ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • এলেবেলে: পর্ব ৩


    বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (May 15, 2021)
     
    আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট অরুণবাবু

    অরুণবাবু ছিলেন আমার জীবনে ‘নালে-ঝোলে-অম্বলে’র মতো, কুমড়োর ছেঁচকির সঙ্গে আলুর মতো, গ্রীষ্মকালের ঘুনঘুনে ঘোর-ওঠা বিয়ারের উপচানো গ্লাসের মতো! আমার চল্লিশ বছরের চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। আমার জীবনে এমন কোনও বিষয় ছিল না যাতে আমি অরুণবাবুকে জড়িয়ে নিইনি। এমনিতেই টালিগঞ্জে টানা চল্লিশ বছর একসঙ্গে কাজ করে যাওয়া লোক কম, তার মধ্যে অনন্যসাধারণ অরুণবাবু, অরুণ গুহঠাকুরতা। আমি থাকতাম যতীন দাস রোডের মুখটায় আর অরুণবাবু লেক টেরেস-এর এক গলিতে ছাদওয়ালা, দেড়কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাটে। ১৭৮/এ শরৎ বোস রোড, পাটকেল ছোঁড়া দূরত্ব। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট, কিন্তু যাকে গোপন সব কথা বলা যায়, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট কিন্তু যার কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়া যায়, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট যার বাড়ি থেকে বই এনে কালই ফেরত দিয়ে যাব বলে বছরের পর বছর রেখে দেওয়া যায়। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট, অথচ ফিল্মমেকিং-এর অনেক টেকনিকাল খুঁটিনাটি আমি অরুণবাবুর কাছ থেকেই শিখেছি, একথা বলতে একটুও দ্বিধা নেই। সে-সময়ের ফিল্ম-এডিট একদম অন্য জিনিস। অরুণবাবুই শিখিয়েছিলেন কীভাবে এক শটের ল্যাজার সঙ্গে পরের শটের মুড়ো ব্লেড দিয়ে হালকা হাতে চেঁছে, একচুল সিমেন্ট দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চিপে ধরে রাখতে হয়— এমন ভাবে, যেন কোনও ফ্রেম বাদ না পড়ে, শট কাটাজোড়া হয় জলের মতো। আমরা মিক্সিং করতাম একদম ফাইনাল রেকর্ডিং-এর সময়। পসিটিভ-এর ওপর তিনটে করে মার্ক থাকত, শেষ মার্কিং-এ রেকর্ডিস্ট শ্যামসুন্দর দে বা তার সহকারী জ্যোতি সাউন্ডের নবটা ঘুরিয়ে দিত, ভাবনামতো যখন যে শব্দ বা সুর আসার কথা তা শুরু হত। এখানে মার্কিং একদম নিখুঁত হতে হবে, না হলেই সব গেল। অরুণবাবু ছিলেন মার্কিং-এ পাক্কা। এক বালতি জলে কী করে নদীর ঢেউ তুলতে হবে বা দুটো কাঠের টুকরো দিয়ে কীভাবে দরজা খোলা-বন্ধের শব্দ তৈরি করতে হবে, সবই ছিল অরুণবাবুর হাতের ম্যাজিক! সারাদিনের এডিটিং-এর কাজ শেষ হয়ে গেলে আমরা যখন ব্যথা চোখ আর টিপটিপ করা মাথা নিয়ে সিগারেট-চা খেতে বাইরে বেরোতাম, তখন সারা ঘর জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফিল্ম-এর বিভিন্ন টুকরোর পাহাড় এক-এক করে মুহূর্তে মু্ভিওয়ালায় ঘুরিয়ে গুটিয়ে নিতেন অরুণবাবু, যাতে পরের দিনের এডিটে সবটা হাতের কাছে মজুত থাকে।   

