২রা মে ২০২০, সত্যজিৎ রায় শতবর্ষে পা রাখলেন। তখন সমগ্র বিশ্বজুড়ে অতিমারীর সময়। এক অদৃশ্য শত্রু মানবসমাজকে ছারখার করে দিয়েছে। তারই মধ্যে সত্যজিৎ-স্মরণ শুরু হল দেশে-বিদেশে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং মূলত ডিজিটাল মাধ্যমে। দেশে ও বিদেশে অনেক পরিকল্পনা হল, শতবর্ষে আমরা এই মহান স্রষ্টাকে স্মরণ করব সংঘবদ্ধভাবে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। কিন্তু বিধি বাম। ২রা মে ২০২১, অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউ ভয়ঙ্কররূপে আছড়ে পড়ল আমাদের দেশে। যুদ্ধ, রক্তপাত, মৃত্যু, অর্থনৈতিক মন্দা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভারসাম্যহীনতায় অবসন্ন পৃথিবীতে অবশেষে জীবাণুযুদ্ধ।
এবার ফিরে যাই গত শতাব্দীর শেষভাগে। সত্যজিৎ রায় আমাদের ছেড়ে চলে যান ২৩শে এপ্রিল, ১৯৯২ সালে। জীবনের শেষ পর্বে উনি প্রত্যক্ষ করেন একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পূর্ব ইউরোপের গৃহযুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে ইরাক যুদ্ধ, আধুনিক রিমোট কন্ট্রোল প্রযুক্তির সাহায্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি। আমাদের দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের শক্তির উত্থান ও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রস্তুতি। তারই সঙ্গে বাজার অর্থনীতির উগ্র পণ্যমনস্কতার প্রবেশ, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। এক কথায় সভ্যতার আর এক সঙ্কট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলার তাণ্ডব দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার টাউনহলে বক্তৃতা দিয়েছিলেন ‘Crisis in civilization’ বা ‘সভ্যতার সংকট’। সত্যজিৎ রায় তাঁর শেষ তিনটি চলচ্চিত্রে কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও লাগামছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন। প্রশ্ন করেছিলেন, কে সভ্য! মনমোহন মিত্র আলতামিরার বাইসনের গুহাচিত্র ও আদিবাসীদের মধ্যে যেন খুঁজে পেয়েছিলেন সৌন্দর্য ও সহজসরল জীবনের ছন্দ। এই সংবেদনশীল শিল্পীর শতবর্ষ আমরা যাপন করছি পৃথিবীর গভীর অসুখের দিনে।
সত্যজিৎ রায় জন্মেছিলেন বঙ্গীয় নবজাগরণের আলোয় উদ্ভাসিত এক পরিবারে। পারিবারিক পরম্পরা ও পরিবেশ অবশ্যই অনুকূল ছিল তাঁর বড় হওয়ার পর্বে কিন্তু প্রতিভা তো শুধুমাত্র বংশপ্রবাহে বিচ্ছুরিত হয় না, তাকে আবাদ করতে হয়। সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে সত্যজিতের প্রস্তুতিপর্ব ছিল অসাধারণ। একজন মেধাবী ছাত্রের মতো মনঃসংযোগ করে শিখেছিলেন সঙ্গীত, চিত্রকলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও সিনেমা। যেহেতু সিনেমার সঙ্গে সব ক’টি শিল্পমাধ্যমের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ আছে তাই সত্যজিতের সিনেমাযাত্রা ছিল অনায়াস ও অনাবিল। অথচ নতুন কিছু শেখার তাগিদ ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ‘অসম্ভব’ শব্দটা ওঁর অভিধানে ছিল না। শিখে, জেনে, অধ্যয়ন করে সৃষ্টিশীল কাজকে সম্ভব করতে হবে, এই ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। সত্যজিতের পরিবার বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধনের সন্ধানে লিপ্ত ছিল। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন সেই উদ্দেশ্য নিয়ে। কিশোর-কিশোরীদের সংস্কারমুক্ত একটা সজীব মনের সন্ধান দিয়েছিল ওই প্রকাশনা। উপেন্দ্রকিশোরের পরে সুকুমার রায় সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অনেকদিন পত্রিকা বন্ধ থাকার পরে সত্যজিৎ রায় ও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় নবরূপে আবার সন্দেশ প্রকাশ করেন ষাটের দশকের গোড়ায়।
আজকের ভোগবাদী সমাজে যেখানে শিক্ষা প্রায় পণ্যে পরিণত হয়েছে, সবুজ কচিকাঁচাদের মন সুলভ আকর্ষণে লালায়িত হচ্ছে দিনরাত ধরে, তখন ‘সন্দেশ’-এর প্রচেষ্টার কথা ভেবে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সত্যজিৎ রায়ের উপর তথ্যচিত্র নির্মাণকালে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর বিখ্যাত খেরোর খাতা বা জাবেদা খাতাগুলো দেখার, বোঝার ও শুটিং করার। বিজয়া রায় ও সন্দীপ মানিকদার লেখাপড়ার ঘরটা আমার কাজের জন্যে খুলে দিয়েছিলেন। সত্যজিৎকে নতুন করে চেনার সুযোগ পাওয়ায়, ওঁদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। ‘পথের পাঁচালী’-র খেরোর খাতা ছিল না। খেরোর খাতার ব্যবহার ‘অপরাজিত’ থেকে ‘আগন্তুক’ পর্যন্ত। খাতাগুলো এক-একটা ছোটখাটো ওয়ার্কস্টেশনের মতো। ফ্রেম আঁকা শটের পর শট সাজানো চিত্রনাট্য তো আছেই। এ ছাড়া আরও কত কী! সেটের স্কেচ, প্রপ লিস্ট, পোশাক-পরিচ্ছদের ডিজাইন, ছবির লোগো, কোথাও আবার থিম মিউজিকে একটা ফ্রেজ। কোনও একটি খাতায়, সম্ভবত ‘সদ্গতি’-র সময়, একজন পরিণত বয়সের মানুষ দেবনাগরী লিপিতে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ লেখার অভ্যেস করেছেন। খাতার শেষের দিকে দেবনাগরীতে একটা পুরো দৃশ্য লেখা। আয়ত্ত না করে ছাড়ব না— এই ছিল সত্যজিতের শেখার ইচ্ছে।
এ ছাড়া খাতার বিভিন্ন পর্বে অন্তরের অন্তরতম অনুভূতির লিখিত প্রকাশ। অতি স্বল্প পরিসরে। যেমন একটি নদীতটের লাইন ড্রয়িং-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সিলিউট একটা আকৃতি। তলায় লেখা, ‘এখন তোমাকে চাই।’ আবার কোনও একটি খাতায় লেখা ‘জানি না’ বা ‘আমি জানি না।’ জানার ও শেখার কী প্রবল হাহাকার করা আর্তি! এবং ঠিক সেই কারণেই সত্যজিৎ এক অপার বিস্ময়!
সত্যজিৎ-মানস তৈরির পিছনে ছিল ঐতিহ্য ও বহুচর্চিত স্বাতন্ত্র্য। চিত্রকলা, সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রে আমরা তার পরিচয় পাই। আর ছিল রসবোধ, সুরুচি ও সর্বোপরি— মানবতাবাদ। সত্যজিতের শিল্পকর্ম নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে ও আশা করি ভবিষ্যতেও হবে। তাঁর শতবর্ষে আমাদের শিক্ষণীয় হল— প্রস্তুতিপর্ব, নিরলস পরিশ্রম, নিয়মানুবর্তিতা, ক্রমাগত অধ্যয়ন ও চর্চা আর চোখ-কান খোলা রেখে নিজের কাজ করা।
সত্যজিৎ পার্সোনাল কম্পিউটার, ইন্টারনেট, সেলফোন এইসব প্রযুক্তি দেখে যাননি। সারা জীবন সমস্ত ইলাস্ট্রেশন করেছেন হাতে। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, ওঁর হাতে ফোটোশপ পড়লে কী হত! হয় ব্যবহারই করতেন না বা নতুন কোনও পদ্ধতি ও স্টাইলের উদ্ভাবন করতেন। প্রযুক্তিকে তিনি অবশ্যই গ্রহণ করতেন, কিন্তু যে প্রযুক্তি নির্ভরতা মানুষকে যন্ত্রবৎ রোবটে পরিণত করে তাকে পরিত্যাগ করতেন অনায়াসে। পারিবারিক ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্যের এমন বিরল ব্যক্তিত্ব আমাদের প্রিয় ‘মানিকদা’।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়া দিয়ে এই নিবন্ধ শেষ করলাম—
‘এক যে ছিল উপেন্দর
গল্প বলার যাদুকর।
তার যে ছেলে সুকুমার
ছড়ার সেরা রূপকার।
তার যে ছেলে সত্যজিৎ
চলচ্চিত্রে সর্বজিৎ।
তুলনা নাই অন্য
তিন পুরুষই ধন্য।’