ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • উত্তরবঙ্গ ডায়েরি: পর্ব ২


    সুমনা রায় (Sumana Roy) (April 3, 2021)
     
    জনজাতির উপকথা আর সমকাম

    মফস্‌সলেও কি হোমোসেক্সুয়াল আছে না কি?’ ‘উত্তরবঙ্গে কখনও প্রাইড মিছিল হয়েছে?’ ‘উত্তরবঙ্গের মতো স্বর্গে কে এই হোমোসেক্সুয়ালটির মতো রোগ ছড়িয়ে দিল?’ 

    মফস্‌সল শহরের প্রেক্ষাপটে তৈরি সমকালীন হিন্দি সিনেমা যখন ভারতবাসীকে ভারতবর্ষ চেনাচ্ছে— অনেকটা যশ চোপড়ার ছবিতে চেনা সুইৎজারল্যান্ডের আদলে— খবরের কাগজের ওয়েবসাইটগুলোতে এই ধরনের প্রশ্ন এখনও উঠে আসে। কৌস্তভ চক্রবর্তীর বই ‘ক্যুয়ারিং ট্রাইবাল ফোক টেলস ফ্রম ইস্ট অ্যান্ড নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়া’ পড়তে গিয়ে এই প্রশ্নগুলো আমাকে অবাক— প্রায় স্তম্ভিত— করে দিয়েছিল। কৌস্তভ জলপাইগুড়িতে বড় হয়ে উঠেছেন এবং বর্তমানে দার্জিলিং-এর সাউথফিল্ড (প্রাক্তন লোরেটো) কলেজের অধ্যাপক। সাহিত্যক্ষেত্রে এবং সংস্কৃতিশাস্ত্রে তাঁর শিক্ষা এবং তাঁর সমকামী দৃষ্টিভঙ্গি মিলিয়ে কৌস্তভ তৈরি করছেন এই অঞ্চলের উপকথার একটা ক্যুয়ার বা সমকামী বিশ্লেষণের আর্কাইভ।

    কৌস্তভ পুরুষ-নারী দ্বিভাজনের বাইরে নিজেকে দেখতে চান; কেতাবি ভাষায় বলা যায়, অপরত্ব বা ‘আদারনেস’-এর (‘otherness’) সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন। এই ‘আদারনেস’ শব্দটাকে এখন অবশ্য পণ্ডিতরা এতগুলো ক্ষেত্রে ব্যবহার করে ফেলেছেন যে এটা একটা ফ্রি-সাইজ তাঁবুতে পরিণত হয়েছে, কিন্তু কৌস্তভ এটাকে ব্যবহার করতে চান অনেকগুলো কারণে। সেগুলো হল: তিনি সমাজের তৈরি যৌন ছাঁদের বাইরে নিজেকে দেখতে চান। আর, মূলস্রোতের ধ্রুপদী ও জনপ্রিয় সাহিত্যের তুলনায় লোকসাহিত্যের ঐতিহ্যকে যে নিচু চোখে দেখা হয়, এবং লিখিত ও মৌখিক সাহিত্যের মধ্যেও যে ক্ষমতা-বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে— সেটা মনে রাখেন। এবং অবশ্যই, এই অপরত্বের সঙ্গে নিজেকে মেলানোর ক্ষেত্রে কৌস্তভের মনে কাজ করে যায়, যেখানে তিনি থেকেছেন ও বড় হয়েছেন, সেই উপেক্ষিত জলপাইগুড়ি। 

    এই লেখা লিখতে বসে এটা সচেতনভাবে মনে রাখতে হচ্ছে, আমাদের ছোট শহর এবং গ্রামের LGBT (এলজিবিটি; Lesbian Gay Bisexual Transgender) ইতিহাস সম্বন্ধে যে এই যুগেও আমরা কত কম জানি। 

    আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাট গ্রাম পঞ্চায়েত জলদাপাড়া ন্যাশনাল পার্ক পর্যটকদের কাছে চেনা নাম; মাদারিহাট থেকে ২২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত টোটোপাড়া এখন টোটো নামক উপজাতির প্রধান বাসস্থান। টোটোরা ভুটান-পশ্চিমবঙ্গ বর্ডারের কাছে তোর্সা নদীর উপকূলে বাস করেন। কৌস্তভ টোটোদের উপকথায় তিনটে প্রধান চিন্তা এবং চরিত্রাঙ্কন লক্ষ করেছেন: ‘প্রধান মাতামহী থেকে ঠগ জাদুকরী’, ‘অবাধ্য ঘনিষ্ঠতা’ এবং ‘মন্দে স্বাধীনতা’। যুবকদের এবং এই মাতামহী চরিত্রের মধ্যে যে ইরোটিক সম্পর্ক কৌস্তভ খুঁজে পেয়েছেন— যা এদেশে হিন্দু বা খ্রিষ্টান ধর্মীয় আচার এবং বৈধতা আসার আগের যুগের যৌন চিন্তার প্রমাণ— সেগুলো দেখা যায় ‘কুমড়ো রাজকুমার’ (‘দ্য পাম্পকিন প্রিন্স’; The Pumpkin Prince), ‘অনাথ বালক’ (‘দ্য অরফ্যান বয়’; The Orphan Boy), ‘দুই অনাথের কাহিনি’ (‘দ্য স্টোরি অফ টু অরফ্যানস’; The Story of Two Orphans) এবং ‘ডাইনি মা’ (‘দ্য উইচ মাদার’; The Witch Mother) নামের উপকথাগুলোয়।     

    ‘কুমড়ো রাজকুমার’ একটা পরিবর্তন-কাহিনি; জীবজন্তু এবং গাছপালার মানুষে রূপান্তর এবং মানুষের অন্য কোনও অস্তিত্বে রূপান্তরের ঐতিহ্যে তৈরি একটা গল্প। এক বৃদ্ধ চাষি-দম্পতি একটা কুমড়ো খুঁজে পায়, যা তাদেরকে অনুরোধ করে, আমাকে কেটো না, আমি তোমাদের সব কাজে সাহায্য করব। কুমড়ো হয়ে যায় তাদের নাতি। এর পরের ঘটনা বহু উপকথায় দেখা যায়। রাজার বড় মেয়েরা এই নাতিকে প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু ছোটমেয়ে জানতে পারে যে কুমড়োর দেহে আসলে বন্দি এক রাজপুত্র, এবং রাজপুত্রকে বিয়ে করে। তাদের সন্তান-সন্ততি হয়, তখন বড় মেয়েরা ছোটমেয়েকে খুব হিংসে করতে শুরু করে। বড় রাজকুমারী হিংসের চোটে ছোটবোনকে নদীতে ডুবিয়ে মেরে ফ্যালে এবং কিছুদিনের জন্য তার ‘স্বামী’কে বোকা বানাতে সফল হয়। অবশেষে ‘কুমড়ো রাজকুমার’ বড় রাজকুমারীর ছল-চাতুরি ধরে ফেলে এবং তাকে সুপারি গাছের জন্য খোঁড়া এক গর্তে ফেলে দিয়ে হত্যা করে। 

    এই রূপান্তরগুলোকে— নিজেকে বদলে নেওয়াকে— কৌস্তভ ভেবেছেন: একটা জুলুমবাজ বিষমকামী সমাজের দাবিদাওয়া থেকে নিষ্কৃতির চাহিদা। শুধু টোটো নয়, রাভা, লিম্বু এবং লেপচা উপজাতির লোকসাহিত্যের বিভিন্ন উপাখ্যানেও কৌস্তভ নতুন ভাবে আলো ফেলেছেন ও এই ধরনের অর্থ খুঁজে পেয়েছেন।

    কৌস্তভ চক্রবর্তীর বিশ্লেষণে এই কাহিনি— এবং টোটোদের মৌখিক ইতিহাসে এর বহুবিধ বয়ান— হয়ে ওঠে ‘ক্যুয়ার জীবন’-এর প্রতিফলন, যেখানে বিষমকামী জীবনের বাইরে বাঁচা কোনও ব্যক্তি ধারাবাহিক ভাবে কিছু সম্পর্কের ভিতর দিয়ে যেতে থাকে; যৌন কামনা উদ্রেককারী মাতামহী থেকে মৃতা স্ত্রী-র প্রেত অবধি। কৌস্তভ লিখছেন: ‘গল্পটা থেকে বোঝা যায় যে পরিবর্তিত আদিবাসী জীবনে, কাঙ্ক্ষিত ‘ক্যুয়ার জীবন’ শুধুমাত্র একটা কুমড়োর ছদ্মবেশেই বাঁচা যায়।’  

    কুমড়ো আর সুপারি, টোটোপাড়ায় এবং উত্তরবঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলে যা হামেশাই বেড়ে উঠতে দেখা যায়, অন্য গল্পেও উঠে আসে। অনাথ বালকের উপকথায় প্রায় এই গোছেরই পরিবর্তনের ঘটনা দেখা যায়। এই রূপান্তরগুলোকে— নিজেকে বদলে নেওয়াকে— কৌস্তভ ভেবেছেন: একটা জুলুমবাজ বিষমকামী সমাজের দাবিদাওয়া থেকে নিষ্কৃতির চাহিদা। শুধু টোটো নয়, রাভা, লিম্বু এবং লেপচা উপজাতির লোকসাহিত্যের বিভিন্ন উপাখ্যানেও কৌস্তভ নতুন ভাবে আলো ফেলেছেন ও এই ধরনের অর্থ খুঁজে পেয়েছেন।      
    কিন্তু বইটা পড়তে গিয়ে— যেখানে এই উপকথাগুলো সম্ভবত প্রথমবার ইংরেজিতে অনূদিত— আমাকে সবচেয়ে ছুঁয়ে গেছে রূপান্তরের প্রবল আকাঙ্ক্ষা। তার মধ্যে আছে মনুষ্যশরীরের গঠন থেকে মুক্তির ইচ্ছে, সামাজিক পরিকাঠামো থেকে মুক্তির ইচ্ছে, এমনকী মানুষ থেকে অন্য প্রাণীতে বা উদ্ভিদে বদলে যাওয়ার ইচ্ছে, এবং সেখান থেকে আবার মানুষের রূপে ফিরে আসার ইচ্ছে। এই রূপান্তরের গল্প সব সংস্কৃতিতে দেখা যায়। এরা যেন মানুষের কামনার একটা সিন্দুক, অনেক রকম আধার নিয়ে মানুষের কল্পনার পরীক্ষা- নিরীক্ষার একটা আর্কাইভ। 

    পশ্চিমবঙ্গ যখন বিধানসভা নির্বাচনের স্লোগান আর গানে উদ্বেল, তখন উত্তরবঙ্গের উপকথায় এই অনাথ শিশুদের নিয়ে গল্প এবং তাদের প্রতি সমাজের আচরণ নিয়ে পড়ছি, আর আমার এলজিবিটি বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে। কোনও রাজনৈতিক দলের ম্যানিফেস্টোয় তাদের জীবন বা প্রয়োজন নিয়ে কোনও আলোচনা আমি দেখিনি। 

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook