সে প্রায় পুরাকালের কথা! কলকাতা কফি হাউস জুড়ে উপচে পড়ছে একজনই কবির কবিতার লাইন। কবির নাম শঙ্খ ঘোষ। বইটির নাম ‘দিনগুলি রাতগুলি’, যা বই হয়ে প্রকাশ হওয়ার আগেই গুচ্ছ হিসেবে বেরিয়ে গেছে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় আর শঙ্খ ঘোষের অমোঘ কিছু লাইন অন্যান্য অনেক কবির অনেক কবিতার লাইনকে কনুই দিয়ে ঠেলে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে আগে আগে। ‘আমার জন্য একটুখানি কবর খোঁড়ো সর্বসহা/ লজ্জা লুকোই কাঁচা মাটির তলে—/ গোপন রক্ত যা কিছুটুক আছে আমার শরীরে, তার/ সবটুকুতেই শস্য যেন ফলে।’ এমন নিরীহ অথচ আশ্চর্য শক্তিময়, দ্যুতিময় লাইন, একের পর এক কবিতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এই বইয়ের সর্বাঙ্গে। এর বেশ কিছুকাল পরে ইঁদুরের গর্ত থেকে এক-আধটা কবিতা ও নিজস্ব কবিতার বই নিয়ে আমি, ভাস্কর (চক্রবর্তী) ও আরও কয়েকজন বেরিয়ে পড়েছি কলকাতার রাস্তায়। এইরকমই একদিন গর্ত থেকে সদ্য বড়রাস্তায়-পড়া আমি দেখি, টগবগিয়ে ছুটে আসছে অতি সুন্দর একটি ঘোড়ার গাড়ি। চোখ কচলে ভাল করে তাকাই। দেখি ঘোড়ার গাড়ি নয়, আসলে একটা রিক্সা। চাপা খেতে খেতে প্রায় বেঁচে যাই!
— কে, বুদ্ধদেব না?
— হ্যাঁ, বুদ্ধদেব।
— কোথায় যাচ্ছেন?
— অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-র বাড়ি।
— আরে! আমিও তো যাচ্ছি, উঠে আসুন।
মনে আছে সেদিন প্রায় রাত এগারোটা অবধি আমরা আড্ডা মেরেছিলাম। তখন ওঁরা সুন্দরবনের বাঘের পাশাপাশি ঘুরে বেড়ানো কবি, আর আমি? ‘শ্যাম লাহিড়ী বনগ্রামের/ কী যেন হয় গঙ্গারামের!’ শঙ্খ ঘোষকে বাসে তুলে দিয়ে, মগ্ন আমি একা-একা হাঁটতে-হাঁটতে এগিয়ে গিয়েছিলাম শেষ বাসের দিকে। জীবনে কত হাজার-হাজার মনে রাখার মতো আড্ডা যে দিয়েছি তার ঠিকানা নেই! ক্লিন্ট ইস্টহুড থেকে কুরোসাওয়া, তবু সেইদিনের আড্ডা মনে আছে বিশেষ করে তার কারণ সে-আড্ডা আমাকে আজও মনে করিয়ে দেয় যে, সত্যিই সত্যি কথা বলা ছাড়া কোনও কাজ নেই কবিতার, কোনও কাজ নেই সিনেমার! আমি অনেক চালাক কবি, ধূর্ত কবি, হিংসুটে কবি, পিঁপড়ে কবি, একমনে নাকখোঁটা কবি দেখেছি, কিন্তু শঙ্খ ঘোষ ছিলেন এমন আশ্চর্য কবি যাকে যে কেউ এসে আঘাত করে চলে যেতে পারে, যে কেউ বাড়ি ঢুকে চারটি অখাদ্য কবিতা শুনিয়ে, মিষ্টি খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওঁরই গুষ্টি উদ্ধার করতে পারে! শঙ্খ ঘোষ বাংলা কবিতার রাজ্যে সবচেয়ে বর্মহীন কবি। সবচেয়ে নিভৃতচারী। আমাদের সময়ের ও তারও পরের সদ্য কবিদের আশ্রয়স্থল ছিল তাঁর বাড়ি। ভাস্কর, ভাস্কর চক্রবর্তী, মাঝে মাঝেই খালাসিটোলা থেকে চলে যেত শঙ্খদার বাড়ি, বিরক্ত করবে না বলে কড়া না নেড়ে বাড়ির দোরগোড়ায় ঘুমিয়ে থাকত। পরদিন ভোরে শঙ্খদা দরজা খুলে দেখতেন ভাস্করকে, তারপর ঘরে নিয়ে গিয়ে চা-জলখাবার খাইয়ে তার দুঃখসুখের গল্প শুনে বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন।
তখন আমি যতীন দাস রোড-এ থাকি আর শঙ্খ ঘোষ তো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার নামী অধ্যাপক। হঠাৎ সন্ধেবেবেলায় ফোন— ‘বুদ্ধদেব, একটা ক্লাস নেবেন আমাদের বাংলা ডিপার্টমেন্টে? বিষয়: সাহিত্য ও সিনেমা।’ বিষয় নিয়ে আমার আর শঙ্খদার কয়েকদিন আলোচনা হল। তারপর ক্লাসের দিন ঠিক হল। আমি ঠিক করলাম আইজেনস্টাইন-এর ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ দেখাতেই হবে। গোর্কি সদনের গৌতম ঘোষকে বললাম। এক কথায় রাজি হয়ে গেল। ঠিক হল ট্যক্সি নিয়ে গোর্কি সদন থেকে ফিল্মের রিল তুলে শঙ্খদাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাদবপুর যাব। লেকচারের দিন প্ল্যানমাফিক গৌতমের কাছ থেকে সিনেমার রিলগুলো তুলে, শঙ্খদার বাড়িতে পৌঁছে ট্যাক্সিকে পাঁচ মিনিট দাঁড়াতে বলে শঙ্খদার কাছে গেলাম। পাঁচ মিনিট বোধহয় পনেরো মিনিট হয়েছিল। শঙ্খদার বাড়ি থেকে কেউ চা না খেয়ে বেরোতে পারে না। দুজনে গলির মুখে ফিরে এসে দেখি ট্যাক্সি গায়েব, ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ সমেত। দুজনেই চোখে সর্ষেফুল দেখছি! কেন জানি না, আমাদের মনে হল সর্দারজী ট্যাক্সিওয়ালা এটা করবে না, নিশ্চয় ফিরে আসবে। তাছাড়া ভাড়াও তো নেয়নি, আর ফিল্ম বেচে ভাড়া তোলা? না, সে কী করে হতে পারে! এক ঘণ্টা হয়ে গেল আমরা অপেক্ষা করছি, ট্যাক্সি এল না। দু’ঘণ্টা পর শঙ্খদা বললেন, ‘আজ তো হল না। আমাকে তো ইউনিভার্সিটি গিয়ে জানাতে হবে, আমি জানিয়ে আসছি। আপনি এখানেই ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করুন। কালকে ক্লাসটা নিতে পারবেন?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। কালকের মধ্যে নিশ্চয় সর্দারজী ফিরে আসবেন।’ শঙ্খদা অন্য ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর শঙ্খদা আর আমার ভরসা অটুট রেখে কালো-হলুদ ট্যাক্সি উড়িয়ে সর্দারজী এলেন। বললেন, ‘আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব! কত সওয়ারি আসছে। একটা ট্রিপ করে এলাম তাই। আপনাদের সামান আছে সঙ্গে, লৌটকে তো আনা হি থা।’
ক্লাস একদিন পিছিয়ে গেল বটে, কিন্তু ভিড় হল দ্বিগুণ। অন্য ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েরা এসে যোগ দিল। কয়েকজন লেকচারারও। সিনেমা করার জন্য কলেজে পড়ানোর চাকরি ছেড়ে দিয়েছি তার কিছু বছর আগে, এতদিন পর আবার ক্লাসরুম, ছাত্রছাত্রীদের জ্বলজ্বলে মুখ— আমারও খুব ভাল লেগেছিল! প্রথম দশ মিনিট সময় নিলেন শঙ্খদা। আমি কে, আমার সিনেমা কী, আমার কবিতা কী— এ নিয়ে বললেন। সেই সময় শঙ্খ ঘোষের কবিতায় এমন বেশ কিছু ইমেজ চলে আসত যা প্রায় সিনেমার মতো, প্রায় শট-ডিভিশন করে লেখা। যেমন, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’র প্রথম চারটি লাইন— ‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি/ তোমার জন্য গলির কোণে/ ভাবি আমার মুখ দেখাব/ মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ কিংবা ‘রাঙামামিমার গৃহত্যাগ’; চারটি লাইন একটি নিখুঁত সিন, যা থেকে একটা গোটা সিনেমা তৈরি হয়ে যায়— ‘ঘর, বাড়ি, আঙিনা/ সমস্ত সর্ন্তপণে ছেড়ে দিয়ে মামিমা/ ভেজা পায়ে চলে গেল খালের ওপারে সাঁকো পেরিয়ে/ ছড়ানো পালক, কেউ জানে না!’ শেষের লাইন— ‘ছড়ানো পালক, কেউ জানে না’র ওপরে একটা স্তব্ধ স্পেস, কিছুটা সাদা ফাঁকা অংশ— পারফেক্ট টাইম ল্যাপ্স! আমি বোধহয় আমার ক্লাস শুরু করেছিলাম এই দিয়েই। আর কী কী বলেছিলাম আজ আর তা মনে নেই, তবে সব সময়েই যেটা বলি, বোধহয় সেটা সেদিনও বলেছিলাম— কবি হতে হবে এমন নয়, সুরে স্বর ভাঁজতে হবে এমন নয়, ছবি আঁকতে পারতে হবে এমনও নয়, কিন্তু কবিতা, সুর আর ছবির কাছাকাছি থাকা, এদের নিয়ে থাকা দরকার একজন ভবিষ্যৎ-ফিল্মমেকারের। একই ভাবে কবি, লেখক, শিল্পী বা সুরকারকেও মজে যেতে হবে সিনেমায় আর অন্য মাধ্যমগুলিতে।
মাঝে মাঝেই আমাদের দেখা হত সাহিত্য সম্পর্কিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। আমি অনিয়মিত হলেও শঙ্খদা প্রায় শেষ পর্যন্ত নিয়মিত। তাঁর বাড়িতেও রবিবারের আড্ডা বসত, সবার জন্য দরজা খোলা। আমি কোনও আড্ডারই নিয়মিত সদস্য হতে পারিনি কোনওদিন, বিশেষ করে সে-আড্ডায় যদি অনেক লোকজন থাকে। আমার পছন্দ একাকী দু’তিনজনের আড্ডা, যেখানে প্রচুর কথা না হয়ে আসল কথা হয়। এরপরেও হঠাৎ একদিন আবার শঙ্খদার ফোন। বললেন, ‘সাহিত্য অকাদেমি আমার ওপর একটি তথ্যচিত্র বানাতে চায়, আমি আপনার কথা বলেছি। বলেছি, আপনি রাজি থাকলে তবেই আমি রাজি।’ ঝালমুড়ি বানানোর বাজেটের ছবি, কিন্তু বিষয় তো শঙ্খ ঘোষ। বললাম, ‘আমি রাজি।’ শঙ্খদা, আমার দুজনেরই বেশ উৎসাহ। ঠিক হল কোনও ভয়েস ওভার নয়, শঙ্খদাই বলবেন শঙ্খদার জীবনের গল্প। ওঁর দীর্ঘ একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। ছোটবেলা, বাংলাদেশ, দেশভাগ, কবিতা, রাজনীতি, যোগাযোগ এবং অনেক অ-যোগাযোগের কথা উঠে এসেছে সেই ছবিতে, আর এসেছে তাঁর অনবদ্য কবিতাপাঠ। সে-সময়ে একনাগাড়ে অনেক কথা হয়েছে অনেক বিষয় নিয়ে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে শঙ্খ ঘোষ, শক্তি-সুনীল-সমরেন্দ্র ছাড়িয়ে এই আমাদের অনেকের শরীরেই তখন কমিউনিজম-এর আঁচ। কিন্তু অনেকেই পার্টি মেম্বার হওয়ার থেকে বিরত থেকেছি। একটা সাহিত্যমেলায় শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের দেখা। এ সময়ে দুজনেই দুজনের কবিতা সম্পর্কে যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। সুভাষ শঙ্খকে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে। আপনি কি পার্টিতে জয়েন করছেন?’ শঙ্খ ঘোষ বুঝতে পারেননি কী উত্তর দেবেন। ভেবেছিলেন ‘হ্যাঁ’ বললে সুভাষ হয়তো খুশি হবেন, তবু শঙ্খ বলেছিলেন ‘না’। একবুক নিশ্বাস ছেড়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘বাঁচালেন।’ সুভাষ হয়তো চেয়েছিলেন শিল্পী যেন তাঁর সমালোচনা করার স্বাধীন জায়গা না হারিয়ে ফেলেন কখনও। এই ঘটনাটি ছবিতে এসেছে। তাঁর নিজের মুখে বলা কথা। এসেছে শঙ্খ ঘোষের রাজনৈতিক চেতনার নানান ভাবনা। কিন্তু কেন জানি না, ছবি শেষ হওয়ার পর শঙ্খদা আমার হাত ধরে অনুরোধ করলেন এই ছবি যেন তাঁর জীবিতাবস্থায় না দেখানো হয়। কেন এমন অনুরোধ করেছিলেন তা স্পষ্ট করে বলেননি, তবে সিপিএম পার্টি চটবে এমন ভয় বোধহয় তাঁর ছিল না। শঙ্খ ঘোষ বারবার পথে নেমে প্রতিবাদ করেছেন সব রাজনৈতিক দলের, সব অন্যায়ের। এর জন্য তাঁকে কেষ্টামার্কা রাজনীতির দালালের নর্দমার মতো বক্তব্যও শুনতে হয়েছে।
আজকে সেই ছবি ইন্টারনেটে ছেয়ে গেছে। কত মানুষ দেখছেন, ফোন করছেন। শঙ্খদা আর নেই। ২০২০-’২১ আর কত জীবন নেবে জানি না! তবে শঙ্খ ঘোষের চলে যাওয়া, এমনকী এই পরিণত বয়সেও ক্ষতিই! কারণ, মাথা না নোয়ানো ছিল নিভৃত এই কবির স্বভাবজাত— কাজে এবং বেঁচে থাকায়।