বাজার করার অভিজ্ঞতা দিয়ে এই লেখার সিরিজটি শুরু করেছিলাম, তাতে বাঙালির খাওয়া-দাওয়ার ইতিহাসে বাজার-সংস্কৃতি কীভাবে হইহই করে ঢুকে পড়েছে, তার বর্ণনাও ছিল। তবে এ কথাও সত্যি যে, বাঙালির ইতিহাসে বাহুল্যবর্জিত আহারের কথাই বারবার পাওয়া যায়, যে আহারে আয়োজনের চেয়ে তৃপ্তির মূল্য অনেক বেশি। প্রাণকৃষ্ণ দত্তের ‘কলিকাতার ইতিবৃত্ত’ বইটিতে পুরনো কলকাতা তথা বাংলার যে সমাজচিত্র পাওয়া যায়, তাতে দুটি ব্যাপার স্পষ্ট। প্রথমত, সাধারণ বাঙালির মধ্যে খাওয়া-দাওয়া নিয়ে খুব বেশি বাড়াবাড়ি নেই, বস্তুত আহার্যের মধ্যে শিল্পসুষমা ও সুরুচির অনুষঙ্গটি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত— বরং সমাজজীবনের দৈনন্দিনতার মধ্যেই তার প্রায় অলক্ষ্য উপস্থিতি। এমন ব্যবস্থায় বাজার-নির্ভরতার কোনও জায়গা নেই, আর সত্যিই তো, ‘উঠানে মরাই-বাঁধা ধান, বাগানে ফলমূল, তরিতরকারি, পুষ্কর্ণী বিলে অপর্যাপ্ত মৎস্য থাকিতে [গৃহস্থ] বাজার যাইবেন কেন?’ দ্বিতীয়ত, আয়োজনের বাহুল্যবর্জন, অনাড়ম্বর সারল্যের মধ্যে তৃপ্তির সন্ধান। গরিবের কথা বলাই বাহুল্য, প্রাণকৃষ্ণ বলেছেন যে সেই সস্তার বাজারেও তাঁদের বেশির ভাগ সময়েই ভাত জুটত না, ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য ফুটিয়ে নিতে হত কলমি, হিঞ্চে, বা সজনে শাক। ‘এক ছড়া তেঁতুল, একটা লঙ্কা ও লবণ হইলে আর কিছুর আবশ্যক অনেকের থাকিত না’। অবাক লাগে না যে, এই সমাজ থেকেই মহাপণ্ডিত রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত বা ‘বুনো রামনাথ’ আঠারো শতকে নবদ্বীপের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে (মতান্তরে তস্য পুত্র শিবচন্দ্রকে) জানিয়েছিলেন, ব্রাহ্মণীর হাতের রান্না উপাদেয় তেঁতুলপাতার ঝোল খেয়ে তাঁর তৃপ্তির কথা।
কিন্তু এ তো গেল নিতান্ত গরিবের কথা। মধ্যবিত্তের জীবনচর্যার দিনলিপিতেও সাধারণ খাদ্যাভ্যাসেরই বিবরণ। প্রাণকৃষ্ণ জানিয়েছেন যে, তাঁর মা’র মামার বিবাহে নাকি সাতদিন ধরে লোক খাওয়ানো হয়েছিল, আর সেই সপ্তাহব্যাপী ভোজের ‘হাইলাইট’ ছিল একদিন দু’রকম ডালের ‘দেওড়’, অর্থাৎ দু’বার পরিবেশন। আরেক বিয়েতে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ দই-চিঁড়ের বদলে লুচি আর চিনি দিয়ে তাঁদের আপ্যায়ন করা হচ্ছে দেখে বরযাত্রীদের মধ্যে পড়ে গেছিল আনন্দের হুল্লোড়। উনিশ শতকে বাঙালি ভদ্রলোকের গার্হস্থ্য সংস্কৃতির শীলিত সুষমার পরিমণ্ডলেও সাধারণের মধ্যে তৃপ্তির অন্বেষণের এই প্রবণতাটি পুরোপুরি লোপ পায়নি। মানদা দেবীর দিনলিপিতে বর্ণিত তাঁর খুড়তুতো বোনের সঙ্গে তাঁর ভাবী শ্বশুরের কথোপকথনের কথা আগেই বলেছি।
পরিমিতি ও আড়ম্বরহীনতার এই পরিমণ্ডলে ভোজনবীরদের কথা যে মাঝেমধ্যে আসেনি তা নয়। বস্তুত প্রাণকৃষ্ণ উনিশ শতকে ‘কলিকাতার ইতিবৃত্ত’ লিখতে বসেও তাঁর বিগত প্রজন্মদের ঢালাও সার্টিফিকেট দিয়েছেন এই বলে যে ‘এখনকার অপেক্ষা তাঁহারা অধিক আহার করিতেন’। এক ‘কুনকে’ চালের কমে ‘সাধারণ ভদ্রলোকের’ ক্ষুন্নিবৃত্তি হতই না, আর রাজা-জমিদারদের মধ্যে বিস্তর বহুভোজী ছিলেন যাঁরা অনায়াসে শেষ করতেন একটা গোটা কাঁঠাল বা ‘একটি বৃহৎ ছাগলের মাংস’। পৌষপার্বণের সময় বড় বড় আস্কে পিঠে আর সিদ্ধ পিঠে যখন তাঁরা চিবিয়ে খেতেন, ‘তখন তাঁহাদের মুখভঙ্গিমা দেখিয়া ছোট ছোট ছেলেরা ভয়ে কাঁদিয়া উঠিত’। কালীপ্রসন্ন সিংহও তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় ‘মুন্কে রঘু’ নামে এক ভোজনবীরের কথা উল্লেখ করেছেন, যিনি ছিলেন নদীয়ার উলা বীরনগর গ্রামের ব্রাহ্মণসন্তান রঘুনাথ ভট্টাচার্য, ইচ্ছে করলে একবারে এক মণ খাবার উদরস্থ করতে পারতেন, তাই নাম হয়েছিল ‘মুন্কে’। অসাধারণ ভোজনক্ষমতার স্বীকৃতি হিসেবে কয়েকশো বিঘা নিষ্কর ব্রহ্মোত্তর জমি তিনি দান পেয়েছিলেন নদীয়ার রাজা সেই কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকেই, যিনি রামনাথ তর্কসিদ্ধান্তের রসনারুচিকে তেঁতুলপাতার ঝোলের উপরে ওঠাতে পারেননি। আমরা আরও জানি, ‘আধমণি কৈলেস’ নামে পরবর্তী কালের আর এক ব্রাহ্মণের কথা, যিনি লুচি- তরকারি-দই-মিষ্টি মিলে অনায়াসে উদরসাৎ করতে পারতেন প্রায় আধ মণ খাবার। এই সেই সময়, যখন অমানুষিক ভোজনক্ষমতা বিশেষ কৃতিত্বরূপে গণ্য হত, এবং কোনও ধনী বাড়ির ক্রিয়াকর্মে এই ধরনের ঔদরিকরা সসম্মানে নিমন্ত্রিত হতেন।
তবে মনে রাখা দরকার যে প্রাক্-ঔপনিবেশিক বাংলার খাদ্যাভ্যাসের যে ছবিটি এই বিবরণগুলি থেকে ফুটে ওঠে, তাতে খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে শৈল্পিক পরিশীলন ব্যাপারটি তত ওতপ্রোত নয়। সাধারণ মানুষ বাজারের উপর নির্ভরশীল নন, পল্লীপ্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এক কৌমনির্ভর যৌথজীবন থেকেই তাঁরা সংগ্রহ করছেন ক্ষুন্নিবৃত্তির রসদ, অল্প আয়াসেই সম্ভব হচ্ছে ক্ষুন্নিবৃত্তি এবং চিত্তসন্তোষ, কিছু কিছু ভোজনবীরদের নিয়ে তৈরি হচ্ছে কিংবদন্তি— এই অনুষঙ্গগুলিকেই আমরা বারবার ঘুরে-ফিরে আসতে দেখি। রন্ধনবিদ্যা ও খাদ্যাভ্যাস তখনও শিল্প বা ‘আর্ট’ হয়ে ওঠেনি, রুচির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বাছবিচারের সোফিস্টিকেশন সে তখনও অর্জন করেনি। এমন বলা ভুল হবে না যে, পাকশালার সংস্কৃতির সঙ্গে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের সম্পর্কসূত্রটি এ সময়ে গড়ে ওঠেনি, তার ইতিহাস তখনও দূরায়ত। এমনকী মুন্কে রঘু বা আধমণি কৈলাসদের ঔদরিকতার উপাখ্যানেও মুখ্য উপাদানটি দৃশ্যবিলাস বা spectacle-এর, আতিশয্যকে বারোয়ারি বিস্ময় বা আনন্দের উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের, ‘কৃতিত্বের’ পুরস্কার হিসেবে পৃষ্ঠপোষকের অনুগ্রহ বিতরণের।