    এন টি ওয়ান স্টুডিওর হত্তা-কত্তা-বিধাতা ছিলেন মেহ্তাজি। দশ পয়সার ছাড়ও দিতেন না কাউকে, সে সত্যজিৎ রায়ই হোক, ঋত্বিক ঘটকই হোক বা রাজেন তরফদার। বেশিদিন টাকা বাকি থাকলে ভোর ভোর সোজা ডিরেক্টর বা প্রোডিউসারের বাড়িতে হানা দিতেন। তখন ‘দূরত্ব’ শেষ হব হব করছে আর মাঝে মাঝেই সকালবেলা দরজা খুলে দেখা যাচ্ছে লম্বা-ফরসা-চক্চকে মেহতাজি গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। নমস্কার, গুড মর্নিং-এর বালাই নেই, প্রথম কথা— ‘ক্যয়া বুদ্ধদেওবাবু, পয়সা কভ মিলেগা?’ এভাবেই ঠোকর খেতে খেতে এগোতে এগোতে একবার পুরোপুরি আটকে গেলাম। কোনও কেষ্টবিষ্টুকে ধরেই কিছু হল না। ছবি শেষ, প্রিন্ট বেরিয়ে গেছে, ছবি দিল্লিতে পাঠাতে হবে ইন্ডিয়ান প্যানোরামার জন্য, এদিকে স্টুডিওতে হাজার দুয়েক টাকা তখনও বাকি। মেহ্তাজিকে পুরো টাকা না মিটিয়ে ছবি বের করতে কেউ কোনওদিন পেরেছে কি না জানি না, তবু বুক ঠুকে চললাম আমি আর আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। স্টুডিওতে দশটা লোকের সামনে মান-ইজ্জতের বারোটা বেজে গেল। নরম-গরম কোনও কিছুতেই মেহ্তাজিকে টলানো গেল না। পা-টা জড়িয়ে ধরতে শুধু বাকি, অরুণবাবু বললেন, ‘আসুন তো আপনি।’ বাইরে বেরিয়ে বললেন, ‘আপনি চা খান আমি আসছি।’ মাথা নিচু করে বসে আছি স্টুডিওর ক্যান্টিনে আর কাপের পর কাপ চা চলছে। পকেটে পয়সা নেই তাই পেটে খিদে থাকলেও চা-ই ভরসা। এভাবেই চলতে চলতে হঠাৎ দেখি গুপি-বাঘার মতো নাকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অরুণবাবু। বললেন, ‘চলুন। অ্যাকাউন্টস অফিসে টাকা ঢুকে গেছে, আমার কাছে আরও কিছু টাকা আছে। ওরা সব রেডি-টেডি করুক, ততক্ষণে কিছু খাওয়া যাক।’ সাড়ে তিন টাকায় ভাত, ডাল, তরকারি, মাছের ঝোল এবং ছোট খুরিতে দই। এমন কতবার হয়েছে যে এই একটা খাবারই আমরা দুজন ভাগ করে খেয়েছি। অনেক সময় আবার আমি, অরুণবাবু আর বিপ্লব মানে চিত্রপরিচালক, সম্পাদক বিপ্লব রায়চৌধুরী— তিনজন মিলে একটা মিল খেতাম। এর মধ্যে আবার খুরির দইটুকু বিপ্লব তুলে রাখত বান্ধবীর জন্য। মেডিক্যাল কলেজ থেকে ক্লাস করে সে ঘেমে-নেয়ে আসত বিপ্লবের এডিটিং-এর ঘরে। 

    সিনেমার জন্য সব কিছুই করা যেত তখন, সব কিছুই করা যায় এখনও। অরুণবাবু কী না করতে পারতেন সিনেমাকে ভালবেসে— নাচ, গান, অভিনয় তো ছিলই, কিন্তু এ বাদেও আর যা যা হয় সব করতে পারতেন। পরে জেনেছিলাম, সেইদিনের সেই টাকা জোগানোর রহস্যের পেছনে অরুণবাবুর স্ত্রী-র হাত ও গলার কিছু ভূমিকা ছিল। ভালবাসার তুমি কী জানো!

    অরুণবাবুর গল্প শেষ হওয়ার নয়। যে লোক অহমিয়া, ওড়িয়া, ভোজপুরি, হিন্দি চারটে ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে, গান গাইতে পারে। ঢাকাইয়া, সিলেটি, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম থেকে মানভূম, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, চব্বিশ পরগনা— যে কোনও ডায়ালেক্ট যার মুখে ফুলঝুরির মতো ফোটে, যার ঝুড়িভর্তি অভিজ্ঞতা আর ঝুলিভর্তি গল্প, তাকে নিয়ে তো গল্প চলতেই থাকে, চলতেই থাকবে। অরুণবাবুর গল্প হাঁ করে শুনতাম সবাই, এমনকী কত বার একই গল্প শুনতাম! শুটিং-এর শেষে রাতের আড্ডা অরুণবাবু গানে-গল্পে জমিয়ে দিতেন। ‘একটু নিন না, অরুণবাবু’ বললে, বলতেন— ‘তা দিয়েন একটু, চুল পরিমাণ!’ ‘কালপুরুষ’-এর শুটিং চলছে, ডিসেম্বর মাসে উড়িষ্যার অড়ি গ্রামে। মহানদীর হাওয়া হাড়মজ্জা কাঁপিয়ে দিচ্ছে, আর সবাই কতক্ষণে প্যাক-আপ হবে ভাবতে ভাবতে কোনও রকমে কাজ করছে। হঠাৎ অরুণবাবু গলা ছেড়ে ভোজপুরি গান ধরলেন। দারুণ চনমনে সেই গানের তালে তালে নাচ শুরু হয়ে গেল। এক মুহূর্তে ইউনিট চাঙ্গা। চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়া সোজা কথা না। ওই শুটিংয়েই ওখানকার গ্রামের লোকজন, বাচ্চা, বুড়ো জোগাড় করা হয়েছে— ক্রাউড হিসেবে। তারা দর্শকের ভূমিকায়। সামনে কিছু নেই তবু যেন যাত্রাপালা দেখছে, হাসছে, হাততালি দিয়ে উঠছে আর সবচেয়ে বড় কথা ক্যামেরার লেন্সে তাকাচ্ছে না… এই করতে আমাদের কালঘাম ছুটে গেল। কিছুতেই হয় না। ক্যামেরার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে কেউ না কেউ। শেষে যখন হাল ছেড়ে দেওয়ার অবস্থা, অরুণবাবু বললেন— ‘একটা লাস্ট ট্রাই নেওয়া যাক, আমাকে একটা টেবিল জোগাড় করে দে।’ টেবিল এল, তাতে চড়ে অরুণবাবুর সে কী নাচ আর গান! সঙ্গে নানা রকম অঙ্গভঙ্গি। লোকাল আর্টিস্টরা হেসে খুন, হাততালির হররা, ওকে টেক।

    কলকাতায় তখন সবে লকডাউন শুরু হয়েছে। মাস্ক ব্যাপারটা যে কী এবং কেন লোকে তখনও সমঝে উঠতে পারেনি। পুরো অবস্থাটাই সবার আয়ত্তের বাইরে। ডামাডোলের সেই শুরু। রোজই প্রায় অরুণবাবুর সঙ্গে কথা হয়, দুজনেই দুজনকে বলে থাকি— ‘বাড়ি থেকে বেরোবেন না কিন্তু দাদা।’ তবু এর মধ্যেই চুপিচুপি ঝোপেঝাড়ে এক-আধটা দোকান খুলছে, এক-আধটা সেলুন— যার মধ্যে একটা আবার অরুণবাবুর বিশেষ স্নেহধন্য। এই নাপিত নাকি চুল কাটার সময় এমন গা-হাত-পা টিপে দেয় যে খদ্দের ঘুমিয়ে কাদা, ঘুম থেকে যখন ওঠে তখন দেখে মাথার সব চুল সাফ। বহুদিন আর চুল কাটতে হবে না ভেবে বোধহয় সেই নাপিতের কাছেই গিয়েছিল অরুণবাবু আর তার কিছুদিন পরেই জ্বর। কয়েকদিনের মধ্যেই গলা ব্যথা, কাশি, শ্বাসকষ্ট। তারপরেই হাসপাতাল। আই সি ইউ। গৌতম, গৌতম ঘোষ, ফোন করে সবটা জানাল। ওই হাসপাতালের ব্যবস্থা করে। অরুণ, আমি আর গৌতম বহু যুগের বন্ধু। ফোন করলাম অরুণবাবুকে, হাসতে হাসতে বলল, ‘আরে দেখুন না, এরা আমাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে। আপনি চিন্তা করবেন না, কয়েকদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাব। ওই শালা নাপিত কী করল দ্যাখেন, ঘুম ভেঙে উঠে আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখি… আপনি সাবধানে থাকবেন, আপনাকে নিয়েই চিন্তা। কাল আবার কথা বলব।’ 

    পরের দিন ফোন আর ধরলেন না অরুণবাবু। গৌতমকে ফোন করলাম। ও জানাল, অরুণ আর নেই।

    এখনও মাঝে মাঝেই মনে হয় দরজা খুলে দেখব বাইরে দাঁড়িয়ে হাসছেন অরুণবাবু, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। 

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র
     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook