ডরাইতে আয় আর বন্দুকের আওয়াজ শুনাই
রক্ত জইম্মা যায়, আমি ফরিসয় (পরিচয়) হারাইতাম না
নিতে দিতাম না, আইজ ভাগলে কালকে আমরা নাই।’
ট্রেনের হর্নের ভোঁ-ও-ও শব্দ, বহু যাত্রীর কলরব। স্টেশনে গাড়ি ঢুকছে। তার জানান দিচ্ছে ভারতীয় রেলওয়ের অতিপরিচিত ঘন্টি, যার আওয়াজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত মানুষের স্মৃতি, আকাঙ্ক্ষা— নতুন যাত্রার, নতুন শুরুয়াতের, কিংবা বাড়ি ফেরার। যত গভীর ঘুমই হোক, প্ল্যাটফর্মের ঘন্টির ডাকে তড়াক করে উঠে বসার ট্রেনিং আমরা ছোট থেকেই পেয়েছি। আমাদের দেশের ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’-র ক্রমশ বিরল উদাহরণের তালিকায় এই আওয়াজটি আমার কাছে অন্যতম— তা-ও বেসরকারিকরণের ঢেউয়ের ধাক্কায় যদি টেকে! দেখা যাক। ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাকার শব্দ যেমন যাত্রীদের এক নতুন ছন্দে বেঁধে ফেলে, তেমনই প্ল্যাটফর্মের কোলাহলের মধ্যে থেকে উঠে আসে গানটার তাল। সিলেটি ভাষায় লেখা এই গানের শুরুতেই ব্যস্তবাগীশ ভাবে কেউ একজন রিকশাওয়ালাকে বলছেন তাঁকে জলদি তারাপুর স্টেশন নিয়ে যেতে। কিন্তু কীসের এত তাড়া?
‘হোয়েল ইন দ্য পন্ড’-এর (‘Whale in the Pond’) গীতিকার, শৌর্য সিংহ, ‘আইজ ভাগলে কালকে আমরা নাই’ গানটি লেখে ২০১৫ সালে শিলচরে প্রথম ব্রড গেজ ট্রেন চালু হওয়ার প্রেক্ষাপটে। বরাক উপত্যকার অনেক মানুষের কাছে এই ঘটনাটা বহির্বিশ্বের সঙ্গে এক নতুন সম্পর্কের সূচনা করে— শাঁখ বাজিয়ে, মালা হাতে ওই দিন বরণ করা হয়েছিল প্রথম সেই ট্রেন এঞ্জিনটিকে। উন্নয়নের প্রতীক। অথচ (স্বাভাবিক ভাবেই) এঞ্জিনের প্রথম যাত্রা ছিল একক; জোড়া ছিল না মানুষ-বহনকারী কামরা। কিছুটা যেমন উন্নয়নের এই ন্যারেটিভের দম্ভে মুছে দেওয়া হচ্ছে মানুষের আত্মমর্যাদা রক্ষার রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ইতিহাস, একইসঙ্গে সেই সময়ে চলছিল অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরির কাজ।
এই জায়গা থেকে ‘আইজ ভাগলে’ গানটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় শিলচর স্টেশনেই রচিত পুরনো এক ইতিহাসের কথা, যাতে তার বিস্মৃতির ওপর পুনর্লিখিত না হয় একতরফা উন্নয়নের কাহিনি। ফিরিয়ে নিয়ে যায় ১৯৬১ সালের ১৯-এ মে, যেদিন ওই স্টেশনেই নিজেদের পরিচিতি এবং ভাষার জন্য লড়াই করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১১ জন বাঙালি সত্যাগ্রহী। অসমিয়াকে একমাত্র দাফতরিক ভাষা হিসাবে ঘোষণার বিরোধিতা করেছিলেন তাঁরা। অসম-কে একভাষিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে দিতে নারাজ ছিলেন ভাষা-আন্দোলনকারীরা।
