত হয়েছে। ১৯৮২-তে মুক্তি পায় ‘গৃহযুদ্ধ’। দেশ-বিদেশে সচেতন দর্শককুল নড়েচড়ে বসে। ১৯৮৩-তে প্রকাশিত হয় ‘রোবটের গান’। এখানেও বুদ্ধদা আধুনিক জীবনের শূন্যতা ও যান্ত্রিকতার দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ‘এই ঘর’ কবিতাটি উদ্ধৃত করছি:
এই ঘর
কেউ থাকে না এখানে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে,
কাছে দূরে কেউ থাকে না
সকালবেলা
দরজা খুলে যায়
রাত্রিবেলা
বন্ধ হয়ে যায় দরজা
আরও অনেক পরে,
দরজা ভেঙে
ঘরে ঢকে মৃত মানুষ,
শুয়ে থাকে
মৃত মানুষীর পাশে।
৫
ক্রমশ বুদ্ধদা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন চলচ্চিত্র জগতে। শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণ নয় দেশ-বিদেশের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে কখনও প্রতিযোগী কখনও বিচারক হিসেবে উপস্থিত থাকতে হয়। এরই ফাঁকে তিনি রচনা করেন বেশ কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা। তাঁর সম্পর্কে সবাই বলেন ‘সেলুলয়েডের কবি’। তাঁর ছবির পরতে পরতে দর্শক খুঁজে পান কাব্যের সুষমা।
বুদ্ধদেবের পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রের সংখ্যা চোদ্দো। কবিতার বই, প্রকাশিতব্য ‘একলা একটা চেয়ার’কে ধরে এগারো। আমার মনে হয় কবি বুদ্ধদেব যখন কবিতা লেখেন তখন বেতাল হয়ে তাঁর পিঠে চেপে বসে থাকে চলচ্চিত্রকার বুদ্ধদেব। আবার চলচ্চিত্রকার বুদ্ধদেব যখন চিত্রনাট্য লেখেন বা ছবি পরিচালনা করেন তখন বেতাল হয়ে তাঁর পিঠে চেপে বসে থাকে কবি বুদ্ধদেব।
‘রোবটের গান’-এর পরের বই ‘ভোম্বলের আশ্চর্য কাহিনী ও অন্যান্য কবিতা’। বেশ কয়েকটি দীর্ঘ কবিতার সংকলন। ম্যাজিক রিয়ালিটি নিয়ে এখন অনেক কথা হয়, বুদ্ধদেবদার কবিতার সঙ্গে প্রথম থেকেই ম্যাজিক রিয়ালিটির ব্যাপারটা ছিল। মনে করে দেখুন ‘কফিন কিংবা সুটকেশ’-এর ‘একটা দরজা খোলা থাকে’— ‘… ভাতের থালার কাছে বসে সে দেখতে পায়/ একটা ভাতকে ঠেলে নিয়ে চলেছে অন্য আরেক ভাত/ আর তার মা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঢুকে পড়ছেন/ মাটির ভেতর, মাটি ফুঁড়ে/ তার বিছানার পাশে শুয়ে থাকছেন পুরোনো দিনের মতো’। বা, ‘হিমযুগ’-এর সেই বিখ্যাত ‘মাগুর মাছ’— ‘… সারা সকাল সারা দুপুর বাড়ি ভরে যায় মাগুর মাছের গন্ধে।/ তারপর আবার রাত্রি নামে, শান্ত হয়ে থাকে পৃথিবী। বৌ/ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে সাঁতার কাটার/ শীতল নীল দূর-বয়সের দিঘির ভিতর।/ হঠাৎ ওঠে হাওয়া, আর/ রান্নাঘরের দরজা ভয়ঙ্কর শব্দ করে খুলে যায়,/ আঁতকে ওঠে বৌ— মাগুর মাছ,/ মাগুর মাছের পেছনে তাদের স্বপ্ন, মাগুর মাছের সামনে/ তাদের স্বপ্ন,/ অদ্ভুত শিস দিতে দিতে/ মাগুর মাছেরা সারারাত এ-ঘর ও-ঘর করে/ আর খুঁজে বেড়ায় সেই শান্ত সুন্দর বৌকে’।
৬
‘ভোম্বলের আশ্চর্য কাহিনী ও অন্যান্য কবিতা’র পরের বই ‘উঁকি মারে নীল আর্মস্ট্রং’। এই বই আগের বইগুলোর থেকে একদম আলাদা বলা যাবে না। কিন্তু বলার ভঙ্গিমায় কোথাও একটা বদল লক্ষ করা যায়। তার কারণ হতে পারে সামাজিক প্রেক্ষাপটের বদল, হতে পারে নিজের জীবনের মানচিত্রে পরিবর্তন। এই বইয়ের দুটি কবিতা উদ্ধৃত করছি—
কেউ নেই
টেলিফোন বেজে যায় ঘরে কেউ নেই।
দরজার ফাঁক দিয়ে
রোজের কাগজ ঢুকে পড়ে
ঘরে কেউ নেই।
বাথরুমে জল পড়ে
কল ভেসে যায়
ঘরে কেউ নেই।
চিঠি এসে বসে থাকে
ঘরে কেউ নেই।
সিটি বাজে কুকারে
ঘরে কেউ নেই।
ঘরে আছে জোড়া খাট
খাটের তলায় দুটি লাশ শুয়ে আছে
ঘরে কেউ নেই।
গাছ
তোমার বুকের কাছে হাত পাতি
পাতা ঝরে পড়ে।
তুমি কি গাছের মতো ডানা মেলো
তারা গোনো, শিশিরে ধোয়াও উরু,
নখের আঙুল ?
গাছের গুঁড়ির কাছে হাত পাতি
দুধ ঝরে পড়ে।
৭
‘উঁকি মারে নীল আর্মস্ট্রং’-এর পরের বই ‘গুটগুটিয়ে চলেছে নীল পোকা’। এই বইয়ে ‘সিনেমা’ শিরোনামে তিনটি কবিতা আছে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিতা সব সময়েই জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে এই তিনটি কবিতার পূর্ণাঙ্গ পাঠ তাঁর কবিতা সম্পর্কে আগ্রহী পাঠকদের পক্ষে জরুরি। পরের বই ‘ভূতেরা কোথায় থাকে’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৭ সালে। আর তারই পিঠোপিঠি ২০১৮ সালে বেরোয় ‘বেঁচে থাকা জিন্দাবাদ’। বুদ্ধদেবদা ‘ভূতেরা কোথায় থাকে’র সময় থেকেই বেশ অসুস্থ। ডায়ালিসিস চালু হয়ে গেছে তবু লেখা বা ছবি বানানো বন্ধ হয়নি। রবীন্দ্রনাথের তেরোটি কবিতা নিয়ে তেরোটি ছবি বানিয়েছেন। জীবনানন্দের কবিতা নিয়েও ছবি করার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। শেষ ছবি ‘উড়োজাহাজ’ খুবই শারীরিক ক্লেশ নিয়ে তৈরি। কিন্তু ছবিটি একটি অসাধারণ স্বপ্নতাড়িত ছবি। বুদ্ধদেবদার সেরা ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম। এই সময়েই লেখা হয় শেষ কবিতার বই, এখনও প্রকাশিতব্য, ‘একলা একটা চেয়ার’। এই বইয়ের নাম-কবিতাটি কিন্তু আগের বই ‘বেঁচে থাকা জিন্দাবাদ’-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কবিতাটি শেষ হয়েছে এইভাবে—
বৃষ্টির ভেতর
একলা একটা চেয়ার
ভেসে চলেছে
সম্রাট অশোকের দিনগুলোতে।
শেষ তিনটি বইয়ের বেশিরভাগ কবিতাই দীর্ঘ— প্রেম, বাস্তব ও পরাবাস্তব হাত ধরাধরি করে আছে। আছে জীবনকে নিবিড়ভাবে ভালবাসার কথা। শহুরে লোভ-যান্ত্রিকতা-অসহায়তার পাশাপাশি বুদ্ধদেব সবসময় চোখে চোখ রেখে সত্যি কথা বলেছেন। আর পাঠকের অন্তস্থলের সত্যকে জাগিয়ে দিতে চেয়েছেন।
৮
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চলচ্চিত্রে আন্তর্জাতিক খ্যাতি বাঙালি হিসেবে আমাদের গর্বের কারণ নিশ্চয়। কিন্তু এর ফলে একজন ক্ষমতাবান কবিকে চলচ্চিত্রের খ্যাতির আড়ালে চলে যেতে হয়েছে। এটা নিশ্চিতভাবেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ও বাংলার কবিতাপ্রেমী মানুষের দুর্ভাগ্য। আশাকরি, আগামী দিনে তাঁর কবিতা নিয়ে আরও চর্চা হবে এবং কবিতার জগতে তাঁর প্রকৃত স্থান নির্ধারিত হবে।
৯
অনেক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে আমরা দেখেছি— কবি, চলচ্চিত্রকার, গদ্য লেখক, সংগীতবোদ্ধা, হয়তো আরও কিছু। কিন্তু বুদ্ধদেব আদতে ছিলেন একজন স্বপ্নতাড়িত মানুষ। তাঁর সেই স্বপ্ন দেখার তাড়না তিনি আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করার চেষ্টা করেছেন নানাভাবে। সপ্তাহে চারদিন ডায়ালিসিস হয় যে মানুষের, তিনি ফোন করে বলেন, ‘নতুন ভাল গল্প কিছু পেলে’? বলেন, ‘কাল রাত্তিরে সাতটা কবিতা লিখেছি। কবে শুনবে’?
এই লেখাটা লিখতে লিখতে কোনও সংশয় হলে মনে হয়েছে দৌড়ে যাই বুদ্ধদার বাড়ি। তারপর সারাদিন কবিতা-গান-ছবি-গল্প। সেই সত্তর/একাত্তর থেকে দেখা হলে কথা আমাদের যেন আর শেষ হয় না। ছয়ের দশকের আমাদের প্রিয় কবিরা এক-এক করে আগেই বিদায় নিয়েছেন, ছিলেন বুদ্ধদা। দশই জুন তিনিও চলে গেলেন। সাতই জুন সন্ধেবেলা ফোন করেছিলেন— অনেক কথা হল, পরিকল্পনা হল। আমি বললাম ভ্যাকসিনের সেকেন্ড ডোজ না নিয়ে আপনার কাছে যাব না। ‘সেকেন্ড ডোজ’ হয়তো নেওয়া হবে, বুদ্ধদাকে আর ছুঁতে পারব না।
১০
ছয়ের দশকের কবিদের সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা আমাকে দিয়ে একটা কবিতা লিখিয়ে নিয়েছিল— ‘বালাই ষাট ও সত্তরের একজন’। বুদ্ধদার পছন্দের সেই কবিতা বুদ্ধদাকে উৎসর্গ করে এই লেখা শেষ করলাম—
বালাই ষাট ও সত্তরের একজন
রবীন্দ্রসদন স্টেশনে নামতে যাব ধাক্কা খেলাম সুব্রতদার সঙ্গে—
সেই মোটা কালো ফ্রেম, মাথাটা পুরো সাদা।
পেছনে ভাস্করদা জিন্সের প্যান্ট, লাল টি-শার্ট।
শামশেরের বয়স বাড়েনি।
তর্কে ব্যস্ত ব্যান্ডমাস্টার আর মানিক চক্রবর্তী
মানিকদাকে আমি প্রথম দেখলাম পাজামা পাঞ্জাবিতে
মাথায় আবার গামছার পাগড়ি।
আমার আর নামা হল না।
ষাটের তোড়ে সেঁধিয়ে গেলাম কামরার ভিতরে।
চললে কোথায় ? সমস্বরে ষাট উত্তর দিল, মোচ্ছব করতে।
সুব্রতদা বলল, কেমন আছিস ? মাসিমা-মেসোমশাইয়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে
দেখা হয়।
ভাস্করদা, উলুখড়ের কবিতাসংখ্যায় আমার লেখা নেবে না ?
আমি এখন নীল আকাশে মেঘের কালি দিয়ে লিখি।
সুব্রতদা, আকাশ যে নীল নয় এখন বালকও জানে, ভাস্কর জানে না।
সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
শামশেরের মুখে কোনো কথা নেই, চশমার পেছনের চোখে সেই অসাধারণ হাসি।
তর্ক থেমে গেছে, তুষারদা এখন নতুন ছবির শট বোঝাচ্ছে নিরুপায় মানিকদাকে।
আমি তো হাওয়ায় ভাসছি। এতদিন পর একগুচ্ছ ষাট।
সবাই একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে বুদ্ধদেবের খবর কী ?
বললাম, এই মুহূর্তে আর. এন. টেগোরের কেবিনে শুয়ে শুয়ে
খুব শক্ত একটা অঙ্ক কষছে।
কফিন কিংবা সুটকেশ ছেড়ে হিমযুগ পার হয়ে এখন বলছে,
বেঁচে থাকা জিন্দাবাদ।
কৃতজ্ঞতা: শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়, তিমিরকান্তি ঘোষ