উদযাপনের কারণ কমে আসছে ক্রমশ। ক্ষয়িষ্ণু মাটির ওপর দাঁড়িয়ে জোর করে নাচলে, সে মাটি একেবারে ধসে পড়বে। যখন দেখা যাচ্ছে আগুন জ্বলছে, তখন তা না নিভিয়ে মিথ্যে সান্ত্বনার সুরে আনন্দের গান গাওয়া একটা প্রতারণা। তাই দুঃখটাকে আলিঙ্গন করা ছাড়া আর উপায় দেখি না। সেই আলিঙ্গনের স্পর্শে যদি কিছুটা দুঃখ কমে যায়, তাহলেই হবে।
আমাদের তো এগোনোর কথা ছিল। তা-ই পড়েছিলাম চার্লস ডারউইনের বইতে। ছোট থেকে শিখেছি, আমরা মানুষ হয়েছি বাঁদরের প্রজাতি থেকে এবং ক্রমে নাকি যাত্রাটা আমাদের পৌঁছে দেবে উন্নততর স্তরে। উন্নততর বাঁচার অঙ্গীকারে। সেটা যে হয়নি, তা স্পষ্ট। মানুষের বাঁচাকে আরও সহজ ও মসৃণ করে তোলার সমস্ত অনুষঙ্গ খুঁজে পেয়ে থাকলেও, আমাদের যাত্রাটা আদতে পেছনের দিকে। বিবর্তনটা ঘটছে উল্টো দিকে। যদি তা না হয়ে থাকত, তবে আজ মানুষকে শুধু নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য সবার দ্বারে কড়া নাড়তে হত না।
কিছু অভিজ্ঞতা হল বেশ কয়েকদিন ধরে, অত্যন্ত তিক্ত। আমরা কেউ কোনওদিন অতিমারী দেখিনি। আমাদের আগে যাঁরা এই বিচিত্র ঘটনা দেখেছেন, তাঁরা বেঁচেছিলেন ১০০ বছর আগে। তাই আমাদের কাছে কোনও ‘রেফারেন্স পয়েন্ট’ নেই। আমরা ভারতবাসীরা তুলনা করতে ভীষণ পছন্দ করি— ‘এটা কেন আগের থেকে খারাপ’, ‘ওটা আগের মতো হয়নি’, ‘তখনকার দিন অনেক ভাল ছিল এখনকার তুলনায়’ ইত্যাদি। তবে এই অতিমারীর চুলচেরা বিশ্লেষণ ও তার সঙ্গে আগের অতিমারীর তুলনা খুব একটা করা যাচ্ছে না, কারণ ১০০ বছর আগের স্মৃতিচারণ করার লোক নেই। তাই সবটাই নতুন— বাড়িতে বন্দি থাকা, চারিপাশে মৃত্যুর খবর শোনা প্রতিনিয়ত, অথবা চোখের সামনে হাজারে হাজারে দাহ না-হওয়া ঠান্ডা শরীর দেখা।
কিন্তু এই নতুনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এমন কিছু ঘটেছে, যেটা কেউ কোনওদিন আশা করিনি। আমরা আবার পুরাকালের দিকে এগিয়ে চলেছি— যেখানে শুধু বাঁচার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলোই লাগে, বিলাসিতার অবকাশ নেই। তবে যখন সেই সামান্য প্রয়োজনীয় বস্তুটুকুও আসে না কাছে, তখন মানুষ থেকে বাঁদরের ইতিহাসটা সামনে বেরিয়ে আসে।
২০২১ সালে দাঁড়িয়ে আবার নিজেদের একটা অচেনা লড়াইয়ে যোগদান করতে হয়েছে। সেই যুদ্ধ আমরাই ডেকে এনেছি হয়তো। তবে যুদ্ধের ময়দানে যাঁদের সামনে থেকে আশ্বাস জাগানোর কথা ছিল, তাঁরা নিভৃতে, নিরাপদে। শুধু নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য আজ এই চিৎকার করে গলা ফেটে যাচ্ছে, কাল খাবারের জন্য এই একইভাবে লড়তে হবে, জল পাওয়ার জন্য মরতে হবে। এমনই এক প্রগতি ডেকে এনেছি আমরা।
যে অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম, সেটা আমার মতো অনেকের হয়েছে। আমি নিজে আক্রান্ত অবস্থায় ঘরে বসে দেখতে পেলাম চারিদিকে হাহাকার, সামান্য অক্সিজেন বা হাসপাতালে একটি স্থানের জন্য মানুষ অসহায়। তখন কিছু গৃহবন্দি বন্ধুরা হেল্পলাইন শুরু করি, সুস্থ হওয়ার পর রিলিফ সেন্টার ইত্যাদির কাজও হয়। তবে সেই কাজটা জরুরি কেন হয়ে উঠল, সেটাই সবচেয়ে বেশি ভাবাল আমাকে।
আমাদের তো করার কথা ছিল না এই কাজ। গণমাধ্যম খুলে দেখা যায়, হাজারে হাজারে মানুষ অচেনা রোগীর পরিবারকে দ্রুত জরুরি সামগ্রী জোগাড় করে দিচ্ছেন। সেটা কারও রোজের কাজ নয়। এই কাজ থেকে কেউ অর্থ বা যশ অর্জন করছেন না। হয়তো দু’একজন পিঠ চাপড়ে বলছেন ‘দারুণ করছিস, এগিয়ে যা!’ কিন্তু নিজেদের দিনের কাজ আর রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়ে যাঁরা শুধু স্বার্থহীন হয়ে সাহায্য করছেন, তাঁদের মানসিক পরিশ্রমের বোঝা কেউ ভাগ করে নিতে পারবেন না।
কাদের থাকার কথা ছিল এই বিপর্যয়ের সময়? যাঁদের নাম আছে, প্রচুর সঞ্চিত অর্থ আছে, হাতে ক্ষমতা আছে। তাহলে দশজনের ভাল হত। তাঁরা উধাও হলেন। রাজনৈতিক বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা জানেন, এটাই হওয়ার কথা ছিল, কারণ প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাসিবাদ ‘মডার্ন’ হয়ে উঠতে পারেনি। তার অত্যাচারের রূপ আগের মতোই। তাই কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক সহজাত প্রতিবর্ত ক্রিয়া, এই শাসনে থাকা কিছু অমানবিক প্রাণীর।
তবুও ভীষণ রাগ হল নিজের ওপর, আমরা এই এক ভুল বারবার করি, আমরা জানি এই মৃত্যুর সার্কাসের পরিচালক কারা, তাও তাঁদের নির্দেশকের স্থানে বসাই। এই অতিমারীর মতোই চূড়ান্ত ঘন অন্ধকারের রাত আবারও আসবে বহুবার, আর তখনও আমরা দেখব নির্লজ্জ, বোধহীন কিছু শাসককে, যাঁরা কোনওদিন আলো নিয়ে আসবেন না। ঠিক যেমন এবার হল, সামান্য নিঃশ্বাসের জন্য মুখ খুলে আর্তনাদ করতে পারলেন না কোনও এক অসহায় ভারতবাসী।
এগিয়ে এল কারা? নাম জানি না, চিনি না— এমন কিছু ফোন নাম্বার। এঁদের কারও কাছে ‘জেড প্লাস সিকিওরিটি’ নেই, গাড়িতে বাতি নেই, খবর কাগজে নাম নেই, বা ফোনে প্রভাবশালী কন্ট্যাক্ট নেই। এঁরা ছাত্র, ছাত্রী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, বেকার যুবক-যুবতী। তাঁরা নেমে পড়েছেন আরও কিছু অজানা মানুষের সাহায্য করতে, সাহায্য পেলে হয়তো অজানা ব্যক্তিটি সুস্থ বোধ করবেন, কিন্তু পরে ধন্যবাদটুকুও শোনা হবে না। তাতে কী এসে যায়? সাহায্যের হাতটা তাতে কোণঠাসা বোধ করে না।
পৃথিবীর যাবতীয় অন্ধকার যখন নেমে এসে নিয়ম শাসায়, তখন এই মানুষের মিছিলটাই অলৌকিক শক্তির মতো নেমে আসে, ইতিহাস তাই বলে। যৌথ প্রচেষ্টায় তখন অন্ধকার ঢাকতে হয় বলেই হয়তো অনেক চোখরাঙানি আর অভাবের মধ্যে থেকে মানুষ মাথা তুলেছিল। এবারও মানুষের এগিয়ে আসায় ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে যাঁরা অনেকদিন এই যুদ্ধের ক্লান্তিতে ধুঁকছেন, তাঁরা জানেন, জনগণ বেশিদিন মনে রাখে না, ‘পাবলিক মেমোরি ইজ শর্ট-লিভড’। হয়তো ইতিহাসের শেষের দিকে কয়েকটা পাতায়, শিশুপাঠ্য বিদ্যালয়ের বইতে, এই সময়ের অদৃশ্য অলীক ঐক্যের কথা লেখা থাকবে, মানুষের ঘামের গন্ধ লুকিয়ে থাকবে, ব্যর্থতার কিছু চোখের জলের উল্লেখ থাকবে। কিন্তু সবাই মনে রাখবেন কি না, সেটা সন্দেহের। পাবলিক মেমোরিতে হয়তো স্থান করে নেবেন তাঁরা, যাঁরা চিতা পোড়ার ধোঁয়া দেখেন না— এটাই দুর্ভাগ্যের। যাঁরা স্বার্থশূন্য হয়ে অনেকের জীবনে শান্তি এনেছিলেন, স্বস্তি এনেছিলেন, তাঁদের মনে না রেখে, হয়তো আবার বহুমত দিয়ে আনা হবে এমন মানুষদের— যাঁদের অজ্ঞানতা আর অন্ধত্বে ক্ষয় নেমে এসেছিল। কিন্তু তাও যদি হয়, তাতেও সাহায্যের হাতগুলো কোণঠাসা করবে না, যেমন তারা এর আগের বহু অন্ধকার সময়েও করেনি।