ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ‘দেবী’ ছবির অভিজ্ঞতা


    শর্মিলা ঠাকুর (Sharmila Tagore) (May 1, 2021)
     

    সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার প্রথম ছবি ‘অপুর সংসার’ আমাকে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিল। কিন্তু তার দামও দিতে হল। কলকাতায় আমার বাংলা মিডিয়াম স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম, কারণ স্কুলের প্রধান-শিক্ষিকা শ্রীমতী দাস মনে করলেন, আমি যেহেতু সিনেমায় অভিনয় করেছি, তাই বাকি মেয়েরা আমার প্রভাবে বখে যাবে। আমার মা-বাবা তখন আসানসোলে থাকতেন, তাঁরা সেখানকার লরেটো কনভেন্ট স্কুলে আমায় ভর্তি করে দিলেন। কলকাতার সব বন্ধুবান্ধব ছেড়ে নতুন স্কুলে জীবন শুরু করা, তার ওপর আবার ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল! একটা নতুন ভাষার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা ছিল ভয়াবহ। মনে আছে, প্রথম দিন আমায় ‘অন আ উইন্ডি ডে’ বিষয়ে রচনা লিখতে দেওয়া হল। পুরো রচনাটা আমি প্রথমে বাংলায় লিখে, তারপর একেবারে প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে ইংরেজিতে অনুবাদ করলাম। তা করতে গিয়ে সেই লেখায় যে ব্যাকরণ গুলিয়ে একেবারে যা-তা হয়ে গেল, তা তো বোঝাই যাচ্ছে! আমি স্কুলে সবার থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াতাম, কারণ সবাই ইংরেজিতে কথা বলত। 

    পরের বছর স্কুলের ছুটির সময়, মানিকদা আমায় ‘দেবী’ সিনেমার জন্য ডেকে পাঠালেন। এটা ছিল আমার দ্বিতীয় ছবি। আমার বয়স তখন চোদ্দো বছর। ১৯৫৯ সালে তৈরি হয়েছিল ছবিটি। আজ, এত বছর পর, এতগুলো সিনেমা করার পরেও, ‘দেবী’ আমার সবচেয়ে প্রিয় সিনেমা, ওই ছবিতেই আমার সবচেয়ে পছন্দের অভিনয়। যদিও গল্পটা ১৮৬০ সালের প্রেক্ষিতে রচিত, তবু তার বিষয়টা, আমার মতে, আজও প্রাসঙ্গিক। 

    উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগের প্রেক্ষিতে গল্পটা লেখা। তখন হিন্দু রক্ষণশীলদের আর যুক্তিবাদী সংস্কারপন্থীদের মধ্যে বিরোধ চরমে উঠেছে। এই দ্বন্দ্ব জমিদার শ্রেণিতেও ঢুকে পড়েছে, এবং অনেক তরুণ-সংস্কারক এই শ্রেণি থেকেই উঠে এসেছেন। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (একজন জমিদার) যে ‘দেবী’ গল্পের আসল বীজ বা আইডিয়াটি লেখক প্রভাত মুখোপাধ্যায়কে দিয়েছিলেন, এতে খুব অবাক হওয়ার কিছু নেই। সেই যুগের অন্ধ হিন্দু কুসংস্কার এবং তার সমালোচনা ও তা বাড়তে বাড়তে শেষ অবধি তীব্র বিদ্রোহ— এই দ্বন্দ্বটাকেই রূপ দেওয়া হয়েছে ‘দেবী’ গল্পের চরিত্রগুলোর মধ্যে। যে-বাবা নিজের নিরীহ বড় ছেলেকে দমিয়ে রাখেন, তিনি গোঁড়া হিন্দুয়ানির প্রতিনিধি। ছোটছেলে উমাপ্রসাদ নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি, যে-প্রজন্ম পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারায় দীক্ষিত। সে কলকাতায় পড়াশোনা করে এবং যুক্তিবাদী শিক্ষকের কাছে সংস্কারবাদী শিক্ষা পেয়েছে। তবুও, এই সংস্কারবাদী কন্ঠ যে যুগ-যুগ ধরে শিকড় গেঁথে বসে যাওয়া গোঁড়ামির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়, তা বোঝা যায়, যখন হরিসুন্দরীর চিঠি পেয়ে উমাপ্রসাদ বাড়ি ফিরে আসে। পুরোহিতদের মন্ত্রোচ্চারণ, গ্রামবাসী ভক্তদের উন্মাদনা এবং বাবার ইচ্ছে তার হাত-পা বেঁধে রাখে।  