‘হোয়েল ইন দ্য পন্ড’-এর প্রথম অ্যালবাম, ‘মার্বেল্স’ (‘Marbles’), প্রকাশিত হয় ২০১৭-র জুন মাসে। হাজরা আর গড়চা রোডের মোড়ে ডুড্ল রুম বলে একটি স্টুডিওতে ওদের পারফর্ম্যান্সের পর অ্যালবামটি প্রকাশ হয়। তার আগে অবশ্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দলের দুজন সদস্য— শৌর্য আর শিরীন (ঘোষ)-এর গান শোনার সুযোগ হয়েছিল একাধিক বার, ইউ জি আর্টস-এর করিডোর বা ঝিলপাড় বাদ দিয়েও।
গান্ধী ভবনে ২০১৬-র জানুয়ারিতে অধ্যাপক আনন্দ লালের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় ইংরেজি বিভাগীয় প্রযোজনা, এরিস্টোফ্যানিসের গ্রিক কমেডি, ‘লাইসিস্ট্রাটা’। প্রাচীন গ্রিক সঙ্গীতের নিয়মকানুন গবেষণা করে, ভীষণ মজার এবং অভিনব এক সাউন্ডস্কেপ তৈরি করেছিল ওরা। পরবর্তীতে, ওই নাটকের একটি সুর খুঁজে পাই হোয়েল-এর প্রথম অ্যালবামের ‘দ্য কল’ (‘The Call’) গানে। গ্রিক কমেডি থেকে অনেকটা দূরে সরে, তখন সেই সুরটি ধারণ করেছিল এইচ পি লাভক্রাফটের কাল্পনিক দানব, ক্থূল্হু-র (‘Cthulhu’ ওরফে ‘The Great Old One’) উদ্দেশ্যে লেখা একটি ব্যালাডের রূপ। কিন্তু কোথায় ক্থূল্হু আর কোথায় ’৬১-র ভাষা আন্দোলন— হোয়েল কি তার মানে ধর্মেও আছে, জিরাফেও আছে? প্রশ্নটা মাথায় না এলেই অবাক হতাম।
হোয়েল-এর বিবর্তন কীভাবে হল— বা হচ্ছে— তাহলে দেখে নেওয়া যাক। ওদের প্রথম অ্যালবাম পুরোটাই ছিল ইংরেজিতে। শৌর্য, শিরীনের সঙ্গে গিটারে ছিল দীপ ফিনিক্স। প্রতিটা গান শুনে আন্দাজ করা যায় কতটা যত্ন নিয়ে লেখা। একঘেয়ে প্রেম অথবা ধার করা নস্টালজিয়ার ধার করা সুর ফেলে রেখে নতুন আমেজের খোঁজ পাওয়া যায় ওদের গানে। বিষয়বস্তু অনুযায়ী নির্বাচন করা হয়েছে বাদ্যযন্ত্র আর অ্যারেঞ্জমেন্ট— বহুমুখী বাদক হওয়ার যা সুবিধা— ফলত প্রত্যেকটা গানের সাউন্ড বেশ আলাদা, মানানসই। প্রথম গান, ‘মার্বেল্স’-এ ভেসে আসে শিরীনের মেলডিকার স্নিগ্ধ টানা সুর, আর তারই সঙ্গে অতি সূক্ষ্ম হারমনি। জেম্স জয়সের ছোটগল্পের দ্বারা অনুপ্রাণিত ‘অ্যারাবি’-তে (‘Araby’) পাওয়া যায় ঔদ জাতীয় কোনও বাদ্যযন্ত্রের ইঙ্গিত। তেমনই ‘দ্য কল’-এ সমুদ্রগর্ভে ক্থূল্হুর বাসস্থানের সাউন্ডস্কেপ তৈরি হয় জাহাজের ডেকের বিশৃঙ্খল চেঁচামেচি, কোলাহল, হাসি-ঠাট্টার মধ্যে দিয়ে। সেই সময়ে ইংরেজি বাদে অন্য কোনও ভাষায় গান লেখার সম্ভাবনা ওদের মাথায় ছিল কি না জানি না।
শৌর্যকে জিজ্ঞেস করতে বলল, এক সঙ্গীতানুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের অনুরোধ রক্ষা করতে প্রথম সে মাতৃভাষায় গান লেখার চেষ্টা করে। শিলচরের স্কুলে যদিও বাংলা শেখানো হয়, কথ্যভাষা বলতে শৌর্যর মনে আসে সিলেটি। আর মাতৃভাষার সঙ্গে আঞ্চলিক ইতিহাস, ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য বা ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতি জড়িয়ে থাকবে সে তো খুবই স্বাভাবিক। সেই থেকে ইংরেজির পাশাপাশি সিলেটিতে গান লেখা শুরু করে দেয়। প্রথম প্রচেষ্টার ফল— ‘আইজ ভাগলে’— হোয়েল-এর দ্বিতীয় অ্যালবাম, ‘দোফন’-এর প্রথম গান।
‘দোফন’-এর ছ’টা গানের মধ্যে দুটো সিলেটি ভাষায়। ইতিমধ্যেই ব্যান্ডের চতুর্থ একজন সদস্যও যোগ হয়েছে— ম্যান্ডোলিনে সাগ্নিক সমাদ্দার। অ্যালবামের সঙ্গে একটা পুস্তিকাও পেয়েছিলাম। হোয়েল বরাবর ওদের সমসাময়িক অল্পবয়সি শিল্পীদের সঙ্গে মিলিত ভাবে কাজ করে এসেছে— গান-বাজনায় সঙ্গত দেওয়া থেকে শুরু করে প্রচ্ছদের ছবি আঁকা কিংবা ভিডিও অ্যানিমেশনের ক্ষেত্রেও। ‘দোফন’-এর প্রচ্ছদ ওদেরই এক বন্ধু, নীলের আঁকা। দেখা যাচ্ছে খোলা মাঠের মধ্যে দিয়ে একজন মানুষের দিশাহীন দৌড়। দু’হাত প্রসারিত, মাথার পিছনে বিরাট আলোর গোলা। সম্ভবত শেষ আকাশের সূর্য। প্রচ্ছদের অনুপ্রেরণা পিলুর বাড়ির বসার ঘরে টাঙানো একটা ছবি, যা ওঁর ঠাকুমা উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন ১৯৬০-এর দশকে শিল্পী অমলানন্দের থেকে।
অ্যালবামের বিষয়বস্তু পৃথিবীর শেষের সে-দিন। মজার ব্যাপার হল, এইরকম সাংঘাতিক একটা ঘটনার নানা সম্ভাব্য রূপ— পারমাণবিক হলোকাস্ট, বিশ্ব উষ্ণায়ন, সুপারনোভা, (কিংবা অতিমারী)— কল্পনা করতে গিয়ে গানগুলো যেন আরও বেশি করে সৌন্দর্যের আশ্রয় নিয়েছে, যে সৌন্দর্যের আনাচেকানাচে লুকিয়ে আছে নিয়তির ছায়া। সাধারণত আমরা অ্যাপোক্যালিপ্সের কথা ভবিষ্যৎমুখী হয়ে ভেবে থাকি। কিন্তু যদি হঠাৎ কেউ আমাদের নিয়ে গিয়ে ফেলে সেই শেষ মুহূর্তে? যদি কল্পনা করতে বলে এমন একটা সময় যখন ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই, আছে কেবল বর্তমান আর অতীত? সব গান, সব মুহূর্তেই যেন এলেজির সুর। তখন আমাদের মনের অবস্থা কেমন হবে?
কোনও কোনও গান, যেমন ‘দ্য নাইট্স এন্ড’ (‘The Night’s End’) বা ‘কাইট/লূন’-এ (‘Kite/Loon’), সেই মুহূর্তে পাশে আছে কোন প্রিয়জন। মনে পড়ছে আগেকার কথা, ইচ্ছা হচ্ছে ছোটবেলার অলিগলি তাদের সঙ্গে নতুন করে চিনতে। আবার ‘দোফন’ নামের গানটায় আমরা দেখছি একজন মরিয়া হয়ে পারমাণবিক বোমার হাত থেকে বাঁচতে একটি ভরতি বাঙ্কারে আশ্রয় চাইছে, কিন্তু তার ভেতরের মানুষ ফুর্তিতে মশগুল। কোনও সাড়া না পেয়ে সে ভাবছে, সবই তো শেষ হয়ে যাবে। কোনও কৃত্রিম আশ্রয় না পাওয়াই হয়তো মুক্তি।
হোয়াটসঅ্যাপে পুরনো মেসেজ ঘেঁটে দেখলাম, আমি শৌর্যর সঙ্গে যোধপুর পার্কের মোড়ে দেখা করে ‘দোফন’-এর কপি সংগ্রহ করেছিলাম ২০২০-র ১১-ই মার্চ। অর্থাৎ সবে কোভিডের নতুন বাস্তবে আমরা পা দিয়েছি। অ্যালবামের কাজ নিশ্চয়ই তার অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। ভেবে গায়ে কাঁটা দেয়— তখন বুঝতেও পারিনি কতটা পালটে যাবে আমাদের ‘সাধারণ’-এর সংজ্ঞা। শেষের সে-দিন কি মনে হবে— তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আমার কাছে হল এই যে, হোয়েল-এর গানের সাহায্যে সেই দিনটা কল্পনা করার পর আমরা যখন আবার বাস্তবে ফিরে আসব, তখন কি আমাদের মধ্যে কিছু বদলে যেতে পারে? আমরা কি একটু আলাদা চোখে দেখব আশপাশের মানুষ, পরিবেশ, গাছপালা, জীবজন্তুদের?
সম্প্রতি ওদের দুটো নতুন গান— ‘বারাখা’ আর ‘দুই থাপ্পড়’— ই পি (EP) আকারে বেরিয়েছে। ‘দুই’ নামের এই অ্যালবামটি প্রকাশ পায় ২০২০-র ডিসেম্বরে। দুটি গানই সিলেটিতে লেখা। প্রথমটিতে দেখছে শিকল ভাঙার স্বপ্ন, আর ‘দুই থাপ্পড়’ বলে সেই সব বাচ্ছাদের কথা, স্কুলের পরীক্ষায় অঙ্কে ২৫-এ ২২ পেলেও যাদের বাড়ি ফিরতে ভয় পেতে হয়।
আমাদের দেশে পেশাদারী সঙ্গীতকার হতে গেলে নিজের খেয়ালে চলা বেশ কঠিন। আর অন্য দিকে, কলকাতায় ‘ইনডিপেন্ডেন্ট’ শিল্পী হিসাবে রোজগার অতি সামান্য। পুঁজির ওপর নির্ভর করার সুযোগ-সুবিধা যাদের নেই, তাদের জন্য কি আদৌ কোনও রাস্তা আছে? হোয়েল চেষ্টা করছে একটা নতুন পথ, নতুন পন্থা খুঁজে বের করার।
স্টুডিও ভাড়া করা বেশ খরচসাপেক্ষ। তাই ওরা রেকর্ডিং করে ব্যান্ডের সদস্যদের বাড়িতেই। ছোটবেলায় যেমন কম্বলের তলায় ঘাপটি মেরে টর্চের আলোয় বই পড়তাম, সেইভাবেই, মাঝরাতে যখন রাস্তাঘাট নিস্তব্ধ, তাঁবু খাটিয়ে সাউন্ডপ্রুফ করে ওরা একে-একে গান, বাজনা রেকর্ড করে। সাউন্ড-মিক্সিং নিজেরাই করে, আর বন্ধুস্থানীয় শিল্পীদের সাহায্যে ওদের গান ফুটে ওঠে অ্যালবামের প্রচ্ছদ বা ভিডিও আকারে। এ ছাড়াও উদ্যোগ নিয়ে, সমবয়সি আরও অনেকের সঙ্গে ওরা চেষ্টা করছে কলকাতায় ছোট ছোট ইনডিপেন্ডেন্ট শিল্পীদের জায়গা করে দেওয়ার। এই ধরনের কিছু অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে— সে এক নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা (অংশগ্রহণ বলছি কারণ ওই পরিবেশে নিজেকে শ্রোতা হিসেবে দেখার চেয়ে এই নতুন ভাবনার অংশীদার মনে করতে ভাল লাগে।)।
হালে কোভিডের কারণে অন্যান্য অনেক শিল্পীদের মতনই হোয়েল-এর বহু পরিকল্পনায় ব্যাঘাত ঘটেছে। ২০২০-র লকডাউনের আগে যেমন ওদের কথা ছিল দেশের নানান শহরে ট্যুর করার। আশা করব আগামী দিনে শুধু হোয়েল নয়, ওদের মতন আরও যারা নিজেদের পন্থায় তাঁদের নতুন সঙ্গীতভাবনা এবং সমাজ-সচেতনতার বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দুর্গম পথ বেছে নিয়েছেন, তাঁদের কাজের ব্যাপারে আমাদের সকলেরই সচেতনতা বাড়বে। এই অসময়ে কলকাতার সংস্কৃতির আড্ডায় তার চেয়ে বড় পাওনা আর কী হতে পারে? লাইভ পারফর্ম্যান্স আবার কবে চালু হবে বলা মুশকিল। আপাতত পাড়ার পুকুরে না হলেও স্পটিফাই, ইউটিউব, অ্যাপ্ল আর অ্যামাজন মিউজিক-এ হোয়েল-কে খুঁজে পেতে পারেন।