এর বিপরীতে অবশ্য ক্ষমতাবানের শারীরিক শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন হিসেবে ভোজন-বীরত্বের প্রদর্শনী সাজানোর চেষ্টাও আমাদের ইতিহাসে বিলক্ষণ আছে, যার এক মারাত্মক নমুনা আমরা দেখেছি ঔপনিবেশিক বাংলার শ্বেতাঙ্গ চটকল-মালিকদের আহারের আয়োজনে। ঐতিহাসিক দীপেশ চক্রবর্তীর বইয়ে আমরা পড়ি যে, নিম্নতন শ্রমিকদের উপর তাদের কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৮৯০-এর দশকে ঔপনিবেশিক বাংলার চটকলগুলির, সাধারণত স্কটিশ ম্যানেজারদের সামগ্রিক জীবনচর্যাই হয়ে উঠেছিল ক্ষমতার এক মুক্তকচ্ছ প্রদর্শনী, আর দৈনন্দিন খাওয়া-দাওয়ার ভূমিকা সেখানে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে প্রত্যুষে কিছু টোস্ট, গোটাকয়েক ডিম, এবং চা সহযোগে ‘ছোটা হাজরি’ বা খুচরো প্রাতরাশ সারার পরেও আসল ব্রেকফাস্টের সময় সাহেব ম্যানেজারদের টেবিলে হাজির থাকত ‘fish, stewed steak and onions, eggs, curried fowl and rice, with the usual addednda of tea or coffee, with bread, butter and jam.’ কেউ কেউ আবার তার পরেও দু’এক পেগ হুইস্কি-সোডা সাবড়ে দিতেন। শরীর বা শারীরিক সক্ষমতার সঙ্গে উপনিবেশবাদের গভীর সম্পর্ক নিয়ে আরেক ঐতিহাসিক এলিজাবেথ কলিংহ্যামের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাও এই প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য। কলিংহ্যাম দেখিয়েছেন কীভাবে শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক শাসকদের ডাইনিং টেবিল হয়ে উঠেছিল কখনও অতি-আমিষাহারের মাধ্যমে শাসকশ্রেণীর শারীরিক সক্ষমতার আস্ফালনের, আবার ক্ষেত্রান্তরে পরিশীলিত ব্রিটিশ আভিজাত্য প্রদর্শনের প্রকরণ।
ভোজনক্ষমতার সঙ্গে বাহুবল বা শারীরিক সক্ষমতার সম্পর্কটির রূপরেখা তার আগে অবশ্য স্পষ্ট ভাবে গড়ে ওঠেনি। অন্য ভাবে বলতে গেলে, ঔপনিবেশিক আমলে শারীরিক সক্ষমতাকে কেন্দ্র করে শাসক ও শাসিতের মধ্যে সবল / দুর্বল অথবা পৌরুষ / নারীত্বের নতুন বিভাজন রচিত হবে, যে বিভাজনের প্রক্রিয়ায় অনিবার্য ভাবে জায়গা করে নেবে খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাসের আলোচনা। কিন্তু তার রূপরেখাটি যেহেতু মুন্কে রঘু বা আধমণি কৈলাসদের সময়ে দৃশ্যমান নয়, তাই সে অর্থে এই অসাধারণ ভোজনবীরদের ‘কৃতিত্বের’ কোনও রাজনৈতিক তাৎপর্য নেই, উপনিবেশের শাসিত গোষ্ঠীদের শারীরিক প্রতিস্পর্ধার প্রতীক হিসেবে তাঁদের গণ্য করা যায় না। তাঁদের ক্ষমতায় চমৎকৃত হতে হলেও সে চমৎকারিত্ব প্রাক্-আধুনিক, তাই প্রাক্-রাজনৈতিকও বটে। সেই রাজনীতি তৈরি হবে তখনই, যখন ব্রিটিশ রাজপুরুষরা ‘ভেতো’ বাঙালিকে পেটরোগা, ভিতু, দুবলা-পাতলা জাতি বলে দুয়ো দিতে আরম্ভ করল, আর সেই অপবাদ ঘোচানোর জন্য বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যে তৈরি হল ‘বাহুবল’ আর মাংসাহারের প্রতি এক ধরনের আসক্তি। প্রেশার-শুগার-অ্যাসিডিটিতে রণক্লান্ত আমরা বাহুবলটায় বিশেষ সুবিধে করতে পারিনি বটে, কিন্তু অন্যটায় এখনও পাঙ্গা নেব যে কোনও কারও সাথে, এখনও।