They said, ‘We don’t serve niggers here,’ I said, ‘That’s okay, I don’t eat ‘em.’ But they put me out in the street. So, I went down to the river, the Ohio River, and threw my gold medal in it.”
— মুহম্মদ আলির আত্মজীবনী ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ থেকে।
একটা নদীর তলায় একটা সোনার মেডেল পড়ে যাওয়া, একটা উত্তোলিত মুষ্টি, একটা নোয়ানো মাথা, পুরুষদের পাশে একজন নারীর দৌড়— এবং আরও সাম্প্রতিক কালে— জাতীয় সঙ্গীতের সময় এক-হাঁটু গেড়ে বসে থাকা: খেলার স্টেডিয়াম থেকে শুরু হয়ে এই প্রতিবাদগুলোর তরঙ্গ বিভিন্ন দেশ, কাল ও সম্প্রদায়কে কাঁপিয়ে দিয়েছে।
কেন কিছু কিছু খেলোয়াড় এই কাজ করেন? এগুলো কি স্বতঃস্ফূর্ত, না কি অনেক ভেবেচিন্তে প্রতিরোধের চিহ্ন হিসেবেই এগুলো ব্যবহার করা হয়? বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে খেলোয়াড়রা যত প্রতিবাদ জানিয়েছেন, অন্য সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে জানাননি কেন? এবং সবচেয়ে জরুরি: যাঁরা ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, তাঁদের তারপর কী হয়েছে? সম্প্রতি, ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের সময়, প্রতিবাদ আবার খেলার জগতে ঢুকে পড়েছে, কারণ বহু খেলোয়াড় এক-হাঁটু গেড়ে বসে, বর্ণবৈষম্যের শিকার হওয়া মানুষদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছেন। জাতীয় সঙ্গীতের সময় মাথা নুইয়ে একটি হাঁটু গেড়ে বসে থাকার কাজটা কি খেলোয়াড়দের মধ্যে এই উপলব্ধি ফিরিয়ে আনল যে, তাঁরা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল ঘটাতে পারেন? হয়তো কোভিড-অতিমারী চলে যাওয়ার পরে, উত্তরগুলো স্পষ্ট হবে।
প্রাক্তন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্ট বোলার মাইকেল হোল্ডিং ক্যামেরার সামনেই ভেঙে পড়েছিলেন, কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যেও যে-বর্ণবৈষম্য চলে, তা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে। ওই মুহূর্তটা বুঝিয়ে দিয়েছিল, কেন খেলার জগতের কিংবদন্তিরা প্রতিবাদ করাটাকে জরুরি মনে করেন। ওই প্রতিবাদগুলোয় স্পষ্ট হয়, এত বড় মানুষদেরও কতখানি অবিচার ও প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে সাফল্য পেতে হয়েছে। যে-পরিস্থিতি থেকে এই বৈষম্য জন্ম নেয়, সেই এঁদো জলা থেকে যখন কোনও খেলোয়াড় উঠে আসেন, তাঁর মনে ক্ষতচিহ্ন থাকে— একটা খোলা ক্ষত— যা জ্বলে, পোড়ে, এবং প্রায়ই বিষিয়ে ওঠে, এমনকী যখন তাঁর বিশ্বজোড়া নাম, তখনও।
কখনও, সময়ের দাবিতে কোনও খেলোয়াড় এমন একটা প্রতিবাদ করতে বাধ্য হন, যা করার সময় তিনি জানেনই, তাঁর কেরিয়ার এবং জীবন ধ্বংস হয়ে গেল। এখন অনেকেই ভুলে গেছেন ভেরা কাসলাভস্কা-র কথা, যিনি আগেকার চেকোস্লোভাকিয়ার জিমন্যাস্ট ছিলেন। যখন ১৯৬৮-র মেক্সিকো অলিম্পিকে তিনি এলেন, তখন তিনি মহাতারকা, কারণ সেই সময়ে তাঁর চেয়ে বেশি অলিম্পিক স্বর্ণপদক পৃথিবীতে আর কারও ছিল না। কিন্তু তাঁর শ্রী ও সৌষ্ঠবের আড়ালে তিনি একটা বেদনার কাহিনি লুকিয়ে এনেছিলেন। এই অলিম্পিকের মাত্র দু’মাস আগে চেকোস্লোভাকিয়া-কে অধিকার করে নিয়েছিল সোভিয়েত বাহিনী, এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্য গোপনে জোট বেঁধেছিলেন যাঁরা, কাসলাভস্কা ছিলেন তাঁদের একজন।
