পাহাড় উত্তরদিকেই মুখ করে থাকে,’ ও বলল। আমার ভাইপো পাহাড় আঁকতে শুরু করেছে। কয়েক মাস আগেও পাহাড়ের ব্যাপারে ওর কোনও আগ্রহই ছিল না। যখন ছোট ছিল, আমরা হিমালয়ের দিকে আঙুল তুলে ওকে বাংলা শব্দটা বলতাম: ‘পাহাড়’। ওর জগৎটা তখন ছিল কয়েকটা বাছা-বাছা বিশেষ্যের ক্ষুদ্র মিছিল। অচেনা শব্দগুলো সেই সারির পিছনের দিকে ঠেলে দেওয়া হত। ও সবসময়েই শব্দটা ভুল উচ্চারণ করত: ‘পাওয়ার’ (‘power’)। ‘পাওয়ার’ কী, তা অবশ্য জানত না। খানিকটা প্রেক্ষাপটে পর্বতমালার মতোই, ‘পাহাড়’ শব্দটাও যেন নিজেকে ঠেলে ওর সচেতনতার পিছনের সারিতে পৌঁছে গিয়েছিল। পাহাড় হয়ে উঠেছিল ওর মা-বাবা এবং দাদু-দিদার সমার্থক— ওর ছোট্ট মনে তাঁদের জন্য আলাদা করে মনোযোগ দেওয়ার সময় হয়ে ওঠেনি।
এই অদ্ভুত সময়ে, যখন সে গোটা জীবজগৎটাকে পড়াশুনোর বইয়ের মাধ্যমে খুঁজে বেড়াচ্ছে— বিজ্ঞানের বইয়ে দেখা হলুদ সর্ষেফুল স্বচক্ষে দেখার জন্য তার সর্ষে বীজ পুঁতে গাছ হওয়া দেখা চাই— পাহাড়ের ক্ষেত্রে যেন চলনটা একেবারেই বিপরীতমুখী। পাহাড়কে সে নিজের আঁকার খাতায় ধরে ফেলছে।
লাইনের উপর লাইন হেলিয়ে, পৃথিবীর চেয়ে অনেক কম খাটুনিতে পাহাড় আঁকার সময় সে যেন হিমালয়কে ঘরে ডেকে আনে, আঁকার খাতায় ডেকে আনে। আমার মনে হয়, আমরা যারা পাহাড়ের পাদদেশে বাস করি, গত এক বছরে যেন পাহাড় তাদের জীবন থেকে দূরে সরে গিয়েছে, কোনও দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের মতো। কিন্তু আমার ভাইপোর আঁকা দেখে তা মনে হয় না, যেখানে পাহাড়ই বিষয়; আমার ছোটবেলার আঁকিবুঁকির মতো পটভূমিকা নয়। ভাবতে থাকি, কী বদলেছে?
আমি একদিন বইটা ওকে দেখাই— যে বইয়ে পায়ে হেঁটে পাহাড়ে ওঠার কথা লেখা এবং আঁকা রয়েছে। লেখক-চিত্রকরের বর্ণিত পাহাড়ের আঁকে-বাঁকে জায়গাগুলো আমাদের চেনা; আমরা গাড়ি থেকে দেখি। কিছু বিরতি যেন প্রয়োজনের চেয়ে অভ্যাসবশত; নিজের বাড়ির সামনে থমকে দাঁড়ানোর মতো, একটা অদৃশ্য আঠায় বাইসাইকেলের ব্রেক কষে ফেলার মতো। আমার খুব পছন্দের এই শিল্পীর অন্য বইও আমি এই ছোট্ট ছেলেটাকে পড়ে শোনানোর চেষ্টা করে দেখেছি— যেমন ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’— কিন্তু সেই বই তার মনে ধরেনি।
‘হাওয়াবদল ও অন্যান্য রচনা’। ‘শব্দচিত্র’, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া শান্ত, গৌণ নাম। শব্দটাকে যোজক চিহ্ন দিয়ে আলাদা করেননি, যেন তাঁর মনে এই দুই শব্দের স্বকীয়, পৃথক অস্তিত্ব ছিল না। এই চিন্তা থেকেই উঠে এসেছে বইয়ের নান্দনিকতা এবং গঠন— কথা এবং চিত্রের কোনও শ্লাঘা, কোনও শ্রেণীগত পার্থক্য ব্যাতিরেকে স্বচ্ছন্দ সহাবস্থান। বইয়ের প্রচ্ছদে পর্বতমালার ড্রয়িং, যার নিচে পাদদেশ-সম বইয়ের নাম এবং গৌণ নাম, এবং এর পরে শুধু বিশেষ্যে ভরা ছোট একটা অংশ। বিশেষ্যের কথা বলছি, কেননা এটা আমার ভাইপোর পৃথিবীকে বিশেষ্যে চিনে নিতে চাওয়ার অভ্যাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। অবনীন্দ্রনাথ আমাদের কলকাতা থেকে দার্জিলিং-এর পাহাড়ে নিয়ে চলেন, আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে:
‘শিয়ালদহ। ইবিএসআর। শহরতলি। পদ্মা। জল্পাইগুড়ি। শিলিগুড়ি। সুখনা। সুখনা’র জঙ্গল। বনপথ। তিস্তা। পাহাড়তলি। পর্বত। রেশ। ঝর্না। দেওয়ালি’।
লিপিবদ্ধকরণের এই নাম। ‘পর্বত’ এবং ‘দেওয়ালি’-র অংশ সবচেয়ে দীর্ঘ, এবং গদ্যে লেখা। অবনীন্দ্রনাথের অননুকরণীয় গদ্য, যার শিরায়-শিরায় ধ্বনিবৃত্তি, যার বক্তব্যের অত্যাশ্চার্য তেজ এখনও পাঠককে মুগ্ধ করে।
কবিতা আসে দ্বিতীয় পর্যায়, এবং হঠাৎ; পাহাড়ের বুক চিরে বিদ্যুতবেগে ছুটে চলা ট্রেনের জানালায় ক্রমাগত বদলে যাওয়া দৃশ্যের মতো। অবনীন্দ্রনাথ এই কবিতার নাম রেখেছিলেন ‘গদ্যছন্দ’— এঁকেছিলেন দুটো ছিপছিপে কোনিফার গাছ, যার মাথায় ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘমালা। এই ছবি আমার ভাইপোকে দেখাতে গিয়ে, শিলিগুড়ির প্রথম গ্রীষ্মের তাপেও, আমি শীত বোধ করে শিউরে উঠি।
প্রথম কবিতার নাম ‘পাহাড়িয়া’, এবং এর সঙ্গীত উঠে আসে অবনীন্দ্রনাথের বাংলা ভাষার অসাধারণ ব্যবহার থেকে। এর ছন্দ, বিরতি, এই সব কিছু নিয়েই পাঠক যেন পাহাড়ে চড়ার বোধ উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি যে পর্যটক, পাহাড়ে উঠতে গেলে বার-বার দম নিতে দাঁড়াতে হয়েছে, সে বোধ আসে যথেষ্ট সংখ্যক বিরতির ব্যবহারে (অবনীন্দ্রনাথের অকপট স্বীকারোক্তি, তিনি ‘পরদেশী’)। নিশ্বাসের নিরিখে বাকি পর্বতমালার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ের পার্থক্য বর্ণনা করেছেন অবনীন্দ্রনাথ: ‘উত্তর-পাহাড়ের-নিশ্বাস-মন্ত্র’। ‘ঝর্না’, যাকে অবনীন্দ্রনাথ ‘আলোর মালা’ রূপে বর্ণনা করেছেন, এবং ‘ঝাউবন’-এর পরবর্তী অংশে কথায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে লেখা রয়ে যায় অসমাপ্ত, এবং ফুটে ওঠে এই ছবি:
কথা অপর্যাপ্ত, তাই ছবিতে পাঠককে আলো (‘ঘরের কোণে কাঁচের বুদবুদে ধরা নিভন্ত বাতি’) এবং তার অন্তর্ধান দেখাতে হয়। ‘জ’-এর শব্দ সারা কবিতা জুড়ে: ঝর্না, ঝাউবন, জঙ্গল। আমার ভাইপোকে এ-কথা লক্ষ করাতেই সে মনে করিয়ে দেয় কাছের এক জঙ্গল-ভ্রমণের কথা এবং সেখানে একটানা ঝিঁঝিঁপোকার ডাক। অবনীন্দ্রনাথ কি এই শব্দ অনুকরণ করতে চেয়েছিলেন?
বইয়ের পাতা ওলটাতে-ওলটাতে, শুধুই ছবি দেখে, এবং কথা পড়ে নয় (আমার ভাইপোর অস্থিরতা কথার জন্য অপেক্ষা করতে চায় না)— গাছের ডাল, মেঘ, ঢাল বেয়ে নামা নালার পাশে পাহাড়ি মহিলাদের দল— আমার ওকে বলতে ইচ্ছা করল, এভাবেও উত্তরবঙ্গকে ‘লেখা’ যায়। এমন একটা বইয়ে, যার রীতি অনির্ণীত, যা কবিতা এবং গদ্য, কথা ও ছবির মাঝে অনায়াসে, অবিরত বয়ে যেতে পারে, যেখানে পাঠক ইচ্ছামত চরে বেড়াতে পারেন, বিরাম নিতে পারেন, বা পড়তে পারেন— ঠিক যেমন ভাবে পাহাড় হেঁটে তিনডারিয়ায় পৌঁছে যাওয়া যায়।