ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মিহি মন্তাজ: পর্ব ২


    শুভময় মিত্র (May 7, 2021)
     
    রস 

    মুঠো করা আঙুলগুলো এককাট্টা করে লোকটা ডানহাত তুলেই রেখেছে। কিছু বলছে না। কিছুটা খুলছে। আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওই টেবিলে আরও দুজন খাচ্ছে। একজনের কচুরি শেষ। তরকারির ঝোল বেশি থেকে গেছে। শালপাতার ফাঁক দিয়ে নিঃশব্দে তলায় চলে যাচ্ছে। সে উঠে পড়ল। হাত ধুয়ে, দাম দিয়ে রাস্তায় নেমে গেল। মুহূর্তের মধ্যে ময়লা ন্যাতা দৌড়ে এসে সাফ করে দিল টেবিলের কিছুটা। উড়ে এসে পাখা মুড়ে বসল একজন। আর একজনের তরকারি শেষ, একটাও কথা না বলে সে তার হাফ-খাওয়া কচুরির দিকে তর্জনী স্থির করে রাখল। লোক এসে ঝোল উপচে দিল, আলু নয়। হাত-তোলা লোক এখনও পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি। গামলা থেকে হাতায় তুলে, মাটিতে ফেলতে ফেলতে এনে তার পাতে ভাসিয়ে দেওয়া হল রসগোল্লার ঘোলাটে রস। হাত নেমে গেল। এবারে রসের দিকে তর্জনী। পড়ল দু’পিস স্লাইস করা পাঁউরুটি, কাঁচা। রসে পাঁউরুটি, পাঁউরুটিতে রস মাখিয়ে খাওয়া শুরু হল আস্তে আস্তে। হাত আর একবার উঠেছিল। জলের জগ আর খালি গ্লাস পড়ে গেল ঠক ঠক করে। নিজের দিকে ঝোল টানার চেষ্টা করলেও ওই রসের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারে না, শালপাতার অসাবধানী বুনোটের মধ্যে দিয়ে অন্তঃসলিলা আগ্রাসনের সম্ভাবনা অনুভব করে আমার রগ দিয়ে ঘাম গড়াতে শুরু করল। এসব দেখছিলাম, আমাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছিল বলে। একশো টক দই চেয়েছি। অন্যান্য বাঘা বাঘা কাস্টমারদের পাশে এই অকিঞ্চিৎকর চাহিদা পাত্তা না পাওয়ারই কথা। মিষ্টির দোকানের টক-টক গন্ধে চুঁইয়ে চুঁইয়ে কবিতা এসে গেল। চমচমে থমথমে পিপীলিকা সমাধি, আরশোলা দুখে মাপে ঘন লাল পয়োধি। পরের লাইন এল না। নজরটা আটকে ছিল পাঁউরুটি ও রসের হোলি খেলায়। রসের বিছানায় পাঁউরুটির আসন পেতে, উল্টে, কী যেন পরীক্ষা করে, কিছুটা খেয়ে আবার হাত উঠল। সিঙাড়া এল। চুড়োটা ফুটো হল। মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। মাঝের সিনটা আর দেখতে চাইছিলাম না। ফের তাকালাম। সিঙাড়ার শরীরে রসমাখা আঙুল মুছে, তাকে আচমকা দু’তালুতে জাপ্টে ধরে চালান করে দেওয়া হল মুখে। লোকটার মুখ দেখিনি একবারও। পেছন থেকে রগের শিরার নিঃশব্দ ওঠানামা দেখে বুঝতে পারছিলাম, সিঙাড়াটা রসেবশেই আছে। আমার দই এখনও আসেনি। না নিয়ে বেরিয়ে গেলে কেউ কিছু বলবেও না। এদিকে ঘটনা একটা বেয়াড়া টার্ন নিয়েছে, লোকটা উঠে দাঁড়িয়েছে। বেসিনেও যায়নি, কাউন্টারেও নয়, ঝোলা নীল ফুলশার্টে হাত বুলিয়ে সে দোকানের বাইরে রাস্তায় নেমেছে সর্বাঙ্গে বোশেখ মাসের রোদ মেখে। পয়সা দিল না তো। মিষ্টির দোকানে প্রিপেড হয়? না কি লোকাল গুন্ডা? আসে, খেয়ে বেরিয়ে যায় ! দই ছেড়ে আমি ভিড়ের মধ্যে দিয়ে পিছলে চলে গেলাম রাস্তায়। লোকটার পাশ দিয়ে ক্যাজুয়ালি গেলাম। মুখটা দেখা দরকার। চেনা লাগল, ঠিক মনে করতে পারলাম না। এমনও হতে পারে, মনের ভুল। ইতিহাস বইতে ছাপা বাংলার বিখ্যাত কারুর সঙ্গে মিল আছে এর। ইউ.এন. ব্রহ্মচারী কি? 