তাঁর দুটো ইভেন্টের একটায় ভেরা স্বর্ণপদক পেলেন না বিচারকদের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের জন্য, অন্যটায় সোনা ভাগ করে নিতে হল এক সোভিয়েত প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে। পুরস্কার নিতে পোডিয়ামে উঠে, উনি একটাই কাজ করেছিলেন। যখন সোভিয়েত জাতীয় সঙ্গীত বাজছিল, তিনি নিজের পতাকার দিক থেকে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। চেক চ্যাম্পিয়নের প্রতিবাদটির অনন্য ভঙ্গিমায় লালিত্য ছিল, আবার তার বার্তাটাও পৌঁছে গিয়েছিল গোটা পৃথিবীতে। এর মাশুল অবশ্যই দিতে হয়েছিল, তাঁর কেরিয়ার সেই মুহূর্তে শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাঁকে পরের কুড়ি বছর কোচিং করতেও দেওয়া হয়নি, বেঁচে থাকার জন্য তিনি ঝাড়পোঁছের কাজ করতেন। কিন্তু এও ঠিক, তাঁর সঙ্গে যে সোভিয়েত প্রতিযোগী সেদিন স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন, তাঁর নামটা আমার মনে নেই, আর গুগল করতেও ভাল লাগছে না।
ওই অলিম্পিকের আরও বিখ্যাত প্রতিবাদ ছিল: ২০০ মিটার দৌড়ের পুরস্কার নিতে উঠে আমেরিকার টমি স্মিথ (সোনা পেয়েছিলেন) এবং জন কার্লোস-এর (ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন) হাত তুলে মুঠো করে কুর্নিশ, কৃষ্ণাঙ্গ শক্তির মহিমা বোঝাতে। আগের দশকটায় বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে অনেকগুলো প্রতিবাদ হয়েছিল, এ স্যালুট ছিল তারই প্রতিফলন। প্রতিবাদের জল অনেক দূর গড়িয়েছিল, বিশেষত আমেরিকায়। এরও মাশুল দিতে হয়েছিল, দুজনকেই অলিম্পিক ভিলেজ থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের পরিবারের দিকে ধেয়ে এসেছিল প্রচুর হুমকি, আর টাইম ম্যাগাজিন তাঁদের প্রতিবাদ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে, অলিম্পিকের ‘সিটিয়াস অল্টিয়াস ফর্টিয়াস’ (‘আরও দ্রুত, আরও উঁচু, আরও শক্তিশালী’) মোটো-র আদলে লিখেছিল ‘অ্যাংগ্রিয়ার, ন্যাস্টিয়ার, আগলিয়ার’ (আরও রাগি, আরও নোংরা, আরও কুৎসিত)। যদিও সেজন্য টাইম আজও লজ্জিত হয়ে আছে। কিন্তু টাইম, থুড়ি, সময় তখন এমনই ছিল, রৌপ্যপদকজয়ী অস্ট্রেলিয়ার পিটার নরম্যান এই প্রতিবাদকে সমর্থন করেছিলেন বলে, তাঁকে আর কখনও তাঁর দেশের হয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। এমনকী ৩২ বছর বাদে, ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকে, মশাল-অনুষ্ঠানে বা অন্য কোনও উদযাপনের সময় তাঁকে ডাকা হয়নি। অবশ্য তার কয়েক বছর পরে, ২০০৬ সালে, পিটারের অন্ত্যেষ্টিতে, টমি ও জন তাঁর কফিন বহন করেছিলেন।
ক্যাথরিন সুইটজারের প্রতিবাদের উপসংহারটা অবশ্য নিষ্ঠুর নয়। এই দূরপাল্লার মহিলা-দৌড়কুশলী ঠিক করলেন, তিনি শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য অনুষ্ঠিত যে বোস্টন ম্যারাথন, তাতে অংশ নেবেন। উনি দৌড়চ্ছিলেন ওঁর কোচের সঙ্গে, আর ওঁর বয়ফ্রেন্ডও (একজন স্বাস্থ্যবান হ্যামার-থ্রোয়ার) পাশে ছিলেন। দৌড়ের একজন কর্তাব্যক্তি, জক সেম্পল, চেষ্টা করছিলেন ক্যাথরিনের গেঞ্জি থেকে তাঁর রেস নম্বরটা ছিঁড়ে নিতে। একটা সময় তো এমন কাণ্ড হল, মনে হল ক্যাথরিন দুটো রেসে দৌড়চ্ছেন— ম্যারাথনটাও দৌড়চ্ছেন, আবার সেম্পলের হাত এড়াতেও দৌড়চ্ছেন! সৌভাগ্যক্রমে, আস্তে আস্তে খেলাটা ঠিকঠাক ট্র্যাকে ফিরে এল, লোকজনের সুবুদ্ধির উদয় হল, কয়েক বছর পর ক্যাথরিন নিউ ইয়র্ক ম্যারাথন জিতলেন, এবং সেই জয়কে কেউ অবৈধ ঘোষণা করার ঔদ্ধত্য দেখাল না।
প্রতিবাদী খেলোয়াড় নিয়ে কোনও প্রবন্ধই মুহম্মদ আলিকে বাদ দিয়ে লেখা যায় না। উনি কেরিয়ারের একদম গোড়া থেকে বর্ণভিত্তিক অবিচারের প্রতিবাদ করেছেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগ দিতে অস্বীকার করেছেন, এবং সুযোগ পেলেই, মার্কিন সমাজ ও খ্রিস্টান ধর্মে নিহিত বর্ণবৈষম্যকে বেআব্রু করেছেন। আলি পরিবর্তন চেয়েছিলেন, এবং হ্যাঁ, এখানেও মাশুল দিতে হয়েছে, তাঁকে কোনওদিন ইউএস বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি, এবং ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ আমেরিকার কোনও রাজ্যে বক্সিং লাইসেন্স দেওযা হয়নি, যে সময়টা উনি দক্ষতার তুঙ্গে ছিলেন। কিন্তু আলি আলিই। তিনি হাল ছাড়েননি, এবং পৃথিবীর প্রথম প্রকৃত সর্বজনীন ক্রীড়া-তারকা হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর জাদু ছড়িয়ে পড়েছিল আটলান্টা থেকে ম্যানিলা, নিউ ইয়র্ক থেকে কিনশাসা। ১৯৯৬ সালে, আটলান্টা অলিম্পিকে আলি যখন মশাল জ্বালালেন, তা অলিম্পিকের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থেকে গেল।
এখন প্রতিবাদ জানানো হয় টুইটারে, আর সে-প্রতিবাদের সমর্থন এবং নিন্দেমন্দও তক্ষুনি নথিবদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু খেলার মাঠে প্রতিবাদ আর এই প্রতিবাদের তফাত হল: মন্তব্য করা আর কাজ করার মধ্যে যে-তফাত। খেলার মাঠকে ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা আর সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করার মধ্যে যে-তফাত। সেই জন্যই ন্যাশনাল ফুটবল লিগের একজন কোয়ার্টার-ব্যাক— কলিন কেপারনিক— একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। ২০১৬ সালে জাতীয় সঙ্গীতের সময় এক-হাঁটু মুড়ে বসে বর্ণবৈষম্যের প্রতিবাদ জানানোর যে-রেওয়াজ তিনি শুরু করেন, তা ক্রমেই ছড়িয়ে যায়। যত ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে থাকে, তত এই প্রতিবাদ বাড়তে থাকে। ২০২০-তে, জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার পর সারা পৃথিবী জুড়ে খেলোয়াড়রা ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের স্বরে গলা মেলান। এখন সব প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচের শুরুতেই খেলোয়াড়রা এভাবে প্রতিবাদ জানান। আচ্ছা, এতে কি সত্যি কোনও কাজ হয়? বলা শক্ত, কিন্তু যাঁরা খেলোয়াড় হতে চান, তাঁদের কাছে নিশ্চয় একটা বার্তা যায়— তেমাকে চেষ্টা করতে হবে, বদলাবার এবং মূর্তিমান বদল হয়ে ওঠার। ‘বি দ্য চেঞ্জ।’
যা থেকে মনে পড়ে যেতে পারে ভারতের কথা, যা অহিংসা ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের জন্মস্থান। যেখানে চিপকো আন্দোলন থেকে পথনাটক— কত ধরনের প্রতিবাদ লাগাতার ঘটতে থাকে, অথচ স্টেডিয়াম বা খেলার মাঠে সবাই চলে নিয়মমতে, কেউ একবারও স্থিতাবস্থাকে নাড়াঘাঁটার সাহস দেখায় না। আমাদের একটি পুরনো গ্রন্থ অনুযায়ী, একটি বালক এক গুরুর শিক্ষালয়ে ভর্তি হয়নি, কিন্তু তাঁর প্রদর্শিত পথেই সবকিছু শিখে নিচ্ছিল, তাই গুরু ছেলেটিকে আদেশ দেন, ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে দিয়ে এই জ্ঞানের মাশুল চোকাতে। সেই গুরুর নামে এখন এই দেশের সর্বোচ্চ কোচিং পুরস্কার দেওয়া হয়— দ্রোণাচার্য পুরস্কার। এই দেশে সামাজিক ন্যায় আর খেলাধুলো যে হাত-ধরাধরি করে চলবে না, তাতে আশ্চর্য কী?