ওই তিনি আসছেন। গাছের আড়াল থেকে দেখতে পেলাম আমি। তাঁকে ঘিরে পাশে পাশে এগিয়ে আসছেন আরও অনেকেই, কিন্তু তাঁর সেই হেঁটে আসার মধ্যে কোনও ঘোষণা, কোনও জৌলুস নেই। বরং আছে নৈঃশব্দ্যের আভা, সংযমের সঞ্চার। তিনি শঙ্খ ঘোষ। খুব বেশি সভা বা জমায়েতে তো আসেন না তিনি, তাই তাঁর দেখা পাওয়া এক বিরল ঘটনাই বটে। সে ছিল সেই রকমই এক দিন।
সম্ভবত কবিতা উৎসবের সূচনা বা দ্বিতীয় দিন, সালটা মনে নেই, তবে অন্তত দু’দশক পিছিয়ে বটেই। বাংলা আকাদেমির প্রাঙ্গণ সেজে উঠেছে ঝালরে, পোস্টারে। এদিক-ওদিক তরুণ কবিদের জটলায় গমগম করছে গোটা চত্বর। এরই মধ্যে এসেছেন শঙ্খ ঘোষ। একবার দেখেছি তাঁকে, আকাদেমির প্রেক্ষাগৃহে ঢুকতে। তরুণদের পাঠ আছে সন্ধের সভায়, তাঁদের লেখাই শুনতে এসেছেন সামনে থেকে। আমার পাঠের আমন্ত্রণ নেই, কিন্তু বন্ধুরা কবিতা পড়বে, তাই সোৎসাহে আমিও হাজির। তখন দেখলাম, সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন। সেই ওঠাটুকু দেখতে দেখতে, ওঁর সেই ঋজু ভঙ্গিমার হাঁটা দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল সমস্ত কবিতাদের কথা, যারা আমার কাছ অবধি পৌঁছেছে ওঁরই কলম হয়ে। এমন মানুষকে যে দেখতে পাব কখনও, সে-কথা তো কল্পনাতেও ছিল না। আমি উত্তেজনায় তাই আকাদেমির নিচের চত্বরেই অপেক্ষা করছিলাম। সভা ভাঙলে নিশ্চয়ই দেখা পাব আর একবার।
সেটাই হল। নেমে এসে প্রাঙ্গণ ছেড়ে বাইরের দিকে পা বাড়ালেন তিনি, সঙ্গে অনেক মানুষ। আমি একটা গাছের আড়াল থেকে দেখছি। তাঁর ওই বহমান চলা, চলতে থাকা। কেমন অলীক বলে মনে হচ্ছে সব। এমন সময়ে আমার নাম ধরে ডাক শুনতে পেলাম। ‘শ্রীজাত, লুকিয়ে আছ কেন? এদিকে এসো।’ চটক ভাঙতে দেখি, সব্যসাচীদা। কবি সব্যসাচী দেব। শঙ্খ ঘোষের পাশে পাশেই হাঁটছিলেন তিনি, চোখ পড়েছে আমার দিকে। আমাকে বিশেষ কেউ চেনেন না, চেনার কথাও নয়। সব্যসাচীদা চেনেন, কী যেন কী সূত্রে। আমি স্পষ্টই ডাকটা না শোনার ভান করে আরও কিছুটা আড়াল নিলাম। কিন্তু সফল হলাম না। আবার শুনলাম সব্যসাচীদার হাঁক, ‘আরে ভয় পাবার কিছু নেই। এসো, স্যারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।’
ভয়টা এতক্ষণ পাচ্ছিলাম না, এবার পেলাম। ‘স্যার’ মানে সকলেই জানে। বাংলা কবিতায় ‘স্যার’ একজনই। শঙ্খবাবু। শঙ্খ ঘোষ। সব্যসাচীদা তো তাঁর সরাসরি ছাত্র বলেই জানি, কিন্তু যাঁরা কস্মিনকালেও ওঁর একটি ক্লাস করেননি, তাঁরাও নাকি ওঁকে স্যার বলেই ডাকেন। আমি গুনলাম প্রমাদ। শঙ্খ ঘোষকে দেখতে পাওয়ার মধ্যে একরকম অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চ আছে ঠিকই। কিন্তু তাই বলে আলাপ? কেনই বা আমার সঙ্গে আলাপিত হতে যাবেন তিনি, আর আমিই বা ওই মাপের একজন কবির সামনে গিয়ে কী বলব? এসব মাথায় ঘুরছে যখন, সব্যসাচীদা আরও একবার ডাকলেন। ততক্ষণে এই ডাকাডাকির কারণেই থমকে দাঁড়িয়েছেন শঙ্খবাবু। যথারীতি তাঁকে ঘিরে থাকা মৌনমিছিলও স্থাণু। অপেক্ষা চলছে আমারই, যা আমার কাছে আরওই অস্বস্তির। শেষমেশ পাতার আড়াল থেকে বেরিয়ে গুটিগুটি পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম সামনে। সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি আর কোরা শালের গা থেকে যে-আভা ভেসে বেরোচ্ছে, সে-ই যেন নীরবতার রং, স্থৈর্যের গঠন। এমন মনে হল আমার। চোখ তুলে তাকাতেও পারছি না, তাকিয়ে আছি চটি পরা একজোড়া পায়ের দিকে। ‘এত ভয়ের কী আছে? স্যার কি বাঘ না ভাল্লুক?’ সব্যসাচীদা কৌতুক মেশানো বকুনির সুরে কথাটা বললেন। পরক্ষণেই বললেন, ‘স্যার, ও শ্রীজাত। কবিতা লেখে, খুব লাজুক ছেলে।’
সুযোগ পেয়েছি যখন, প্রণামের লোভ ছাড়ব না। পায়ে হাত ঠেকাতেই মাথায় পেলাম ওঁর হাতের স্পর্শ। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতে আমার কাঁধে রাখলেন একখানা হাত। বললেন, ‘তোমার লেখা তো পড়েছি আমি। কখনও বাড়িতে এসো।’ এই বলে অতি মৃদু হাসলেন, তারপর আবার রওনা দিলেন। তখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না কোনও কিছুই। ওঁর দেখা পাওয়া, ওঁর সঙ্গে আলাপ করতে পারা, একদিন আমাকে ওঁর বাড়ি যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো, কোনওটাই সত্যি বলে বিশ্বাস হচ্ছে না। আর সবচাইতে অকল্পনীয় বাক্যটি কানে বেজে চলেছে, ‘তোমার লেখা তো পড়েছি আমি।’ এও সত্যি? আমি তো পাঠক একজন ওঁর সমস্ত লেখার। সেই পাঠকের তুচ্ছ লেখাও পৌঁছেছে ওঁর কাছে, আর তা উনি পড়ে দেখেছেন? অন্য কেউ হলে অবিশ্বাস করেই ফেলতাম, নেহাত শঙ্খ ঘোষ বলে মানতে হল। মিথ্যে উনি বলেন না। বুঝলাম, কয়েক রাতের ঘুম খোয়া গেল।
এই ছিল ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। আজ বুঝি, সেদিন ওই পরিপার্শ্বে সব্যসাচীদা না থাকলে এবং আমাকে গাছের আড়াল থেকে টেনে বার না করলে আমার জীবনটাই অন্যরকম হত। কেননা শেষ দু’দশক কি তার চেয়েও বেশি সময় ধরে, শঙ্খ ঘোষ আমার আশ্রয় হয়ে থেকেছেন। সেসব কথার বিস্তার অনেক, রয়েসয়ে সময় নিয়ে বলা যাবে। শেষ দেখা হল, এই তো ক’দিন আগে, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১। ওঁর ৮৯তম জন্মদিন। শঙ্খবাবুর জন্মদিনে তো কত কত মানুষের ভিড়। চেনা, অল্প চেনা থেকে সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষজনও তাঁদের প্রিয় কবির বাড়িতে হাজিরা দেন, একবার অভিবাদন জানাবেন বলে। পুরনো ছাত্রছাত্রীরা ভিড় করেন প্রতিবার, উৎসব সাজিয়ে নিতে হবে, এই অভিপ্রায়ে। আর আমাদের মতো পাঠকরাও যাই, আড্ডার একপ্রান্তে বসে থাকার অছিলায়। টানা অনেক বছর এইরকমই চলছিল, কিন্তু কবে যেন কে এ-কথা ওঁর কাছে ফাঁস করে দিল যে, আমার গান গাওয়ার বাতিক আছে। সে-গান যে কেমন, সে-কথা অবশ্য তিনি বা তাঁরা বলেননি, কিন্তু তাইতেই শঙ্খবাবুর ভরসা হল যে, আমার গান বুঝি শোনা যায়। সেই শুরু হল দস্তুর। ওঁর জন্মদিনের আসরে একখানা কি দু’খানা গান আমাকে গাইতেই হবে, নইলে ছাড় নেই। যদি-বা কখনও ভিড়ের মুখে রক্ষা পেয়ে না-গেয়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম করেছি, সেই ভিড় থেকেই কেউ একজন বলে উঠেছেন, ‘স্যার, আজ শ্রীজাতর গান হবে না?’ এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে-কণ্ঠস্বর, আবারও, সব্যসাচীদার। সুতরাং, ফের বসে পড়তে হত গলায় গান নিয়ে।
গান আমি শুনি অনেক অনেক, কিন্তু গাইবার মতো করে জানি গুটিকতকই। সেসবই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শোনাতাম। এমনও হয়েছে, পরপর দু’বার জন্মদিনে একই গান গেয়ে ওঠায় ওঁর ছাত্রীরা বলেছেন, ‘হবে না, এটা তো আগের বছর শুনেছি।’ কিন্তু এ-বছর ছবিটা ছিল অন্যরকম। কোভিডের কারণে বড় জমায়েত করা যাবে না। তার ওপর শঙ্খবাবু ও প্রতিমাদি, দুজনেরই শরীর বেশ অসুস্থ। কিন্তু তাই বলে একবারও দেখা করতে পারব না? শেষমেশ স্থির হল, ভাগে ভাগে যাওয়া হবে, পাঁচ-সাতজনের দল বানিয়ে, এবং কোনও দলই আধঘণ্টার বেশি থাকবে না। এতে শঙ্খবাবুর মন খারাপ হয়ে গেলেও, আমাদের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এই বন্দিদশার জীবনে দেখা তো হবে আবার! আর আমি ভাবলাম, এ-যাত্রা ছাড় পাওয়া গেল। একে ভিড় নেই, তায় মুখোশ পরে যাওয়া, গানের প্রশ্নই উঠছে না।
শেষমেশ অবশ্য উঠল। আধঘণ্টা বসে, আড্ডা দিয়ে, জলখাবার খেয়ে যখন উঠছি আমরা, আমার দিকে সকৌতুক তাকিয়ে, মুখোশের আড়াল থেকেই শঙ্খবাবু বলে উঠলেন, ‘কী ব্যাপার শ্রীজাত? করোনায় তো গান গাওয়া বারণ নয়।’ এমন বাক্যের সামনে হার মানা ছাড়া গতি কী। এই শেষবারও আড়াল থেকে আমাকে টেনে বার করলেন উনি। মুখোশ খুলতে হল। গাইতে হল গান। এ-গান আগেও ওঁকে শুনিয়েছি বেশ কয়েকবার। রামপ্রসাদের বাঁধা। ‘মা তোমারে বারেবারে জানাব আর দুঃখ কত / আমি ভাসিতেছি দুঃখনীরে, স্রোতে শ্যাওলার মতো।’ কেন যে হঠাৎ এই গানখানাই মনে পড়ে গেল আমার, জানি না। শেষ করে মুখ তুলে দেখি, তাকিয়ে আছেন আমারই দিকে। এ তো কোনও উপহারের যোগ্যও নয়, তবু যেন গ্রহণ করেছেন সস্নেহে, এমনই সেই দৃষ্টি। বেরিয়ে আসার আগে যখন প্রণাম করছি, তখনও জানি না, এই শেষ প্রণাম। বহু বছর আগের এক প্রণাম যে-বন্ধনী শুরু করেছিল, আজ এই প্রণাম দিয়ে সেই বন্ধনী বন্ধ হচ্ছে। আর এই দুই প্রণামের মধ্যে রাখা থাকছে আমার একজন্মের প্রাপ্তি।
আসার সময়ে বললাম, ‘পয়লা বৈশাখ পার করে একবার আসব, কেমন? ভাল থাকবেন।’ হাসলেন কেবল। তারপর দুর্বল শরীর নিয়েও দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন আমাদের, যা উনি বরাবর করতেন। কেবল ওঁর যাওয়ার সময়ে এগিয়ে দিতে যেতে পারলাম না। দুই প্রণামের বন্ধনীর মধ্যে আটকা পড়ে থাকলাম, নিঃশব্দে।