    হরিসুন্দরী হচ্ছে বাড়ির বড়বউ, সে এ-সবের মাঝামাঝি একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে। সে যুক্তিবাদী মহিলা, কিন্তু আবার শতাব্দী-প্রাচীন এই গোঁড়া মনোভাবের প্রভাব ও নিয়্ন্ত্রণ থেকে বেরিয়েও আসতে পারে না।  

    ছবির চিত্রনাট্য পড়ে আমি বুঝতে পারলাম, সিনেমাটায় অভিনয় করার, চরিত্রটার অনেক দিক বের করে আনার, কী অসামান্য সুযোগ রয়েছে। আমার বিবেচনায়, এই সিনেমাটার মধ্যে কণামাত্র ত্রুটি নেই, একটা স্বরও বেসুরে বাজেনি। ছবিটার থমথমে আবহসঙ্গীত, ছবিটার অসামান্য ফোটোগ্রাফি— যা আসন্ন সর্বনাশের ইঙ্গিতগুলোকে আরও তীব্র করে তোলে, ছবিটা যে নিশ্চিত চলনে তার ভয়ঙ্কর ক্ল্যাইম্যাক্স-এ পৌঁছয়, সব কিছু নিখুঁত। ছবির শুরুর শটগুলোতেই জমিদার কালীকিঙ্কর রায়ের আকুল ধার্মিকতা বোঝা যায়, যা পরের ঘটনাগুলোর পক্ষে উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলে। জমিদার প্রায় ঘোরের মধ্যে দুর্গাপুজো দেখতে থাকেন, চারিদিকের হাওয়া ধুপের ধোঁয়ায় ভারী হয়ে থাকে, সাউন্ডট্র্যাকে চলে ঢাক আর ঝাঁঝরের শব্দ— সব মিলিয়ে দর্শকের মনে একটা অস্বস্তি তৈরি হতে বাধ্য। দর্শক মুহূর্তে বুঝতে পারেন, তিনি ধর্মের নেশায় বুঁদ এক চরিত্রের সান্নিধ্যে এসে পড়েছেন।     

    সিনেমাটা নিয়ে আমার খুব গর্ব হয়। মানিকদারও মনে হত, ‘দেবী’ আর ‘চারুলতা’ তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছবি, কারণ, তাঁর নিজের ভাষায়, এই ছবিগুলোয় তিনি সবচেয়ে কম ভুল করেছেন। আজকেও যখন আমি ছবিটা দেখি, অবাক হয়ে ভাবি, কী অসামান্য কৌশলে আমার মতো একজন নবাগতার কাছ থেকে অমন অভিনয় আদায় করে নিয়েছিলেন। আমার মনে হয়, এটাই ছিল ওঁর সবচেয়ে বড় ক্ষমতা, একজন নতুন সুযোগ পাওয়া অভিনেতাকেও তিনি এতটুকু অস্বচ্ছন্দ বোধ করতে দিতেন না, এবং তাঁকে দিয়ে একদম দৃশ্যের উপযোগী আবেগটিকে প্রকাশ করিয়ে নিতেন, যা বোধহয় সবসময় অভিনেতাটি বুঝতেও পারতেন না। সেইজন্যই তাঁর ছবিতে সবার অভিনয় এত স্বাভাবিক, অভিনয় বলে মনেই হয় না।

    তাঁর স্বপ্নে দয়াময়ীর মুখচোখ দেবীর মুখচোখে রূপান্তরিত হতে দেখার পর, শ্বশুর যখন দয়াময়ীর কাছে ‘মা, মা’ বলতে বলতে ছুটে আসেন, শুধু সেই দৃশ্যটি ভাবুন। তিনি অপার ভক্তিতে দয়ার পায়ে পড়েন, দয়ার ভাসুরও তা-ই করেন। দয়া এতে যে প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা ও আতঙ্ক অনুভব করে, তা চলতি চিত্রভাষায় বোঝানো হয় না। তাকে দেখা যায়, নখ দিয়ে পাশের দেওয়াল আঁচড়াতে এবং পায়ের বুড়ো আঙুলগুলো গুটিয়ে নিতে। এবং দর্শক বুঝতে পারেন, তার গোটা অস্তিত্বটাই কুঁকড়ে যাচ্ছে। আমি দর্শক হিসেবে তা অনুভব করতে পারি, পঞ্চাশ বছর পরে ছবিটা দেখেও।

    তার পাশ্চাত্য ভাবধারায় শিক্ষিত কলকাতা-নিবাসী স্বামীর অনুপস্থিতিতে, শ্বশুরের এই উগ্র উন্মত্ত ইচ্ছেকে বাধা দেওয়ার কোনও শক্তিই দয়াময়ীর নেই। একইসঙ্গে সে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থারও শিকার, যা তাকে পদে পদে শিখিয়েছে, বাড়ির পুরুষদের কথা কোনও প্রশ্ন না-করে মেনে চলতে। যখন তাকে মালাটালা পরানো হচ্ছে এবং দেবী হিসেবে সাজানো হচ্ছে, তখনও তার মুখ দেখলেই বোঝা যায়, তার মনে প্রচুর সন্দেহ, কিন্তু সে সেই প্রশ্নগুলো করার বা আত্মপক্ষ সমর্থনের পক্ষে বড্ড কমবয়সি, বড্ড ভিতু, বড্ড বেশি ঐতিহ্য-বন্দি। অনবরত পুজো পেতে পেতে, কিছুদিনের মধ্যেই তার বাস্তব সম্পর্কে ধারণাও গুলিয়ে যেতে শুরু করে, এবং সত্যজিৎ ধীরে ধীরে তার বিয়োগান্ত নিয়তি উন্মোচন করেন।

    শুটিং-এর সময়েই, ছবিটির প্রেক্ষাপট এবং আমার চরিত্রের প্রভাব আমার উপর পড়েছিল। ‘অপুর সংসার’ করার সময়, সেট-এ গেলে আমার চনমনে লাগত। এখানে, আমার মনে হত আমি যেন একটা ভার বয়ে চলেছি, যেন আমার বুকে কী একটা ওজন চেপে বসে আছে, যেন একটা কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। অবশ্য আমার যে পরিমাণ মেক-আপ থাকত, যতগুলো মালা পরে থাকতে হত, তার জন্যও এই অনুভূতি অনেকটাই হতে পারে। তবে সাহস করে এটুকু বলি, দয়া যে প্রচণ্ড নিপীড়নের কষ্টটা অনুভব করত, তার ছোঁয়াচও কোনওভাবে আমার লেগেছিল, যা চরিত্রটাকে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।

    পশ্চিমে, ছবিটাকে প্রবল ভাবে ভুল বোঝা হয়েছিল। বাংলায় সকলেই কালী-উপাসনার সঙ্গে পরিচিত, আর গোঁড়া হিন্দু পরিবারের কাঠামো ও কট্টর বিধিনিষেধ বিষয়েও সবাই জানেন। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শক এসব কিছুই জানেন না, তাই তাঁরা ঘটনাগুলোকে ভাল করে ধরতেই পারতেন না, কারণ প্লটটা তো গড়েই উঠেছে সাবেক বাঙালি ধ্যানধারণার মূল সুরটা অবলম্বন করে।

    এমনকী ভারতেও, ছবি রিলিজের সময় অনেক ঝামেলা হয়েছিল। অনেকে ভেবেছিলেন ছবিটা হিন্দুধর্মকে আক্রমণ করেছে, তাই বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। সরকারও এমন ছবিকে নিয়ে হইহই করতে চাইছিলেন না, যা এমন সব কুসংস্কার নিয়ে কথা বলে, যেগুলো, সরকারের মতে, দেশ থেকে উঠে গিয়েছে। তার ওপর, সত্যজিৎ ছিলেন ব্রাহ্ম, তাই এমন ইঙ্গিতও দেওয়া হচ্ছিল, তিনি ইচ্ছে করেই এমন বিষয় বেছেছেন যা হিন্দুত্বকে আক্রমণ করে— যা একেবারেই মিথ্যে। মানিকদা তখন বোঝালেন, ছবিটা হিন্দুত্বের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে, হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে নয়। আশ্চর্য ব্যাপার হল, এই ছবির বিষয়টা ঘোষণা করার দিন পনেরোর মধ্যে, পশ্চিম ভারতে একটা ঘটনা ঘটল। যেখানে এক গ্রামের তরুণী বধূকে এক আঞ্চলিক দেবীর অবতার হিসেবে ঘোষণা করা হল। আমি সত্যজিতের জীবনীকার অ্যান্ড্রু রবিনসন-এর সঙ্গে একমত, যিনি বলেন, ছবিটা বোঝাতে চায়, ঈশ্বরের সৃষ্টি ও নতুন নতুন ঈশ্বরের সৃষ্টি করে চলেছে মানুষই, এবং মানুষের মনই সিদ্ধান্ত নেয়, ঈশ্বরকে মানুষের মঙ্গলের জন্য ব্যবহার করা হবে, না অমঙ্গলের জন্য।

    কোনও সন্দেহই নেই, ছবির বিষয়টা এখনও প্রাসঙ্গিক। দেশে অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারের অন্ধকার অঞ্চলের অভাব নেই। আর পুরুষদের তৈরি করা সামাজিক কাঠামোয় মেয়েদের নিত্য ব্যবহার করা হচ্ছে ও তারা অসহায় শিকারে পরিণত হচ্ছে। সমাজের একটা বড় অংশে, মেয়েরা নিতান্ত বন্দি, তার পালাবার উপায় নেই, অন্যরকম কোনও জীবন বাঁচার অধিকারই নেই। তাকে মগজ ধোলাই করা হয়েছে: তার পরিবার তার সম্পর্কে যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই তার পক্ষে সবচেয়ে ভাল, তার কাজ পরিবারকে সেবা করা, তার নিজের কোনও পছন্দ বা মতামত থাকতেই পারে না। ‘দেবী’ ছবিতে, যখন উমাপ্রসাদ দয়াময়ীকে বলে, তার সঙ্গে কলকাতায় চলে যেতে, দয়া যেতে চায় না, তার মনে হয় তার শ্বশুরের কথা, ভাসুরের বাচ্চাটার কথা। ছবির শেষদিকেও, সে এই অবতার হওয়ার রটনাটাকে ছুড়ে ফেলতে পারে না, স্বামীর অকল্যাণের কথা ভেবেই। সে বলে, ‘যদি আমি দেবী হই, তোমার যদি অমঙ্গল হয়।’ এ ধরনের ভাবনা এখনও অনেকেই ভাবে, আর ধর্মবিশ্বাস সেটাকে আরও পোক্ত ভিত দেয়। ‘দেবী’র প্রাসঙ্গিকতা এখানেই, কারণ ধর্মের রক্ষণশীলতাকে ব্যবহার করে নারীকে নিপীড়নের সমস্যাটা নিয়ে এ ছবি কথা বলে। এই সমস্যা দূর করার জন্য চাই শিক্ষা, যে-শিক্ষা যুক্তিবাদী চিন্তার জন্ম দেয়। এই শিক্ষায় বিশ্বাস করতেন রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ। এ বিশ্বাস ‘অপুর সংসার’, ‘দেবী’— দুটি ছবিতেই  নিহিত।

    ধর্মকে যতদিন অজ্ঞতা ও কুসংস্কার ছড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হবে, যতদিন ধর্মের সত্যিকারের সহনশীল প্রগতিশীল প্রকৃতি মানুষকে এড়িয়ে যাবে, ততদিন ‘দেবী’ ছবিটি থাকবে প্রবল ভাবে প্রাসঙ্গিক, এবং যাঁরা অর্থময় সিনেমা ভালবাসেন তাঁদের এই ফিল্মটি দেখতেই হবে।

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook