ভোরের সফর
আট টাকার তন্দ্রার ওষুধই জলে গেল। অবশ্য জল দিয়েই গিলেছিলাম। তারপর সারারাত সমুদ্রতাড়িত জাহাজের বেগে বিছানার এপাশ আর ওপাশ অনুসন্ধান করেছি, চোখ তার নোঙর খুঁজে পায়নি।
ভোরবেলা অগত্যা উঠে বের হয়ে গেলাম। সকালবেলার মোহাম্মদপুর ফাঁকা আর বাতাসময়। টাউন হলের দিকে যাবার পথে-পথে সবুজ পুলিশ আর সবুজ সবজির পসরা। এই ভোরবেলা পুলিশ এসে সবজিবাজার তুলে দিচ্ছে। সবজিরা এখান থেকে ওখানে যায়, কোনওদিন বাগানে ফেরত যেতে পারে না।
তাজমহল রোড পার হতেই, পুলিশের হুইসেলের চেয়েও দ্রুত বৃষ্টি নেমে এল। ইকবালের রোডের এক বাড়ির বাড়তি কার্নিশের নিচে আশ্রয় নিলাম। অল্পক্ষণ। বৃষ্টির বুলেটে নিহত হল না কিছুই। ইকবাল রোডে দাঁড়িয়ে ইকবালের গজলের এক বাক্য গুনগুন করে উঠল মাথার ভেতর— ‘আমার এই দেহ পোড়া শেষ ছাই বেদনায় ফের হৃদয় না হয়ে ওঠে/ যে বেদনায় কেটেছে জীবন যেন সেই বেদনার দিকে না ছোটে’। বৃষ্টি থামতে ইকবাল রোড থেকে বের হয়ে নূরজাহান রোডের দিকে হাঁটা দিলাম। কোভিডের রীতিতে এখন আর একজায়গায় বাজার বসে না। মানুষের মতো বাজারকেও মেনে চলতে হয় দূরত্ব। কোনওকালেই কি আর যেখানে বাজার থাকার কথা, সেখানে বাজার বসে?
‘স্পর্শ করে অন্য নানা ফুল
অন্য দেশ, অন্য কোনো রাজার,
তোমার গ্রামে, রেলব্রিজের তলে,
ভোরবেলার রৌদ্রে বসে বাজার।’
উৎপলকুমার বসুর ‘নবধারা জলে’-এর এই কবিতাংশ আমাকে ভ্রান্তিময় করে রাখে। একে তো স্বরবৃত্তে লেখা কোন কবিতায় এমন ধীর, শান্ত দোলা আর চোখে পড়ে না। দ্বিতীয়ত এই অংশটুকুর বিষাদ কি দূরবর্তী দয়িতা, ফেলে আসা দেশ, নাকি কোনও ছিন্ন আকাঙ্ক্ষার ছিটকে থাকা রক্ত, কার প্রতি সেটা বুঝতে পারি না।
নূরজাহান রোডে মুরগিবাজার বসেছে। এ-বাজার ক্ষণস্থায়ী। আগেই বলেছি, ভাইরাস পৃথিবী শুধু মানুষকেই দ্বিধাভক্ত করেনি, বাজারও বসিয়েছে আলাদা আলাদা। অর্থাৎ যেখানে মুরগি বিক্রি হচ্ছে সেখানে সবজি বিক্রি দুরস্থ নয়। যেখানে ফল বিক্রি হবে সেখানে ডিম বিক্রি চলবে না। মুরগি কেউ জীবন্ত নিয়ে যান, অধিকাংশই জবাই করে কেটেকুটে নিয়ে যান। নূরজাহান রোড সকালবেলা কুক্কুটরক্তে প্লাবিত হয়ে থাকে। হায় ভারতেশ্বরী নূরজাহান, যিনি সমাধিস্থলে লিখে রেখেছেন, ‘গরীব গোড়ে দীপ জ্বেলো না, ফুল দিও না কেউ ভুলে; শ্যামাপোকার যেন পাখা পুড়ে না যায়, বুলবুল যেন তাতে ব্যথা না পায়।’ আজ অজস্র মুরগির রক্ত নূরজাহান রোডকে লাল করে রাখে, নূরজাহানের সমাধিতে এই গৃহস্থ জঠরের বুলবুলের বেদনা পৌঁছোয় কি না আমরা জানি না।
এখন দোকানে-দোকানে সূর্য রঙের সিঙারা তৈরি হয়ে গেছে। সূর্যের মতোই উত্তপ্ত, তবে ধোঁয়াময়। সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখি, ঘুমের ওষুধের মতোই সেটা অকেজো, ঘোলাটে, বিষণ্ণ।
আমার সঙ্গে টলতে-টলতে এখন মোহাম্মদপুরই ফিরে যাচ্ছে মোহাম্মদপুর।
২.
কখনও-সখনও প্রকৃতি এমন বৈপরীত্য দেখায় যা মানুষের বিচারের অতীত। বড় শুষ্ক ছিল এবারের গ্রীষ্ম। আমের মুকুল আকুল হয়েও প্রাণ পায়নি, ঝরে গেছে। কিন্তু মধ্য জ্যৈষ্ঠের বৃষ্টির বেদনা আমকে ফেরার হতে দেয়নি। ঢাকার মানুষ এখন আক্ষরিক অর্থেই আমজনতা। প্রতিবার যেমন হয়, বিশাল-বিশাল আড়ত করে ‘রাসায়নিক মুক্ত আমের মেলা’, ‘আমের বাজার’, ভ্যানে করে করে রাস্তায় রাস্তায় আম বিক্রি— সেসব তো আছেই। কেউ হয়তো মোটে দশটা-বিশটা আম নিয়ে চাটাই বিছিয়ে বসেছে ফুটপাথে। ঘণ্টাখানেক বেচতে পারলে লাভ পঞ্চাশ কি ষাট টাকা কি বড়জোড় একশো। এমনকী মুদি সদাইয়ের দোকানেও ডিমের পাশে শোভা পাচ্ছে পাঁচটা কি ছয়টা আম। কী বিচিত্র সব নাম তৈরি হয়ে আছে আমের। এক আমের নাম হাড়িভাঙা, আম রেখে কে কবে কার হাঁড়ি ভেঙেছে? আরেক জাতের নাম ল্যাংড়া। গবেষণায় যতদূর দেখেছি কোনও আমই হাঁটতে পারে না, শুধু এর ঘাড়েই কেন তবে ল্যাংড়া হবার দোষ? আরেক আমের নাম গোপালভোগ। ব্রজের রাখাল এ-আম খেয়েছিলেন কি না, সে-সংবাদ শ্রীমতী রাধাই দিতে পারবেন। খুবই আকর্ষণীয়, দেখতে রূপসী আমের নাম আম্রপালী। তা হবে নাই বা কেন, আড়াই হাজার বছর আগে বিহারে যার নৃত্যছন্দে লোকালয় দুলেছে, আজ তারই নামের আম যে মহানাম রাগে ভুবন দোলাবে তাতে আশ্চর্য নই। আমের মধ্যে সবচেয়ে কম চলেন ফজলি মহাশয়। আকারে এত বৃহৎ, জাতে এত ভারী, রাশভারী লোক ছাড়া সুরসিকের মধ্যে তাঁর প্রচলন কম। তবে আম দিয়ে যারা দুধভাত খেতে চান তাঁদের জন্য এই আম আদর্শ। আম কেবল মৌসুমি ফলই নয়, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের উপার্জনের উৎসও বটে। ফেসবুকে ঢুকলে প্রায়ই ভুল হয়ে যায়, এ কি ফেসবুক না আমের বাজার! নানাভাবে নানা মাধ্যমে বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে আম এসে পৌঁছোয় ঢাকায়। ঘরে বসে শুধু অনুরোধ জানালেই হল, একেবারে পাতা-টাতা-সহ আপনার ঘরের দোরে এসে পৌঁছোবে বাগান থেকে সংগ্রহ করা আম। এবার অবশ্য এক নতুন বিষয় লক্ষ করছি, শুধু রাজশাহী অঞ্চল থেকেই নয়, দেশের অন্যান্য জায়গায়ও বাণিজ্যিক বাগানে আমের ফলন ও ব্যবসা বেশ জমেছে। বাদ নেই পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ও। এ দেশে কি আমের শেষ আছে? জনাব মাহবুব সিদ্দিকী তো হাজার পৃষ্ঠার বই-ই লিখে ফেললেন আম নিয়ে। ছিলেন পুলিশকর্তা, অবসরের পর তাঁর ধ্যানজ্ঞান হয়ে গেল বরেন্দ্রভূমির নদী, আম, জনপদ। মির্জা গালিব বলতেন আমের মোটে দুটো গুণ থাকা চাই— এক, প্রচুর মিষ্টি হতে হবে, দুই, সংখ্যায় প্রচুর হতে হবে। গালিব মাথায় থাকুন, আর বাঙালির থালায় থাকুক আম।
৩.
সোনালি ড্রাগনের মতো রোদ উঠে গেছে চারপাশে। আজও নিদ্রাহীন রইল সারারাত। বেলা উঠতেই ওষুধ খেয়ে ঘুমাব সিদ্ধান্ত নিয়ে ওষুধ খেলাম এবং না ঘুমিয়ে রাস্তায় বের হয়ে গেলাম। রাস্তার দোষ নেই। আমার মাথায় তখন ‘ব্ল্যাক’ ব্যান্ডের গান ঘুরছে— ‘রোদের ভেতর রোদ, ক্রোধের ভেতর ক্রোধ’। কিন্তু ক্রোধের বদলে আমার পাশে এসে থামল এক রিকশাচালক, অধিকার ও আদেশের সুরে বললেন— ‘ওঠেন।’ সম্ভবত আমার টলায়মান চলাচল দেখে তার মনে হয়েছে, এ-তরী আমি একা বাইতে পারব না। আমি তড়িঘড়ি রিকশায় উঠে পড়লাম। বললাম, ‘নিউমার্কেট যাব।’ কেন নিউমার্কেটের কথা বললাম জানি না। এখান থেকে সোজা সটান নিউমার্কেট যাওয়া যায় বলে, নাকি আমার মাথায় অনেকদিন ধরে নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোকে ফের খুঁড়ে খুঁড়ে দেখার ইচ্ছে হল বলে? রিকশায় চলতে-চলতে জানা গেল রিকশাচালক এক মাস হল রিকশা ধরেছেন। কোভিডের আগে অন্য কাজ করতেন, এখন রিকশা চালান। এ এক ব্যাপার হয়েছে, মফস্সলের কর্মহারা মানুষেরা ঢাকাতে এসে কেন রিকশা চালানো শুরু করছে? রিকশা চালানো খাটুনির বটে, ঝুঁকিও বটে। কিন্তু এত সহজে অন্য কোনও কাজ পাওয়া যাবে না। অন্য কোন কারিগরি কাজ নিতে গেলে হেন প্রশ্ন-তেন প্রশ্ন। রিকশায় সেই ঝামেলা নেই। মালিকের গ্যারেজে যাও, ন্যাশনাল আইডির ফটোকপি জমা দাও। দিনের নির্দিষ্ট জমার চুক্তি জমা দিয়ে রিকশা নিয়ে যাও। নিউমার্কেট নেমে বললাম, ‘কত ভাড়া?’ গড় ভাড়ার চেয়ে চাইলেন কম। আমি ন্যায্য ভাড়া তাঁর হাতে গুঁজে বললাম, ‘আপনি কম চেয়েছেন, ভাড়া জানেন না।’ আসলে নিউমার্কেটে আসার একটা গূঢ় উদ্দেশ্য আছে আমার। অনেকদিন ধরে আউট অফ প্রিন্ট হওয়া দুটো বইয়ের খোঁজে এখানে এসেছি। একটা বই যে এখানে আছে সেটা নিশ্চিত জানি। আরেকটা অনিশ্চিত। নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানগুলো চুপসে গেছে একেবারে। কোথায় সেই জৌলুস? কতগুলো একাডেমিক বইয়ের দোকান আর বিদেশি স্পাই থ্রিলারের পাইরেটেড কপি এই তো সম্বল। নীলক্ষেতও কবেই বুড়িয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় বইয়ের মার্কেট আজিজ মার্কেট এখন কাপড়ের পসরা করে করে ক্লান্ত। বড় করে কয়েকটি বইয়ের দোকানের উত্থান ঘটলেও, পুরনো বইয়ের এই যে সকাতর আমন্ত্রণ সে কি তবে উঠেই গেল? আমি মফসস্ল থেকে ঢাকায় পড়তে এসেছিলাম তার একটা গোপন কারণ ছিল বই কেনা। সে দিন বিগত।
নিউমার্কেট অভিযান সফল হল না। আমার বই অপ্রাপ্যই রয়ে গেল। নিউমার্কেট থেকে বের হয়ে হেঁটে-হেঁটে আমি বাংলা একাডেমির দিকে যাই। আজ সাপ্তাহিক বন্ধ। কিছুকাল আগেই বাংলা একাডেমির সভাপতি বরেণ্য অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার কোভিডে মারা গেছেন। পরবর্তী সভাপতি শামসুজ্জামান খানও চলে গেলেন কোভিডে। তার মাসখানেক পরে একাডেমির সভাপতি হাবিবুল্লাহ সিরাজী ভাইও বিদায় নিলেন এই সেদিন। হাবিবুল্লাহ সিরাজী বাংলা একাডেমির বিরল মহাপরিচালকদের একজন, যিনি অধ্যাপক বা আমলা ছিলেন না, সাহিত্যিক হিসেবে মহাপরিচালক হয়েছিলেন। মহাপরিচালক হিসেবে তাঁর দক্ষতা কেমন ছিল সে-কথা নিয়ে নানা কথা হতে পারে। তবে সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে তাঁকে নিয়ে শোক করেছেন সকলে। পৃথিবীতে এর বড় অভাব এখন। সজ্জন মানুষের। বাংলা একাডেমি পর পর এতগুলো ধাক্কা নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। একাডেমির পাশ দিয়ে নির্মীয়মান উড়াল মেট্রোরেলের হাহাকার, গর্জন। তার নিচে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে বাংলা একাডেমি, বাংলা ভাষা।
রাস্তার ওপারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেগুন গাছের সারি। তাদের দীর্ঘ বিপুল শরীর আর পাতা থেকে ছোট ছোট করে জলকণা ঝরে পড়ছে। যেন বলছে— শান্ত, শান্ত হও। আমাকে? না নিজেকেই? কে জানে!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র