ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • লকডাউন আর বুড়ো আয়না

    গুলজার (April 9, 2021)
     

    বড় আশ্চর্য সময় চলেছে এখন। দুঃসময়ও বলা যায়, শূন্য— মানে ফাঁকা সময়ও বলা যায়। যে সময় ঠাসা নয় নানা চাহিদা দিয়ে, কাজ দিয়ে, অকাজ দিয়ে। নাড়াচাড়ার করার মতো অনেকটা সময় হাতে আছে বটে। কিন্তু হেলায় ফেলেও রেখে দিয়েছি অনেক সময়। 

    কোভিডের জন্য যে সময়টা পেলাম, সেটাকে সত্যি খুব ভাল করে ব্যবহার করা উচিত ছিল। জ্বালানোর কেউ ছিল না। ছিল না কোনও আবদার, অনুরোধ, উৎপাত। কিন্তু পারলাম কই তেমন করে ঘষে, মেজে সময়কে তকতকে পালিশ করে ব্যবহার করতে? সারা পৃথিবী থেকে বিছিন্ন হয়ে সময় নিয়ে যে বিশেষ কিছু করতে পারব না, সেটা প্রথম দিকে বুঝিনি।

    কোভিড আমায় প্রথম খুব গভীর ভাবে নাড়া দিল, যখন দেখলাম পরিযায়ী শ্রমিক, দিনমজুর, সবাই দলে দলে নিজেদের গ্রামের দিকে চলল। খালি পায়ে, ঘুমন্ত বাচ্চাকে কোলে নিয়ে, বুড়ি মা’কে পিঠে চাপিয়ে, বস্তায় বেঁধে শহুরে জীবনকে পায়ে করে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকল গ্রামের দিকে। কতজন তো পথেই মারা গেল, কত মানুষ খেতে পেল না, কত শিশু কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল বুকে কষ্ট আর অবিশ্বাস নিয়ে। আমার মনে পড়ে গেল ছোটবেলার কথা। ১৯৪৭-এর সেই দিনগুলো, যখন সীমানা পেরিয়ে জীবন হাতে করে দলে দলে, লাখে লাখে মানুষ আশ্রয়ের জন্য ছুটছিল। সেই যন্ত্রণা, সেই অনিশ্চয়তা— সব যেন একটা বৃত্ত ঘুরে ফের চলে এল আমার সামনে। ফারাক একটাই, আমরা তখন গ্রাম থেকে শহরমুখো হয়েছিলাম, আর এখন সবাই শহর থেকে গ্রামের দিকে চলেছে। 

    আমার মনে পড়ে গেল ছোটবেলার কথা। ১৯৪৭-এর সেই দিনগুলো, যখন সীমানা পেরিয়ে জীবন হাতে করে দলে দলে, লাখে লাখে মানুষ আশ্রয়ের জন্য ছুটছিল। সেই যন্ত্রণা, সেই অনিশ্চয়তা— সব যেন একটা বৃত্ত ঘুরে ফের চলে এল আমার সামনে। ফারাক একটাই, আমরা তখন গ্রাম থেকে শহরমুখো হয়েছিলাম, আর এখন সবাই শহর থেকে গ্রামের দিকে চলেছে। 

