আহমেদাবাদ শহরে সবরমতীর পার দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছি, এ শহরেরর বিখ্যাত, সুসজ্জিত নদীর ঘাটের ধার ঘেঁষে। নদীর জলকে দু’ধারেই আটকে রেখেছে নিটোল খয়েরি কংক্রিটের খাড়া পাঁচিল ও বাঁধানো ঘাট। রোদে তাতানো ঘাটগুলোকে যেন নদীটার থেকেও বেশি চওড়া লাগে— ধাপে ধাপে নেমে এসেছে একেবারে নদীর জলের ধার পর্যন্ত। কাদা নেই, শ্যাওলা নেই, কোনও অপরিচ্ছন্নতা নেই। এখানে বড্ড বেশি কংক্রিট, বড্ড বেশি। এদিকে-ওদিকে ছড়ানো-ছেটানো কিছু গাছ যেন অপ্রস্তুত হয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে— এই জ্যামিতিক ভাবে পরিপাটি, পরিকল্পিত রকমের ক্লিনিক্যাল, অতি-নাগরিক স্থাপত্যের দ্বিধাহীন মহাকাব্যের মাঝে তাদের ঠিক মানাচ্ছে না। প্রকৃতির কোনও খামখেয়াল এখানে দাগ ফেলতে পারেনি, অগোছালো করে দিতে পারেনি, আঙুল বোলাতে পারেনি। সবকিছুকে এবং সবাইকেই সরে যেতে হয়েছে কংক্রিটকে জায়গা করে দেবার জন্য। জায়গাটা ফাঁকা, ভীষণ ফাঁকা লাগে।
আমার গন্তব্য স্ক্র্যাপইয়ার্ড থিয়েটার, সেখানে দেখা করব স্থপতি এবং নাট্যব্যক্তিত্ব কবীর ঠাকোরের সঙ্গে, যিনি তাঁর বাড়ির পিছনের দালানটাকে একটা ডি আই ওয়াই (ডু ইচ ইয়োরসেল্ফ, অর্থাৎ নিজেই তৈরি করো) থিয়েটার স্পেস বানিয়ে ফেলেছেন। পাল্ডি অঞ্চলের একটা গলি ধরে এগিয়ে গেলে তাঁর বাড়ি। গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ল উজ্জ্বল হলুদ রং করা একটা দু’চাকার যান— এক টুকরো স্ক্র্যাপ আর্ট (বাতিল জিনিস দিয়ে তৈরি শিল্প), যেন মহা ফূর্তিতে থিয়েটারের গুণগান গাইছে। এটাকে বাঁদিকে এবং বাড়িটাকে ডান দিকে রেখে এগিয়ে গেলাম— বাড়ির দেওয়ালের ধার দিয়ে এক ধাপ সিঁড়ি উঠে গিয়েছে, প্রথমে লোহার ধাপ, তারপরে কাঠের। এটাও স্ক্র্যাপ বুঝি? সোজা এগিয়ে গেলেই মূল বাড়ির লেজুড় হিসেবে এক ধরনের আউটহাউস। ঢুকে পড়লাম, বাঁদিকে ছোট একটা রান্নাঘর, ডানদিকে অনেকগুলো আয়না এবং চেয়ারে সজ্জিত জোড়াতালি দেওয়া মেক-আপের ঘর। আর তার পরেই চোখে পড়ে রঙ্গমঞ্চ। খোলা চত্বর, পায়ের নীচে পাথরের মেঝে, আর ধাপে ধাপে দর্শক-শ্রোতাদের বসার জায়গা। উপর থেকে জায়গাটাকে আলিঙ্গন করে আছে একটা পল্লবিত গাছ, যেন অধীর আগ্রহে উঁকি মেরে দেখছে মঞ্চে আজ কী অনুষ্ঠান হবে! জায়গাটা ফাঁকা, তবে ভীষণ ভরাট লাগে।
এখানেই দেখা হল কবীরের সঙ্গে, তাঁর সঙ্গে আছেন আরও কিছু তরুণ, যাঁরা এই থিয়েটার স্পেসটিকে— এবং থিয়েটারকেও নিজেদের ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছেন। বিগত পাঁচ বছরে স্ক্র্যাপইয়ার্ড সত্তর-আশিজন মানুষের একটা গোষ্ঠী গড়ে তুলেছে, যাঁরা এখানে কাজ করেন। প্রত্যেকেই নানা রকম কাজ করেন। এটা গণতান্ত্রিক যৌথক্ষেত্র, কোনও রকম উচ্চাসন-নিম্নাসন বা হায়ারার্কি নেই। একে অপরের কাজে সাহায্য করতে এঁরা প্রায়ই একে অন্যের দায়িত্ব অদল-বদল করে ভাগ করে নেন, পরিচালনা থেকে অভিনয়, প্রযোজনার কাজ থেকে টিকিট বিক্রি বা মঞ্চের তদারকি। গত পাঁচ বছরে পঁচিশজনেরও বেশি নতুন পরিচালক এখানে তাঁদের প্রথম কাজ পরিবেশন করেছেন। শহরজুড়ে এই ক্ষেত্রটি জন্ম দিয়েছে একাধিক নবীন দলের, যাঁরা শাখা ছড়িয়ে নিজেদের কাজ করতে শুরু করেছেন, এবং সে কাজ দেখাতে ও ভাগ করে নিতে ফিরে এসেছন এই স্ক্র্যাপইয়ার্ডেই। টিকিট বিক্রির থেকে অভিনেতা ও কলাকুশলীদের স্বল্প পারিশ্রমিকের টাকা উঠে এলেও পেট চালানোর মতো পাকা পেশা করতে যে উপার্জন প্রয়োজন, তা এঁদের হয় না। এ বিষয়ে কবীরের একটা পরিকল্পনা আছে। নন-প্রফিট প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেজিস্টার করে সরকারি ও বেসরকারি অর্থায়নের অধিকার অর্জন করা। পাশাপাশি তিনি জানান, গুজরাটের সরকার প্রতি বছর সংস্কৃতির খাতে পঞ্চাশ কোটি টাকা খরচা করে। দুজনেই ভাবতে বসি, এ টাকাটা তা হলে যায় কোথায়? তবে স্ক্র্যাপইয়ার্ডকে আত্মনির্ভর কী করে বানানো যায়, তা কবীরের মূল ভাবনা নয়। তাঁর লক্ষ্য, এই প্রাণবন্ত, পরীক্ষামূলক যে থিয়েটার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, তাকে টিকিয়ে রাখা। তাঁর মূলমন্ত্র হচ্ছে, ‘শুধু থিয়েটার করে যদি বেঁচে থাকতে না-ও পারা যায়, অন্তত থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে।’
আমাদের আলাপচারিতার মধ্যেই এসে পড়ে চায়ের কাপ। এতে অবশ্য অবাক হবার কিছু নেই— হাজার হোক, এটা থিয়েটারের ক্ষেত্র, চা তো থাকবেই। বস্তুত, শূন্য থেকেই এই স্ক্র্যাপইয়ার্ডের জন্ম ও বেড়ে ওঠা, ‘সমাজের জঞ্জাল কুড়িয়ে এনে এর সৃষ্টি, কারণ সমাজের কাছে থিয়েটার হল জঞ্জাল,’ জানান কবীর। গোড়াতে সত্যিই সব ছিল কুড়িয়ে আনা জিনিস দিয়ে বানানো। ফ্লোর বানানোয় যে পাথর ব্যবহার করা হয়েছে, সে সব তাঁর অন্য একটা বাড়ি তৈরির সময়ের বাড়তি বা ফেলে দেওয়া পাথর। প্রথমদিকের আলোগুলোও কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস দিয়ে তৈরি; ফ্লেক্সের সিলিন্ডারে কম শক্তির হ্যালোজেন লাগিয়ে স্টেজের স্পটলাইট, আর ফ্যানের রেগুলেটরকে একটু পালটে নিয়ে বানানো হয়েছিল ডিমার বোর্ড। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওঁরা অবশ্য ‘ঠিকঠাক’ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে শুরু করেছেন, তবে পুরনো আলোগুলো এখনও রয়েছে, নতুনের পাশাপাশি তাদেরও ব্যবহার করা হয়।
এই নতুন ক্ষেত্র তৈরি করার পিছনের কারণটা অবশ্য কবীরের আর একটা কথায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাঁর মতে আহমেদাবাদের থিয়েটার বড় একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে, পুরনো বিষয়বস্তু আবার ব্যবহার করে নতুন নতুন জঞ্জাল তৈরি হচ্ছে। তাই এখানে তাঁরা জঞ্জাল ব্যবহার করে সৃষ্টি করেন নতুন, পরীক্ষামূলক বক্তব্য ও শিল্প, যা আমাদের সমসাময়িকের কথা বলে।
ইতিহাসের প্রসঙ্গটা আমাকে একটু বোঝাতে কবীর বলেন ষাটের এবং সত্তরের দশকের গুজরাটি পেশাদারি নাটকের স্বর্ণযুগের কথা। জনপ্রিয় জুটি প্রবীন ও সরিতা যোশীর নতুন শো তখন শুরু হত আহমেদাবাদে, চলত টাউন হলে আর প্রেমাভাই হলে এক মাস ধরে। পারেখস-এর দোকানে লম্বা লাইন পড়ে যেত টিকিট কেনার জন্যে। গুজরাটে কলেজে কলেজে একাঙ্ক নাটকের প্রতিযোগিতার একটা সুদীর্ঘ প্রথাও রয়েছে বহুদিন। আশির দশকে গুজরাট সমাচার বলে একটা স্থানীয় সংবাদপত্র এই যুব থিয়েটার প্রতিযোগিতার সূচনা করে, এখনও প্রত্যেক বছর সে প্রতিযোগিতা চলে ঠাকোরভাই দেশাই হলে। প্রথমদিকে প্রচারের আলোয় আসার লোভেই গোটা রাজ্যের কলেজ থেকে প্রতিযোগীরা আসতেন, তবে এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারাটাই ক্রমে একটা মানসম্মানের ব্যাপার হয়ে উঠল। থিয়েটার ও ফিল্মের কিছু খ্যাতনামা শিল্পী এই প্রতিযোগিতার হাত ধরেই উঠে এসেছেন, যেমন অভিজাত যোশী, সৌম্য যোশী, এবং কবীর নিজেও। কিন্তু সমস্যা ছিল, কলেজের গণ্ডিটা পেরনোর পরে এ বিষয়ে আর বিশেষ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল না। নাটকের এই প্রাণবন্ত সংস্কৃতিটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, এমন পেশাদারি বা পরীক্ষামূলক থিয়েটার আহমেদাবাদে হচ্ছিল না। এঁদের মধ্যে বেশিরভাগই চলে যেতেন মুম্বই। এ ছাড়াও রাজনৈতিক বা প্রতিষ্ঠানবিরোধী নাটক করার জন্য যে সুরক্ষাটা দরকার, সেটাও ছিল অত্যন্ত সীমিত। এই অভাবগুলো দূর করার প্রচেষ্টাই করে স্ক্র্যাপইয়ার্ড। এর পরে বেশ কিছু বছর কেটে গিয়েছে, প্রয়োগশালা এবং ফুটলাইটসের মতো আরও অনেকগুলো বেসরকারি পরিচালিত, বিকল্প ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, যারা সবাই নিয়মিত নানা রকমের কাজ পরিবেশনা করে। ২০২০ সালের নভেম্বরে লকডাউন উঠে যাবার পর থেকে স্ক্র্যাপইয়ার্ড নিজেই ছ’টি নতুন নাটক মঞ্চস্থ করেছে, প্রত্যেকটির পরিচালক আলাদা, নাট্যশিল্পীরাও ভিন্ন। কবীর এই ক্ষেত্রটিকে বলেন ‘নাট্য পরিচালক ও অভিনেতাদের জন্য এক রকমের প্রসূতি গৃহ।’
কবীর প্রথম কাজ শুরু করেছিলেন রঙ্গমণ্ডলের পরিসরে— যাদের পত্তন স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে। কিছুদিন পরেই, ২০১৪ সালে, রঙ্গমণ্ডল প্রযোজনা করে আহমেদাবাদ রঙ্গ মহোৎসবের— অনুষ্ঠানও বটে, প্রতিযোগিতাও বটে, তাতে কলেজ থিয়েটার এবং শখের থিয়েটারের দলের জন্যেও অবারিত দ্বার। প্রতিযোগিতা হিসেবেই এ উৎসব পরিকল্পিত হয়েছিল, বেশ কিছু আকর্ষণীয় পুরস্কারও ছিল, তবে আখেরে অনুষ্ঠানটির লক্ষ্য ছিল পারফর্ম্যান্স এবং অংশগ্রহণের একটা আবহ সৃষ্টি করা, যাতে মানুষ যোগ দিতে আগ্রহী হন। এ উদ্দেশ্যেই প্ল্যাটফর্ম পারফর্ম্যান্স ও পেশাদারী পারফর্ম্যান্সের মতো অন্য কিছু অনুষ্ঠানের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। বছর পাঁচেক আগে প্রতিষ্ঠিত স্ক্র্যাপইয়ার্ডও মানুষের সঙ্গে নাটকের যোগাযোগ স্থাপন করা এবং সহজেই যুক্ত হতে সাহায্য করার এই রীতিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গুজরাটি নাট্যদর্শকেরা মূলত মধ্যবয়সি হন— নাটকের প্রাসঙ্গিকতা এবং তার প্রতি মানুষের আগ্রহ যে কমতির দিকে, এ তারই নিশ্চিত প্রমাণ। কিন্তু স্ক্র্যাপইয়ার্ডে যে ক’টি নাটক হয়েছে, কমবেশি প্রত্যেকটিই দেখতে এসেছেন অন্তত জনা তিরিশেক করে নতুন দর্শক— যাঁরা আগে কখনও নাটক দেখেননি, কিন্তু এবার কোনও বন্ধু বা আত্মীয়কে মঞ্চে দেখবেন বলে হাজির হয়েছেন। মঞ্চে এবং মঞ্চের বাইরেও স্ক্র্যাপইয়ার্ড একটা তরুণ নাট্যসমাজ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে বলেই মনে হয়— সমকালের কথা সোজাসুজি বলতে পারবে, এমন শিল্পের কল্পনায় ও সৃষ্টিতে আগ্রহী একটা সমাজ।
এরকমই একটা নাটক কবীর লিখেছিলেন স্ক্র্যাপইয়ার্ডের পত্তনের আগে, ‘টেল অফ টিয়ার্স’ নামে। দিল্লিতে ২০১২ সালের কুখ্যাত ধর্ষণের ঘটনা, এবং গুজরাটের ২০০২ সালের দাঙ্গার মামলায় একাধিক রায়, যা সে সময়ে ঘোষিত হচ্ছিল, এই দু’টি বিষয়ে একটা দ্বিমাত্রিক প্রতিক্রিয়া ছিল কবীরের নাটক। পারিবারিক দায়িত্ব, ভূমিকা ও প্রতিক্রিয়া ছিল এ নাটকের বিষয়বস্তু— এ গল্পে একজন উকিল তাঁর বাবাকে দাঙ্গার সময়ে ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগের হাত থেকে আদালতে নির্দোষ প্রমাণ করতে সফল হন, কিন্তু মামলার পরে জানতে পারেন, বাবা আসলে অপরাধগুলো করেছিলেন। সে সময়ে একাধিকবার কবীর নাটকটি মঞ্চস্থ করতে পেরেছিলেন, কিন্তু রাজ্যে এবং গোটা দেশে সমসাময়িক যা পরিস্থিতি, তাতে আবার মঞ্চস্থ করা থেকে বিরত থাকবেন। কবীরের বক্তব্য, সে সময়ে যাঁরা মধ্যপন্থী, তাঁদের সঙ্গে কথোপকথন সম্ভব ছিল, যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে তাঁদের সপক্ষে আনা যেত। এখন সমাজে কে কোন পক্ষে রয়েছে সে লাইনগুলো খুব স্পষ্ট করেই টানা হয়ে গিয়েছে।
এ সময়ে দাঁড়িয়ে স্ক্র্যাপইয়ার্ডের সুরক্ষার কথাও ভাবতে হবে— শুধু জায়গা হিসেবে নয়, এই ক্ষেত্রে কী কী করা সম্ভব সে বিষয়েও। গুজরাটে ড্রামাটিক পারফর্ম্যান্সেস অ্যাক্ট নামক স্বৈরাচারী আইনটির খুব দাপট— বহু বাধা, সেনসর বোর্ডের নানারকম চোখরাঙানি, নাটকের অনুমতি পেতে বিস্তর কাঠখড় পোড়ানো, অঢেল খরচ। স্ক্র্যাপইয়ার্ড তুলনামূলক ভাবে একটা ছোট প্রয়াস, প্রতিষ্ঠানের চোখে চোখ রেখে লড়াই করা তাঁদের পক্ষে কঠিন। মজার কথা হচ্ছে, আসল বিপদটা আসে দর্শকদের থেকে। জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের সমাজটি আর শুধুই পরিচিত আত্মীয়-বন্ধুদের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নতুন, অপরিচিত দর্শকেরাও আসেন, এবং তাঁরা সসম্মানেই স্বাগত! কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে সেই ভিড়ে দক্ষিণপন্থীদের আগমনের সম্ভাবনা এবং আশঙ্কাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
দর্শকদের মধ্যে নানা রকমের মানুষ থাকেন, এবং বিশেষ বিশেষ দর্শকদের কথা মাথায় রেখেই লেখা নাটক স্ক্যাপইয়ার্ড পরিবেশনা করতে শুরু করেছে। যেমন ছোটদের জন্য নাটক— এটা কিন্তু পরিকল্পনা ছাড়াই হয়ে গিয়েছিল। ছোটদের জন্য একটা নাটক লিখতে এবং মঞ্চস্থ করতে হবে, এ প্রস্তাব নিয়ে কবীরের কাছে আসেন প্রবীণ ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও অনুবাদিকা ধীরুবেন পাটেল (যাঁর এখন ৯৪ বছর বয়স)। কবীর সামাজিক-রাজনৈতিক নাটকের লোক, তাই নিজের খুব একটা আগ্রহ ছিল না, তবে ভদ্রমহিলা তাঁকে রাজি না করিয়ে ছাড়বেন না! এ নাটকের পিছনে তিনি টাকাও নিজে ঢালবেন বলে জানান। অতএব মোগলি বালু টনক টুনটুন নাটকের জন্ম, এবং বহু শিশু এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের মিলিয়ে সম্পূর্ণ নতুন একটা দর্শক শ্রেণির আগমন। উপচে পড়া হাউজফুল ভিড়ে এ নাটক কুড়িবারেরও বেশি মঞ্চস্থ হয়েছে।
নতুন বিষয়বস্তু, পরীক্ষামূলক ও বহুমুখী কাজ, এবং নবীনদের উপস্থিতি— স্ক্র্যাপইয়ার্ডের সাফল্যের পিছনে এই জিনিসগুলোর অবদান অনস্বীকার্য, তবে কবীরের মতে থিয়েটারের যে ডিজাইন, তারও একটা অবদান রয়েছে। আকাশের নীচে ওপেন-এয়ার নাট্যক্ষেত্রটি সরাসরি ভাবে মুম্বইয়ের পৃথবী থিয়েটারের অনুপ্রেরণায় বানানো— মঞ্চের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ইত্যাদি পরিমিতিগুলো শুনলাম হুবহু এক, সার দিয়ে বেঞ্চির মতো দর্শকাসনগুলোও পৃথবী থিয়েটারের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ ধরনের নাট্যক্ষেত্রে যে নৈকট্য পাওয়া যায়, তা দর্শকের সঙ্গে একরকমের আন্তরিকতাও সৃষ্টি করে, তাতে সহজেই তাঁদের কল্পনা এবং সরাসরি যুক্ত হবার রাশ ধরে নিতে পারেন নাট্যশিল্পীরা। পৃথবী থিয়েটারের ডিজাইন এবং সৃষ্টির পিছনে রয়েছে স্থপতি বেদ সাগানের শৈলী। ডিজাইন করতে শুরু করার আগে শশী কাপুর এবং জেনিফার কেন্ডল তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, যতগুলো থিয়েটারের মঞ্চ সম্ভব ঘুরে দেখার, সেখানে মঞ্চস্থ নাটক নিজে দেখতে যাবার, যাতে নাট্যশিল্পী এবং নাট্যদর্শকের চোখে পৃথবী থিয়েটারকে কেমন দেখতে হতে পারে, সে বিষয়ে একটা বিশদ ধারণা বেদ করতে পারেন। কবীর একাধারে স্থপতি এবং নাট্যব্যক্তিত্ব, অতএব এ জিনিস যে তাঁকে অনুপ্রেরণা দেবে, তা বলাই বাহুল্য।
পৃথবীর মতোই স্ক্র্যাপইয়ার্ডও জনবসতির অঞ্চলেই গড়া, অতএব প্রতিবেশিদের নিয়ে নানা সমস্যা লেগেই থাকে। বড় বেশি আওয়াজ, বড্ড বেশি ভিড় হচ্ছে, যানবাহন আটকে যাচ্ছে— এ হেন বিভিন্ন নালিশ পাওয়া যায়। বলে রাখা ভাল, স্ক্র্যাপইয়ার্ড, স্থানীয় নাচের ক্লাস, এবং সমান্তরাল একটা গলিতে রেড ক্রস সোসাইটি— এই তিন জায়গায় আগত মানুষের ওই পাড়ায় বিশেষভাবে গাড়ি পার্ক করা নিষিদ্ধ। কবীর হেসে জানান, অপ্রত্যাশিতভাবেই স্থানীয় মন্দিরে যে ভিড় হয়, সে নিয়ে কিন্তু কারোর কোনও মাথাব্যাথা নেই। তাঁর মতে, মুম্বইয়ের মানুষ পৃথবী নিয়ে গর্ব করেন, থিয়েটারটিকে নিজেদের সম্মানের বিষয় এবং শহরের পরিচিতির একটা অচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে দেখেন, এটাই পার্থক্য। আমেদাবাদে ব্যাপারটা সেরকম নয়, এরকম ক্ষেত্রগুলোর কোনও মূল্য নেই— যদিও শহরের একটা সাংস্কৃতিক ম্যাপ একবার কবীরকে উপহার দেওয়া হয়েছিল, সেখানে তাঁর কাজকে সম্মান জানাতে মানচিত্রে চিহ্নিত করা ছিল স্ক্র্যাপইয়ার্ড।
স্ক্র্যাপইয়ার্ড ছেড়ে ফের যখন নদীর দিকে ফিরছি, তখন না ভেবে পারলাম না— একটা শহরের পরিচিতি, সংস্কৃতি এবং প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখে, পুষ্টি দেয় কে? স্ক্র্যাপইয়ার্ডের মতো ক্ষেত্রগুলো? না কি ওই সবরমতীর ঝাঁ-চকচকে ঘাট?