ভাল ছেলের মতো রাত দশটায় খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম আগে। সকালে উঠে স্কুল, সন্ধেবেলায় টিউশন, নাটকের রিহার্সাল ইত্যাদি। এই জীবনটা বেশ ছিল, তেমন জটিল ছিল না, অন্তত জটিলতা টের পেতাম না। তারপর পড়াশোনার বই বাড়ল, মাস্টারমশাইদের সংখ্যা বাড়ল, নাটকের শো বাড়ল, সিনেমার অফার বাড়ল। তখন জেগে থাকা বাড়ল। সারাদিনই পছন্দের জিনিসগুলো করতাম, কিন্তু রাতে আরও বেশি আনন্দ পেতে লাগলাম। শুরু হল অদল-বদল। রাত দশটায় আর ঘুমোই না, ভাল ছেলে আর রইলাম না কি তাহলে? কিন্তু এই যে বড় হচ্ছি!
প্রথমে ভাবলাম, রাতটা এতটাই শান্ত যে একটা আশ্রয় পেলাম। কেউ আসছে না বিরক্ত করতে, বেশ অনেকটা সময় পেলাম। আর সেই শান্ত রাতের আরাম, হাত ধরে নিয়ে এল আরও কিছু বন্ধু। তারাও আমার মতো রাত জেগে কিছু করছে, ভাবছে, লিখছে, শুনছে, দেখছে। সেই সব বন্ধুরা এক বয়সের নয়, কিন্তু একরকম ভাবেই রাতের নিচে বসে আছে। সবাই মাথা তুলে তাকাচ্ছে একই চাঁদের দিকে, আকাশটাও এক, তবে নিচের মাটিটা আলাদা। হয়তো আকাশটাই আমাদের বন্ধু বানাল।
আর বন্ধু হয়েই মনে হল আরও একটা কথা, ‘প্রজন্ম’ কথাটার গণ্ডি বড্ড অস্পষ্ট। শুধু একটা সময়ে জন্মানোটাই কি একটা প্রজন্মে পড়ে যাওয়া? এটাও তো তাহলে স্টিরিও-টাইপ করা হল। রাতগুলোয় যখন বিভিন্ন বয়সের বন্ধু মিলে কথা বলতাম, মেসেজ করতাম, ভাবনা ভাগ করে নিতাম, তখন মনে হত, শুধু বয়স বা দশকের বিচারে তো প্রজন্ম নয়, সম-মানসিকতার বিচারে প্রজন্ম। আমার চেয়ে অনেক বড় দাদা বা দিদিও আমার প্রজন্মেরই, যদি তার চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি আমার মতোই হয়। আবার, আমার একেবারে এক বয়সের ছেলে বা মেয়েও হতে পারে আমার ঠাকুমার প্রজন্মের, যদি সে বস্তাপচা মূল্যবোধ আঁকড়ে বসে থাকে। আবার উল্টোটাও হতে পারে, আমিই হতে পারি আমার দশ বছরের বড় দাদার চেয়ে বুড়ো। রাত-জাগা আমাকে এই মূল্যবান কথাটাও শিখিয়ে দিয়ে গেছে, কোনও লোকের বয়সের বিচার এখন তাই করি টাক বা চুলে-পাক দেখে নয়, তার ভাবনা বুঝে, হাসিটা মেপে।
‘আজকালকার ছেলেমেয়েরা’ খুব রাত জাগে আর দিনে ঘুমোয়— কথাটাও সেইজন্যেই খুব খচখচ করে লাগে। আজকাল বলতে কী? কারাই বা আজকালকার ছেলেমেয়ে? আমার যেমন টিউশন বেড়েছিল বলে পড়াশোনার বাইরের জগৎটাকে রাতের স্নিগ্ধতায় খোঁজার চেষ্টা করছিলাম, তেমনই আমার আর এক বন্ধু তার অফিসের রিভলভিং চেয়ার আর ফাইলের স্তূপের থেকে মুখ বাড়িয়ে হয়তো সঙ্গীতের দুনিয়ার সন্ধান করছিল সেই একই রাতে। আমার এই অচেনা বন্ধুর আর আমার সময় আলাদা, স্থান আলাদা, আমাদের জগৎ আলাদা। তবুও আমরা একই আকাশের নীচে, একাকিত্বের পরিবেশে (যেখানে আর কেউ আমার নিজের চাওয়াগুলোর ওপর কর বসাচ্ছে না), নিজের মনের মতো কিছুর সন্ধানে একনিষ্ঠ ভাবে এগোচ্ছিলাম। তাই আমরা হয়েছিলাম সেই রাতে একেবারে এক বয়সের, এক মানসিকতার, একই যাত্রার দোসর। তাই শুধু ‘আজকালকার’ বললেই হবে না। প্রজন্ম ছাড়িয়ে ভাবতে হবে।
কীভাবে সব বদলে যায়, তাও দেখলাম। ভেবেছিলাম, রাত জাগার মধ্যে জটিলতা নেই। পরে বুঝলাম, শুধুই জটিলতা থেকে পালানোর জন্য একটা রাত জাগা, আর একটা দিনের বেলা বিছানায় ঘুমের মধ্যে কাটিয়ে দেওয়া। আসলে বুঝেছি, এই রাতটাই শুধু আমার। এটা আমার সময়, একান্ত আমি আছি আর একটা স্নিগ্ধতা রয়েছে, যে প্রশান্তি আমার ভয়, আনন্দ, ঘৃণা, দুঃখগুলো এক জায়গায় গচ্ছিত রাখবে, গোপনে। এই একটাই সময়, যখন মনে হয়, কেউ আমার কাছে প্রত্যাশা নিয়ে আসছে না, কারও কাছে কিছু প্রমাণ করার নেই আমার। এই সময়টায় আমার হেরে যাওয়ায় কেউ হাসবে না, জিতলেও বাহবা দেবে না।
তার মানে, আমার দিনের বেলাটা আমাকে বড্ড দমবন্ধ করে তুলেছে। রাতের ওই কয়েকটা ঘণ্টা আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছে। দিনের বেলায় সবাই তেড়ে আসছে। আমি প্রশ্ন করতে পারছি না। কঠিন কিছু দেওয়াল দিনের বেলায় আলোটাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। সেই দিনের বেলার ঘাম নিয়ে তাই রাতে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছি। সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার অনেক অনেক সময় বাকি আছে, তবে একটা কথা ভীষণ স্পষ্ট, আমাদের দিনেরবেলাগুলো আরও সহজ করে তুলতে হবে। শুধু নিজের জন্য নয়, অন্য অনেকের জন্যও। কারণ আমার দিনের বেলার মেজাজ আর একজনের রাতকে হয়তো অশান্ত করে তুলছে।
বাবা-মায়েরা সহজেই বলে দিচ্ছে, আমার ছেলে বা মেয়ে বেশ আছে। আর একবার ভাবতে হবে, এটা বলার আগে। আপনার সেই ছেলে/মেয়ে দিনের বেলা ভাল থাকার অভিনয় করছে হয়তো শুধুই। কিন্তু যখন রাতে আপনি ঘুমিয়ে পড়ছেন, সে অন্ধকার বাড়িতে একা হাঁটছে, বা ফ্ল্যাটের জানলায় বসেই আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারণ তখন অভিনয়ের প্রয়োজন শেষ। তখন যে রাত।