শান্তিনিকেতনে ইন্দ্রনাথ মজুমদারের বইয়ের দোকান ‘সুবর্ণরেখা’। মামুলি বইয়ের দোকান নয়। ইন্দ্রনাথ মজুমদার আমাদের ইচ্ছেমতো বই ঘাঁটাঘাঁটি করতে উৎসাহ দিতেন। আমরা তখন স্কুল-পড়ুয়া। টাকা না থাকলে বলতেন, ‘নিয়ে যাও, দাম দিতে হবে না।’ তাঁর বন্ধু-বৃত্ত ছিল নজরকাড়া। বহু শ্রুতকীর্তি মানুষকে সুবর্ণরেখায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারতে দেখেছি। সম্ভবত সেই ভিড়েই প্রথম দেখেছিলাম এক শীর্ণকায়, মেজাজি, স্বল্পবাক শিল্পীকে। পরে জেনেছিলাম তাঁর নাম সোমনাথ হোর। বিশ্বভারতীর কলাভবনের অধ্যাপক। আমরা ভীষণ ভয় পেতাম। চোখে চশমা, মাথায় টুপি, কাঁধে একটা ‘স্লিং ব্যাগ’। একটা ছোট্ট খাতায় কখনও কখনও তাঁকে স্কেচ করতেও দেখেছি। পরে আর একটু বড় হয়ে যখন ছবি দেখতে শেখা, আমাদের চারপাশে কত সহজে ঘুরে বেড়ানো এই গুণীজনদের যেন নতুন করে আমাদের চেনা শুরু। মুকুল দে, ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মা, সোমনাথ হোর, কল্পাতি গণপতি সুব্রহ্মণ্যন, যোগেন চৌধুরী, রীতেন রায়চৌধুরী, রেবা হোর, সনৎ কর, শর্বরী রায়চৌধুরীর মতো অনেককেই। খুব ছোটবেলায় আমার বাবা শান্তিনিকেতন ডাকঘরে আমাকে এক এলোমেলো চেহারার প্রৌঢ়ের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রণাম কর।’ তারপর রামকিঙ্কর বেইজ আমাকে অনেক আদর করেছিলেন। তিনি কে তখনও আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। এখন ভাবলে ভাল লাগে, শান্তিনিকেতনের নীল গগনের সোহাগ মেখে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর ভাস্কর্যগুলোর মতোই আমার গায়েও রয়ে গেছে সেই বিশ্ববিশ্রুত শিল্পাচার্যের স্নেহের পরশ।
তখন নতুন বাছুরের শিং গজাবার মতো আমাদের হাত থেকে কবিতা বেরোচ্ছে। আমি আর আমার প্রিয় সতীর্থ বিক্রম সিংহ খাঙ্গুরা ভাবলাম, দুজনের কবিতা নিয়ে একটা বই বেরোবে আর তাতে ছবি আঁকবেন সোমনাথ হোর। সোমনাথদা আর রেবাদির মেয়ে চন্দনাদি ছিল আমার আর বিক্রমের এক রকমের পৃষ্ঠপোষক। চন্দনাদি বলল, ‘ঠিক আছে। বাবার সঙ্গে বাড়ি এসে দেখা কর, কিন্তু কী হবে আমি কিছু জানি না।’ তখন শ্যামবাটির বাঁধের পাড়ে ওঁদের বাড়ি ছিল। আমি আর বিক্রম একা যেতে ভয় পেয়ে অজয়দা বলে এক পেটানো চেহারার দাদাকে নিয়ে গেলাম। অজয়দা পাশেই নবনালন্দা স্কুলে তখন নাচ শেখাচ্ছে। নিয়মিত ব্যায়াম এবং মারামারি করত। আমরা ভাবলাম, ছবি আঁকার প্রস্তাব আমরা দেব, ধমক খাওয়ার পরিস্থিতি হলে অজয়দাকে এগিয়ে দেব। সেটা ছিল শীতকাল। সোমনাথদা বারান্দায় একটা কাঠের চেয়ারে বসে। গায়ে একটা মিহি চাদর জড়ানো। লম্বা চুল, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। যেন এক স্থিতপ্রজ্ঞ সাধক, তাঁর ধ্যানের আসনে বসে আছেন। চন্দনাদি ভিতর থেকে একবার উঁকি মেরে চার কাপ লাল-চা দিয়ে স্মিত হেসে আবার ভিতরে চলে গেল। সেই হাসির মধ্যে কোথাও যেন একটা উদ্বেগের ছায়া ছিল— সম্ভবত দুই অসহায় কবি যশপ্রার্থীর দুঃসাহসিক প্রকল্প এবং তার সম্ভাব্য পরিণতির কথা ভেবে। দু’চার কথা বলার পর আমরা মূল কথাটা পাড়লাম— ‘আমরা কবি। আমাদের কবিতার বই বেরোবে। সঙ্গে চাই আপনার আঁকা নতুন বেশ কয়েকটা ছবি।’ সোমনাথদা স্থির। দৃষ্টি বহু দূরে প্রসারিত। যেন আমাদের ভিতর দিয়ে লাল বাঁধের স্থির জলাশয়ের দিয়ে তাকিয়ে। দীর্ঘ স্তব্ধতায় আমাদের হাত-পা অসাড় হয়ে গেছে। পালাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সোমনাথদা অজয়দাকে বললেন, ‘নবনালন্দার সামনে রাস্তাটা কাটা। যেতে খুব অসুবিধে হচ্ছে। একটা কোদাল দিয়ে মাটি ভরাট করে আগে ওটা সমান করে তারপর এসো।’ ‘আচ্ছা’ বলে আমরা সেদিন ফিরে এলাম। সাহস করে আর কোনও দিন, অন্তত নিজেদের কবিতার সঙ্গে সোমনাথ হোরকে ছবি এঁকে দিতে বলিনি। কিন্তু তাঁর স্নেহ আর প্রশ্রয় পেয়েছি অনেক।
শুনেছিলাম শ্যামবাটির বাড়িতে ভাস্কর্যের প্রয়োজনে নিয়মিত লোহা-গলা ধোঁয়া বুকে নিতে নিতে সোমনাথদার অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। আর সেখানে থাকতে চাইছিলেন না। সোমনাথদা শ্যামবাটির সেই বাড়ি বিশ্বভারতীকে দান করে নতুন বাড়ি করে উঠে এলেন অবনপল্লীতে একেবারে আমাদের বাড়ির পাশে। মাঝে শুধু একটা নামমাত্র বেড়া। বেড়ার ওধার থেকে মাঝে মাঝে গল্প করতেন, মা, বাবা, বোন অথবা আমার সঙ্গে। আমার বোনের বিয়ের দিন বাড়ি এসে দিয়ে গিয়েছিলেন আকাশে একতারা তুলে নৃত্যরত এক বাউলের এচিং। ততদিনে আমি সোমনাথদার ‘তেভাগার ডায়েরি’ পড়েছি। তাঁর ভাস্কর্য আর ছবির গভীর অনুরাগী। খেতে না পাওয়া মানুষ, পশু, যন্ত্রণাকাতর সমাজের ক্ষত বারবার ফিরে এসেছে সোমনাথ হোরের ছবিতে। তিনি খুবই অসুস্থ থাকতেন, কিন্তু বারান্দায় বসে অবিরাম ছবি এঁকে যেতেন। দেখা করবার একটা নির্দিষ্ট সময় ছিল। তাঁর উপর আমার উৎপাত কিন্তু থামেনি। বহুবার আমার অনুরোধে এঁকে দিয়েছেন ছবি। কখনও বেড়ার ওপার থেকে হঠাৎ ডেকে উপহার দিয়েছেন নিজের নতুন কোনও কাজ। ছবির নীচে কাঁপা হাতে লেখা, ‘নীলাঞ্জনকে সোমনাথদা।’
শান্তিনিকেতনে সোমনাথদা যাতায়াত করতেন সাইকেলে। পরে শরীর ভেঙে গেলে তাঁকে রিকশায় যাতায়াত করতে দেখেছি। শান্তিনিকেতনের আনাচে-কানাচে তাঁকে নিয়ে ছড়িয়ে আছে অনেক গল্প। একবার শুনেছিলাম, উৎসাহী এক শিল্পসংগ্রাহক তাঁর বিশেষ একটা কাজ সংগ্রহ করার জন্য তাঁর পায়ের কাছে রেখেছিলেন একটা ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’। সোমনাথ হোর হেলায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সেই প্রস্তাব। আপদে-বিপদে তিনি সাহায্য করতেন আর্তদের। আর একবার সোমনাথদা অসুস্থ। শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর পিয়ারসন হাসপাতালে ভর্তি। তাঁকে দেখে সবে বেরিয়েছেন মানিদা অর্থাৎ কে জি সুব্রহ্মণ্যন। তাঁকে ঘিরে ধরেছেন অধ্যাপকেরা। মানিদা খুব মজা করে কথা বলতেন। সামনে কয়েকটা গাধা চরছিল। অধ্যাপকদের মধ্যে কেউ সেদিকে মানিদার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘শান্তিনিকেতনে এখন আর আগের মতো গাধা দেখা যায় না।’ মানিদা বললেন, ‘যাবে কী করে! সবাই প্রফেসর হয়ে গেছে!’
একবার একটা কার্ড বিক্রি করে শান্তিনিকেতনের এক সংস্থাকে সেই টাকা দেব বলে সোমনাথ হোরকে অনুরোধ করলাম একটা সাদা-কালো ছবি এঁকে দিতে, যেটা সহজে ‘সিল্ক স্ক্রিন’-এ ছাপা যায়। শিল্পের পরিভাষায় যাকে ‘সেরিগ্রাফ’ বলা হয়। একদিন বিকেলে তিনি ডাকলেন। বসতে বললেন। চাদরের ভিতর থেকে বাড়িয়ে দিলেন একটা খাম। দেখলাম সামান্য কয়েকটা রেখায় এঁকে দিয়েছেন টুপি পরা একটা ছেলের অসামান্য একটা ছবি। ছবিটা খুব পছন্দ হল আমার। কার্ড ছাপা হয়ে যাবার পর দশটা কার্ড নিয়ে মূল ছবিটা ফেরত দিতে গেলাম তাঁকে। মূল ছবিটার মাপ এক থাকলেও ছাপার সময় কাগজের মাপ কিছুটা ছোট করতে হয়েছিল। তাতে ছবির মাথার উপরের সাদা অংশ কিছুটা কমে যায়। ব্যাপারটা আমার নজরে পড়েনি, এটা নিয়ে এত ভাবিওনি। কিন্তু চমৎকার ছাপা। ভাবলাম সোমনাথদা নিশ্চয়ই খুব খুশি হবেন। ছাপা ছবি দেখে সোমনাথদার মুখটা লাল হয়ে গেল। আমাকে বসতে বলে চা আনালেন। একটা কথাও বললেন না। তাঁর চোখে-মুখে ভয়ঙ্কর একটা অস্থিরতা। আমার একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। এক সময় আমাকে বললেন, ‘আমি ইচ্ছে করেই ছবির মাথায় ফাঁকা জায়গাটা ছেড়েছিলাম। কমিয়ে দিলি, তাই আমার মাথার ভিতর এখন ভীষণ চাপ দিচ্ছে।’ ‘চাপ দিচ্ছে’ কথাটা এত আকুল হয়ে বলছিলেন যে, লজ্জায় আমি অধোবদন হয়ে গেলাম। খুব বিচলিত হয়ে বলাম, ‘আমি বুঝতে পারিনি।’ মূল ছবিটা ফেরত দিয়ে আমি ফিরে আসছিলাম। উনি বললেন ‘এটা তোকে দিলাম, তোর কাছে রেখে দে।’ শুধু শূন্যতার দাম চেয়ে, না পেয়ে বিব্রত এক শিল্পীর আপাত সঙ্কীর্ণ, অস্থির বারান্দা থেকে আমি বাড়ি ফিরে এলাম। কিন্তু যেন একটা ঘোর লেগে গেল— সেই যেখানে রেখার শেষ আর অবকাশের শুরু, সেই স্বাধীনতার ঘোর। সীমার ভিতর অসীমের ঘোর! তাঁর চলে যাবার এতদিন পর আমার সোমনাথ হোর তাই যেন শুধু এক নিবিড় শূন্যতার ঘোর।