    তবে, কোভিডের পুরো সময়টাই কি আর কেবল ভেবে ভেবে কাটিয়ে দেওয়া গিয়েছে? একেবারেই নয়। রীতিমতো কঠিন সব কাজ শিখতে হয়েছে। যেমন আই-ম্যাক বলে একটি অ্যাপল কম্পিউটারকে বাগে আনতে হয়েছে। এমনিতে সে যে খুব ভালমানুষ, তা নয়। তবে আমার ১১ বছরের কঠোর অভিভাবক, আমার নাতি, কম্পিউটারটাকে এবং আমাকে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে রাখতে পেরেছে। সে-ই আমাকে জুম কল, গুগল ডুয়ো, গুগল মিট ইত্যাদি শিখিয়েছে। এবং আমি তা ঠিকঠাক জায়গা-মতো ব্যবহার করে কেল্লা ফতে করছি। কিন্তু সব জিনিসই তো আর আই-ম্যাক নয় এবং ১১ বছরের কিশোরের আয়ত্তে নয়। সুতরাং পরের জিনিসটি যা শিখতে হল, তা আই-ম্যাক আবিষ্কারেরও বহু আগে আমার শেখা উচিত ছিল, এত বয়সে এসে নয়। তা হল, দাড়ি কামানো। চিরকাল নাপিত আমার দাড়ি কামিয়ে দিয়েছে। বিদেশ গেলে আমার দাড়ি বেড়ে যেত, আমি দেশে ফিরে চেনা নাপিতের কাছে কামিয়ে নিতাম। কিন্তু কোভিড আসায় ভারি বিড়ম্বনা হল। গত ৭৫ বছর যা করিনি, যা আমায় দিয়ে কেউ করাতে পারেনি, কোভিড তা করিয়ে নিল। আর সবচেয়ে কঠিন হল, গোঁফজোড়াটি দুইদিকে ঠিকঠাক রেখে দাড়ি কামানো। চোখ-টোখ কুঁচকে যখন আয়নার সামনে দাড়ি কামানোর মহাযজ্ঞটি করতাম, আয়নাও খানিক তামাশা করত। বলত, ‘অ্যাই বুড়োটা, এত কায়দা করতে হবে না। চামড়া ঝুলে গেছে, চুল পাকা, শরীর নুয়ে পড়েছে, আবার কেমন দেখাচ্ছে সেই নিয়ে ভাবনা।’ আমি কিছু মনে করিনি তাতে। ওরই বা কী দোষ? আমার সঙ্গেই এত বছর থেকেছে, বয়স হয়েছে তো। ওরই নজর কমজোরি হয়ে গিয়েছে। অবশ্য এসব কারণেই  আমার সঙ্গে আয়নার কখনওই সম্পর্ক ভাল নয়। কখনও হয়তো বা বলত, ‘খুব হল বাইরে বেরোনো, টেনিস খেলা, সারা দিন মেতে থাকা অন্য সব কিছু নিয়ে। এখন তো এত সময় পেয়েছ। হাতের কাজগুলো সারো। কত বাকি লেখার, কত বই পড়া বাকি!’ তা মন্দ বলেনি। কিন্তু ওকে তো আমি বোঝাতে পারিনি যে আমি একলা-সময় চেয়েছিলাম, বিচ্ছিন্ন হতে চাইনি। বিচ্ছিন্ন থেকে জীবনের রসদ পাওয়া যায় না। আর জীবনের রসদ না পেলে কলমের ডগায় অক্ষর এসে বসে না। জীবনের সঙ্গে অক্ষরের যে একটা গভীর যোগ রয়েছে। 

    কিছু করিনি, কিছু পড়িনি, কিছু লিখিনি বললে ভুল হবে। কোভিডের নানা রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে কবিতা লিখেছি। দশ-দশটা নজরুলগীতি অনুবাদ করেছি। আর এখন তো লালন সাঁই আমার ওপর ভর করেছেন। তাই তাঁকে নিয়ে চলছে অনুসন্ধান। ইচ্ছে আছে, তাঁর লেখা অনুবাদ করব। তবে আগে যে মাসে দু’এক বার বাড়ি থেকে বেরোতাম, কখনও দিল্লি যেতাম, কখনও অন্য কোথাও— সেসব উঠে গিয়ে মানুষের মুখ দেখাই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেটা মোটে ভাল লাগে না। বয়স হয়েছে বলে তো আর মুক্তির দরজা কেউ বন্ধ করে দিতে পারে না। কিন্তু এই কোভিড এসে এমন ভাবে জীবন উল্টেপাল্টে দিল যে, নতুন নিয়মে জীবন সাজিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। 

    আমার বিশ্বাস, জীবন এমন ভাবে চলবে না। ঘুরে দাঁড়াবে, সহজ হবে। আমাদের চেনা অভিযোগ ফিরে আসবে। ততদিন বুড়ো আয়নাটাকে গালমন্দ করে কাটাই, আর কী! 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook