তারপর ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে হঠাৎ একটা গুজব কানে এল। বড় সাংঘাতিক গুজব। একজন হিন্দুস্থানী বন্ধু খবরটা আমাকে দিলে। গুরু দত্ত নাকি আত্মহত্যা করেছে। দিল্লির কোন এক উর্দু কাগজে খবরটা বেরিয়েছে। খবরটা শুনেই আমি প্রথমে চমকে উঠেছিলাম। কিন্তু পরে বিচার করে ভেবে দেখলাম খবরটা হয়তো সত্যি নয়। সত্যি হলে কেউ-না-কেউ আমাকে তা জানাত, অন্তত গুরুর স্ত্রী গীতা কিংবা তার ভাই আত্মা!
আর তখন আমারও প্রায় শেষ অবস্থা। ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ তখন শেষের দিকে। শেষের দিক মানেই ক্লাইমেক্সের দিক। টাকা দিয়ে কেনা-বেচার পরে হিসেব-নিকেশ করা। তখন সেই হিসেব নিয়ে আমিও মহা ব্যস্ত।
হঠাৎ একটা টেলিগ্রাম এল গুরুর কাছ থেকে। ভাবলাম, তাহলে গুরু ভালো আছে! তাহলে গুরু সুস্থ আছে। উত্তর দিলাম— আমি যাচ্ছি—
গুরু পরে টেলিফোন করলে— বোম্বে চলে আসুন, কথা আছে— মনটা আনন্দে নেচে উঠল।
কী কথা কে জানে। শেষ দেখা হয়েছে জানুয়ারি মাসে, আর তখন নভেম্বর মাস। গুরুর কলকাতার ডিস্ট্রিবিউটার যাবার ব্যবস্থা করে দিলে। আবার সেই বোম্বাই। যখন সাস্তাক্রুজে নামলুম তখন রাত নটা। রতন এসেছিল এয়ারপোর্টে। জিজ্ঞেস করলাম— গুরু কেমন আছে?
রতন সেই চিরাচরিত কায়দায় বললে— আচ্ছা হ্যায় জি। তার কাছে কিছু খারাপ থাকতে নেই। সে শুধু ভালো খবরটাই দিতে শিখেছে। সে জানে সুসংবাদ দেওয়াটাই ভদ্রতা। সে বড়-বড় সাহেবের কাছে কাজ করে সহবত শিখে বড় চাপরাশি হয়েছে। গাড়িটা গিয়ে পালি হিলের বাগানের মধ্যে ঢুকল। গাড়ি থেকে নামতেই সামনে গুরু এসে হাসিমুখে দাঁড়াল। কিন্তু আমি হাসতে পারলাম না। আমি ভয় পেয়ে গেলাম গুরুকে দেখে। দেখলাম গুরুর মাথা কামানো। গুরুকে প্রায় চেনাই যায় না। তবে কি যা শুনেছিলাম সব সত্যি? গুরু কি সত্যিই আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছিল?
গুরু বললে— আসুন, রাস্তায় কোনও কষ্ট হয়নি তো? কিন্তু এবার বাড়িতে গীতাকে দেখতে পেলাম না।
যে ঘরে গিয়ে বসলাম সে ঘরটাতেই দেখি গুরুর বিছানা। এর আগেরবারে আমিও ওই ঘরে শুয়েছি। ঠিক সেই ঘরে গুরুর বিছানা পাতা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আমার স্যুটকেস নিয়ে গিয়ে অন্য ঘরে রাখা হল। আরও অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম গুরুর নিজের শোবার ঘরে তার ভাই আত্মার শোবার ব্যবস্থা হয়েছে। সে বিলেত থেকে ইন্ডিয়াতে এসেছিল, তা আগেই শুনেছিলাম। কিন্তু তার নিজের আলাদা ফ্ল্যাট ছিল। সেখানেই সে সপরিবার থাকত। কিন্তু সে-ই বা হঠাৎ এ বাড়িতে এল কেন? আর যদি বা এলই তো এখানে গুরুর ঘরেই বা শুচ্ছে কেন? আর গুরুই বা হঠাৎ মাথার চুল কামিয়ে ফেলেছে কেন?
আমার চোখে যেন সব কিছু ওলটপালট লাগল। অথচ গুরুর মুখ দেখে কিছু বোঝবার উপায় নেই। আগেকার মতো মুখময় হাসি। সেই সিল্কের লুঙ্গি আর সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি। আমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। আত্মাও এল। তখন আত্মার সঙ্গে আমার অতটা ঘনিষ্ঠতা হয়নি বলে খানিক পরে আত্মা ঘর থেকে চলে গেল।
মনে আছে সেটা নভেম্বর মাস। ১৯৬১ সলের নভেম্বর। কলকাতাতে অল্প অল্প হিম পড়লেও বোম্বাইতে তখনও শীত নেই। গুরু তার চিরাচরিত প্রশ্ন করলে, কেমন আছেন?
আমি উত্তরে বললাম, আমাকে ডেকেছেন কেন? গুরু বললে— আপনার ‘মিথুন-লগ্ন’ গল্পটা নিয়ে বাঙলা ছবি করব— বললাম আপনার ‘সাহেব বিবি গোলাম’ কতদূর হল?
— প্রায় শেষ হয়ে আসছে। আর মাস দু-এক হলেই শেষ হয়ে যাবে—
দেখলাম গুরুর বালিশের কাছেই একখানা ‘মিথুন-লগ্ন’ পড়ে আছে। গুরু বলতে লাগল— এ যা বই, এতে হিন্দি ছবি ভালো হবে না। হিন্দি করলে গল্পটা খারাপ হয়ে যাবে। আপনি সিনারিও লিখে দিতে পারবেন?
বুঝলাম খেয়ালি মানুষ, আবার এক নতুন খেয়ালে মেতেছে। কোনও নতুন আইডিয়া মাথাতে এলেই গুরু তা নিয়ে যেমন বরাবর মেতে ওঠে, এও ঠিক তেমনি। তখন তাই নিয়েই দিন-রাত ভাববে, তাই নিয়েই দিন-রাত স্বপ্ন দেখবে। তা বলে বাঙলা ছবি?
বললাম— আপনি বাঙলা ছবি করতে পারবেন?
গুরু বললে— কেন করতে পারব না? হিন্দি ছবি করে ঠিক মন ভরে না। অনেক জিনিস করতে চাই, কিন্তু আমাদের হিন্দি ছবির দর্শকদের দিকে চেয়ে করতে পারি না। অনেক কমপ্রোমাইজ করতে হয়।
গল্প করতে করতে রাত হয়ে গেল। খাওয়া-দাওয়া করাই ছিল। নিজের ঘরে শুতে গেলাম। শুতে গিয়ে ভাবতে লাগলাম, এ কী হল? গীতা বাড়িতে নেই কেন? গুরুই বা মাথা কামিয়ে ফেলেছে কেন? আমি যে ঘরে শুতে গেলাম সেটা নীচে। অনেক রাত পর্যন্ত ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি।
যথারীতি ভোরবেলা উঠে আবার নিজের লেখা নিয়ে বসেছি। চা এল। সঙ্গে এল মাদ্রাজী জলখাবার। এসব কখনও খাইনি আগে এ বাড়িতে।
রতন সেই আগেকার মতোই নির্বাক। তাকে জিজ্ঞেস করলেও কোনও উত্তর পাওয়ার আশা নেই। বললাম— এ-সব কেন?
সে কিছু উত্তর না দিয়ে চলে গেল। দুপুরবেলা ভেতরে গিয়ে লাঞ্চ খেলাম। সঙ্গে আত্মার স্ত্রী নাগম্। তার কাছে শুনলাম সে-ই সবকিছু চালাচ্ছে। গীতার সঙ্গে গুরুর তুমুল ঝগড়া হয়ে গেছে। গীতা সান্তাক্রুজে নিজের মা-এর বাড়ি চলে গেছে। শুরু একা রয়েছে। অগত্যা সংসারের হাল ধরার জন্য আত্মা আর নাগম্ এখানে এসে রয়েছে। শুনে অবাক হয়ে গেলাম। আমি ক’মাস ছিলাম না, তার মধ্যে এতসব কাণ্ড হয়ে গেছে। অথচ গুরুকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। রাত্রে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম গীতার সঙ্গে একবার দেখা হলে ভালো হয়।
পরের দিন সকালে বারান্দায় বসে আছি, দেখি গেট দিয়ে গীতার গাড়িটা ঢুকছে। আমাকে দেখে গীতা সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে আমার ঘরে ঢুকল। নমস্কার বিনিময়ের পর আমি বললাম, আপনার বাড়িতে এসে আপনাকে দেখতে না পেয়ে মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেছিল আমার—
প্রথমে গীতা কিছু বলতে চায়নি। কেমন যেন রহস্যজনক ভাবে আমার দিকে চাইল। যেন কিছু বলতে গিয়ে ও থেমে গেল। আমার বেশি পীড়াপীড়ি করতে সাহস হল না। ওদের পারিবারিক ব্যাপারের মধ্যে আমিই বা থাকি কেন?
কিন্তু আমার গল্প-লেখক মন কিছুতেই শান্ত হতে চায় না। মানুষের মনের জটিল তত্ত্বের দিকটার জট ছাড়াতে না পারলে যে আমার তৃপ্তি হয় না। বহুদিন ধরে এই বাড়িতে আসছি, কিন্তু কোথায় যেন একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করছি। ঠিক আপনার আমার বাড়ির মতো নয়। প্রচুর টাকা, প্রচুর খ্যাতি, প্রচুর অপব্যয় আর সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর অশান্তি। এর মূল কোথায়? এর রহস্যের কেন্দ্রটা কোনখানে? কেন এরা বিচ্ছিন্ন? কেন এরা বিনিদ্র?
বললাম— সত্যি বলুন তো, কেন আপনি এ-বাড়ি ছেড়ে বাপের-বাড়ি চলে গেলেন?
গীতা বললে— আমি আর থাকতে পারলাম না এখানে, এখানে ওর সঙ্গে এক বাড়িতে থাকা আর আমার সম্ভব হল না।
— কেন?
— আমার মা’র শরীর খারাপ। তাঁকে দেখতে হয়—
— সে তো দিনের মধ্যে দশবার গিয়ে দেখে আসতে পারেন। আপনার নিজের গাড়ি, নিজের ড্রাইভার রয়েছে, আর পাঁচ মিনিটের তো রাস্তা—
গীতা সে-কথার উত্তর না দিয়ে চুপ। তারপর বললে— আমি যাই—
বললাম— গুরু ন্যাড়া মাথা হল কেন, বললেন না তো?
গীতা উঠে দাঁড়িয়ে বললে— ওই শরৎচন্দ্রের ‘বৈকুণ্ঠের উইল’ ছবিটা হচ্ছে, ওতে নায়কের পার্টে বাপ মারা যাওয়ার পর একটা দৃশ্য আছে, তাতে ন্যাড়া মাথা হওয়ার দরকার ছিল, তাই—
— কিন্তু সে তো মেক-আপ-এ ন্যাড়া মাথা করলেই চলত?
গীতা বললে তা জানি না। আর তা ছাড়া ওর তো একটু-একটু টাক পড়ছে। তাই স্টুডিওর নাপিত ডেকে কামিয়ে ফেলেছে মাথাটা—
তারপর বললে আমি যাই, আমার ছেলেদের জামা-কাপড় নিতে এসেছি— আপনার খাওয়া দাওয়ার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে, আমি নেই বলে—
বললাম— কষ্ট তো হবেই, আপনি শিগগির-শিগগির চলে আসুন। বাড়িতে বাড়ির গৃহিণী না থাকলে যে মানায় না!
আর কিছু না বলে গীতা চলে গেল। বিকেলবেলার দিকে আত্মার স্ত্রী নাগম্ এল। বললে— শুনলাম, গীতা নাকি এসেছিল? বললাম— হ্যাঁ।
নাগম বললে— দেখুন, গীতার সংসার, গীতার বাড়ি, আমার ঘাড়ে সব চাপিয়ে দিয়ে গীতা সেখানে গিয়ে পড়ে আছে, আমার আর ভালো লাগছে না এখানে থাকতে— কী যে করি—
দেখলাম আমার অবর্তমানে সংসারটা যেন এই ক’মাসের মধ্যেই অন্যরকম হয়ে গেছে। যেন চারদিকে ছন্নছাড়া ছন্নছাড়া ভাব। কেউ যেন কিছু প্রকাশ করতে চায় না। অথচ গুরু কিন্তু ঠিক সেই রকমই আছে। যথারীতি ঠিক সেই রকমই ‘সাহেব বিবি গোলামে’র শুটিং চলছে। বাড়ির ভেতরে না থাকলে এ-সব কিছুই বোঝা যেত না। অথচ আমরা তো বাইরে থেকেই মানুষকে বিচার করি, বাইরের চেহারা, বাইরের ব্যবহার দিয়েই সবাইকে যাচাই করে থাকি।
সেদিন সন্ধেবেলা কাটল গুরুর সঙ্গে গল্প করে। কিছুই টের পেলাম না।
বললে— আজ রাত্রে কি খাবেন? বললাম— আপনাদের বাড়িতে যা রান্না হবে, তাই-ই খাবো—
গুরু বললে— বাড়ির রান্না খেতে পারবেন না আপনি। আমি হোটেল থেকে ভালো খাবার নিয়ে আসছি— গীতা বাড়িতে নেই—
বললাম— কেন মিছিমিছি আবার হ্যাঙ্গামা করবেন?
কিন্তু গুরু শুনলেন না। কোন এক পাঞ্জাবি রেস্টুরেন্ট থেকে প্রচুর মাংস-মাছ আনতে বলে দিলে রতনকে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম এ কি হল? এমন তো হয়নি কখনও। গীতা নেই বলে বাড়ির রান্নাও খারাপ হয়ে গেল?
যা হোক, পরের দিন স্টুডিওয় গিয়েছি। সারাদিন শুটিং-এর পর সন্ধেবেলা দুজনে বসে আছি। স্টুডিওর স্টাফ সবাই চলে গিয়েছে। কেউ নেই। শুধু আমি শুরু আর তার সঙ্গী। রতন যথারীতি ছায়ার মতো তার সাহেবের সেবা করে চলেছে। ক্লান্ত গুরু এক সময়ে বললে, আপনি তো বিমলবাবু এখানকার কারোর সঙ্গেই মেশেন না। কোথাও যান না। গেলে আমার সম্বন্ধে অনেক কথা শুনতে পেতেন—
বললাম— কি কথা?
গুরু বললে— আমার সময়টা ক’মাস ধরে খুব খারাপ চলছে—
— কি রকম?
গুরু বললে— গত সেপ্টেম্বর মাসে আমার বাবা মারা গেলেন, তারপর থেকেই নানা রকম ঝঞ্ঝাট চলছে—
গুরুর মুখ থেকে এ ধরনের কথা এই-ই প্রথম শুনলাম। তারপর বলতে লাগল— বোধহয় শোনেননি, আমি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলুম—
আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। বললাম— সে কি?
গুরু বললে— হ্যাঁ, বড় কষ্ট পেয়েছি, অনেকদিন ভুগেছি। এখন একটু ভালো হয়েছি। কিন্তু সে যে কি কষ্ট, আপনাকে কী বলব…
বলতে বলতে গুরুর মুখের চেহারাটা কেমন বদলে গেল। যে লোক আত্মহত্যা করতে গেছে এবং আত্মহত্যায় সফল না হয়ে শেষ পর্যন্ত বেঁচে আছে, তার মুখ থেকে তারই অভিজ্ঞতার গল্প শুনছি এ যেমন অস্বাভাবিক, তেমনি অবিশ্বাস্য। গুরুর সেই এয়ারকন্ডিশন করা ঘরের মধ্যে সন্ধে সাতটার সময় আমি যেন দিব্যদর্শন করতে লাগলাম। সত্যিই বিচিত্র দিব্যদর্শন। এমন করে এমন ঘটনা আর কখনও কারো মুখ থেকে শুনিনি। আর শুনবোই বা কি করে? গুরু দত্ত তো আর দুজন নেই পৃথিবীতে! বললাম— আপনি আত্মহত্যা করতে গেলেনই বা কেন?
গুরু বললে, সে অনেক কথা—
বললাম— যত কথাই থাক, আত্মহত্যা করবার মতো কি ঘটনা ঘটল? গুরু বলতে লাগল— আমার সময়টা গত সেপ্টেম্বর থেকেই খারাপ যাচ্ছিল। টাকার অভাব নয়, টাকার অভাব আমার বলতে গেলে মিটেই গেছে— আপনি জানেন বোধহয় আমার বাবা মারা গেছেন— বললাম— শুনেছি—
গুরু বললে— তার আগে আমি ইউনিট নিয়ে কলকাতায় গিয়েছিলাম আউটডোর শুটিং করতে। সেইখান থেকেই শুরু হয়েছিল। সে এক বিচিত্র ঘটনা—
সন্ধেবেলা দুজনে মুখোমুখি বসে গল্প করছি। স্টুডিওর লোকজন সবাই বাড়ি চলে গেছে। খানিক পরে আমাদেরও বাড়ি চলে যাবার কথা। হঠাৎ এক সময়ে গুরু নিজের কাহিনী শুরু করল। বড় বিচিত্র বড় মর্মান্তিক সে কাহিনী। মানুষ যে এক বিচিত্র জীব, তা সেদিন টের পেলাম গুরুর কথায়। আমি এসব কিছুই জানতাম না।