ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মানিকজেঠু


    সাত্যকি ঘোষ (May 1, 2021)
     

    সত্যজিৎ রায়, এই নামটার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ‘বিজলী’ সিনেমা হল-এ ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ দেখতে যাওয়ার সময়। প্রচণ্ড ভিড় ছিল। সেটা ১৯৬৯ সাল। কিন্তু মানিকজেঠুকে প্রথম ভাল করে চাক্ষুষ দেখি ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ। আমার কাকার বউভাতের দিন (আমার বাবা নিমাই ঘোষ, সত্যজিৎ রায় আমাদের পারিবারিক বন্ধু)। সেদিন সেভাবে কোনও কথা না হলেও, মনে আছে, উনি যখন বসেছিলেন, হাতে একটা সিগারেট ধরা ছিল। টানছিলেন না। ছাইটা শুধু বড় হচ্ছিল। ওঁর বসার যে কায়দা, মানে একটা পায়ের ওপর আর একটা পা তোলা, সেভাবেই বসেছিলেন। এটা আমি কখনও ভুলতে পারব না। তারপর সেদিন যখন খেতে বসেছিলেন, মনে আছে উনি ডাল চেয়ে খেয়েছিলেন। ডাল খেতে খুব ভাল ভালবাসতেন। সেদিনের স্মৃতি এটুকুই। তখন আমার কতই বা বয়স! ন’-দশ বছর হবে।

    কিন্তু আমি যখন কলেজ শেষ করে কাজ আরম্ভ করি, তখন মানিকজেঠুর কাছে যেতাম। ওঁকে কাজ দেখাতাম। তখন আমি ‘ইমেজ ফোটোগ্রাফস’ বলে একটা জায়গায় কাজ করছি। কী কাজ করছি সেখানে? আমার কাজ ছিল সকাল সাড়ে ন’টার মধ্যে স্টুডিও ঝাঁট দেওয়া আর ট্যাঙ্কে জল তোলা। এরপর সাড়ে দশটায় স্টুডিওটা খুলে বসতাম আর অপেক্ষা করতাম, কখন রাত আটটার পর ডার্করুমটা খালি হবে আর আমি প্রিন্ট করব, প্র্যাকটিস করব। এই সময়টায় কিন্তু জেঠু আমার ডার্করুমে কাজ করার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিলেন। আমি যে ফোটোগ্রাফি চর্চা করি, ভবানীপুরে ইমেজ স্টুডিওতে জ্যোতিষজেঠুর (চক্রবর্তী) ওখানে যাই, এই সবই উনি জানতেন। তখন ওই একটাই নামকরা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ল্যাব ছিল। একদিন হল কী, দুপুরের দিকে মা’কে ফোন করে উনি জিজ্ঞেস করেন, ‘সাত্যকি কোথায়?’, মা যথারীতি বলে দিয়েছে আমি ইমেজ-এ গেছি। তখন তো আর অন্য কোথাও যেতাম না। তখন বলেছেন, ‘আমায় ইমেজ-এর নম্বরটা দিতে পারবে?’ মা দিয়ে দিয়েছেন। এর মানে হল, নিজের তাগিদে কথা বলতে চান। মা কিন্তু আমাকে এটা বলেননি, আর মানিকজেঠুও মা’কে বলে দেননি আমাকে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলতে। এরপর উনি আমায় ফোন করেন। সেটা একটা শুক্রবার ছিল সম্ভবত। বলেন, ‘কাল তুমি বারোটার সময়ে ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে আসবে। রায় তোমাকে লাইটিং-এ হেল্প করবে।’ রায় মানে সৌমেন্দু রায়। আমি খুবই ক্যাজুয়ালি বলেছিলাম, ‘জেঠু, বাবা তো রয়েছেই, আপনি আমাকে ডাকছেন কেন?’, ‘যা বলেছি তাই কোরো। কাল বারোটার সময় তুমি তোমার ক্যামেরা নিয়ে চলে আসবে।’ সেই ব্যারিটোন ভয়েস।

    ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে গেছি। একটা কর্নারে ছবি উঠবে। তখন আমার একটাই লেন্স। যাই হোক, ছবি তুলে, রোল প্রসেস করে, কন্ট্যাক্ট শিট বের করে সন্ধেবেলা জেঠুর কাছে নিয়ে গেছি। উনি সব দেখেশুনে বললেন, ছবির প্রিন্টটা ওভাল শেপ-এ করে দিতে হবে। ছবিটা কী? ‘ঘরে-বাইরে’-তে যখন নিখিলেশ সন্ধেবেলা ঘরে ফিরে বিমলাকে বলছে, জানো তো কাল সন্দীপ আসছে— তখন ক্যামেরা, দেরাজের ওপরে রাখা নিখিলেশ-বিমলা-সন্দীপের ফোটোগ্রাফকে দেখাবে। এখানে সন্দীপের এই ছবিটাই ওভাল দরকার। জেঠুর সেটা দরকার রবিবার বারোটা-সাড়ে বারোটার মধ্যে। রাতারাতি সব করে ওঁর কাছে নিয়ে গিয়ে দেখাতে, খুব খুশি হয়েছিলেন। তারপর আরও অনেক কাজ করেছি। ‘ঘরে-বাইরে’ ছবিতে যেখানে ভিক্টর ব্যানার্জি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের খবর পড়ছেন কাগজে, ওই কাগজটার ছবি তোলার জন্য উনি আমাকে সঙ্গে করে ন্যাশনাল লাইব্রেরি নিয়ে গেছিলেন। আমি ছবি তুলেছিলাম। জেঠু সেটা আনন্দবাজার থেকে প্রিন্ট করান। আমি যখনই ছবি তুলেছি, প্রতিটা ফ্রেম আগে থেকে স্কেচ করা থাকত। ছবি বড় হয়ে গেলে, উনি সেগুলো ক্রপ করে নিতেন। 

    এরপর উনি আমাকে ‘সন্দেশ’-এর কাজ দিতেন নিয়মিত। এবং আশ্চর্যের কথা, উনি আমাকে চেক-এ পেমেন্ট করতেন। এক হাজার, দু’হাজার, তিন হাজার টাকার চেক। একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলি। গৌতম ঘোষ ওঁর ‘পার’ সিনেমাটা জেঠুকে দেখাতে নিয়ে গেছেন শিশির মঞ্চে। স্পেশাল স্ক্রিনিং। কথা হয়েই আছে, আমরা একসঙ্গে ফিরব। এবারে শেষে যখন ভিড়ের মধ্যে সব ফোটোগ্রাফার ছবি তুলছে— ঠিক সেই সময়েই উনি আমায় চিৎকার করে বলছেন, ‘সাত্যকি, তোমার চেকটা রেডি হয়ে গেছে, নিয়ে যেও।’ ওখানে ওটা তো না বললেও চলত! কিন্তু আজকে বুঝতে পারি, উনি রেকগনাইজ করার জন্য ওটা করেছিলেন। যাতে সবাই জানে, সাত্যকি ওঁর কত কাছের লোক। তখনও আমি স্টুডিও করিনি। এরপর আমি যখন ১৯৮৭ সালে স্টুডিও করি, উনিই নাম দিয়েছিলেন ‘ফোকাস’। লোগোটাও ওঁরই তৈরি করা। এবং আমার এখানেই উনি ‘গণশত্রু’র পোস্টার শুটিং-এর জন্য এসেছিলেন। আমি ছবি তুলেছিলাম। যেটা বলতে চাই, তখন তো আমার বয়স নেহাতই অল্প, এত কাজও করি না। সেই সময়ে মানিকজেঠুর প্রেরণা, উৎসাহ, আমার জীবনে খুব বড় প্রাপ্তি।

    আরও একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ‘ঘরে-বাইরে’-র শুটিং তখন শেষ হয়ে গেছে। অ্যান্ড্রু রবিনসন সেই সময়ে কলকাতায়। সম্পূর্ণ কাকতালীয় ভাবে, আমাকে পাঠাবেন বলে একদিন বাবা অ্যান্ড্রু-র সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছেন সকাল সাড়ে দশটায়, আর ওই একই দিনে, একই সময়ে, মানিকজেঠুও আমাকে ডেকেছেন কী একটা কাজে। আমিও হ্যাঁ করে দিয়ে এসেছি না জেনেই। তখন তো আর এত টেলিফোনের চল ছিল না! উনি সমস্ত কাজ সকালবেলায় ডেকে বোঝাতেন। হল কী, মানিকজেঠু যেহেতু খুব কাছের লোক, আমি অ্যান্ড্রুর সঙ্গে একঘণ্টা ছবি নিয়ে আলোচনা সেরে, কেনিলওয়ার্থ হোটেল থেকে হাঁটতে হাঁটতে ওঁর কাছে গেছি। প্রায় পৌনে বারোটায়। সত্যি বলতে কী, ওই অল্প বয়সে ব্যাপারটা নিয়ে মাথাই ঘামাইনি। কিন্তু দরজা খুলেই জেঠুর বকুনি, ‘এই তোমার সাড়ে দশটা?’ উনি অপেক্ষা করছিলেন আমার জন্য। আর জেঠুর মধ্যে একটা ব্যাপার ছিল, যখন কোনও কাজ কাউকে বোঝানোর কথা থাকত, যতক্ষণ না সেটা হচ্ছে, অন্য কোনও কাজে মন দিতে পারতেন না। সেদিন উনি একটা কথা আমাকে বলেছিলেন, যেটা আমায় মাঝে মাঝেই ভাবায়। আমি আজ যেখানে পৌঁছেছি, তাতে ওই একটা বাক্যের প্রভাব বলে বোঝানো যাবে না। বলেছিলেন, ‘অ্যান্ড্রু আগে, না আমি আগে?’ আমি পুরো বিষয়টাকে ক্যাজুয়ালি নিয়েছিলাম বলেই, উনি ওই কথাটা আমাকে বলেছিলেন। বোঝাতে চেয়েছিলেন, আমার priority-টা আমি যেন বুঝতে শিখি। 

    আমি যেহেতু একজন ফোটোগ্রাফার, আর এই জার্নিটা যেহেতু বাবার হাত ধরেই শুরু হয়েছে, বাবার একটা কথাও আমাকে ভাবায়। বাবা বলতেন, ‘তোকে তো খাওয়াতে-পরাতে হচ্ছে না, মোমেন্টটা কেন ছাড়বি!’ কত ছোটখাটো বিষয়ে যে বাবার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছি! এই কথাটা বলে নিই, আমি যেহেতু ছোটবেলায় ঠাকুমার কাছে থাকতাম, তাই নিরামিষ খাওয়ার অভ্যেস ছিল। আর তখন হোটেলে খেতে যাওয়া মানে রীতিমতো একটা উৎসব। মনে আছে, একবার ‘স্কাইরুম’-এ আমরা খেতে গেছি। আমি, বাবা, মানিকজেঠু আর জেঠিমা। তখনকার দিনে টেবিল-ম্যানার্স খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু বাবা আমায় সেখানে খেতে যাওয়ার আগেই বলে দিয়েছিলেন, ফিশ অর্ডার করতে। যাতে কাঁটা-চামচ দিয়ে খেতে কোনও অসুবিধে না হয়। এই সূক্ষ্ম জিনিসগুলোও জীবনে শেখার। এবারে বাবার তোলা একটা ছবির কথা বলি। মানিকজেঠু কোনও একটা শুটিংয়ে গেছেন। গেস্টরুমে বাথরুমের দরজাটা খোলা। ওঁর আন্ডারওয়্যারের দড়িটা ঝুলছে। প্যান্টের বেল্ট ঢিলে। কাঁধে তোয়ালে। আর বাথরুমে যাওয়ার আগে যেরকম সিগারেট ধরায়, হাতে ওইরকম সিগারেট। এই ছবিটা আমাকে নানাভাবে চিন্তাভাবনা করতে শেখায়। বাবাকে সর্বক্ষণ জেঠুর সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকতে দেখেছি।

    একটা ঘটনার কথা বলে শেষ করি। ১৯৮৮-’৮৯ সাল নাগাদ মানিকজেঠু বিজ্ঞাপনের শুটিং করতে গিয়েছিলেন কাঠমান্ডুতে। লিপটন কোম্পানির শুটিং ছিল। উনি মডেল। জেঠিমাও ছিলেন। সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা যেটা, এই গোটা অ্যাসাইনমেন্টটা আমার নামে হয়েছিল। আর আমার বাবা এতটাই জড়িয়েছিলেন ওই পরিবারের সঙ্গে, জেঠু-জেঠিমা কী পরে যাবেন সেটাও বাবা ঠিক করে দিয়েছিলেন। ওঁরা সেটা নিয়ে গিয়ে পরেওছিলেন। বাবা-আমি দুজনেই সেখানে ছবি তুলেছি। আমাকে ওখানে কোম্পানির অল-ইন্ডিয়া হেড বলেছিলেন, ‘মানিকদা যদি সুইৎজারল্যান্ড বলতেন, আমরা সেখানেই বিজ্ঞাপনটা শুট করতাম।’ কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বিজ্ঞাপনটা শেষ পর্যন্ত রিলিজ হয়নি। এটা যে আমার জীবনের একটা কত বড় অধ্যায়! কেননা, তখন আমার কোনও পরিচিতিই ছিল না। ফোটোগ্রাফির ব্যবসায় সবে আমার এক-দু’বছর হয়েছে। কিন্তু সেই সময়ে মানিকজেঠু আমাকে নিজে থেকে ডেকে যে-সম্মানটা দিয়েছিলেন, আজও আমি সেটা ভুলতে পারি না। 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook