মিঠি! এই মিঠি!’— নাথুর ক্যান্টিন থেকে শাওন ডাকছে। মন্দাক্রান্তা একটুও ব্যস্ততা দেখাল না, যেমন আসছিল ঠিক তেমনই ধীরগতিতে লাইব্রেরির দিকে যেতে লাগল।
‘এই মিঠি, শুনতেই পাচ্ছিস না মনে হচ্ছে? আর ইউ ডেফ?’ শাওন এবার উঠে এসে ওর রাস্তা আটকেছে।
‘অনেকবার বলেছি না, অচেনা লোকের সামনে অসভ্যের মতো ডাকনাম ধরে ডাকবি না, সিভিলের ছেলেগুলো রয়েছে ওখানে।’ ক্রুদ্ধ চোখে প্রায় ভস্ম করে দিচ্ছে শাওনকে, ‘তোকে যদি আমি তোর ডাকনামটা ধরে চিৎকার করে ‘বুড়ো, বুড়ো’ বলে ডাকি, খুব খুশি হবি তুই?’
‘রাগলে কিন্তু তোকে ফাটাফাটি দেখায়। মাইরি তুই আমাকে ‘বুড়ো’ বললে হাল্লাট হয়ে যাব। বাই দ্য ওয়ে, বুড়ো নামটা কী করে জানলি রে? শঙ্কু বলেছে নিশ্চয়ই।’
‘আমার জানার সোর্স এত লিমিটেড ভাবলি কী করে? তোর মতো তো সবসময় বেপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ঘুরি না!’, মন্দাক্রান্তা ঝঙ্কার দিচ্ছে। সত্যি শাওনটা সবসময় ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছেলেগুলোর সঙ্গে ঘোরে। ওর নিজের আর্টসের বন্ধুদের সঙ্গে ইদানীং ওকে প্রায় দেখাই যায় না।
‘কী করব বল! ওরা যে সব স্কুলের বন্ধু। ব্যাটারা সব ক’টা জয়েন্টে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেয়ে গেল। আমার শালা কোথাও কিছু হল না। তাই কম্পারেটিভে হ্যাজাতে এলাম। তারপর তোর মন পাওয়ার কত চেষ্টা করলাম। তুইও পাত্তা দিলি না। সেই দুঃখেই তো নাথুদার ক্যান্টিনে এসে বসে থাকি।’ মুখটা যথাসাধ্য করুণ করে শাওন পাশে পাশে হাঁটছে।
মন্দাক্রান্তা জানে ওর একটা কথাও সত্যি নয়। মিন করে বলছেও না। শাওনটা এরকমই। একটু ভাসা-ভাসা উড়ু-উড়ু। জয়েন্টে বসার প্রশ্নই নেই। হায়ার সেকেন্ডারিতেও আর্টস ছিল ওর। তা ছাড়া ছোট থেকেই মেয়ে কম দেখেনি ও কলকাতার নামী কোএডুকেশন স্কুলে পড়ার সূত্রে। মন্দাক্রান্তাকে দেখে ফিদা হয়ে যাবার কোনও প্রশ্নই নেই। তবু শাওনের বলার ধরনে মজা পেল ও— ‘প্লিজ শাওন, তোর এই ডেলিবারেটলি ন্যাকা কথা বলার ম্যানারিজমটা ছাড়। এটা সিক্সটিজে চলত, এখন আর চলে না।’ উত্তরে শাওন আর অপেক্ষা না করে একেবারে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে। পাণিপ্রার্থনার ভঙ্গিতে বলছে— ‘মন্দাক্রান্তা দেবী, সিক্সটিজের ন্যাকা স্টাইলও আপনার পছন্দ হয় না, আবার হাল আমলের মিঠি নামের মধুর সম্ভাষণও আপনার মনে ধরে না, তবে আপনার কী অভিরুচি অনুগ্রহ করে বলিবেন কি?’ সাধু-চলিত মিশিয়ে বলে যাচ্ছে শাওন।
এখনও ক্যাম্পাসে বেশি ভিড় নেই। মাত্র কয়েকজন পথচারী ইতিউতি যাচ্ছে। তবু তার মধ্যেই দু-একজন বেশ কৌতূহল নিয়ে শাওন আর মন্দাক্রান্তার দিকে তাকাচ্ছে। রীতিমতো অপ্রস্তুত হয়ে গেছে মন্দাক্রান্তা।
‘কী হচ্ছে কি শাওন? উঠে পড় বলছি এই মুহূর্তে!’ শাওনের কব্জির কাছটা ধরে প্রায় জোর করে ওকে দাঁড়াতে বাধ্য করছে। সত্যি এত এমব্যারাস করতে পারে শাওনটা! মনটা হঠাৎ কেমন যেন তেতো হয়ে গেছে। উল্টোদিক থেকে সুজাত, অর্ণব আর তৃণা আসছে। ওরা দেখতে পেয়েছে কি? সম্ভবত না। কারণ তাহলে তৃণা কিছু একটা মন্তব্য না করে ছাড়ত না। ওরা এসে হাসিমুখে ঘোষণা করল— ‘আমরা আজ এন.সি-র ক্লাস কেটে কফি হাউসে যাচ্ছি। এনিবডি ওয়ান্টস টু গো?’ মন্দাক্রান্তা মাথা নাড়ছে। ওর এখন শাওনের সঙ্গে কফি হাউসে যাবার একটুও ইচ্ছে নেই।
‘যাই বলিস, একই ইউনিভার্সিটির প্রফেসরের মেয়ে হওয়ার সুবিধের চেয়ে অসুবিধেই বেশি।’ অর্ণব আলগা ভাবে বলল।
‘মানে?’ মন্দাক্রান্তার জিজ্ঞাসা।
‘মানে খুব সিম্পল। তোর বাবা দেখে ফেলতে পারেন বলে তুই কফি হাউস অবধি যেতে চাস না। তোর কোনও ফ্রিডম অব মুভমেন্ট নেই।’
‘মোটেই না। আমার বাবা মোটেই ওরকম মেয়ের উপর নজরদারি করা টাইপ নন। আমি নিজে যেতে চাই না বলেই যাচ্ছিলাম না। কিন্তু এখন বললি যখন, তখন যাব।’ ওরা সবাই আবার ক্যাম্পাসের মধ্যে দিয়ে এইট বি-র দিকে হাঁটছে।
‘সত্যি মিঠি, আসলে কিন্তু তোর স্বাধীনতা দেখে আমার হিংসেই হয়। আঙ্কল নিজের জগতে থাকেন, আন্টিও কাজে বেরোন, প্লাস শি ইজ নট অ্যাট অল অ্যান ইন্টারফিয়ারিং টাইপ, তোদের একজন বন্ধুর মতো, না রে? বাড়িতে সবসময় মা যখন টিকটিক করে পেছনে লাগে, ন্যাগিং ভাবে একই কথা বলে যায়, দেন আই অফন থিংক অব ইয়োর মাম। হাউ লাকি ইউ আর!’ তৃণা হাউহাউ করে একাই কথা বলে যাচ্ছে। মন্দাক্রান্তা কিছু বলল না। ও জানে না ওর ফ্যামিলি সম্পর্কে তৃণা কতটুকু জানে। প্রায় ইউনিভার্সিটির উল্টোদিকেই বাড়ি। মন্দাক্রান্তার বন্ধুরা সময়ে-অসময়ে প্রায়ই বাড়িতে হানা দেয়। মামণিকে দেখে প্রত্যেকের চোখে একটা বিস্ময় ফুটে ওঠে, তা ও জানে। মামণির প্রায় চল্লিশ। মন্দাক্রান্তার আঠারো বসন্ত পার হয়েছে। মামণিকে দেখে চল্লিশ বলে কেউ কল্পনা করতে পারবে না। বড়জোর তেত্রিশ-চৌত্রিশ মনে হয়। সেজন্যই বন্ধুদের মুখে প্রায়ই ঘুরেফিরে আসে এসব কথা। মামণি ওদের সঙ্গে সহজ বন্ধুর মতো মেশে বলে বন্ধুরাও একটু লাই পায়। মন্দাক্রান্তার বন্ধুদের সঙ্গে এরকমভাবে মিশে মামণি কি মনে করে ওরা মামণিরও বন্ধু হবে? মামণির উচিত আরও সংযত হয়ে চলা। বিশেষত মামণির নিজের জীবনেও যখন রসালো গল্প আছে। এমনিতে হলে এত ভয় পেত না মন্দাক্রান্তা। কিন্তু বাবাও যেহেতু এই ইউনিভার্সিটিরই অধ্যাপক, সেইজন্যই ভয়। এখনও পুরনোদের মুখে অধ্যাপক প্রভাত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর চেয়ে ষোলো বছরের ছোট ছাত্রী সুচেতনা দত্ত-র প্রেমকাহিনি ঘোরে— মন্দাক্রান্তা আঁচ পেয়েছে। কয়েক মাস আগে প্রথম যখন ভর্তি হয়ে ক্লাস করতে শুরু করেছে তখন ওর বাবার বন্ধু ও সহকর্মী অনাদিজেঠু আরেক প্রবীণ অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন— ‘এই হচ্ছে মন্দাক্রান্তা। আমরা মিঠি বলি। ফিলসফির প্রভাতের মেয়ে।’ সেই অধ্যাপক যেন একটু বেশিই উচ্ছ্বাস দেখিয়েছিলেন, অন্তত মন্দাক্রান্তার তাই মনে হয়েছিল। ‘আরে প্রভাত মানে আমাদের রোমান্টিক! কিছু মনে কোরো না মা, কিছুদিন আগেও তোমার বাবা-মার প্রেম তো আমাদের গল্পের বিষয় ছিল। এই ক্যাম্পাসে প্রেম তো অনেকেই করে স্টুডেন্টরা, কিন্তু প্রভাত যাকে বলে প্রেমের হদ্দমুদ্দ দেখিয়ে দিয়েছিল। কেমন আছে তোমার মা? অনেকদিন দেখা হয়নি সুচেতনার সঙ্গে। ওকে বোলো আমার কথা। তোমরা তো কাছাকাছিই থাকো বোধহয়?’
‘মামণি ভাল আছেন। বলব আপনার কথা।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে মন্দাক্রান্তা সরে গেছিল। গা জ্বালানো কথা সব। অনাদিজেঠু পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন— ‘এ লোকটা চিরকাল একই রকম রয়ে গেল। কাকে কী বলা যায়, কী বলা যায় না সে-বিষয়ে জ্ঞানগম্যি হল না আর।’ তারপর থেকে সাবধান হয়ে গেছে। ইউনিভার্সিটিতে প্রভাত চ্যাটার্জির মেয়ে হওয়ার সুবিধের থেকে অসুবিধেই বেশি, সে-কথা ও এখন হাড়ে হাড়ে জানে। সবসময় সতর্ক থাকে ও। প্রফেসাররা তো বটেই, ওর বন্ধুরাও কে কতদূর জানে সে-সম্পর্কে ওর ধারণা নেই কোনও। আচ্ছা, এই যে আলোচনাটা হঠাৎ কিছুর মধ্যে কিছু নেই, মামণির দিকে ঘুরে গেল— এর পিছনে কি একটা ষড়যন্ত্র আছে? এরা কি ইচ্ছে করে ওর প্রতিক্রিয়া দেখার চেষ্টা করছে?
সাবধান, সাবধান— অদৃশ্য অ্যান্টেনাগুলো শুঁড় নাড়ছে চারপাশ থেকে। সুজাতা কী বলছে শুনতে কান খাড়া করছে ও।
‘… শি ইজ আ রিমার্কেবল লেডি। এত ডিগনিফায়েড, পয়েজড অথচ এত ফ্রেন্ডলি। কোয়াইট আনইউজুয়াল। সত্যি মিঠি, আমি তো সেদিন ঠিক করে ফেলেছি— নেক্সট দিন তোর বাড়ি গেলে আর আন্টি বলে ডাকব না তোর মামণিকে। সুচেতনাদি বলব।’ সুজাতা বেশ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার মতো ভঙ্গিতে বলল। কথা বলতে বলতেই দোতলায় উঠে চেয়ার টেনে বসেছে ওরা। ভিতরে কী একটা যেন গুড়গুড় করছে। অদ্ভুত একটা মিশ্র অনুভূতি। খানিকটা রাগ, খানিক ঈর্ষা আর অনেকটা দুঃখ নাকি অভিমানের চাপা গুমোট বিজগুড়ি কাটছে ভিতরে।
‘দ্যাটস দ্য ওয়ার্ড। দিদি। আই এগ্রি। জানিস মিঠি, সেদিন জ্যোতি তোদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে দোলনকে জিজ্ঞেস করছিল— আচ্ছা আন্টির কি চাইল্ড ম্যারেজ হয়েছিল? সি মাস্ট হ্যাভ বিন সেভেনটিন অর এইটটিন হোয়েন মিঠি ওয়াজ বর্ন।’ শাওন খুব একটা মজার কথা বলেছে এমনভাবে দুলে দুলে হাসছে। মন্দাক্রান্তার ভিতরে সেই নাম-না-জানা অদ্ভুত অনুভূতিটা ভুসভুস করে ছড়াচ্ছে। হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু না, কিছুতেই হার মানবে না মন্দাক্রান্তা। কিছুতেই মাথা নোয়াবে না বাইরে থেকে আসা এই চাপের কাছে। দাঁতে দাঁতে চিপে নিজেকে সংযত করছে মন্দাক্রান্তা, মনটাকে বশে আনছে কোনও রকমে। তারপর নিজেকেও অবাক করে ভীষণ স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘কী যে হয়েছে তোদের! বড্ড বাজে বকছিস তখন থেকে। এই যে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোদের সঙ্গে এলাম, কই, কফি কই? শুধু কোল্ড কফি নয়, পকোড়াও খাব কিন্তু।’
চারটে নাগাদ বাড়ির দিকে হাঁটা দিল মন্দাক্রান্তা। আজকে দিনটা অসম্ভব ভারী কেটেছে। প্রথম দিকে শাওনের মেলোড্রামা, মামণির সৌন্দর্য ও বয়েস নিয়ে চর্বিতচর্বণ— সর্বোপরি তরুণ দেখেছে— চিকু নকি একা একা হেঁটে নিজের মনেই হাসতে হাসতে রিজেন্ট এস্টেটের ভিতর দিয়ে কোথায় যাচ্ছিল। তরুণ গাড়ি থেকে ডেকেছে, ও উত্তর দেয়নি। ‘আমি এতটা ভুল করব? চিকু ভেবে অন্য কাউকে ডাকব?’— ‘চিকু বলে যখন চিনতেই পারলি, তখন গাড়িতে তুলে নিলি না কেন? বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে উল্টোদিকে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে আসতিস।’ বন্ধুদের সমবেত বকুনিতে একটুও দমেনি তরুণ— ‘খেপেছিস! দিনকাল ভাল নয়, যদি ওটা চিকু না হয়ে অন্য কেউ হয়, তবে কিডন্যাপার বলে লোকজন পেটাবে আমাকে। বাবারও অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছিল, আর সবচেয়ে বড় কথা চিকু যথেষ্ট বড় হয়েছে। লুকিয়ে যদি ধর ওখানে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে যায় তাহলে আমি বলবার কে? স্পেশালি সে মেয়ে যখন আমাকে টোটালি ইগনোর দিচ্ছে, তখন আমি জাস্ট ওর দিদির বন্ধু বলে জোরজার করে গাড়িতে ওঠাতে যাবই বা কেন?’ অকাট্য যুক্তি।
‘খুব বেশি বকাবকি করিস না মিঠি— যাই করুক না কেন।’ তৃণা সতর্ক করে দেবার ভঙ্গিতে বলেছিল।
কিন্তু মন্দাক্রান্তা আজ মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে একটা হেস্তনেস্ত ও করবেই। চিকু কী ভেবেছে কী? এমনিতেই মামণির ব্যাপারে সবসময়ই সতর্ক-সন্ত্রস্ত হয়ে চলতে হয় মন্দাক্রান্তাকে। তার উপর চিকুর জন্য বন্ধুদের কাছে বেশ অপমানিত লাগছে আজ। স্বাভাবিক সৌজন্যবোধও কি হারিয়ে গেছে চিকুর? তরুণ ডেকেছে, অথচ উত্তরটুকু দেবার প্রয়োজনও অনুভব করেনি ও? দিন-দিন বড্ড বাড় বাড়ছে চিকুর। ওর ভিতরে কেমন একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব এসেছে। শাসন করারও কেউ নেই। ভালবাসার টানও কাজ করে না বাড়িতে। বাবা তো চিরকালই ছাড়া-ছাড়া। বই মুখে দিয়েই বসে থাকেন সবসময়। মামণির ব্যাপারে বাবার টান বুঝতে পারে না মন্দাক্রান্তা। কিন্তু তাদের দু’বোনের ব্যাপারে যে বাবা একরকম উদাসীন, সেই নিষ্ঠুর সত্যটুকু দিনের পর দিন আরও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে মন্দাক্রান্তার কাছে। চিকুটা নিজের ভাল না বুঝে তিলে তিলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আসলে ব্যাধিটা চিকুর একার নয়, তাদের সংসারের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে মারণব্যাধির মতো বাসা বেঁধেছে। গোড়ার থেকে মাটি আলগা হয়ে ঝুরো ঝুরো। এ-ভাঙন রোধ করার সাধ্য নেই মন্দাক্রান্তার। পালাতে হবে। যে কোনও ভাবে হোক পালাতে হবে ওকে। তার আগে চিকুর সঙ্গে কথা বলা দরকার। তার চেয়েও আগে কথা বলা দরকার বাবা কিংবা মামণির সঙ্গে।
বাড়ি গিয়ে চাবি ঘুরিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে মিঠি দেখল চিকু এখনও ফেরেনি। সমস্ত বাড়ি শুনশান। বাবার আজ বিভাগীয় সেমিনার। আসতে দেরি হবে। মামণি ফেরার সময় বলে যায়নি। কয়েকদিন প্রচণ্ড গরমের পর হঠাৎ মেঘলা হয়ে এসেছে। গুমোট বিকেল গড়িয়ে চলেছে ঝড়ভাঙা সন্ধ্যার দিকে। সব দরজা-জানলা খুলে দিল মিঠি। আসুক, ঝড় আসুক। তছনছ করে দিয়ে যাক সব কিছু। টেপরেকর্ডারে গান চালিয়েছে মিঠি, ‘ওরে ঝড় নেমে আয়, আয় রে আমার শুকনো পাতার ডালে।’ হঠাৎ হাওয়া ছেড়েছে একটা। মিঠি বা চিকু গান গাইতে পারে না। মামণির গলা খুব সুন্দর। মামণির সব কিছুই সুন্দর। চেহারা, গানের গলা, কথা বলার ভঙ্গি। মামণি জিতে গেছে। মিঠি হেরে গেছে। মিঠি হেরো। পুকুরের দিকে মুখ করা বারান্দা। ওপাশের রাস্তার একটা অংশও দিব্যি দেখা যায়। কেউ আসছে না, কেউ আসছে না মিঠির কাছে। শুধু ঝড় আসছে। আসুক। রাস্তার ধারে গুলমোহর গাছটায় প্রথম ফুল এসেছে। এলোমেলো হাওয়ায় বেঁকেচুরে যাচ্ছে গাছটা, দুলছে ঝুপসি পাতাগুলো। কালো বিষণ্ণ ঝড়ের মেঘ ভেঙে পড়ছে কালবৈশাখী হয়ে। মিঠি নড়ছে না। তীক্ষ্ণ, খরখরে চোখে সোজা তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। দু’একবার বিদ্যুৎ-চমক। কোথায় যেন বাজ পড়ল— কড়-কড়-কড়াৎ। হাওয়া ছুটল দুরন্ত, বেসামাল, আর বছরের প্রথম কালবৈশাখী ঝরে পড়ল বড়-বড় জলের ফোঁটার সঙ্গে। বড়, আরও বড় হচ্ছে জলের ফোঁটারা, ঝরে পড়ছে গুলমোহর গাছে, নেমে আসছে মিঠির চোখের পাতায়, সোঁদা মাটির বুনো গন্ধে ভরে উঠছে দিগ্বিদিক। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমূল ভিজতে ভিজতে মিঠি দেখল এইট বি-র দিক থেকে একটা ট্যাক্সি বাঁক নিয়ে ঢুকছে ওদের পাড়ায়। ঠিক গুলমোহর গাছের তলায় এসে থামছে ট্যাক্সিটা। আর একটু পরেই প্রবল বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে ট্যাক্সি থেকে নেমে আসছে চিকু আর চশমা পরা দারুণ চোখা চেহারার একটা ছেলে, নাকি লোক ? দরজায় বেলের শব্দ ৷
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র