    কোনওদিন কারুর পিছু নিয়েছি এমন নয়। হঠাৎ ঘুরে ঠান্ডা চোখে টার্গেট বুঝিয়ে দিতে পারে, আমি কি বুঝতে পারিনি ভেবেছ? এক্ষেত্রে এমন হলে কী বলব, সেটা ভেবে নেবার চেষ্টা করলাম। বেশ জমিদারি চালে হাঁটছে লোকটা। তাড়া নেই বিশেষ। ফুটপাথে বসা একজন হকারকে মোবাইল কভারের দাম জিজ্ঞেস করল। পাশের দোকান থেকে কিনল নাইলনের দড়ি। দাম নিয়ে অল্প বচসা হল। দোকানি রেগে গিয়ে বলল, ‘হাতি গলায় দড়ি দিলেও ছিঁড়বে না!’ একটু পরে ফলের দোকান, মাসি হেসে গড়িয়ে পড়ল, লোকটা বলেছে, ‘তোমার তরমুজ কত?’ নারকোল কেনা হল। এবারে পকেট থেকে বেরোল প্লাস্টিকের ব্যাগ, ওতেই ভরা হল সবকিছু। কোথাও কোনও টাকা-পয়সার ব্যাপার নেই। ফ্রি না কি? মাঝে মাঝে পকেটে হাত দিয়ে কী যেন দেখছিল লোকটা। মানিব্যাগটা আছে তো? এই ভয়টা আমার খুব হয়। আজ অবশ্য হল না। বুকপকেটে অল্প টাকা ছাড়া কিছু নেই। ইমিটেশন গয়নার দোকানের গায়ে ঝলমলে মেয়েদের সোনার গায়ের ছবি দেখল একটু। আঙুল ছোঁয়াল গয়নার ওপর। নিজের আঙুলটা দেখল। এরপর চটির দোকান। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঢুকল। বেরোল একজোড়া বাচ্চাদের জুতো হাতে নিয়ে। সেটাও ব্যাগে ঢুকে গেল। আর যা-ই হোক, জুতো আর ফল এক ব্যাগে, এ আবার কেমন কাজ? আর কিছু নিল না। ফিরবে বোধহয়। কোথায় থাকে জানার ইচ্ছে করছিল। চললাম পেছন-পেছন, দূরত্ব রেখে। একটা গলিতে ঢুকে তৃতীয় বাড়ির দরজায় কড়া নেড়ে হাঁক পাড়ল, ‘এই যে’। দরজা খুলল। একটা বেড়াল বেরিয়ে দৌড় লাগাল একদিকে। এক মহিলা বেরিয়ে এসে আমাকে দেখতে পেয়ে একগাল হেসে বললেন, ‘আজ আপনাকে ধরেছে বুঝি? তা বেশ, আসুন আসুন, কুটু, দ্যাখ কে এসেছে।’ আমাকে চেনেন উনি ? তার মানে আমিও চিনি? আমাদের আত্মীয় কি? কিছুই মনে থাকে না আর। লোকটাও আমার দিকে তাকিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল, ‘বাপ রে বাপ, কী দাম সব, আসুন আসুন, একটু জল খান, চা হবে।’ 

    এই অবস্থায় পালানোর উপায় নেই। না ঢুকতে চাওয়ার কোনও যুক্তিও তৈরি করিনি। আসলে যেন চিনিই, এমন ভান করে ঢুকে পড়লাম। খেয়াল করলাম, মানে বুঝতে পারলাম, একটাই ঘর। ঝুল-ধরা টিউবলাইট। পাখা নেই। রেগুলেটর আছে। পুরনো মশারি-তোলা খাট, তলায় রাজ্যের জিনিস। তোরঙ্গ, ঝুড়ি, দড়িবাঁধা গুচ্ছের কাগজ, একটা চুপসানো ফুটবল। একপাশে মেঝেতে স্টোভ। কুলুঙ্গিতে ঠাকুর, ফুল, ধূপদানি। দেওয়ালে পূর্বপুরুষের ছবি নিশ্চয়ই, মিথ্যে মার্বেলের মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছেন। ইনিও চেনা, ডব্লিউ. সি. ব্যানার্জি, অবিকল। ভেতরের একটা দরজায় ময়লা পর্দা। দুজনে ওখানেই ঢুকেছেন। অন্য দরজা ফাঁক হল, বুঝলাম বাথরুম। হামা দিয়ে হাফ বেরোল একটি বাচ্চা। অফুরন্ত নাল ঝরছে। হাতে বাটি। কোথায় বসব বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়েই ছিলাম। আমাকে দেখে খুশি হয়ে খোকা বাটিটা ছুঁড়ে দিল আমার দিকে, সারা ঘরে ভিজে মুড়ি ছড়িয়ে পড়ল। এবারে প্রত্যেকটি মুড়িকে লক্ষ করে সে এগোতে শুরু করল। বেছে বেছে মুখেও পুরতে লাগল একটি একটি করে। মুড়ি ছাড়াও আরও কীসব তুলে মুখে দিচ্ছিল। মহিলা একবার ঢুকে বললেন, ‘আসছি, বসুন না, বাজারটা গুছিয়ে রেখে দিই। কুটু, অত পিঁপড়ে খেতে নেই।’ বলে, নারকোলটা খাটের তলায় গড়িয়ে দিলেন আলগোছে। মুড়ি ছেড়ে বাচ্চা তড়বড় করে ওই দিকে চলে গেল। ঢুকে পড়ল জিনিসপত্রের অলিগলির মধ্যে। আর দেখতে পাচ্ছিলাম না ওকে। ঘটর-ঘটর শব্দ শুনতে পেলাম। তারপর চুপচাপ। মহিলা একবার ঘুরে গেলেন, বললেন, ‘রোজ বাজার না করলে ওনার মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। তাই আমি বলি, যাও, যা খুশি কেনো, সারাজীবন কষ্ট করেছ, এখন এটুকু আহ্লাদ করলে দোষ নেই, কী, ঠিক কি না? যাই, তেল-সাবানটা দিয়ে আসি, চানে ঢুকেছেন, বুধবার তো, আজ জেসমিন চাই। কুটুউউউ, বেরিয়ে এসো। চান করবে। খাবে। বাবা এখ্খুনি বেরোবে কিন্তু।’ বলে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। বাথরুম থেকে বালতি টানার, তারপর জলের হুসহাস শব্দ হল। বাবা? কে কার বাবা? লোকটা কমপক্ষে পঁয়ষট্টি। বাচ্চার মুখে কথা ফোটেনি। কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে আমার। এখানে এসে পড়াটাই ভুল হয়েছে। ‘আসছি, বসুন, এক মিনিট’, গলা শুনলাম ভেতর থেকে। মেঝেতে ছড়ানো মুড়ির মাঝখানে বসব? এদিকে চানঘর থেকে সাবান-জল গড়িয়ে আসছে ঘরে। চৌকাঠ ফাটা। ফেনা-জল ধরে ফেলছে অনেকগুলো মুড়িকে। তার কয়েকটা ভোল বদলে ভেলা হয়ে জলের সঙ্গে নাচতে নাচতে যাচ্ছে। যার পেছন পেছন এসে পড়েছি, সেই লোক গামছা পরে চানঘর থেকে বেরিয়ে আমার দিকে না তাকিয়ে, ওই জলের ওপর ছপছপ করে, কপালে দু’হাত ঠেকিয়ে বিড়বিড় করতে করতে দরজা দিয়ে একদম রাস্তায় বেরিয়ে যেতেই, প্রায় হাঁটু অবধি কাপড় তুলে ভদ্রমহিলাও বেরোলেন বাথরুম থেকে। অমনি জুঁইফুলের সুগন্ধে ভরে উঠল অগোছালো, ময়লা ঘরটা। চা করতে হবে না, ব্যস্ত হবার দরকার নেই, আবার তো আসব, বলায় খুব সহজে সেটা মেনে নিলেন। মাথায় ঘোমটা দিয়ে বললেন, ‘চান করিয়ে না দিলে দিনের পর দিন করবেন না। আসলে, প্রথমে সেই পাইপলাইন হল। জমি চলে গেল তো, টাকা দিয়েছিল, কিন্তু ওনার সে টাকা নেওয়ার সময়ই হল না। চিৎপুরে উনি তখন বিরাট ব্যাপার। তারপর, এবাড়ির কথা বলেই বা কী হবে আর। কত করেছেন সবার জন্য। কেউ কেউ মনে রাখে। আসে। ওই যে দাগাটা লাগল, ওতেই একদম গেল মাথাটা।’ 

    ভাল করে দেখিনি, যতদূর খেয়াল আছে, গলির মধ্যে হলেও বাড়িটা বেশ বড়। একতলায় পরপর অনেকগুলো জানলা। ওপরেও। মাঝখানে সদর দরজা। আমরা ঢুকেছিলাম পাশের দরজা দিয়ে, অর্থাৎ এই অংশটা আলাদা। লোকটার মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণ আন্দাজ করলাম। স্ত্রী তো তেমন অস্বাভাবিক নন। মাথা গেল বলেই কি দুম করে বুড়োবয়সে সন্তান হল? ঘরদোরের অবস্থা একেবারেই সুবিধের নয়। এ লোক কোথাও পয়সা দেয় না, সামঞ্জস্যহীন দুমদাম এটা-সেটা কিনে আনে। নিবেদিতপ্রাণ বৌ সবকিছু সমর্থন করেন। কথার সুরে স্বামী সম্পর্কে কোনও হতাশার চিহ্ন নেই। কী সুন্দর থপথপিয়ে চান করিয়ে দিলেন। আমি না-হয় দরজার একটু বেশি কাছেই এসে পড়েছিলাম। তাই বলে বাড়িতে ঢোকাবেন কেন? ‘আজকাল ছেলেপুলেরা রাস্তায় বিরক্ত করে খুব, তা সে করুক। ওদের দোষ দেওয়া যায় না। আবার এটাও ঠিক যে আপনার মতো কিছু লোককে ধরেবেঁধে নিয়ে আসেন যখন তখন। যারা চেনা তারা চেনে। আমি খুব বারণ করতাম, তারপর অনেকে বলল, বৌদি আপনি বুঝবেন না। তুলসীদার কাছে আমাদের বহু ঋণ।’ এই অবধি বলে চোখ মুছলেন। তারপরেই আবার মুখে হাসি ফিরে এল। স্বামী ফিরে এসেছে। এবারে লোকটা আমার পাশ দিয়ে হেঁটে সোজা গিয়ে খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসল। সিলিঙের কড়িবর্গা দেখল। তারপর অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে, যেন প্রথমবার দেখছে। উঠেও দাঁড়াল। অস্বস্তি হচ্ছিল। দৃষ্টিতে এমন একটা কিছু ছিল যে আমি দরজার দিকে সরে এলাম। মহিলা আমাকে আড়াল করে বললেন, ‘উনি বলেছেন তো, আসবেন আবার।’ ঘড়ঘড়ে গলা শুনলাম, ‘শম্ভু কি বেঁচে আছে এখনও?’ ততক্ষণে আমি আবার গলিতে, দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে। ভেতর থেকে একটাই কথা কানে এল, মহিলা বলছেন, ‘সংক্রান্তির আগেই শোধ দেবে, ওই বলতেই তো এসেছিল, নাও, খেতে বোসো, অনেক বেলা হল।’

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র
     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook